#বেলাদোনা (১১)
#ফাতেমা_তুজ
বিজ্ঞানের ছাত্র ইথান। সাইন্স ক্লাবের ছেলে মেয়েদের সাথে দেখে শতভাগ নিশ্চিত হলো বেলা। ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইলো অনেক টা সময় জুড়ে। মানুষ টা কেমন যেন। অল্প দিনেই বেশ আপন হয়ে গেছে। কথা শেষ করে গা থেকে এপ্রোন খুলতে খুলতে বেলার দিকে আসছে ইথান। বেলা ওর জন্য ই অপেক্ষা করছিলো। কাছে এসে ইথান বলল–
” আজ আমার ভাগ্য কোন দিকে চলেছে বলো তো? ”
” কেন বলুন তো। ”
” বেলা! আমার জন্য অপেক্ষা করছে। এটা কি সম্ভব? ”
” কেন সম্ভব নয়। অপেক্ষা করতে পারি না নাকি? ”
” উম অবশ্যই পারো। তবে সব সময় তো পিছু আমিই নেই। ”
হালকা হাসলো বেলা। ইথান কে দেখে অদূর থেকে ছুটে এলো লুসি। এসেই সোজা মালিকের কোলে ঝাঁপিয়ে পরলো নির্বিঘ্নে। বহু দিন পর ইথান আর লুসি কে এক সাথে দেখলো বেলা। লুসি কে কোলে নিয়ে আদর করছে ইথান। বিরবির করে কি যেন বলছে ও। প্রতিউত্তরে লুসি ম্যাও ম্যাও করছে। আর তাঁতে কানে হাত দিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করছে ইথান। কেন করছে, পেছনে কোনো কারন আছে কি না এসবে কোনো মাথা ব্যাথা নেই বেলার। তবে এ দৃশ্য টা বেশ ভালো লাগছে। লুসি বেশ কোমল ভাবে তাকালো বেলার দিকে। কেন যেন মাথা টা নত করে ফেললো বিড়াল টি। ব্যথিত হলো বেলা। লুসি কে কাছে টেনে নিলেই লুসি গা ছেড়ে দিয়ে ইথানের বুকেই লেপ্টে রইলো। বেলা সংশয় নিয়ে ডাকলো লুসি ক্যাট সম্বোধন করে। তবে লুসি পুরো দমে অবজ্ঞা করলো ওর বিনম্র ভালোবাসা।
” হয়তো লুসির মন খারাপ। তবে আসবে দেখিও। ”
” হঠাৎ এমন করলো ক্যান? ”
” জানি না ঠিক। বাদ দাও , চলো সামনে যাওয়া যাক। ”
কালো আঁধার কে সঙ্গে করে চলতে লাগলো বেলা। লুসির আচারন টা বার বার ভাবাচ্ছে ওকে। এক টা অবলা প্রানী কেন ই বা এমন করবে ওর সাথে? এমন তো নয় এর আগে বেলার কাছে আসে নি।
রসুই ঘর থেকে টুকটাক আওয়াজ আসছে। এর স্পষ্ট মানে হেবা আজ বেকারি তে যায় নি। ব্যাগ রেখে রসুই ঘরে উপস্থিত হলো বেলা। হেবা না তাকিয়েই বললেন–
” ফ্রেস না হয়ে রসুই ঘরে আসা ঠিক না ফ্লাওয়ার। ”
” দুঃখিত মা। ”
নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় বেলা সরে গেল। ফ্রেস হয়ে রান্না ঘরে প্রবেশ করলো। হেবার কাজ প্রায় শেষ। বেলার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন
” একটা সুসংবাদ আছে ফ্লাওয়ার। ”
” কি? ”
” চকলেট তৈরি তে সফল হয়েছি আমরা। সেটা গ্রহন ও হয়েছে। এবারের জাতীয় চকলেট দিবসে আমরা নিজ বেকারির তৈরি চলকেট সেল করতে পারবো। বিষয় টা কতো আনন্দের তুমি বুঝতে পারছো? ”
” অভিনন্দন মা। তোমার কাজ বরাবর ই নিখুঁত।”
” ধন্যবাদ সোনা। এবার থেকে বেকারির বিশেষ দায়িত্বে থাকতে হবে তোমায়। আর আমি রেস্ট করবো। ”
” ঠিক আছে। ”
বেলা ভেবেছিলো হেবা মজা করে বলেছে এসব। তবে সত্যিই হেবা রেস্ট নিতে চাচ্ছেন। সেই কারনে বেলা কে বেকারি তে পাঠানো হলো। এমন কি ভাগ্য পরম্পরায় আজ মারিয়া ও নেই বেকারি তে। কয়েক দিনের ছুটি নিয়েছেন নাকি। এসব শুনে বেলার হৃদপিন্ড ভার হয়ে গেল। যদি ও বা হেবা বলেছেন চার ঘন্টা থাকার কথা তবে এখন মনে হচ্ছে চৌদ্দ ঘন্টাই থাকা লাগবে।
কয়েক দিনেই হাঁপিয়ে গেছে বেলা। আজ অবশ্য মারিয়া এসেছেন। এক হাতে বই অন্য হাতে তাঁর স্প্যাচুলা। দুটো কাজ এক সঙ্গে করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে বেলা। তবে কোনো টাই ঠিক ঠাক হচ্ছে না। দুটো মিলিয়ে ঘেঁটে গেছে একদম। তাই যেকোনো এক টাতেই মনোযোগ দিবে বলে মনস্থির করলো। মারিয়া বেলার কান্ড দেখে পাশ থেকে হেসে ফেললেন।
” তুমি যাও বেলা। আমি সামলে নিচ্ছি। ”
” আপনি পারবেন তো মারিয়া আন্টি? ”
” হ্যাঁ পারবো। ”
কপালের ঘাম মুছে বেলা বেরিয়ে এলো। টেবিলে বসে বই নিয়ে পড়ছিলো। তখনি বাইরে থেকে ইথান ইশারা করলো। চোখ গরম করে তাকালো বেলা। ইথান ভেতরে আসতে চাইলে বেলা নিজেই বেরিয়ে এলো।
” সমস্যা কি হুম? বলেছি না বেকারির আশে পাশে আসবেন না এখন। মা জানতে পারলে ভেজাল হবে। ”
” ফোন ধরছিলে না কেন? ”
” সাইলেন্ট করা ছিলো দেখি নি। ”
” এখন চলো। ”
” কোথায়? ”
” আরে চলোই না। ”
বেলা কে জোড় করে নিয়ে যাচ্ছে ইথান। মেয়েটি হাতের বই টা বন্ধ করে চলতে লাগলো পিছু। কিছুদূর হাঁটার পর বেলা কে নিয়ে একটা নিরিবিলি স্থানে বসে পরলো ইথান। ঘাস গুলো কেমন সতেজ। বেলা আলতো হাতে ছুঁইয়ে দিলো সেসব কচি পাতা। নরম আর দাগহীন পাতা গুলো নজর কারার ক্ষমতা রাখে। মৌনতা ভেঙে অনুনয় করে বলল ইথান–
” একটা প্রশ্ন করি? ”
” হু করুন। ”
” তুমি কাউ কে ভালোবাসতে বেলা? ”
বেলার ভেতরে থেকে গরম শ্বাস বেরিয়ে এলো। ইথান প্রশ্নের উত্তরের আশায় চেয়ে আছে এক ধ্যানে। বেলা স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলো
” হয়তো হ্যাঁ। তবে সে এখন আমার কাজিন বোনের হাসবেন্ড। ”
” এর পেছনে কোনো বিশেষ কারন? তুমি কেন বাঁধা দাও নি? তোমার অনুভূতি জানান দাও নি কেন। ”
” মা চায় নি। ”
” শুধু সেটার জন্য? ”
বেলা দুদিকে মাথা কাত করে সম্মতি জানালো। কিছু সময় নীরব থেকে বলল
” এখন আর অনুভূতি নেই। সুপ্ত এক ভালোলাগা কাজ করছিল সেই সময় টা তে। বলতে পারেন জীবনের প্রথম অনুভূতি। ”
” প্রথম বলে কিছু হয় না বেলা। দ্বিতীয় তৃতীয় সব টাই নতুন আর প্রথম। ”
চুপ করে রইলো বেলা। ইথান ওর মন খারাপের কারণ হয়ে গেল। হুট করে কেন যে এমন প্রশ্ন করলো ছেলেটা কে জানে! কয়েক মুহূর্ত থ হয়ে রইলো ইথান ও বেলা। হালকা হালকা বাতাসে দোল খাচ্ছে চারপাশের প্রকৃতি। বেলা উপভোগ করার চেষ্টা করলো। তবে ব্যর্থ হলো তাঁতে। তাই বিদায় নেওয়ার জন্য বলল
” মারিয়া আন্টি বেকারি তে একা রয়েছেন। সামাল দিতে পারবেন না। আমি যাচ্ছি কেমন। ”
” হু যাও। ”
বেলা চলে গেল। ইথান সেখানেই বসে রইলো। কাঁধের ব্যাগ হাতরালো। হাতে তাঁর নীল রঙের ডায়েরী। যাঁর প্রতি টা অক্ষর স্পেনীয় ভাষায় লিখা।
স্টিভেন ছেলে কে পেয়ে খুব ই আনন্দিত। সেদিনের মনোমালিন্য ভুলে ইথান যে এসেছে এটাই অনেক। ওনার বর্তমান স্ত্রী ড্যানি, ইথান কে দেখেই আবেগাপ্লুত হয়ে পরলেন। ভদ্র মহিলা কে এরিয়ে চললো ইথান। যা চোখ এড়ালো না স্টিভেন এর। তবু ও তিনি ছেলে কে জড়িয়ে নিলেন বুকে।
” এখন থেকে এখানেই থাকবে তো মাই সান?”
” নো ড্যাড। ”
” প্লিজ ইথান। ”
” আমাকে ক্ষমা করো। আমি শুধুই সেদিনের কথা রক্ষার্থে এসেছি। ”
” তুমি আমার উপর রাগান্বিত ইথান? ”
ড্যানি পাশ থেকে কথা টা বললেন। খুব সহজ ভাষায় উত্তর করলো ইথান
” আপনার উপর রেগে থেকে যদি কোনো লাভ হতো তাহলে অবশ্যই আমি রেগে থাকতাম। তবে এটা আমার ভাগ্য। তাছাড়া আপনার ই বা দোষ কোথায়। ”
আহত হলেন ড্যানি। মাঝে ইথানের সাথে তিনি খারাপ ব্যবহার করেছেন এটা যেমন সত্য তদ্রুপ সত্য তিনি এই সময়ে অনুতপ্ত। যা ইথানের মনে কোনো ভাবেই প্রভাব ফেলছে না। সকলের সাথে ডিনার করে নিজ ঘরে এলো ইথান। কতো দিন পর এই ঘর টায় এলো হিসেব নেই। উত্তরের জানালা খুলে দিতেই তীর তীর করে আলো প্রবেশ করলো। বিষন্ন ঘরটায় তারুণ্য ফিরে এলো। অন্য রকম সুন্দর লাগছে। ইথান চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল।হাজারো স্মৃতি জড়িয়ে আছে সব অংশে।
ব্যলকনি থেকে লাফিয়ে এলো লুসি। এসেই ইথানের কোলে চরে ম্যাও ম্যাও করতে শুরু করেছে। ইথান ব্যস্ত হয়ে শুধালো
” কি হয়েছে লুসি? ”
বিড়াল টা লাফাতে শুরু করেছে। ইথান সামান্য চুপ করে থেকে বিষয় টা অনুধাবন করলো তারপর যথাসম্ভব দ্রুত ব্যলকনি তে এলো। লুসি, সামনে থাকা নিজের প্রতিরূপ দেখে দ্বিগুণ গতিতে ম্যাও ম্যাও করছে। হেসে ফেললো ইথান। এক হাতে লুসি কে কোলে তুলে নিয়ে অন্য হাতে লুসির প্রতিরূপের উপর হাত বুলালো। নিমেষেই থেমে গেল লুসি। ইথানের চোখে মুখে বেশ আত্মগরিমা ফুটে উঠেছে। ইথান গর্বের সহিত বলল
” আমার করা প্রথম অনবদ্য আবিষ্কার। আমার লুসির প্রতিরূপ। ”
যন্ত্র টি ম্যাও করে উঠলো। যাঁর ফলে ভয় পেয়ে গেল লুসি। এমন জিনিসের সাথে আগে পরিচিত নয়। লুসি কে কোলে তুলে নিয়ে পকেট থেকে ছোট রিমোট বের করে সেটা চাপলো ইথান। সঙ্গে সঙ্গে লুসির প্রতিরূপ যন্ত্রটি থেমে গেল। লুসি একদম ই বোকা বনে গেছে। ইথান আবার হাসলো। যন্ত্রটি কোলে তুলে নিতেই লুসি লাফ দিয়ে নেমে গেল কোল থেকে। ইথান গা দুলিয়ে হাসলো পুনরায়। মজা লাগছে খুব। লুসি ভয় পাওয়াতে যন্ত্র টি রেখে দিলো পাশের টেবিলে। অবিকল লুসির মতো দেখতে। এতো টা জীবন্ত আর সার্প রোবট এর আগে আবিষ্কার হয় নি বোধহয়!
চলবে