বেলাদোনা (১২)

0
154

#বেলাদোনা (১২)
#ফাতেমা_তুজ

হেবা ইদানিং বড্ড ব্যস্ত। কেন এতো ব্যস্ততা জানে না বেলা। সারাদিন ঘরেই থাকেন। আর বেলা কে বেকারি তে পাঠিয়ে দেন। হঠাৎ করেই বেলার মনে হলো হেবা তাঁকে ভালোবাসে না। পরমুহূর্তে ই স্বীয় ভাবনায় লজ্জায় নুইয়ে পরলো। যে মানুষ টি দীর্ঘ উনিশ বছরে ওকে গড়ে তুলেছেন সে মানুষের ভালোবাসা নিয়ে সন্দেহ! এ যে পাপ। বেলা এলিজা কে নিয়ে হেঁটে চলেছে। ঘাম ওর নিত্য দিনের প্রিয় সঙ্গী। এই যে সর্বদা ই স্কাফ পরিধান করে থাকতে হয়! বেলা নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় চলছে। হঠাৎ ই একটা গাড়ি এসে থামলো ওর কাছে। একটা ছেলে বের হয়ে এলো। দেখতে ভারী সুন্দর। বেলা কে দেখেই বিরল হাসলো। বেলা কিছু টা ভীত সন্ত্রস্ত। সে হাঁটা লাগাতেই পিছু ডেকে বলল–
” হেই গার্ল। ”

বেলা থামলো না। উদ্বিগ্ন হয়ে হাঁটা শুরু করলো। মাঝে এসে ছেলেটা বাঁধা দিলো। ভয়ে বেলার অন্তর কেঁপে উঠে। হাত বাড়িয়ে বলল
” আম শাবাব আল বিন। যদি আমি ভুল না করি তো তুমি মুসলিম? ”

বেলা চমকালো। এই একটা শব্দ ওর ভিত নাড়িয়ে দেয়। দ্বিধা দন্ধ আর দম বন্ধকর পরিস্থিতি!

শাবাব একটু খানি অপেক্ষা করে আবার প্রশ্ন করলো। বেলা এবার বলল
” না। আমি বেলাদোনা হালদার। ধর্মে খ্রিষ্টান। ”

” স্কাফ? ”

” পার্সোনাল ইস্যু। ”

বেলা পথ আগালো। শাবাবের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে বেশ কিছু টা বিভ্রান্ত হলো। সচরাচর কোনো খ্রিষ্টান কে স্কাফ পরতে দেখা যায় না। বেলা অনেক টা দূর চলে গেলে শাবাব আবার ও নিজ কাজে মনোযোগ দিলো।

ঘরে এসেই এক টানে স্কাফ খুলে ফেললো বেলা। স্কাফ এর ভেতরে থাকা লালচে কালো রঙের সংমিশ্রণে বেড়ে উঠা সোনালি চুল গুলো বেরিয়ে এলো। মুখচ্ছটায় কেমন দৃঢ়তা। বেলার এমন অকাট্য রূপে এলিজা ভয় পেয়ে গেল। চুপিসাড়ে সরে পরলো বাচ্চা মেয়েটি। বেলা ডিভানে বসে চোখ বন্ধ করলো।
” বেলা! তুমি স্কাফ খুলেছে কেন ফ্লাওয়ার। দ্রুত স্কাফ পরো ডিয়ার। ”

” তোমরা তো কেউ স্কাফ পরো না। আমি কেন পরবো তাহলে? ”

” ফ্লাওয়ার! মায়ের কথা অমান্য করছো কেন? ”

” আমার ভালো লাগছে না কিছু। সব টা এলোমেলো লাগছে। ”

হেবা নিজ হাতে বেলার স্কাফ পরিয়ে দিলেন। শব্দ করে কপালে চুমু খেয়ে বললেন–
” ইসলাম কে তোমার মনে প্রানে ধারন করতে হবে ফ্লাওয়ার। ”

” কিন্তু কেন? ”

” এটা যে তোমার ধর্ম। ”

বেলা থম মেরে রইলো। ইসলাম ওর ধর্ম! সেই কারনেই হেবা ওকে নানান ইসলামিক বই পড়তে দেন। হেবা কিছু একটা বলতে গিয়ে ও বললেন না।

স্পেনীয় ভাষা একটু একটু করে অনুবাদ করছিলো বেলা। সেই সুবাদে ইসলামিক কিছু বিষয় জানতে পেরেছিলো। তবে এখন সেই নীল রঙা ডায়েরী টা খুঁজে পাচ্ছে না। পুরো ঘরময় ছড়িয়ে আছে বই পুস্তকের স্তূপ। এক পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে বসে পরলো। কোথায় গেল নীল রঙের ডায়েরী টা?

বেলার মনে নানান ধরনের প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। জেসন কে মনের অনুভূতি না জানাতে দেওয়ার কারন কি তবে? মনে মনে অনেক টাই নিশ্চিত হলো বেলা। তবু ও হেবার ঘরে উপস্থিত হলো শতভাগ নিশ্চিত হতে। হেবা বেলা কে আশা করে নি। তবু ও বললেন
” রুমে এসো ফ্লাওয়ার। ”

” বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। ”

” সমস্যা নেই। বসো পাশে। ”

বেলা বসলো। হেবা সাহস জোগাতে বেলার হাত দুটো বুকে চেপে ধরলেন। সংশয় এড়িয়ে বেলা বলল
” জেসন কে নিয়ে কথা বলতে চাই। ”

” বলো। ”

” আমি তোমাকে বলেছিলাম তাকে আমি পছন্দ করি। ”

” বলেছিলে ফ্লাওয়ার। কিন্তু এখন কেন এই কথা। ”

” আমার অনুভূতি জানাতে বাঁধা কেন দিয়েছিলে মা? ”

” এটা খুব স্বাভাবিক বেলা। আমি চাই না তাকে বিয়ে করো তুমি। তাছাড়া–

” তাছাড়া কি ? ”

” অনেক কারন ফ্লাওয়ার। সে ভালো মানুষ নয়, তাছাড়া সব থেকে বড় কথা সে খ্রিষ্টান। তুমি তো জানো ফ্লাওয়ার আমি চাই অত্যন্ত শুভ্র একজন নম্র ভদ্র মুসলিম ছেলে তোমার জীবনে আসুক। ”

বেলা আর কথা বাড়ালো না। চোখের জল আড়াল করে বলল
” শুভ রাত্রি। ”

” কষ্ট পেও না ফ্লাওয়ার। আমি সত্যিই তোমার ভালো চাই। ”

” আমি জানি মা। ”

” শুভ রাত্রি ফ্লাওয়ার। নিজের খেয়াল রেখো। ”

বেলা নত জানু হয়ে চলে এলো। হেবার গলা ধরে আসে। এটা সত্য যে বেলার কষ্টে তিনি কষ্ট পান।

সামারা সম্পর্কে বেলার খালাতো বোন হলে ও একবার ই কথা হয়েছে মেয়েটির সাথে। এমন কি বেলার জানা মতে ওদের তেমন কোনো আত্মীয় স্বজন নেই। কেন নেই এ যেন এক চাঁপা রহস্য। কখনো প্রশ্ন আসলে ও অকপটে এড়িয়ে গেছে বেলা। তবে আজ একটু বেশিই ভাবনা এলো। সামারার মা বহু দিন পূর্বেই মা’রা গেছেন। সে মানুষ হয়েছে এক ধর্মীয় চার্চে। এমন টাই শুনেছে বেলা। জেসন এর সাথে বিয়ে টা ও খুব নীরবে হয়েছে। সব টা যেন আকাশ এর মতো বিশাল দৃষ্টির বাহিরে। বেলা নিজ ফোন টা সাইলেন্ট করার জন্য হাতে নিলো। ইথানের অনেক গুলো ম্যাসেজ দেখে একবার ভাবলো রিপলে দিবে না। পর মুহূর্তেই রিপলে দিলো।
” এতো রাত, এখনো ঘুমাও নি বেলা? ”

” যাবো এখনি। ”

” বিরক্ত করলাম তাহলে? ”

” না তেমন না। আমি জেগেই ছিলাম। ”

” ভারসিটি আসবে কাল? ”

” হ্যাঁ। ”

” সেখানেই দেখা হচ্ছে তবে। বিদায়। ”

বেলা সিন করে রেখে দিলো। মাথার উপর ভন ভন করে ঘুরছে সিলিং ফ্যান। বেলার চোখে ঘুম নেই। আর না আসবে।

পরদিন বেলার সাথে দেখা হলো ইথানের। ছেলেটা কে খুব ব্যস্ত দেখাচ্ছে। বেলা ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো।ইথান সমস্ত ব্যস্ততা উপেক্ষা করে বেলার সাথে চলে এলো। ওদের দুজনের বন্ধুত্ব কেমন যেন দ্বিধার মাঝে। অদ্ভুত আর অগোছালো। টুকটাক কথা বার্তা চলতে লাগলো। এক পর্যায়ে ইথান বলল
” তোমাকে চিন্তিত লাগছে বেলা। ”

” কই আমি তো চিন্তিত নই। ”

” বিজ্ঞান কিন্তু মিথ্যে বলে না। ”

” সত্যিই আমি চিন্তিত নই। ”

” আচ্ছা বেশ। চলো আজকে আমরা এক সাথে সাইকেল রাইড এ যাবো। ”

বেলা অন্যমনস্কতায় সম্মতি দিয়ে দিলো। ইথান যখন সাইকেল নিয়ে চলে এসেছে বেলা তখন অবাক।
” কি হলো আসো। ”

” সাইকেল কেন? ”

” বললাম না রাইড এ যাবো। ”

বেলা দু মন নিয়ে ইথানের সাইকেলে উঠে বসলো। ছেলে টা খুব ভালো সাইকেল চালাতে পারে বলতেই হয়। এর আগে ও বেলা উঠেছে দু তিন বার। পুরো মাঠ টা কয়েক বার চক্কর দেওয়া হলে বেলা নামিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করলো। কিন্তু ইথান আরো দু বার চক্কর কেঁটে তারপর রাইড অফ করলো।

এক টা সোনালি আর হালকা কালোর মিশ্রনে গড়া চুল নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন এল। সোফা তে আধ সোয়া হয়ে বসে নির্লিপ্ত ভাবে চেয়ে আছে ইথান। ছেলে টার আর তর সইছে না যেন। মুখচ্ছটায় আগ্রহের সমাবেশ।
” আর কতক্ষন লাগবে মিস্টার এল? ”

” হয়ে এসেছে। ”

উত্তেজনা না ঠেকাতে পেরে ইথান উঠে এলো। গভীর গবেষনা শেষ করে এল বিরক্তি ভঙ্গিমায় বলল
” বিশেষ কিছু পেলাম না। ”

” আমাকে আবারো আশাহত করলেন এল। আমি কতো টা কষ্ট করে চুল জোগাড় করেছি জানেন? ”

” কিন্তু কি করবো ইথান। এখানে তেমন কিছু নেই যা থেকে বড় কিছু প্রমান হয়। ”

ইথানের মুখের গড়ন পাল্টে গেল। রাগে চোয়াল শক্ত হতে শুরু করেছে। এল সান্ত্বনার সুরে বললেন–
” তবে বেলার চুলের বৈশিষ্ট্য অন্য কিছু বলছে। যা ক্লু হিসেবে কাজ করবে। ”

” যেমন? ”

” দেখো আমার দীর্ঘগবেষনায় আমি এতো টুকু নিশ্চিত যে বেলা এক অঞ্চলের অংশ নয়। ”

এল এর কথা বুঝতে না পেরে ইথান আবার বলল
” বুঝি নি। ”

” দেখো ইথান, তুমি বিজ্ঞানের ছাত্র। তুমি খুব ভালো করেই জানো বিজ্ঞান অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনুমান নির্ভর। এর সত্যতা কখনোই শতভাগ নয়। সব কিছুর বাইরেই একজন সৃষ্টিকর্তা আছে। যাকে আমরা সবাই ঈশ্বর বলে সম্বোধন করে থাকি। এই জগতের বিশলতা আমাদের হাতের মুঠোয় নয়। ”

” বুঝলাম না আমি। ”

” বলছি, বেলার চুলের ডি এন টেস্ট করা তে যে বৈশিষ্ট্য পাওয়া গেছে এতে ওর বাবা মা দু স্থানের। অর্থাৎ যে কোনো একজন শ্বেতাঙ্গ আর আরেকজন শ্বেতাঙ্গ নয়। কোনো ভিনদেশী। ”

ইথানের ললাটে অন্যরকম রেখা চলে এলো। এর মানে অনেক টাই স্পষ্ট। তবু ও ইথান পুরো সত্য জানতে চায়। বেলার সোনালী চুল টা হাতে নিয়ে স্থির দৃষ্টি তে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটির চুল সংগ্রহ করা ছিলো অসাধ্য! যা খুব সহজেই করে নিয়েছে ইথান।তাই এক অন্যরকম আনন্দ কাজ করছে ভেতর ঘরে। তবে মনে মনে একটা প্রশ্ন তো এলোই বেলা কি ছোট থেকেই স্কাফ পরতো?

** গল্প টির আলোচনা করুন Fatema’s story discussion আর সর্বোচ্চ আলোচনা করে জিতে যান একটি বই।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here