বেলাদোনা (৩)

0
498

#বেলাদোনা (৩)
#ফাতেমা_তুজ

এলিজার চোখে জল। বেলা এমনি তে শান্ত মানুষ। তবে মাঝে মাঝে রেগে যায় খুব। একটু আগে ও রেগে গিয়ে বেশ বকা ঝকা করেছে। মারিয়া তাঁর রাশভারী কন্ঠে এই প্রথম বারের মতো এলিজার জন্য মায়া দেখালো। ভদ্র মহিলা বেলার দিকে কুকিজ বাড়িয়ে বললেন —
” আমার তো মনে হয় এলিজা ভুল কিছু করে নি। ঐ বদ বিড়াল টা তাঁকে আগে আ’ঘাত করেছে। এলিজা বিরোধ করেছে, হয়তো তখনি চোট লেগেছে বিড়াল টার পায়ে। এখন শুধু শুধু নালিশ হাকালো বদ বিড়ালের তথাকথিত মালিক ঝগড়াটে ছেলেটা। ”

” তবু ও। একটা অবলা প্রানী কে আঘাত করা উচিত নয় সেটা ওকে বুঝতেই হবে। আমি সব সময় বোঝাই তবে তুমি কখনো আমাকে মূল্য দাও না এলিজা। ”

” আমার দোষ নেই আপুই। ঐ শয়’তান বিড়াল টাই তো ”

” হয়েছে, আর অভিযোগ নয়। বেলা তুমি কুকিজ গুলো ডেলিভারি দিয়ে আসো তো। আমি এলিজার খেয়াল রাখবো। ”

” মা ফোন করেছিলো মারিয়া আন্টি? ”

” না এখনো করে নি। ফোন করলে আমি জানাবো। ”

চকলেট কুকিজ গুলো বাক্স ভরাট করে বাইরে নিয়ে এলো বেলা। আমেরিকা তে ট্র্যাফিক কম। আর সব থেকে দারুণ যানবাহন হলো সাইকেল। বেলা নিজস্ব সাইকেলে করেই ডেলিভারি দিতে যায়। একটু জেতেই আজ সাইকেল এর চেইন পরে গেল। দুবার চেষ্টা করে ও চেইন লাগাতে অক্ষম হলো বেলা। এদিকে সময় নেই। ডেলিভারি দিতে লেট হলে অনেক সময় ক্রেতা রা ও পার্সেল ফেরত পাঠায়। সেই হিসেবে এক টা ভয় কাজ করছে। হাতে তেমন টাকা ও নেই যে গাড়ি চড়ে যাবে। তাছাড়া অলিতে গলিতে গাড়ি করে গেলে ও সময় লাগবে বেশ। বেলা চিন্তিত ভঙ্গিমায় সাইকেল টা নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। শুধু চেইন নয়, প্যাডেল টা তে ও সমস্যা দিয়েছে। এদিকে হাতে নেই কোনো ফোন। কি করবে বুঝতে পারছে না। ফিরে গেলে ও ঘন্টা খানেক সময় লাগবে। ওমনি এক সাদা বিড়াল পথ মারালো। প্রচলিত আছে কালো বিড়াল পথ মারালে যাত্রা অশুভ হয়। তবে সাদা, তুষার রঙের বিড়াল পথ মারালে যাত্রা কেমন হয়? এমনি সব উদ্ভট চিন্তা করছিলো বেলা। তখনি পাশ থেকে বিড়াল টি কে শাসানোর শব্দ শোনা গেল। আশ্চর্যজনক ভাবে বিড়াল টির কান ধরে আছে ইথান। আঙুল নাড়িয়ে একদম বাচ্চা দের মতো শাসন করে চলেছে। না চাইতে ও হেসে উঠলো বেলার কোমল ঠোঁট। ইথানের খেয়াল হলো এবার। বেলা কে দেখতে পেয়ে বলল–
” তুমি এখানে কি করছো? ”

” পার্সেল, এই যে পার্সেল ডেলিভারি দিতে যাচ্ছি। ”

” ও তো দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও। ”

” আমার সাইকেলে প্রবলেম দিয়েছে। ”

বেলা পথ আগালো। সাইকেল টা কে টেনে নিয়ে যাচ্ছে মেয়েটির জীর্ণ শরীর। কেন যেন ইথানের মায়া হলো খুব। পিছু না ডেকে সামান্য ছুটে এলো বেলার কাছে। একবার পাশ ফিরে তাকিয়ে বেলা প্রশ্ন ছুড়লো–
” দেখুন আমি আপনার বিড়াল টি কে কিছুই করি নি। এখন যদি কোনোভাবে সে অভিযোগ করে থাকে তাহলে আমি বলবো সে পুরো দমে ঠক ও মিথ্যে বলেছে। আর আপনার উচিত তাঁর কথা চোখ কান বুঝে বিশ্বাস না করা। আর হ্যাঁ এলিজা কে শাসন করেছি আমি। ”

” তুমি অনেক কথা বলো বেলা। ”

চমকালো বেলা। ইথান তাঁর নাম জানলো কি করে? তাছাড়া বেশি কথা ই বা বললো কখন! সে তো শুধু মাত্র সত্যি টা জানালো। ইথান কিছু টা সম্মুখে এসে মেয়ে টির কপালে টোকা দিলো।যাঁর ফলে গভীর ভাবনা মঞ্চ থেকে বেলার ধ্যান ফিরে এলো। উক্ত কাজ টি করা উচিত হয় নি ইথানের,সেটা বুঝতে পেরে ও সে মেকি হাসি দিলো। নিজের সাইকেল টা দেখিয়ে বলল–
” চাইলে আমি তোমাকে হেল্প করতে পারি। ”

” দরকার নেই। আগে বলুন আমার নাম জানলেন কি করে? ”

” সকালেই মারিয়া তোমার নাম ধরে ডেকেছিল। এটা কি খুব অস্বাভাবিক? ”

ইষৎ লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো বেলা। কুকিজ এর বাক্স গুলো ঠিক ঠাক করে নিয়ে সাইকেল নিয়ে হাঁটা লাগালো। তপ্ত রোদ্দুরে গলা শুকিয়ে এসেছে। বোতলে কিঞ্চিত পরিমানে পানি বিদ্যমান। সেটা ও শেষ করে ফেললো অত্যল্পকালে। হেঁটে হেঁটে আরেক টু পথ এসে রাস্তার ধারেই বসে পরলো বেলা। আর সম্ভব নয়। এই উত্তপ্ত আবহাওয়ায় স্কাফ মাথায় করে সাইকেলের বোঝা নিয়ে হাঁটা কুলোচ্ছে না দেহে। ইথান পাশ দিয়ে এমন ভাবে যাচ্ছে যেন বেলা কে চিনেই না। নতজানু হয়ে বেলা প্রশ্ন করলো
” আপনি কি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন? ”

” আমাকে বলছো? ”

” আপনি ছাড়া আশে পাশে তো কেউ নেই। তাই আপনাকেই বলছি। ”

” সাহায্য করতে পারি। তবে এর জন্য আমাকে স্যরি বলতে হবে তোমায়। ”

” স্যরি কেন? ”

” একটু আগেই বেয়াদবি করেছো আমার সাথে। তাই যদি ঠিক সময় এই পার্সেল গুলো ডেলিভারি করতে চাও আমাকে স্যরি বলতে হবে। ”

প্রথমে প্রতিবাদ করলে ও ক্ষণ কাল পরেই হার মেনে নেয় বেলা। ইথানের মুখে বিশ্ব জয় করা হাসি। সাথে তাঁর বদ বিড়ালের ম্যাও ম্যাও ধ্বনি তে বিজয় বার্তা জানান দিলো । কুকিজ এর বক্স গুলো সাইকেলের সাথে ভালো করে লাগিয়ে নিলো বেলা। পরিচিত এক শপের কাছে বেলার সাইকেল রেখে দিলো ইথান। আর তারপর? তারপর ই শুরু হলো যাত্রা।

পাক্কা তিন ক্রোশ পথ পেরিয়ে শেষ পার্সেল টা ডেলিভারি দিতে পারলো বেলা। ইথান এর গাঁয়ে থাকা টি শার্ট ভিজে একাকার। ঘামের কারনে বার বার আঠালো হয়ে যাচ্ছে শরীর। বিরক্তি তে কুঁচকে পরছে ললাটে ভাঁজ। বেলা সাবলীল ভাবে শেষ ডেলিভারি টা দিলো। ইথান প্রশ্ন করলো–
” আরো আছে কি? ”

” না এটাই শেষ ডেলিভারি ছিলো। ”

মোটামুটি ভাবে বেলা সফল। সেই কারনে চোখে মুখে উৎফুল্লতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কপাল বেয়ে নেমে আসা এক গাছি স্বীয় ঝাঁকড়া চুল গুলো কে বা পাশে এলিয়ে দিলো ইথান। বেলা চোখ নামিয়ে মোলায়েম ভঙ্গিমায় বলল
” আপনার রেস্ট প্রয়োজন। অনেক টা খাটুনি গেছে আজ। ”

” আসলেই আমি ক্লান্ত বেলা। রোজ তুমি কতো পরিশ্রম করো। এতো টা পথ এসে ডেলিভারি দেওয়া সহজ কথা নয়। ”

” বেকারি তে কর্মচারি থাকলে ও পার্সেল ডেলিভারি দেওয়ার জন্য ডেলিভারি বয় নেই। বাবা নয়তো মা ই ডেলিভারি দেন। ওনারা বাসায় নেই তাই আমি দিচ্ছি। ”

” এটা কষ্টসাধ্য। ঐ পাশ টায় যাবে তুমি? ”

বাগানে ছোট ছোট চারাগাছের মাথায় ফুল ফুটেছে। প্রতি টি ফুল খুব ই সুন্দর আর নমনীয়। সেগুলো তে হালকা হাতে স্পর্শ করলো বেলা। লজ্জাবতী গাছের গাঁয়ে স্পর্শ করতেই লজ্জা তে নুইয়ে গেল লজ্জাবতী লতা। পরিশ্রান্ত দেহ নিয়ে উঠা ও যাচ্ছে না। ইথানের এমন করুণ অবস্থা খুব একটা চোখে পরে নি তাঁর। পরলে নিশ্চিত ভাবে ব্যথিত হতো। কয়েক মিনিট পার হলে শরীরে বল পেল ইথান। সময় চলে যাচ্ছে। বাসায় ফেরা প্রয়োজন।

ঘর্মাক্ত দেহ নিয়ে বেলা যখন বাড়ি এলো তখন খুব বেশি রাত নয়। তবে এই সময় টা তে আগে বাহিরে থাকা হয় নি কখনোই। মারিয়া বিশেষ প্রয়োজনে নিজের বাসায় চলে গেছেন। সারাদিন ডেলিভারি করে সন্ধ্যার দিকে বেকারি সামলাতে বসে পরেছিলো। যাঁর দরুন লেট হয়ে গেল। তবে এক দিক দিয়ে ভালোই হয়েছে, এলিজা কে সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন মারিয়া। এই রাত্রি কালে বাচ্চা মেয়ে টি কে সাথে নিয়ে চলা ফেরা করা টা হচ্ছে আরেক মুশকিলের ব্যাপার।

দোতলা কাঠের বাড়ি টা জনমানবশূন্য হওয়াতে নির্জীব হয়ে আছে কেমন। একটা ভূতুড়ে ভাব আছে বটে। তবে বেলা ভয় পেল না। ভয় পেলে তাকে চলবে না। বরং শক্ত হাতে লড়াই করে যেতে হবে প্রতি ক্ষণে ক্ষণে। সেদিনের মতো আজ মুশলধারে বৃষ্টি নেই তবে আকাশ গুমোট।
মেকানিক ডেকে মেইন ডোরের লক ঠিক করে দিয়েছেন মারিয়া। নিজের ঘরে এসে বসলো সে। তখনি কলিং বেজে উঠলো। সেই ভয় টা আবার অন্তরে হানা দিয়েছে। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে কেঁপে উঠলো বেলার পা যুগল। এখন কে এলো আবার?

প্রায় দশ মিনিট যাবত কলিং বেজে চলেছে। প্রথম পাঁচ মিনিট ঘাপটি মেরে স্বীয় কক্ষে অবস্থান করলে ও এক মণ দূসাহস সমেত পরবর্তী তে নেমে এসেছে বসার ঘরে। তবে ওপাশে থাকা ব্যক্তি টি নিঃসেন্দহে কলিং বাজানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
ভয় কে জয় করে সেদিনের মতোই এগিয়ে গেল বেলা। ক্ষীন স্বর টাকে সামান্য উঁচু করে শুধালো —
” কে? ”

” আমি। ”

পুরুষালি ভরাট কন্ঠ। তবে এবার যতো টা না আতঙ্কিত হলো তাঁর থেকে বেশি হলো বিহ্বল। নিষ্ফল ভঙ্গিমায় দু পা পিছিয়ে গেল। এটা কি ভ্রম নাকি সত্য?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here