মেঘলা আকাশে রুদ্রই ভরসা
উম্মে হাবিবা তনু
পার্ট:৩২
বাইরে বেশ ঠান্ডা।জানালা দিয়ে হুহু করে শীতল বাতাস ডুকছে রুমের ভিতর।তবুও রুদ্র অনবরত ঘামছে।কোনো কারণ ছাড়াই সে ঘামছে এমনটা নয়।এক্ষুনি খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখে তার ঘুম ভেংগে গেছে।বা পাশে হাতড়ে সাইড টেবিল থেকে পানির বোতলটা নিয়ে ডকডক করে বোতলের পুরো পানি শেষ করে দিলো।তবু যেনো স্বস্তি পাচ্ছেনা।তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে।পাহাড় সমান তৃষ্ণা এসে যেনো ভর করেছে তাকে।এ তৃষ্ণা এত সহজে মিটার নয়।
এই রকম স্বপ্ন সে প্রায়ই দেখে।কিন্তু আজ যেন কিছু ভিন্ন ছিল।কিন্তু কি সেটা বুঝেও বুঝতে পারছে না।এই স্বপ্ন দেখারই বা কি মানে??কেন বার বার এমন স্বপ্ন না দুঃস্বপ্ন দেখে?
এই স্বপ্নটা কি কিছু ইঙ্গিত করছে???বুঝতে পারছি না ঠিক আরও কত খারাপ হবে??কেনো??কেনো??বারবার কেনো দেখি মেঘলা খুব বিপদে আছে??ও তো ওর ভালোবাসার মানুষকে বেছে নিয়েছে।নিশ্চয়ই খুব ভালো না থাকলেও এতটা খারাপ রাখবে না যতটা আমার দুঃস্বপ্নে আসে।কেনো বারবার আমার স্বপ্নে এসে ওভাবে কাদিস তুই??আমি তো চেয়েছি তুই ভালো থাক খুব ভালো থাক।তবে কেনো মেঘলা??কেনো???তুই যা চেয়েছিস তাই তো পেয়েছিস।তবে কেনো তোর কান্নামাখা,দুঃখী মুখটা আমি দেখি???তুই কি খুব বেশি কষ্টে আছিস???আমি কিই বা করতাম?তুইতো আমার মুখ দেখতে চাস না।তাই সব ছেড়ে এত দূরে সরে এসেছি।তবুও…..তবুও তোর কান্নাভরা মুখটা কেনো দেখি??এত কষ্ট কেন দিস তুই??তোর থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েও তোর থেকে কেনো বারবার কষ্ট পাই???
কথাগুলো নিজেকে নিজে বলেই ঝরঝর করে কেঁদে উঠলো রুদ্র।
কে বলে পুরুষ মানুষ কাদতে পারেনা??তারাও কাদে।চিৎকার করে কাদে।কিন্তু তা শুধুই চারদেয়ালের মাঝেই সীমাবদ্ধ।সকাল হলেই সব কষ্টগুলোকে বুকে পাথর চাপা দিয়ে আবার স্বাভাবিক জীবনের গতিপথে ডুকে যায় তারা।
রুদ্রর ফ্ল্যাটটা খুব ছোট।আগে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে রেন্টে থাকতো।কিন্তু এখন একটা ছোট ফ্ল্যাটে উঠেছে।এক বেডরুমের ফ্ল্যাটে।পরিবেশটাও বেশ নিরিবিলি।তাই ওর খুব পছন্দ হয়েছে।একাই থাকে নিজের মতো করে।নিজের কাজ এখন প্রায় সবই নিজে করতে শিখে গেছে।আলাদা থাকার প্রধান কারণ ওর একটা স্পেস দরকার।যেখানে ও একটু নিজের মত করে দিন শেষে থাকতে পারে।তবে ওর মাকে যখন নিয়ে আসবে তখন শিফট হবে এইখান থেকে।পড়াশুনার পাশাপাশি পার্ট টাইম জব করে।বেশ চলে যাচ্ছে।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে আর এক মুহূর্ত দেরি না করে সীমান্ত ফ্রেশ হয়ে রেডী হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।তার পাশে আরেকটা মানুষ যে আছে তাতে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।অথচ সারারাত এই মানুষটাকে আকড়ে ধরে ছিল।তবে তা শুধুই নেশার ঘোরে,ভালোবেসে নয়।সীমান্তর চোখে মেঘলা আর অন্য কোনো মেয়ের মধ্যে বিশেষ তফাৎ নেই।তার রাত কাটানোর সঙ্গী দরকার সে যেই হোক না কেনো!
রুমের দরজা খোলার শব্দ শুনে যেনো সাবিবার দরে প্রাণ ফিরে এলো।আর মনে মনে বলছে আল্লাহ আমার বোনটা যেনো ঠিক থাকে।
সাবিবার জ্ঞান ফিরেছে অনেকক্ষণ।রিনা নামের মেয়েটা অনেক করেছে তার জন্য।কৃতজ্ঞতা চাহনিতে প্রকাশ করেছে ঠিকই কিন্তু মুখে কিছু বলছে না।যতই ওর সেবা করুক তবুও তো আজকের এই অবস্থার জন্য অনেকাংশে এই মেয়েটাই দায়ী।
রিনাকে সাবিবার পাশে দেখে সীমান্তর মাথায় চড়চড় করে রক্ত উঠতে থেকে।চিৎকার করে রিনাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
মা** তোর যা আছে নিয়ে আয় আর বিদায় হ।
রিনা ভয়ে দমে গেল।কিছু না বলে নিজের ব্যাগটা নিয়ে গেটের সামনে আসতেই সীমান্ত ইশারায় থামতে বলে,নিজের ঘরের দরজা থেকে সরে মেইন গেটের সামনে এগিয়ে যায়।
আর ঠিক এই সুযোগেই সাবিবা চট করে ও ঘরে ডুকে পরে।দেখেই বুঝা যাচ্ছে চাতকপাখির মত এতক্ষণ এই সময়টার অপেক্ষাতেই সে ছিল।
রিনা মুগ্ধ চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইল।এমন মানুষও হয়??নিজের সতিনকে কেউ এইভাবে বুক দিয়ে আগলে কেউ রাখে কি না ওর জানা নেই।তবে আজ ওর চোখে কয়েক ফোঁটা অশ্রু যেনো জানান দিচ্ছে।এই প্রফেশন এ যবে পা দিয়েছে তবে থেকে ওর চোখের পানি যেনো শুকিয়ে গিয়েছিল।কিন্তু আজ যে তার চোখের মরা নদী জেগে উঠেছে।
সীমান্ত আরেক দফা ধমকে উঠতেই রিনা দৃষ্টি এড়িয়ে চোখের পানি মুছে ফেললো।তারপর সীমান্তকে অনুসরণ করে গটগট বেরিয়ে গেলো।
সীমান্ত বাহির থেকে দরজা লক করে রিনাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।যেখানকার জিনিস সেখানে ফেলে আসবে।এরপর আর এমন আনপ্রফেশনাল কাউকে আনবে না বলে ঠিক করে নিল।
মেঘলাকে দেখেই সাবিবার ভিতরটা ছেদ করে উঠলো।এ কাকে দেখছে??ফুটফুটে মেয়েটার কি হালটাই না করেছে অমানুষ জানোয়ারটা।মুখে,গলায় কামড়ের দাগ,আঁচড়ে দাগ এ ভরে গেছে।নিষ্প্রাণ দেহটা কোনরকমে বিছানায় ভর দিয়ে ঠেকে আছে।যেনো এক্ষুনি প্রাণটা বেরিয়ে যাবে।সাবিবার দুচোখ গড়িয়ে গাল বেয়ে পানি পড়ছে।
এগিয়ে গিয়ে কাঁথা সরিয়ে দিতেই আরেকদফা আঁতকে উঠল সাবিবা।সারা গায়ে সুতা পরিমাণ জায়গা নেই যেখানে আঁচড় আর কামড় এর দাগ নেই।জায়গায় জায়গায় রক্ত জমাট বেঁধে গেছে।কিছু কিছু জায়গায় ক্ষতর মত হয়ে গেছে।তার ভেতরটাও যেনো ছিঁড়ে যাচ্ছে মেঘলার যন্ত্রণায়।
দ্রুত রান্নাঘরে গিয়ে গরম পানি বসিয়ে দিয়ে আবার ফিরে এলো।কোনো রকমে গায়ে কাপড় জড়িয়ে মেঘলাকে উঠালো।তারপর আস্তে আস্তে ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে গিয়ে গরম পানি দিয়ে গোসল করিয়ে দিল।ক্ষতস্থানগুলো ভালো করে পরিষ্কার করে ওষুধ লাগিয়ে দিল।
মেয়েটার এমন হাল হয়েছে যে নিজ পায়ে ভর দিয়ে দাড়াতে পর্যন্ত পারছে না।কান্না করছে ঠিকই কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না।নিজের স্বামীই কাছেই ধর্ষিত হওয়া বোধ হয় একেই বলে।সাবিবার পেটে মাথা ঠেকিয়ে দুহাতে কোমড় জড়িয়ে ধরে বসে কাদছে।খুব কাদছে আজ মেঘলা।চাপা যন্ত্রণা যেনো গায়ের থেকে মনেই বেশি হচ্ছে।তার সাথে সমান তালে যেনো যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়েছে সাবিবার মনে।
চলবে………