মেঘলা আকাশে রুদ্রই ভরসা
উম্মে হাবিবা তনু
পার্ট:৩৭
আশেপাশে যতদূর চোখ যায় সবই পরিত্যক্ত জমি।
আবাদ হয়না যেনো বহুবছর।
নিজেকে আড়াল করার জন্য কিংবা লোকচোখে ধোকা দেয়ার জন্য এমন একটা জায়গাই যথেষ্ট।
এইখান থেকে লোকালয় অনেকটা দূর।
পায়ে হাঁটা পথ।
তবে নিজস্ব কিংবা ভাড়ার গাড়ি নিয়ে আসা যাবে এইখানে।
কিন্তু ফিরে যাওয়ার জন্য আগে থেকে গাড়ির ব্যবস্থা করা না থাকলে পায়ে হাঁটা ছাড়া উপায় নেই।
এতটা পথ হেঁটে পৌঁছানো এমনিতেই কষ্টকর।
তারউপর মেঘলার শরীরের এই অবস্থা।আটমাস চলছে।পেটও ভারী হয়ে গেছে।
ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা।তৃষ্ণায় গলাটা ফেটে যাচ্ছে।
কোনো রকমে সাবিবার হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে।
মাঝে মাঝেই সাবিবা ওড়না দিয়ে ঘামটা মুছে দিচ্ছে।কিন্তু মুখে রা টাও কাটছে না।
মেঘলা হাঁটছে ঠিকই কিন্তু মনে হাজারো প্রশ্ন।সীমান্তর এই কয়েকদিনের পরিবর্তন।ওর প্রতি যত্ন।সব মিলিয়ে নতুন করে ওর উপর বিশ্বাস ভরসা ফিরে আসছিল।
দুপুরে সীমান্তই তো নিজ হাতে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলো।
সবতো ঠিকই ছিল।
এর মধ্যে কি এমন হলো যার জন্য আপু এমন করলো??
অনেক অনেক প্রশ্ন মনে ঘুরছে।
আপুর বাচ্চার খুনি!!কে??
সীমান্ত??
আপুর বাচ্চা ছিল??
এতদিনও তো বলে নি??
কিন্তু এতগুলো বছর পেরিয়ে এখন কেনো প্রতিবাদ করলো??
কি করতে চাইছে আপু??
কি হয়েছিল আজ??
এত এত প্রশ্ন মনে কিন্তু মুখে কিছু বলল না।
খুব খারাপ লাগছে সীমান্তের জন্য।হয়তো এই কয়দিনে ওর ব্যবহার গুলোর জন্য।
মায়া যে বড্ড ভয়ংকর।
মোহ কেটে গেলেও মায়া যে কাটানো যায় না।
লোকালয়ে যখন ওরা পৌঁছালো তখন চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার।
স্ট্রীট লাইটের আলোয় ওরা এখন এগিয়ে চলেছে।
অনেক মানুষের দৃষ্টিই এখন ওদের দিকে।
সাতাশ আটাশ বছরের এক বিধ্বস্ত মহিলার সাথে বিশ বাইশ বছরের একটা অন্তঃসত্ত্বা মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে।
চট করে বাইশ পঁচিশ বছরের মেয়েকে মহিলা বলা যায় না আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে মেয়ে বলতেও অস্বস্তি হয়।
যেমন মেঘলা অন্তঃসত্ত্বা।ওকে মহিলা বলা গেলেও মুখের আদলে মহিলা না মেয়ে বলতেই স্বাভাবিক লাগে।
ওদের দেখেই বুঝা যাচ্ছে ওদের সাথে অস্বাভাবিক কিছু ঘটে গেছে।
লোকে অনেক কিছুই বুঝে।
কিন্তু এগিয়ে আসছে না কেউই।
শুধু অদ্ভুদভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে।
সাবিবা আশেপাশের বিলবোর্ড,পোস্টার,দোকানের নাম এইসব দেখে বুঝার চেষ্টা করছে এই জায়গার নাম কি!
কিছুক্ষণের মধ্যেই জেনেও গেলো জায়গার নাম।
কিন্তু এইখান থেকে যাবে কিভাবে??
যাবে কোথায়??ওরতো যাওয়ার জায়গা নেই।মেঘলার আছে।কিন্তু ওর বাড়ি অবধি কিভাবে পৌঁছে দিবে??
স্যারকে কি ফোন করবো??
কিন্তু যদি স্যার রেগে যান??কিংবা ফিরিয়ে নিতে নাকচ করেন??
পুলিশ স্টেশনে যেতে পারলে ভালো হতো।কিন্তু এইখান থেকে কতদূর??পৌঁছাবেই বা কি করে??
সাবিবা সবটা ভেবে নিল বিশদভাবে।প্রথমে পুলিশ স্টেশনে যাবে।
একটা সিএনজি হলে ভালো হতো।
আশেপাশে সিএনজি খুঁজতে লাগল।একটা পেয়েও গেলো।কিন্তু ড্রাইভার যেতে রাজি হল না।
সাবিবা ড্রাইভারকে যা ভাড়া তার দ্বিগুণ টাকা দিবে বলায় রাজি হয়ে গেল।
মেঘলাকে সিএনজি তে উঠিয়ে নিজেও উঠলো।
সিএনজি চলতে লাগলো তার নিজ গতিতে।
এর মধ্যে সাবিবা একটা কথাও বললো না।
মেঘলা বলতে চেয়েও পারলো না।ওর শরীরটা যে সায় দিচ্ছে না।
সাবিবার কাধে মাথা রেখে চোখ বুজে রইলো।
পুলিশ স্টেশনে যখন ওরা পৌঁছালো তখন প্রায় রাত ১১টা বাজতে চলেছে।
সাবিবা একদম শুরু থেকে সবটা খুলে বললো।
মেঘলা ওর পাশে বসে শুনছে।কথা বলার অবস্থা ওর নেই।বিশেষ করে শেষ কথাগুলো যেনো বিশ্বাসই করতে পারছে না।এতটা খারাপ কি করে হয় একজন বাবা??সে কি মানুষ??
পুলিশের মনেও যেনো ওদের ঘটনা শুনে মায়া হলো।
সবটা শুনে জিডি ফাইল করে নিল।
এইবার ওদের নিরাপদে বাড়ি পৌঁছানোর ব্যবস্থা করার পালা।
সাবিবা আগেই বলেছে ওর যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।তাই মেঘলার বাড়িতে ফোন করা হবে।
মেঘলার খুব ভয় হচ্ছে।যদি বাবা ওদের ফিরিয়ে না নেয়?কিংবা পরিচয় না দেয়??রেগে যায়??
অনেক ভেবে রুদ্রর নাম্বারটা দিলো।ওই পারবে বাবাকে বুঝিয়ে বাড়ি ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে।
বার কয়েক রুদ্রর নাম্বারটা ডাইল করলো।কিন্তু প্রতিবারই সুইচ অফ বলছে।
মেঘলার খুব কান্না পাচ্ছে।এই প্রথমবার বোধ হয় এমন হলো।ওর প্রয়োজনে রুদ্রকে খুঁজে ও পায়নি।তবে রুদ্র তো জানাতেই পারলো না মেঘলার ওকে প্রয়োজন।
উপায় না পেয়ে ওর বাবার নাম্বারটা দিলো।
মেঘলার সাহস হচ্ছে না কথা বলার।
তাই থানার ওসিই কথা বললেন।
অল্প কথায় সবটা বুঝিয়ে বললেন।
ওপর পাশ থেকে মুবিন হাসান কি বলছে সেটা শুনা না গেলেও ওসির কথায় বুঝা যাচ্ছে তিনি মুবিন হাসানকে সবটা বুঝাতে পেরেছেন।
মেয়ের বাবাতো মুবিন হাসান।অবশ্যই সীমান্তের মত বাবা তিনি নন।সন্তানের বিপদে ফেলে দিবেন কি করে???
এতকিছুর মাঝেও মেঘলার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল।কতগুলো বছর পেরিয়ে বাবাকে দেখবে!!
সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে।কোনোকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
ঘুটঘুটে অন্ধকার।
তারউপর মাথাটা টলছে।প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব হচ্ছে।
মাথায় হাত দিতেই থকথকে কিছু হাতে লাগলো। ঝরে যাওয়া রক্ত শুকিয়ে আসছে।
শরীরের কিছু কিছু জায়গায় খুব জ্বলছে।
কেটে গেছে কিংবা ছিলে গেছে হয়তো।
কিন্তু কোনো কিছু মনে করতে পারছে না।
অন্ধকারে উঠে বসার চেষ্টা করতেই ভাঙ্গা কিছুর সাথে লাগলো।
চাপা স্বরে গোঙ্গিয়ে উঠলো।
হাতের ক্ষানিকটা ছুলে গেলো হয়তো।সেখানেও জ্বলছে।
আবার মাথা তুলতে চাইলো।কিন্তু মাথাটা ঘুরে ওঠল।
পরে গেলো সীমান্ত।
তারপর আর কিছু মনে নেই।
দ্বিতীয় বারের মত সীমান্ত জ্ঞান হারালো বোধ হয়।
মমতা হাসান বড্ড অস্থির হয়ে আছেন।
এত রাতে কার ফোন পেয়ে এমন হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন মুবিন হাসান।
কি এমন জরুরি কাজ পড়লো যে এই এত রাতেই যাওয়া লাগবে!!
অনেকক্ষণ ধরে এই এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন তিনি।
কিন্তু মুবিন হাসান সেসব কানেই তুলছেন না।দ্রুত বাসার পরনের কাপড় পাল্টে শার্ট প্যান্ট পরে নিলেন।
প্রয়োজনীয় সব সাথে নিয়ে যতটা দ্রুত বেরিয়ে গেলেন।যাওয়ার আগে শুধু বললেন,তোমার এতদিনের কথা বোধ হয় আল্লাহ ফলিয়ে দিলেন।দুআ করো যেনো ছোহী সালামতে তোমার আমানত তোমাকে ফিরিয়ে দিতে পারি।আগেরবারের মতো যেনো ফেলে না আসি।এক ভুল যেনো দ্বিতীয়বার না হয় আমার।
মমতা হাসান ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলেন যেনো??
আমার কথা ফলে যাবে??
কোন কথা??
আমার আমানত ফিরিয়ে আনতে গেছে??
কোন আমানত??
কোন ভুলের কথা বলে গেলো??
কি ভুল করেছে মেঘলার বাবা??
কি ফেলে এসেছেন?
কবে ফেলে এসেছেন??
তিনি কোনোকিছু বুঝতে পারছেন না।
কোনো কিছু বুঝার চেষ্টা করতেই মাথায় তীব্র যন্ত্রণা অনুভব হয়।
আপাদত কিছু বুঝার চেষ্টাও করছেন না।
উনার স্বামীর কথা না বুঝলেও মনে মনে দুআ করতে লাগলেন উনার আমানত যেনো ফিরিয়ে আনতে পারে তিনি।
বারবার কেনো যেনো আমানত এর কথা ভাবতেই মেঘলার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে।
উনিতো মেয়েকে ফিরে পাওয়া ছাড়া আর কিছু চান না এ জীবনে।
দিনরাত তো আল্লাহর কাছে এই একটা জিনিসই চাচ্ছেন।
আল্লাহ!ফিরিয়ে দেও আমার মেয়েটাকে।ফিরিয়ে দেও আমার বুকে আমার মেয়েটাকে।আর কিছু চাওয়ার নেই।চাইও না তোমার কাছে কিছু।
চলবে…….
(গঠনমূলক মন্তব্য করে পাশে থাকবেন 😊 ধন্যবাদ😇)