মেঘলা আকাশে রুদ্রই ভরসা উম্মে হাবিবা তনু পার্ট:৩৬

0
297

মেঘলা আকাশে রুদ্রই ভরসা
উম্মে হাবিবা তনু

পার্ট:৩৬

এত ভালোবাসা,এত যত্ন পাবে কখনো কি ভেবেছিল মেঘলা??ভাবেনি।
কিন্তু সেসব এখন সে বাস্তবে দেখছে।
গত কয়েকদিন ধরে সীমান্ত কোনো মেয়েকে বাড়িতে আনেনি,উচু গলায় পর্যন্ত কথা বলে না,মেঘলার প্রতিটি কাজ নিজের হতে করছে।খাইয়ে পর্যন্ত দিচ্ছে।ওর এত খেয়াল রাখছে যে ওর এক একেক সময় মনে হচ্ছে ও স্বপ্ন দেখছে।গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে সে স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে।ক্ষানিক বাদে ঘুম ভাঙলো সব আগের মত হয়ে যাবে।
আল্লাহর কাছে প্রাণ খুলে শুকরিয়া জানতেও কার্পণ্য করেনি মেঘলা।সে এইবার যেনো নিশ্চিন্ত ওর সন্তান এলে সব ঠিক হয়ে যাবে।ওরা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবে।ভাবতেই মনটা ভরে যাচ্ছে।সেসবই সাবিবাকে বলে চলেছে মেঘলা।
সাবিবা ঠোঁটের কোণে মেকি হাসি ঝুলিয়ে সব শুনে যাচ্ছে।ওর কাছে সীমান্তর এই পরিবর্তনটা কেনো যেনো স্বাভাবিক লাগছে না।মনে হচ্ছে বড় ঝড়ের আগের কোনো পূর্বাভাস দিচ্ছে।ঝড় এর আগমুহূর্তে শুনসান নিরবতা চারদিকে ঘিরে আছে।অস্বাভাবিক রকমের স্বাভাবিকতা ঠিক ভালো লাগছে না।কমদিন তো হলো না এ সংসারে আর সীমান্তকেও খুব ভালো করেই চিনে।মেঘলা না হয় ছেলেমানুষ।কিন্তু সেতো না।চোখ কান সব কিছু সজাগ রাখতে কোনো দ্বিধা করছে না।সীমান্তকে সবসময় চোখে চোখে রাখছে।প্রতিটা পদক্ষেপে ঈগল দৃষ্টি মেলে রেখেছে।

হ্যালো!!
…….
সব ঠিকঠাক আছে তো??
…….
তুই এত না ভেবে যা বলছি তাই কর।
…..
এত কিন্তু কিন্তু করার মতো কিছু হয়নি।
…….
এদিকে সব আমি সামলে নিবো।
…….
হ্যাঁ,হ্যাঁ এইভাবেই যেনো থাকে।কোনো নড়চড় যেনো না হয়।
……
আমি ঠিক সময়ে মেঘলাকে নিয়ে আসবো।
……
আমার বড় বউটা খুব জ্বালাতন করছে অবশ্য….ছাড় ওই সব….ঠিক ম্যানেজ হয়ে যাবে।
……
আরে না না ছোট বউটা এত বুঝে না।একটু ভালো করে কথা বললেই গলে যায়।
……
হা হা হা…..
…….
বন্ধু যাই বলো ঘরের বউয়ের চেয়ে অন্যের বউ বেশি খাসা হয়রে…..
……
আমার বউ দুটোর দিকে নজর দিবি না।বেছে বেছে ইন্টেক্ট খাসা জিনিস বের করেছি।
…….
নারে আমার বউ দুটোই বড্ড ভালো।আমার দেখা সেরা মেয়ে।
……..
এইসব বাদ দে..কাজের কথায় আয়..
……
মেঘলাকে রেগুলার চেক আপ এর কথা বলে নিয়ে আসবো।খুব বেশি কঠিন কাজ নয়।
……..
নিজের সন্তান??হাহাহা…এমন কত সন্তান আছে যাদের খোঁজও জানি না।এইসব এ কিছু যায় আসে না।
…….
আগে ধান্ধা পরে এইসব সেন্টিমার্কা কথা ভাববো।
……
দেখ আল্ট্রা করে যদি বুঝি ছেলে হবে তাহলে আমার বিশেষ কোনো সুবিধা নেই।মেরেও ফেলতে পারি রেখেও দিতে পারি।কিন্তু যদি মেয়ে হয় পৃথিবীর মুখ দেখবে।আর সেই মেয়েই হবে আমার আয়ের উৎস।চড়া দামেও বিক্রি করে দেয়া যাবে।হাহাহা…

সাবিবার কান দুটো ধাধা করে জ্বলে উঠলো।আর এক মুহুর্ত সেসব শুনার মত অবস্থা ছিল না।প্রচন্ড ঘৃণায় ভিতরটা গুলিয়ে উঠছে।নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে পারছিল না।কোনো বাবাও এমন হয়???মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো।কোনোকিছু যেনো ভাবতে পারছে না।ক্ষণোকালে কি একটা হলো ছুটে রান্নাঘরের দিকে গেলো।চোখের পলকে সবজি কাটার ছুরিটা হাতে তুলে নিতে এক দন্ড দেরি হলো না ওর।এতি উতি কোথাও যেনো ওর খেয়াল নেই।সোজা সীমান্তর ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো।এই মুহূর্তে ও যেনো এই দুনিয়াতেই নেই।

ঝনঝন শব্দে কিছু একটা পরে যাওয়ার শব্দ হলো।সাথে পরিচিত দুটি পুরুষ এবং নারী কন্ঠ ভেসে এলো।একটা গোঙানির মত শব্দ হটাৎ হটাৎ আসছে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে দস্তাদস্তির শব্দে।চট করেই যেনো ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো মেঘলার।দরফরিয়ে উঠতে গিয়ে বুঝলো ওর শরীরটা বেশ ভার হয়ে গেছে।আট মাসের পেট।নড়াচড়া করাই দায় সেখানে লাফিয়ে উঠার চেষ্টা নেহাতই বোকামি।কিন্তু ওঘর থেকে ভেসে আসা শব্দগুলো ক্রমেই বেড়ে চলেছে।এইভাবে থাকা যাচ্ছে না।বহুকষ্টে উঠে বসলো।আস্তে করে বিছানা ছেড়ে নামলো।এক হাত পেটে আরেক হাত কোমড়ে রেখে ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলো।যত এগুচ্ছে ততই যেনো শব্দগুলো স্পষ্ট হয়ে আসছে।আর ততোই যেন মনের ভেতর ভয় দানা বাঁধছে।কি বলছে আপু এইসব??
কোন বাবা এমন হয় নাকি??না ঝাপসা ঝাপসা মাঝে থেকে শুনে কিছু ভেবে নেয়া যায় না।
আপুর বাচ্চার খুনি??আপুর বাচ্চা ছিল??কই কখনো শুনিনি তো??সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।আর ভাবা যাচ্ছে না কিছু।এঘর থেকে ওঘরের দূরত্ব যেনো কয়েকশো মাইল হয়ে উঠেছে।পা যেনো চলছেই না।

দরাম করে কিছু একটা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
সাথে অদূরে কিছু ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাওয়ার শব্দ হলো।
মেঘলার ভিতরটা দক করে উঠলো।
হটাৎ করেই সব শব্দ মিলিয়ে গেলো।নিরব নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
যতটা সম্ভব শরীরের সব শক্তি দিয়ে এগিয়ে গেলো ওঘরে।

ছোটখাটো ধ্বংসযজ্ঞ প্রমাণ বহন করছে যেনো ঘরটা।মেঘলার শ্বাসনালী থেমে গিয়ে আবার বেড়ে যাচ্ছে।
বিধ্বস্ত অবস্থায় দাড়িয়ে আছে সাবিবা।
তারই সামনে অচেতন হয়ে মাটিতে পরে আছে সীমান্ত।মাথা দিয়ে তিরতির করে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে।
সীমান্তের অতি পছন্দের শোপিস টা ভেঙ্গে গুড়িয়ে মাটিতে পড়ে আছে।
মেঘলা নিশ্বাস নিতেও ভুলে গেছে।কি হচ্ছে বা কি করবে ভাবার মত সে হিতাহিত জ্ঞান টুকুও যেনো অবশিষ্ট নেই।

সাবিবা একবারও মেঘলার দিকে তাকালো না।
নিজের মনেই কিছু একটা হন্যে হয়ে খুঁজছে সারাঘরময়।
কাঙ্ক্ষিত সে বস্তু খুঁজে পেতে খুব একটা সময় লাগলো না।তারপর ঘর বেরিয়ে আসতে গিয়েও ফিরে গেলো।
সীমান্তের ফোনটা হাতে নিল।লক করা।পাসওয়ার্ড তো আর জানা নেই।
সব রাগ যেনো মোবাইলটার উপর গিয়ে পড়লো।অত্যন্ত অবহেলায় ছুড়ে ফেলে দিল।
মোবাইলটাও গুড়িয়ে গেলো।
একটা ড্রয়ার খুলে হাতড়িয়ে কিছু টাকা নিল।
তারপর বেরিয়ে আসতে গিয়েই মেঘলার উপস্থিতি টের পেল।সন্ধিঙ্গ চোখে ওরই দিকে তাকিয়ে আছে।চোখে মুখে ভয় আর প্রশ্নরা উপছে পড়ছে।

মেঘলাকে কিছু বলতে না দিয়ে ওর হাত ধরে টেনে বেরিয়ে যেতে লাগলো।
দরজার সামনে আসতেই অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,আপু ওকে এইভাবে রেখে….
সাবিবা সে কথা কানেও তুললো না।
সদ্য সীমান্তর ঘর থেকে খুঁজে পাওয়া সেই কাঙ্ক্ষিত বস্তু চাবিখানা দিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো বাইরে।
বাইরে থেকে আবার তালা বন্ধ করে খোলা আকাশের নীচে এসে দাড়ালো দুবোন।
কতগুলো দিন,কতগুলো মাস,কতগুলো বছর পেরিয়ে ওরা দুইজন আজ খোলা আকাশের নিচে।
সন্ধ্যার রক্তিম আভা জানান দিচ্ছে সূর্য ডুবে যাওয়ার সময় হলো বলে।
লালাভ অলস সূর্যের আলোয়ও যেনো চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে।
কতগুলো বছর পেরিয়ে সূর্যকে দেখেছে।তার তাপ সইতেও তো সময় লাগবেই।
দুবোন প্রাণখুলে নিশ্বাস নিল।
কিছুক্ষণ আগের সব যেনো ক্ষণিকের জন্য ভুলেই গিয়েছিল মুক্তির স্বাদ পেয়ে।
মুক্তির স্বাদ যে এত সুন্দর এত বছরের জীবনে প্রথমবার অনুভব করল মেঘলা।সময়টা এইখানে থেমে গেলেও ওর দুঃখ নেই।

চলবে……..

আগের পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/140699218169611/posts/281141464125385/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here