মেঘলা আকাশে রুদ্রই ভরসা উম্মে হাবিবা তনু পার্ট:৩৫

0
233

মেঘলা আকাশে রুদ্রই ভরসা
উম্মে হাবিবা তনু
পার্ট:৩৫

পরম আবেশে পেটে মাথা রেখে হাঁটু মুড়ে বসে আছে সীমান্ত।তার চোখ দুটো বুজে আছে,দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে মেঘলার কোমড়।মুখে কিছু বলছে না।এমনকি তার মুখে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়ায়ও বুঝা যাচ্ছে না যে সে রেগে গেছে।

থর থর করে কাপছে মেঘলা।

তার চেয়েও শতগুণ বেশি কাপছে যেনো সাবিবা।হাত পা অবশ হয়ে আসছে তার।এতগুলো মাস মেঘলাকে সীমান্তর সামনে থেকে আড়াল করে রেখেছে।একই ছাদের নিচে থেকেও বহুকষ্টে লুকিয়ে রেখেছে মেঘলার প্রেগনেন্সির কথা।তবুও শেষ রক্ষা করতে পারলো না।এইবার কি হবে মেঘলার আর ওর বাচ্চাটা??সাবিবা ভাবতে পারছে না।পারতো পক্ষে ভাবতে চাইছে।তবে সে তার বোন আর তার সন্তানের গায়ে একটা আঘাতও আসতে দিবে না।যত ভয়ংকর অবস্থাই আসুক না কেনো সে রুখে দাড়াবে,কোনো অন্যায় হতে দিবে না তাদের সাথে যা তার আর তার সন্তানের সাথে হয়েছে।

প্রায় আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা মেঘলা আজ যেনো আবেশে মিয়ে যাচ্ছে।কাপন দিচ্ছে তার গায়ে।সে কাপন তার রন্দ্রে রন্দ্রে জানান দিচ্ছে।এই সময়টায় নাকি প্রতিটা মেয়ে চায় স্বামীর সান্নিধ্য,ভালোবাসা,যত্ন,সময় আর সাপোর্ট।এতগুলো দিন মনে মনে তার সন্তানের বাবার একটু সান্নিধ্য পাওয়ার আশায় বারবার ছটফট করেছে।তবু সে যেতে পারেনি।কয়েক ফুটের দূরত্ব এ তাদের অবস্থান ছিল তবুও তার স্বামী জানতে পারেনি তার অনাগত সন্তানের আগমনের কথা।কারণ আপু চায় নি।কেনো চায়নি তা সে না জানলে অনুমান করতে পারতো।আজ আচমকা এইভাবে জড়িয়ে ধরায় ভেতরের কাপনদের আর আটকে রাখতে পারছে না।মনের সাথে শরীরটা যেনো যুদ্ধ করছে।মন বলছে এই নোংরা,বাজে লোকটার থেকে দূরে সরে যা,কিন্তু শরীর যেনো তার এইটুকু স্পর্শেই আবেশে হারিয়ে যাচ্ছে।

উপস্থিত তিনটি প্রাণী।কারো মুখে রা নেই।নাকি কথারা হারিয়ে গেছে??সবাই গভীরভাবে উপলব্ধি করতে চাইছে।কিন্তু তিনজনের উপলব্ধির বিষয় যেনো ভিন্ন।

মুবিন হাসান প্রচন্ড তৃষ্ণায় হাশফাস করতে করতে ঘরে ফিরলেন।দপ করে সোফাটায় বসলেন।বয়স হচ্ছে।আগের মত আর বল পান না।বহুকষ্টে ক্লাসগুলো করান।অবসর নেওয়ার সময়টাও ঘনিয়ে আসছে।আর তো কিছুদিন এর ব্যাপার।
মমতা হাসান এক গ্লাস পানি নিয়ে স্বামীর দিকে এগিয়ে দিলেন।
এক নিশ্বাসে সবটুকু পানি শেষ করলেন।তবুও তৃষ্ণা মিটেনি।স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন,আরেক গ্লাস পানি দেও।
বিনাবাক্য বেয়ে চলে গেলেন।পরক্ষণেই আরেক গ্লাস পানি নিয়ে ফিরলেন।এইবার মুবিন হাসান তিনবারে পানিটা শেষ করে স্ত্রীর দিকে তাকালেন।
মমতা হাসান আজকাল একদমই কথা বলেন না।মাঝে মাঝে বিলাপ করে কেঁদে উঠেন মেয়ের জন্য।আগের সেই তেজস্বী মহিলা যেনো মিয়ে গেছে।সংসারে কোথায় কি হচ্ছে একসময় যার নখদরপন ছিল সে আজ জানেই না সংসারে কিভাবে চলে।মুবিন হাসান গরজ করে যেটুকু করে সেটুকুই।না পারতে রান্নাটুকু করে।তাও মুখে দেওয়া প্রায় সময়ই দায় হয়ে যায়।মুবিন হাসান অবশ্য সেসব নিয়ে কিছু বলেন না।নিজের মতো করে মানিয়ে নিয়েছেন।
চোখের ইশারায় বসতে বলেন মমতা হাসানকে।
তিনি বসলেন।কিন্তু মুখে কিছু বললেন না।
মমতা তুমি আজকাল ঠিক মত ওষুধ খাচ্ছো না কেন??
মনে থাকে না,নিরুত্তাপ জবাব দিলেন।
এইভাবে চলতে থাকলে তুমি তো আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে।এমনিতেও তোমার শরীর বিশেষ ভালো না।
মমতা হাসান এর কি একটা যেনো হলো…হঠাৎই দুহাতে তার স্বামীর হাত চেপে ধরে ফুপিয়ে উঠলো।
আকস্মিক ঘটনায় ভরকে গেলেন মুবিন হাসান।তিনি কিছু বলার আগেই মমতা হাসান বলে উঠলেন,
আমার মেয়েকে এনে দেও আমি ঠিক হয়ে যাবো।
কি শুরু করলে মমতা??
আমার বিশ্বাস আমার মেয়ে বেচেঁ আছে।তুমি এনে দেও..
অস্পষ্টভাবে বললেন,সে কি আর কোনোদিন আসবে!!
মমতা সে কথা কানেই তুললেন না।তিনি তারস্বরেই বলতে থাকলেন,আমার মায়ের মন।আমি ঠিক বুঝি আমার মেয়ে আছে।কোথাও না কোথাও সে আছে।একদিন আমার মেয়ে আমার বুকে ঠিক ফিরে আসবে।আমি জানি তুমি মিথ্যা বলেছ।আমার মেয়ে আসবে ঠিক আসবে।বিলাপের স্বরে কাদছেন তিনি।
ভাঙ্গা গলায় শুধু বললেন,তাই যেনো হয় মমতা তাই যেনো হয়।
মুবিন হাসান এর চোখের কোনটা ভিজে উঠছে।ইদানিং প্রায়ই তার এমন হয়।আবেগকে সংবরণ করতে পারেন না।অবাধ্য চোখ দুটো ভিজে উঠে।

কিছুদিন ধরেই মমতা হাসান এমন করেন।তার খুব করে মনে হয় মেঘলা ফিরে আসবে।ব্যাকুল হয়ে কাদেন আর অপেক্ষা করেন মেয়ের আসার।

আমার সন্তান না আমাদের সন্তান এইখানে…এই…এইখানে আছে!!
সীমান্তর গলার স্বর পেয়ে ভাবনা থেকে ফিরে আসে মেঘলা।মেঘলার গলা কাপছে।মুখে কোনো কথা আসছে না।সীমান্ত এখনো তার পেটে মাথা রেখে বসে আছে।খুব করে মানুষটার মুখের ভাব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।কিন্তু তার মুখ দেখা যাচ্ছে না।
বলো না…এইখানে আমাদের অনাগত সন্তান আছে??বলেই মেঘলার মুখের দিকে তাকাল।
মেঘলা কাপা কাপা অবস্থায়ই মাথা নাড়ালো।যার অর্থ,হ্যাঁ,এইখানেই সে আছে।
সীমান্ত এইবার অনুযোগের সুরে বলল,আর তুমি সেটা এতদিন আমার থেকে আড়াল করে গেছ??
মেঘলা কি বলবে বুঝতে পারছে না।সীমান্তের এমন আচরণ,কথায় সে বিমোহিত হয়ে যাচ্ছে।হয়ত মানুষটা এইবার বদলে যাবে।সন্তানের আসার খবর এ এমন ব্যবহার!তার থেকে আড়াল করায় কণ্ঠে অভিযোগ ঝরে পড়ছে…তবে কি সীমান্ত বদলে যাবে??আমার সন্তান তার বাবাকে পাবে,হ্যাঁ পাবে…সীমান্তের উষ্ণতায় মেঘলার মনের মধ্যে জমানো বরফ গলতে শুরু করেছে।
সীমান্ত আবার মেঘলার পেটে মাথা ঠেকিয়ে বললো,যা করার করে ফেলেছ।তোমার কিছু বলতে হবে না।কোনো প্রেসার দেওয়া যাবে না এতে আমার সন্তানের আর সন্তানের মায়ের কষ্ট হবে।আমি তাদের কোনো কষ্ট দিতে চাই না।আজ থেকে আমি নিজে তোমাদের সব দায়িত্ব পালন করবো।সব করবো সব।কোনো কিছুতে কোনো খামতি রাখবো না।শ্রেষ্ঠ বর হয়তো হতে পারিনি কিন্তু এইবার আমি শ্রেষ্ঠ বাবা হবো।আমার সন্তান গর্ব করে বলবে,আমার বাবাই বেস্ট।পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা হলো আমার বাবা।
মেঘলার ঠোঁট জুড়ে প্রশস্ত হলো হাসির রেখা।সেতো এতদিন তাই চাইতো মনে মনে।সব স্বপ্ন মনে হচ্ছে।যেনো ঘুম ভাঙ্গার সাথে সাথেই সব মিলিয়ে যাবে।মেঘলা ছোট করে নিজের হাতে চিমটি কাটল।
আওচ…
সীমান্ত সেদিকে তাকিয়ে শব্দ করে হেসে উঠলো।আরে পাগলী এইটা স্বপ্ন না এইটা সত্যি,বলেই উঠে দাড়িয়ে মেঘলার মাথাটা আলতো করে বুকে নিল।তারপর সাবিবার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো।সীমান্ত বুঝতে পারছে সাবিবাই মেঘলার প্রেগনেন্সির বিষয়টা এত দিন ওর থেকে আড়াল করে গেছে।সব এরই কারসাজি।

অদূরে দাড়িয়ে সবটা দেখছে সাবিবা।সীমান্তের দৃষ্টি উপেক্ষা করে সেও তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।তার সে দৃষ্টি তুক্ষর।অনাকাঙ্ক্ষিত ঝড় আসার পূর্বাভাস যেনো সে পাচ্ছে।নিজেকে প্রস্তুত করছে।সে এই ঝড়ের মোকাবিলা করবেই।

চলবে………..

[গঠনমূলক মন্তব্য করে পাশে থাকবেন।ধন্যবাদ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here