#বেলাদোনা (৫)
#ফাতেমা_তুজ
সূর্য যখন নিজের রূপ দেখা তে ব্যস্ত তখন বেলা কে সঙ্গ দেয় ইথান আর লুসি। প্রথম দিকে লুসি কে তেমন একটা ভালো না লাগলে ও এখন বেশ ভালোই লাগে। খানিকটা উন্নতি ঘটেছে এই সম্পর্কের।মাঝে মাঝে লুসি কে কোলে তুলে আদর ও করা হয়। আর বেলার নরম হাতের ছোঁয়া পেয়ে লুসির গাঁয়ের লোম গুলো জাগ্রত হয়ে যায়। ইথান তখন শুধু তাকিয়ে থাকে ফ্যাল ফ্যাল পল্লবে।
ওর কেবলি মনে হয় লুসির মনে ও কাম ভাব বিদ্যমান। না হলে বেলার হাতের স্পর্শে কেন লোম জেগে উঠবে?কাল হেবা ফিরে আসছে। সেই সংবাদ পাওয়া মাত্র ই কাজের প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয়েছে বেলার। প্রায় দশ মিনিট যাবত এক টা টেবিল ই পরিষ্কার করে চলেছে। অথচ আহামরি কিছু নেই তাঁতে। মারিয়া এসব লক্ষ্য করেই মেয়েটির কাজের ইস্তফা দিলেন। এতে অবশ্য বিরোধ করা উচিত ছিলো তবে তেমন কিছুই করে নি বেলা। বরং এক সমুদ্র উৎফুল্লতা নিয়ে বেকারি থেকে বেরিয়ে পাশের নির্জন সরু পথে হাঁটতে লাগলো।
বেলা যে শহরে বাস করে তা আমেরিকার পশ্চিমাংশে অবস্থিত। রকি পর্বতমালার মধ্যবর্তী এই অঞ্চলের উত্তরেই রয়েছে কানাডা। তৃণভূমি আর জঙ্গলাকীর্ণ এই এলাকা টি বেলার জন্মস্থান নয়। আর না তাঁর জন্মভূমি আমেরিকা। সেসব নিয়ে বিশেষ কিছু ভাবছে ও না বেলা। আপাততো তাঁর মন ভীষণ খারাপ। এই মন খারাপের কারণ সে নিজেও উপলব্ধি করতে পারে নি এতো সময় যাবত। তবে বুকের ভেতর অবশ্যম্ভাবী ভয়ঙ্কর বিপদের আশঙ্কায় বুঁদ হয়ে আছে। মনে হচ্ছে কিছু ঘটবে। কিন্তু কি ঘটবে এ যেন এক রহস্য। আচমকাই সেদিনের সেই আক্রমণের কথা মনে পরে গেল। বেলার হাত পা থরথর করে কাঁপছে। টলছে তাঁর শরীর। ঝট করেই ঘাসের উপর বসে পরলো সে। তবে বেশিক্ষণ অবস্থান হলো না। তাঁর পূর্বেই ঝোপ থেকে শব্দ করে বেরিয়ে এলো লুসি।
” লুসি! ” বিস্ময় লুকাতে পারলো না বেলা। লুসি কে সব সময় ইথানের সাথেই দেখেছে। আর নয়তো ইথান ছিলো আশে পাশে। এর মানে ইথান ও রয়েছে এখানে। কোনো ক্রমেই অনাকাঙিক্ষত এই চমকের আশা করে নি বেলা। ইথান কি তবে পিছু নিয়েছে? এমন টা তো হওয়ার কথা না। ইথান কেন তাঁর পিছু নিতে যাবে! আচম্বিতে ব্যাথায় আহ করে শব্দ করলো বেলা। লুসি তাকে আবার আঁচড় কেটেছে। বেলার খুব রাগ হচ্ছে। লুসি কে ধমক দেওয়ার জন্য তৈয়ার হতেই ঝোপঝাড়ের ভেতর থেকে ইথান এর ধীর কন্ঠ ভেসে এলো। যেন খুব দূরে থেকে ডাকছে ছেলে টা। ম্যাও ম্যাও শব্দের সাথে উন্মাদ, বদ্ধপরিকরের মতো লাফানো শুরু করেছে লুসি ক্যাট। প্রথম দিকে বুঝতে না পারলে ও এখন কিছু একটা বুঝলো বেলা। ঝুঁকে লুসি কে কোলে তুলে নিয়ে বলল–
” কি হয়েছে লুসি ক্যাট? তুমি এমন করছো কেন! আর তোমার কর্তাই বা কোথায়? ”
অবলা প্রানী লুসি। সে শুধু ম্যাও ম্যাও করতে জানে। বেলার ভাষা বোঝার মতো ক্ষমতা আছে কি না জানা নেই। তবে লুসি লাফিয়ে পরলো মাটি তে। নরম মাটি তে লুসির নখের দাগ বসে গেল। বেলার দিকে তাকিয়ে ম্যাও ম্যাও শব্দ তুলে ঝোপের মাঝে ঢুকে পরলো। সময় কে নষ্ট না করে বেলা নিজে ও ঢুকে গেল জঙ্গলে। অনেক গুলো ডাল পালা আর কাঁটা যুক্ত গাছের মাঝে চিকন এক রাস্তা। কোনো মতে এক পাতলা গড়নের মানুষের চলাচল করতে ও কষ্ট। যাওয়ার সময় জামা কাপড়ে বিঁধে যাচ্ছে কাঁটা। তবু ও নতুন উদ্যমে লুসি কে অনুসরণ করে ছুটে চলেছে বেলা। বেলার তুলনায় লুসির খর্ব শরীর খুব দ্রুত এগিয়ে চলেছে। বেলা তাল মেলাতে পারছে না কোনো ক্রমে। সে পেছন থেকে লুসির নাম ধরে ডাকতে লাগলো বিরতহীন শব্দে। তবে লুসি না থেমে এগিয়ে চলেছে নিজ মালিকের পথে।
লুসি কে এখন দেখা যাচ্ছে না। চারপাশ জুড়ে সবুজ ঘন ঝোপঝাড়। কিছু বিষধর পোকামাকড়ের দেখা ও মিলে। বেলা বার বার লুসি কে ডেকে চললো। তবে অহংকারী লুসি ক্যাট সাড়াহীন। এবার ভয় হচ্ছে বেলার। ঝোপঝাড় কে তোয়াক্কা না করে আরেকটু আগালো বিড়াল পায়ে। আকস্মিক পাশ থেকে ঝপাৎ করে শব্দ হলো।
” লুসি! তুমি কোথায় যাচ্ছো? ”
বিড়াল টি দু বার ম্যাও ম্যাও শব্দ করে আবার ছুটতে লাগলো। বেলা এবার সর্বশক্তি তে পিছু নিলো। কিছু টা পথ যাওয়ার পর যা দেখলো তা দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলো না মন মস্তিষ্ক। লতা ও গুল্মের ঝোপের পাশেই দৈত্য আকারে হিকরি ওট গাছ। সেই গাছের গোড়া তে শরীর ঠেকিয়ে আছে ইথান। চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে বেশ অসুস্থ। হাতের ইশারায় লুসি কে ডাকলো। লেজ নাড়িয়ে লাফিয়ে ইথানের গাঁয়ের উপর উঠলো লুসি। বা হাত টা নাড়াতে না পারলে ও ডান হাতের সাহায্যে লুসির গাঁয়ে হাত বুলালো। কন্ঠ টা কেমন ফাঁকা হয়ে আসছে। আধবোজা চোখে শুধালো–
” লুসি, কোথায় গিয়েছিলে তুমি? এভাবে লাফিয়ো না প্লিজ। তুমি ব্যাথা পাবে। ”
বেলা এগিয়ে এলো। ইথান তাঁকে এখনো দেখে নি। ঝাঁকড়া চুল গুলো কেমন প্রাণ হীন নিস্ফল। পাশেই বসলো বেলা। ইথানের উপর থেকে লুসি কে উঠিয়ে জিজ্ঞাসা করলো
” কি হয়েছে আপনার? এভাবে হেলান দিয়ে বসে আছেন কেন। ”
” বেলা! তুমি এখানে এসেছো কেন? যাও বেরিয়ে যাও দ্রুত। এই জঙ্গলে বিষাক্ত জীব আর গুল্মের বাস। ”
” আগে বলুন আপনার কি হয়েছে? ”
” কোনো বিষাক্ত জীব কামড় দিয়েছে। ”
হাতের দিকে লক্ষ্য করে তাকালো বেলা। চোখ দুটো বেরিয়ে আসার উপক্রম। ক্ষত স্থান থেকে ফিনিকের মতো লাল তরল ঝরছে। ব্যাকুল হয়ে পরলো বেলা। ইথানের কথা অনুযায়ী কোনো বিষধর জীব কামড় দিয়েছে। সঠিক চিকিৎসা না হলে মৃত্যু অব্দি হতে পারে। কি করবে কি বুঝতে পারছে না। অন্য দিকে উদভ্রান্তের মতো ছুটোছুটি করছে লুসি। কখনো গাছে উঠার চেষ্টা করছে তো কখনো মাটি খামচে ধরছে। বোঝা যাচ্ছে নিজ মালিক কে হারানোর ভয় তাঁকে একেবারে অষ্টাঙ্গে জড়িয়েছে। লুসি কে শান্ত করার জন্য বৃথা চেষ্টা চালালো কতক্ষণ। তারপর ইথানের হাতের ক্ষত স্থানের পাশ টা ভালো করে অবলেকন করলো। বিশেষ কিছু অনুধাবন হচ্ছে না। এই মুহূর্তে সাগরে পরে যাওয়ার মতো অবস্থা বিরাজ করছে বেলার মন মস্তিষ্কে বক্ষঃস্থলের। বুদ্ধিমান প্রানী হওয়া সত্তে ও লুসির মতোই দিশেহারা তাঁর অবস্থা। পক্ষান্তরে ইথান অধিক স্থির। বেশ কিছু টা সময় পর বেলার মনে পরলো বাবার সাথে একটি জড়িবুটি নিয়ে কাজ করা হয়েছিলো। বাবা বলেছিলেন যখন কোনো কিছুই হাতের কাছে পাবে না তখন এই ভেষজের সন্ধান করবে। এতে অনেক বিষক্রিয়া নেমে যাওয়ার মতো শক্তি বিদ্যমান। বেলার বিধ্বস্ত মুখ দেখে ইথানের মুখে স্ফূর্তি শূন্যতাথ উদয় ঘটলো। শুধু মাত্র তাঁর জন্য বেলা আজ চিন্তিত, বিভ্রান্ত, বিধ্বস্ত, ভগ্নহৃদয়। নিজেকে বিপদের মাঝে নিয়ে এসেছে। মেয়েটির বাহু তে হালকা করে স্পর্শ করে ইথান অনুরোধ করলো–
” তুমি এখান থেকে বেরিয়ে যাও বেলা। ”
এক পলক তাকালে ও কথার পিঠে কথা বলে নি বেলা। নিজেকে এলেবেলে মনে হলো ইথানের। লুসি কে চোখ দিয়ে শাসন করলো। কেন সে বেলা কে ডেকে নিয়ে এলো।
প্রায় পাঁচ মিনিট খোঁজাখুঁজির পর এক বিশেষ ধরনের লতার সন্ধান মিললো বেলার। তবে এটাই কি সেই পাতা কি না ঠিক মনে নেই। বহু দিন পর এই ধরনের কাজে হাত লাগিয়েছে কি না। ক্রমশ দূর্বল হয়ে যাচ্ছে ইথান। চোখ মুখ লাল বর্ণে ঢেকে গেছে। ক্ষত স্থানের চারপাশ টা নীল বিষাক্ত বর্ণ উপস্থাপনায় ব্যস্ত। মনে মনে বেশ কয়েক বার সৃষ্টিকর্তার কে স্মরণ করলো বেলা। হাতের তালু তে ভেষজ টা পিষে নিয়ে রস বের করে সেটা লাগিয়ে দিলো ইথানের হাতে। গরম তেল গাঁয়ে লাগলে যেমন অনুভূতি হয় ঠিক তেমনি অনুভব হচ্ছে ইথানের। চোখ খিচে নিলো ব্যাথায়। এই ঝুঁকি টা নিতেই হবে বেলার। আশে পাশে জনমানবশূন্য। ঠোঁট কামড়ে নিজেকে ঠিক রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে ইথান। লুসি আগের থেকে ও অধিক গতিতে ম্যাও ম্যাও করে যাচ্ছে। কয়েক বার আঘাত ও করেছে বেলা কে। তাঁর ধারণা মালিক কে কষ্ট দিচ্ছে বেলা। সব টা দেখা সত্তে ও ইথানের মুখ থেকে বাঁধা দেওয়ার মতো শব্দ উচ্চারিত হয় নি। সে শক্তি আপাততো নেই। বেলার চোখ দুটো কেমন ছলছল করছে। বহু দিন পর কোনো মানুষ কে এমন যন্ত্রনায় কাতরাতে দেখলো।
সেই লোক টা ও যন্ত্রণায় সামান্য আর্তনাদ করেছিলো। তবে বিন্দু মাত্র খারাপ লাগে নি সেদিন। ইথানের দেহের শেষ জীবনীশক্তি ও যেন ফুরিয়ে এলো। নিস্তেজ হয়ে গেল ছেলেটার শরীর।
চলবে