মেঘলা আকাশে রুদ্রই ভরসা
উম্মে হাবিবা তনু
পার্ট:৩৯
কলিং বেল দিতে গিয়েও থেমে গেলেন মুবিন হাসান।
কারণ রাতে তিনি বেরিয়ে যাওয়ার সময় দরজা যেভাবে খুলে রেখে গেছেন তেমনই আছে।
মুবিন হাসান দরজা দিয়ে উকি দিয়ে দেখলেন মমতা হাসান সোফায় বসে আছেন।
সারারাত অপেক্ষা করে ওইভাবেই ঘুমিয়ে গেছেন হয়তো।
মুবিন হাসান ভিতরে ডুকে আলতো করে স্ত্রীর কপালে হাত রাখতেই মমতা হাসান দরফর করে উঠলেন।তিনি যেনো এতক্ষণ ধরে এই অপেক্ষায় ছিল।এক্ষুনি ঘুম না ভাঙলে সব শেষ হয়ে যাবে।
মুবিন হাসান কিছু বলার আগেই তিনি হড়বড় করে বলতে লাগলেন,
আমার আমানত ফিরিয়ে দেও….আমার আমানত কোথায়??
মমতা শান্ত হও।
তুমি আমার আমানত ফিরিয়ে দেও….আমার মেঘলাকে ফিরিয়ে দেও।আমি আর কিচ্ছু চাই না।
মমতা তুমি আগে শান্ত হয়ে বসো।তোমার আমানত ফিরিয়ে দিবো।তুমি বসো।
মমতা হাসান এইবার শান্ত হয়ে বসলেন।উনি শুধু মেয়েকে ফিরে পেতে চান।এই জীবনে আর কোনো চাওয়াই নেই।
মমতা হাসান বিড়বিড় করে বলেই চলেছেন,আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দাও,আমার মেঘলাকে এনে দেও।
মুবিন হাসান সেদিকে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বেরিয়ে গেলেন।
সিঁড়ি ভেঙ্গে মেঘলার উঠতে খুব কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
সাবিবা ধরে ধরে উঠাচ্ছে।
এতটা সময় বাবা মেয়ে একসাথে তাও এতগুলো বছর পেরিয়ে তবুও বাবা মেয়ে একটাও কথা বলেনি।
মেয়ের উঠতে কষ্ট হচ্ছে দেখে এগিয়ে গেলেন ঠিকই মুখে কোনো রা কাটলেন না।
সাবিবা এবং মুবিন হাসান ধরে মেঘলাকে উপরে নিয়ে গেলেন।
মেঘলা আশপাশটা সেই কখন থেকে দেখছে।ওর সেই চেনা জায়গা চেনা পরিবেশ।অনেককিছু বদলে গেছে।বাড়ির রংটা আগের মত চকচকে নেই।ওদের বাড়ির আশেপাশের ফাঁকা জায়গাগুলোতে উচু উচু দালান উকি দিচ্ছে।মানুষগুলোর বয়সটা বেড়ে গেছে।বুড়ো হয়ে গেছে।তবুও চিরও চেনা।
দরজার সামনে আসতেই থমকে গেল।ওর মা…ওর সামনে….মানুষটা কেমন হয়ে গেছে।রোগা রোগা লাগছে।সত্যি বয়সটা এতই কি বেড়ে গেছে নাকি অসুস্থ??কেমন ঘোরের মধ্যে আছে।কেউ যে এসেছে তিনি বুঝতেও পারছে।অথচ ওর মায়ের তো সবদিকে নজর ছিল।তবে কি মাও বাবার মতো নিরব হয়ে গেছে।ওর সাথে কথা বলবে না??
মেঘলা ধীরে ধীরে মায়ের দিকে যাচ্ছে।
বিড়বিড় করে কিছু একটা বলেই চলেছে।কি বলছে???
মেঘলা দাড়িয়ে গেলো।ওর মা যে ওকে ফিরিয়ে দিতে বলছে।মানুষটা তো স্বাভাবিক নেই।মেঘলার বুক ভেঙ্গে কান্না আসছে।
সোফায় মায়ের পাশে গিয়ে বসল।খুব আস্তে ডাকলো,
মা.আ.আ…
মমতা হাসান এর যেনো ঘোর কাটল।কতদিন পর মা ডাকছে কেউ তাকে।অস্পষ্টভাবে মুখ দিয়ে বের হলো..কে…
মা আমি….আমি তোমার মেঘলা…..
মমতা হাসান ঘোর লাগা দৃষ্টিতে মেঘলার দিকে তাকিয়ে রইলেন।বুঝার চেষ্টা করছেন সবটা সত্যি নাকি কল্পনা!!
মা…মা…তোমার মেয়ে ফিরে এসেছে…ও মা….তোমার মেঘলা আমি….
মমতা হাসান কি বুঝলেন….তিনি মেঘলার মাথাটা শক্ত করে বুকের মাঝে চেপে ধরলেন।জোরে জোরে বলতে লাগলেন,
আমার মেঘলা…আমার মেয়ে!!
হ্যাঁ,মা তোমার মেয়ে আমি…তোমার মেঘলা…
মেঘলার আব্বু..মেঘলার আব্বু….দেখো আমার মেঘলা ফিরে এসেছে।মেঘলা মাগো আমি তোমাকে আর বকবো না মারবোও না।আর রাগ করে থাকিস না মায়ের সাথে।আর হারিয়ে যাস না।
মেঘলা মায়ের বুকে মুখ গুঁজে অঝোরে কাদঁছে আর বলছে,আমি আর তোমাদের ছেড়ে কোথাও যাবো না মা,কোথাও যাবো না।
মা মেয়ে অঝোরে কাদঁছে।আর নিজেদের কথাই বলছে।
দরজার সামনে আরো দুইজন মানুষ দাড়িয়ে আছে সে খেয়াল তাদের নেই।মানুষ দুটোও কাদঁছে মা মেয়ের এই মিলন দৃশ্য দেখে।এমন দৃশ্য দেখে যে কঠিন পাথর মনের মানুষেরও চোখ ফেটে অশ্রু আসবে।সেখানে মুবিন হাসান সন্তান হারা বাবা এতদিনে সন্তানকে ফিরে পেলেন।
আর সাবিবা সেতো চিরো অভাগী।মা,বাবা,বোন,স্বামী,সন্তান সব হারিয়েছে।তারতো এ পৃথিবীতে আপন বলে কেউ নেই।কেউ নেই।
মমতা অনেক হয়েছে।মেয়েটাকে ফ্রেশ হতে দেও।
না আমি ছাড়বো না।আবার হারিয়ে যাবে আমার মেঘলা।
মমতা তোমার মেয়ে আর হারিয়ে যাবে না।ছাড়ো ওকে।অনেকটা পথ এসেছে।ফ্রেশ হতে দেও।
মমতা হাসান ছাড়বে না ছাড়বে না করে অবশেষে ছাড়লেন।
সাবিবা আস্তে আস্তে মেঘলাকে ধরে উঠালো।
মুবিন হাসান এর দেখিয়ে দেওয়া ঘরে মেঘলাকে নিয়ে গেলো।
মমতা হাসান এতক্ষণ খেয়াল না করলেও এইবার দেখলেন।এই মেঘলাকে তার মেয়ে মেঘলার মত লাগছে না।উনার মেয়েতো বাচ্চা।আর এই মেয়েটা দেখতে মেঘলার মত হলেও মেয়েটাকে পূর্ণবয়স্ক মনে হচ্ছে।মোটেই বাচ্চা লাগছে না।উল্টে পেট দেখে মনে হচ্ছে কয়দিনের মধ্যে এই মেয়েই একটা বাচ্চার জন্ম দিবে।তিনি যেনো গভীর ভাবনায় তলিয়ে গেলেন।দুইয়ে দুইয়ে চার মিলাতে পারছেন না।জটিল ধাঁধায় পড়ে গেলেন।
সবকিছু পাল্টে গেলেও একটুও পাল্টায়নি মেঘলার ঘরটা।
ঘরের যেখানে যা ছিল ঠিক সেভাবেই সব আছে।একটুও অদলবদল হয়নি ঘরটার।
মেঘলার দুইচোখ আবার ভরে উঠলো।
আজ যে চোখেরা বাঁধ ভেঙেছে।যেনো কথা দিয়েছে মেঘলার চোখ দুটোকে শুকনো থাকতে দিবে না।
সাবিবার হাত ধরে ঘরের সবকিছু ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে।
বেড সাইড টেবিলে খুব যত্নে পড়ে আছে একটা মোবাইল ফোন।বহু পুরোনো মোবাইল ফোন।
এই সেই মোবাইল..হ্যাঁ…..এই সেই মোবাইল যার জন্য ওর গোটা জীবনটা বিষিয়ে গেছে।নরক হয়ে উঠেছে।
সাবিবা নিরব দর্শক এর মত মেঘলার পাশে পাশে থাকছে।ওর চোখ দুটোও আজ বরণ মানছে না।কেদেই চলেছে।
অনেক হয়েছে মেঘলার এই অবস্থায় এইভাবে আর কতক্ষণ??একের পর এক যা ধকল যাচ্ছে তার উপর কাল রাত থেকে না খাওয়া।মেঘলার বাবা থানা থেকে বের হয়ে যে খাবার কিনে দিয়েছে তা ছুঁয়েও দেখেনি।
না এইবার ওকে গোসল করিয়ে কিছু খাওয়ানো লাগবে।
সাবিবা জোর করে মেঘলাকে ওয়াশরুমে পাঠালো।
এরই মধ্যে মুবিন হাসান দুটো শাড়ি নিয়ে আসলেন।
সাবিবা কিছু বলার আগেই তিনি বললেন,মেঘলার যা অবস্থা তাতে পুরনো কাপড়গুলো এখন পড়তে পারবে না আর তুমিই বা কি পড়বে তাই দুটো শাড়ি নিয়ে আসলাম তোমার আন্টির।আরও যা যা লাগবে দেখো সব ঠিকঠাক হয় কিনা?
সাবিবা কৃতজ্ঞতায় হাসলো,জি স্যার দেখছি।
মুবিন হাসান বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন,কিছু লাগলে বল।তোমার আণ্টি মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েছে ঠিকই কিন্তু কারো অযত্ন হতে দিবে না।
জি স্যার লাগলে বলবো।
মুবিন হাসান চলে গেলেন।উনার এখন অনেক কাজ।সবার আগে মেঘলার মাকে সবটা বুঝিয়ে বলতে হবে।
সাবিবার চোখ দুটো ভিজে উঠলো।মা বাবা তো এমনই হয়।সন্তানের ভালো মন্দ সবদিক নিয়েই ভাবেন।তাহলে সীমান্ত কেনো নিজের সন্তানের কথা ভাবতে পারলো না??ওই কেমন বাবা আর স্যার ই বা কেমন??দুই বাবার মধ্যে এত তফাৎ??কেনো??
চলবে………
গঠনমূলক মন্তব্য করে পাশে থাকবেন ধন্যবাদ 😇
সকল পর্বের লিংক
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=169467331959466&id=140699218169611