মেঘলা আকাশে রুদ্রই ভরসা
উম্মে হাবিবা তনু
পার্ট:৪৫
ফজরের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে মুবিন হাসান রুদ্রকে নিয়ে হাঁটছেন।
রোজ সকালেই তিনি হাটাহাটি করেন।রিটায়ার্ড এর পর থেকে ফজরের নামাজ পড়ে সকালে হাঁটতে বের হওয়া কখনো মিস হয় না উনার।আর আজ তো উনার সঙ্গ দিতে সাথে আছে উনার অতি পছন্দের একজন।
মুবিন হাসান খুব গর্ব বোধ করেন রুদ্রকে নিয়ে।জীবনে অনেক কষ্ট করে আজ এইখানে পৌঁছেছে।বর্তমানে কানাডা তে একটা ইউনিভার্সিটিতে ম্যাথ এর লেকচারর রুদ্র।
ক্ষানিকক্ষণ হেঁটে এখন দুইজন একটা মাঠে নরম ঘাসের ওপর বসলেন।
মাটির সুদা গন্ধ নাকে এসে ডেকছে।কি যে ভালো লাগছে।
রুদ্রর পরম আবেশে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।সবে একটু একটু ভোরের আলো ফুটতে শুরু হয়েছে।কমলা আভায় ধীরে ধীরে ভূলোক ছেয়ে যাচ্ছে।মিষ্টি মৃদু মন্দ বাতাস বইছে।পাখির কিচিরমিচির কলরব শুনা যাচ্ছে।
কতদিন কত বছর নিজের দেশে বসে এত সুন্দর একটা সকাল দেখতে পেলো।
ওই দেশেও ভোরে উঠতো কই কখনো তো এত ভালো লাগতো না।তবে কি এইটাই দেশের প্রতি টান??দেশপ্রেম!
গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে তবু মহিলা দলের কেউ এখনো নিচে নামে নি।
মুবিন হাসান ও রুদ্র অধীর হয়ে দাড়িয়ে আছে।
দেখলে রুদ্র আমরা হাটাহাটি করে ফিরে নাস্তা করে রেডী হয়ে গেছি আর ওরা এখনো পারলো না রেডী হতে।
আঙ্কেল এইভাবে বলবেন না।কত কাজ করছে…আমাদের নাস্তা করিয়ে সেগুলো গুছিয়ে পরেই তো রেডী হবে।
তাই বলে এতক্ষণ লাগবে!!মহিলা মানুষের কোনো সময় জ্ঞান নেই বুঝলে….
আস্তে বলুন আঙ্কেল…
ভাগ্যিস বিয়ে করোনি না হয় বুঝতে সময়ের অপচয় কিভাবে চোখে দেখে সহ্য করা লাগে….
জি জি বুঝেছি…
তোমার আণ্টি এমন একটা মহিলা যার জীবনে সময়ের কোনো মূল্য নেই…
আঙ্কেল আস্তে বলুন আণ্টি শুনতে পাবে….
কি আণ্টি শুনবে….আমি ভয় নাকি….
আণ্টি….
কি আণ্টি আণ্টি করছো…..
ভয় পাওনা তাতো পরে বুঝবো….আগে বলো ছেলেটার মাথায় ভুলবাল কথা ডুকাচ্ছ কেনো???
মুবিন হাসান এতক্ষণে বুঝলেন রুদ্র এতক্ষণ কি ইঙ্গিত দিচ্ছিল।আজ উনার খবর আছে।
আরে না মানে মমতা…..
এখন কোনো ধানাই পানাই করে লাভ নাই।
না বলছিলাম কখন নিচে এলে??
যখন তুমি আমার সময় জ্ঞান নিয়ে নিন্দে মন্দ গাইছিলে….
এই যা সব শুনে নিয়েছে….
কি বিড়বিড় করছ??দিন দিন বয়স বাড়ছে আর ভীমরতি বাড়ছে।
মুবিন হাসান রুদ্রর দিকে করুন চোখে তাকিয়ে বললো,আগে বলবে তো..
আমি তো বলছিলামই…আপনি তো খেয়ালই করেননি।
একেই বলে সকাল সকাল বিপাকে পড়া।
মমতা হাসান স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছেন।এইসব এখন প্রায়ই তিনি শুনেন।আগে মানুষটা এমন ছিল না।এখন অনেক বদলে গেছে।উনার এই বদলটা মমতা হাসান এর খুব ভালো লাগে।কাঠখোট্টা বর এর চেয়ে বউ ক্ষেপানো বর অনেক ভালো।
মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে মমতা হাসান বলে উঠলেন,আমি সেধে সেধে দেরি করছি না।তোমার নাতনি গো ধরেছে শাড়ি পড়বে।বিলেতে বড় হওয়া মেয়ে শাড়ি সামলাতে পারে??সাবিবা পড়াচ্ছে দেখলাম…দেখো আরও কতক্ষণ লাগে….
শুরু হল….নাতনি কি আমার একার নাকি??
মমতা হাসান মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলেন।এই লোকের সাথে বেহুদা কথা বলতে থাকলে সারাদিনই চলতে থাকবে।
রুদ্র দাড়িয়ে দাড়িয়ে উনাদের দেখছে।মেয়েটার জিদ মায়েরই মত হয়েছে।বলেছে যখন তখন পড়বেই শাড়ি।তবে ওর খুব হাসি পাচ্ছে।ঠোঁট কামড়ে হাসছে উনাদের কান্ড দেখে।আঙ্কেল আণ্টি স্বাভাবিক হতে পেরেছে এই অনেক।মেঘলার অকাল মৃত্যু সবাইকে ভিতর থেকে ভেঙ্গে দিয়েছিল।মানুষগুলো কি মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছিল।তবে কি শুধু ওই ই পারেনি মানসিক অশান্তি থেকে বের হতে??ওর ভাবনায় ছেদ পড়ল মুবিন হাসান আওয়াজ পেয়ে।উনার একটা শব্দে ওর পৃথিবীটাই থমকে গেল।
মেঘলা…মমতা দেখো মেঘলা…..
মমতা হাসান ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মত ঘুরে দাড়াতেই আবার স্মিতি হারিয়ে ফেললেন।
এ কাকে দেখছেন??স্বয়ং মেঘলা বাসন্তী শাড়ি পরে হাসি হাসি মুখ করে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে।এক্ষুনি তাড়া দিয়ে বলবে,
মা আমার কিন্তু আসতে দেরি হবে।স্কুলে বসন্ত বরণ অনুষ্ঠান আছে।আমাকে রুদ্র দিয়ে যাবে বাসায়।সো নো টেনসন…..
অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলেন শুধু,মেঘলা তুই কিন্তু আজ কোথাও যাবি না…আমার বুকে তোকে আগলে রাখবো…
বাসন্তী রঙ্গা জামদানি শাড়ির জমিনে গোল্ডেন স্টেপের মাঝারি আকারের পাড়।সাথে পড়েছে কাতানের গোল্ডেন ব্লাউজ।গলায় ছোট একটা প্যান্ডেল আর কানে টপ।একহাতে ভর্তি মুঠো চুড়ি আর ডান হাতে ঘড়ি।চোখে হালকা করে কাজলের রেখা টেনেছে।ঠোটে নুডে লিপস্টিক।ব্যাস এইটুকুই মাহার সাজ।তবে ওকে যেনো এতেই অপূর্ব লাগছে।অবিকল ওর মায়েরই মত।শাড়িটাও ওর মায়ের।কোনো এক বসন্ত উৎসবে পড়েছিল মেঘলা।
রুদ্রর পৃথিবীটা যেনো থমকে গেল।এক্ষুনি মেঘলা মুখ ভার করে বলবে,তুই আমাকে আনতে গেলি না কেন??জানিস মা আমাকে কত জবাবদিহি করেছে!!সময়টা যেনো এইখানেই যেনো থেমে যায়।রুদ্র খুব করে চায় একবার শুধু একবার মেঘলাকে ফিরে পেতে।শুধু বলতে চায়,আমি মেঘলার আকাশে ভরসার রোদ হতে চেয়েছিলাম আর কিছুই চাইনি।
মাহা সবার মুখগুলো ভালো দেখে মামনির দিকে ফিরে বললো,মামনি তোমার ভবিষ্যৎ বাণী তো ফলে গেলো…..সবাই কেমন হা করে তাকিয়ে আছে।
সাবিবা স্মিত হেসে বলল,আমি তোকে রেডী করে দিয়ে নিজেই অবাক হয়ে গেছি আর ওরা তো হঠাৎই দেখলো তোকে….
মামনি তবে কি আমাকে খুব সুন্দর লাগছে??
মাহাকে দুহাতে আকড়ে ধরল।মাথায় ভালোবাসার পরশ এঁকে দিলো।
খুব সুন্দর কিনা জানি না তবে মনে হচ্ছে আমার ছোট্ট মেঘলা বোনটা আবার কাছে ফিরে এলো….ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে।
মাহা অবাক চোখে সবাইকে দেখছে।এই মানুষগুলো ওর মাম্মাকে এত ভালোবাসে??তাহলে আশেপাশের মানুষগুলো কেনো ওর মাম্মাকে নিয়ে বাজে কথা বললো!!আমার মাম্মাকে কি এমন লুকিয়ে আছে যার জন্য আমার পাপা এত কষ্ট পায়??ডাইরি বুকে চেপে কেনো কাদে??কি আছে ওতে??
হর্নের শব্দে সবার হুশ হলো বের হতে হবে।আর সামনে দাঁড়ানো মেঘলা রুপী মাহা স্বয়ং অপ্সরা হলেও হতে পারত কিন্তু কখনোই মেঘলা নয়।যে না ফেরার দেশে একবার চলে যায় সে কখনোই ফিরে আসতে পারে না।
সবাই গাড়িতে উঠে বসলো।
গাড়ি তার আপন গতিতে যাত্রা শুরু করলো সাভার স্মৃতসৌধের উদ্দেশ্যে।কারো মুখে কোন কথা নেই।হঠাৎই গুমোট ভাবটা বেড়ে গেল।সবার মুখগুলো থমথম করছে।মাহা বুঝতে পারছে ওর মায়ের জন্যই সবার মন কেমন করছে।ওরও তো মাম্মা এর কথা মনে পড়ে।তাই বলে কি মন খারাপ করে থাকবে??সবার সাথে টুকটাক কথা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু না হু হা করছে শুধু।প্রথম বাংলাদেশে এলো।ওকে একটু এন্টারটেইন করবে তা না…….
নানাভাই এইসব কি ঠিক??
কোনটা আপু..
তোমরা আমাকে একটুও সময় দিচ্ছ না…
আমরাতো তোমার সাথেই…
সাথে তো বুঝলাম জায়গা গুলো চিনিয়ে দিবা কোনটা কি…..গাড়ি থেকে কত কিছু দেখতে পাচ্ছি কিন্তু আমি তো কিছুই চিনি না!!
ওহ এই ব্যাপার…..আমি চিনিয়ে দিচ্ছি।
আস্তে আস্তে গুমোট ভাবটা কেটে যাচ্ছে মুবিন হাসান,মমতা হাসান,সাবিবা সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লো মাহাকে নিয়ে।
কিন্তু রুদ্র????
ওর মনে যে মেঘলা গভীর দাগ কেটে গেছে।একবার ভাবনা মাথায় এলে সেখান থেকে যে বের হতে আর পারে না।বাংলাদেশে পা দেওয়ার পর থেকেই না চাইতেও ঘিরে ধরছে মেঘলা নামক অস্তিত্ব।
চলবে………
গঠনমূলক মন্তব্য করে পাশে থাকবেন ধন্যবাদ 😇
সকল পর্বের লিংক
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=169467331959466&id=140699218169611