আরশিযুগল প্রেম # লেখনীতে — নৌশিন আহমেদ রোদেলা #পর্ব – ৪৫

0
1221

# আরশিযুগল প্রেম
# লেখনীতে — নৌশিন আহমেদ রোদেলা
#পর্ব – ৪৫

প্রায় মাঝরাত। অন্ধকার আকাশে একফালি চাঁদ দেখা যাচ্ছে। ভার্সিটি চত্বরের বিশাল মাঠটা যেন সীমান্তহীন বিশাল প্রান্তর। চারদিকে ধু ধু অন্ধকার। সেই অন্ধকারকে ফুঁড়ে দিয়ে জ্বলজ্বল করে উঠছে সিগারেটের ছোট্ট আগুন। নিজের ডানহাতের কব্জির ওপর একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে শুভ্রব। সিলভার রঙের ঘড়িটা গাঢ় অন্ধকারেও চকচক করছে। শুভ্রব দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘড়িটা খুলে বুক পকেটে রাখল। প্রায় একবছর আগে, আজকের এই দিনটাতেই প্রেয়সীর কাছ থেকে উপহার হিসেবে পেয়েছিল এই ঘড়ি। কি ভীষণ ভালোবেসে ঘড়িটা পরিয়ে দিয়েছিল তনয়া। শুভ্রব বুকে হাত বুলায়। সাথে সাথেই ঘড়িতে মিশে থাকা তনয়ার স্পর্শগুলো যেন শূন্য বুকটাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। তৃষ্ণার্ত মনটা তনয়াকে একনজর দেখার জন্য হাসফাস করে উঠে। শুভ্রব ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে, শিশির ভেজা লম্বা ঘাসগুলোর উপর গা এলিয়ে দেয়। ফোনটা হাতে নিয়ে উদ্দেশ্যহীন ঘাটাঘাটি করে। তনয়াময় গ্যালারীটা শূন্য পড়ে থাকতে দেখেই মনে পড়ে, অনেকদিন আগেই ফোন মেমোরি থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে তার স্মৃতি। কিন্তু কেন জানি, এই ঘড়িটাকে মুছে ফেলতে পারছে না। প্রতিদিন ঘর থেকে বেরুনোর আগে এই ঘড়িটা হাতে জড়ানোর বাজে অভ্যাসটা পাল্টাতে পারছে না। ফোন মেমোরির মত মস্তিষ্ক থেকে তনয়া নামক অসুখটা মুছে ফেলা যাচ্ছে না। শুভ্রবের বেদনাময় দীর্ঘশ্বাসের মাঝেই মুঠো ফোনটা বাজল। শুভ্রব কিছুক্ষণ বিরক্ত চোখে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকেই ফোন তুলল,

—-” হুম, বল।”

—-” বাসায় ফিরবি না ভাইয়া? বাবা-মা চিন্তা করছে।”

শুভ্রব ধমকে উঠে বলল,

—-” আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে বলেছি তোদের? আমাকে নিয়ে ফেদা চিন্তা না করে নিজেরটা ভাব।”

শুভ্রতা উত্তর দিল না। বুক চিড়ে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে চুপ করে রইল। ভাইয়ের সাথে অযথা ঝগড়া করার মত মানসিক পরিস্থিতি আজ তার নেই। শুভ্রতাকে চুপ থাকতে দেখে বুকের ভেতর চিনচিন ব্যাথা করে উঠল শুভ্রবের। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

—-” ছেলেটা কে?”

শুভ্রতা পাল্টা প্রশ্ন করল,

—-” কোন ছেলে?”

শুভ্রব তীব্র মেজাজ দেখিয়ে বলল,

—-” ঠাডিয়ে মারব এক চড়। জানিস না কোন ছেলের কথা বলছি? তোর বয়ফ্রেন্ডের নাম কি? কি করে? তোর মত গরুকে কোন ছাগল পছন্দ করলো জানা থাকা প্রয়োজন আমার। নাম বল।”

শুভ্রতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে অস্বস্তি নিয়ে উত্তর দিল,

—-” আরাফ ভাইয়ার বন্ধু।”

শুভ্রব কপাল কুঁচকাল। বিরক্তি নিয়ে বলল,

—-” ‘আরাফ ভাইয়ার বন্ধু’ এটা কারো সঠিক পরিচয় হতে পারে না। এই জীবনে আরাফ ভাইয়ের অসংখ্য বন্ধু আছে। তাদের সব-কয়টাই কি তোর বয়ফ্রেন্ড নাকি?”

শুভ্রতা ফুঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। চোখ-মুখ খিঁচে বন্ধ করে একদমে বলে ফেলল,

—-” ওর নাম রাফাত আল সাদাফ।”

শুভ্রতার বলা বাক্যটা কান পর্যন্ত পৌঁছাতেই থমকে গেল শুভ্রব। বিস্ময় নিয়ে বলল,

—-” সাদাফ? কোন সাদাফ? সাদাফ ভাই?”

—-” হু।”

শুভ্রবের বিস্ময় যেন আরো একদফা বৃদ্ধি পেল। অবিশ্বাসের সুরে বলল,

—-” সাদাফ ভাই তোর বয়ফ্রেন্ড? আমাদের ভার্সিটির বড় ভাই সাদাফ?”

শুভ্রতা শুকনো ঠোঁটগুলো জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে বলল,

—-” হু।”

শুভ্রব হঠাৎ করেই কোনো কথা খুঁজে পেল না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজেকে শান্ত করে নিয়ে বলল,

—-” সাদাফ ভাইও তোকে পছন্দ করে? নাকি একপাক্ষিক ভালোবাসা টাইপ কিছু?”

শুভ্রতা মৃদু গলায় বলল,

—-” একপাক্ষিক হলে কি বয়ফ্রেন্ড হয়?”

—-” ভাই তোর বিয়ের কথা জানে? ফ্যামিলি যে প্রবলেম ক্রিয়েট করছে, জানে?”

—-” হ্যাঁ। জানে।”

—-” কি বললেন?”

—-” বলল, কান্নাকাটি না করে ঘুমিয়ে পড়ো।”

—-” এটুকুই?”

—-” হু।”

শুভ্রব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। সাদাফ আর শুভ্রতার বিষয়টা এখনও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না সে। তার এই ‘ইমোশনাল ফুল’ বোনটা শেষমেশ সাদাফকে কাবু করে ফেলল? কবে বা কিভাবে শুরু হল তাদের গল্প? বড় হয়ে ছোট বোনের প্রেমবিষয়ক প্রশ্নে খুব একটা কৌতূহল দেখানো যায় না বলে প্রশ্নগুলো এড়িয়ে গেল শুভ্রব। সাদাফ বিষয়ে কথা না বাড়িয়ে নরম গলায় বলল,

—-” ফোন রেখে ঘুমোতে যা। আমি আজ ফিরব না।”

কথাটা বলেই ফোন কাটল শুভ্রব। মাথার নিচে হাত রেখে ঘাসের ওপর লম্বালম্বি হয়ে শুয়ে পড়ল। আবেগাপ্লুত চোখে তাকিয়ে রইল তমসাচ্ছন্ন আকাশের দিকে। অন্ধকার আকাশটিতে কখনও ভেসে উঠতে লাগল হারিয়ে ফেলা প্রিয়তমার মুখ। তো কখনও অশ্রুভেজা ছোটবোনের অবনমিত চোখ।

_________________

সূর্যের তেজ বাড়তেই ঘুম ছুটে গেল শুভ্রতার। সারারাত নিদারুণ দুশ্চিন্তায় খুব একটা ঘুম হয় নি শুভ্রতার। চোখ দুটো লেগে আসতেই অদ্ভুত সব স্বপ্নে চমকে চমকে উঠেছে সে। প্রতিবার ঘুম ভাঙতেই মনেপ্রাণে আল্লাহকে ডেকেছে। নানাভাবে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছে। কিন্তু, বাবা-মা স্বয়ং যেখানে প্রতিপক্ষ সেখানে কি এসব ঠুনকো সান্ত্বনা চলে? শুভ্রতা বিছানা ছেড়ে ফোনটা হাতে নিতেই অর্পনের ম্যাসেজ চোখে পড়ল, ‘ভার্সিটি চলে আয়, জলদি।’ শুভ্রতা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। ফ্রেশ হওয়ার পরও রুম থেকে বের হওয়ার সাহস যোগাতে পারল না। চরম অস্বস্তিতে চোখে-মুখে তিক্ততার ছায়া নেমে এল। কাল রাতের এতোবড় ঘটনার পর বাসার পরিস্থিতি কেমন হবে ভাবতেই গা শিউরে উঠছে শুভ্রতার। অতগুলো রক্তচক্ষুর সামনে বসে খাবার গিলতে হবে ভাবতেই চোখ-মুখ শুকিয়ে এল। শুভ্রতার দুশ্চিন্তা প্রশমিত করতেই হয়ত হঠাৎই ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে সাদাফের নাম্বারটা দেখতেই ঝটপট ফোন তুলে নিল শুভ্রতা,

—-” হ্যালো!”

—-” হুম বলো।”

সাদাফ স্বাভাবিক কন্ঠে প্রশ্ন করল,

—-” কি করছ?”

শুভ্রতা ছোট্ট করে শ্বাস টেনে নিয়ে বলল,

—-” কিছু করছি না। তুমি?”

—-” আমি অনেক কিছু করছি। টেবিলে এতো এতো আনসল্ভড ফাইল আর মোবাইলে আমার শুভ্রাণী।”

শুভ্রতা মৃদু হাসল। শুভ্রতার শব্দহীন হাসিটা সাদাফ পর্যন্ত পৌঁছাল না। কিছুক্ষণ উভয়েই চুপ থাকার পর প্রশ্ন করল সাদাফ,

—-” খেয়েছ?”

—-” না মানে হ্যাঁ।”

সাদাফ শান্ত স্বরে বলল,

—-” শুধু শুধু মিথ্যা বলবে না। আমি জানি তুমি খাও নি। রাতে ঘুমাও নি নিশ্চয়?”

শুভ্রতা উত্তর দিল না। সাদাফ শীতল গলায় বলল,

—-” আরো তিনটা দিন বাকি আছে শুভ্রা। কেন এত চিন্তা করছ? আর যায় কিছু করো না কেন, নিজের অযত্নটা করো না প্লিজ। আমি তো আছি। আমাকে তোমার করে দেওয়ার জন্য কারো অনুমতির প্রয়োজন নেই শুভ্রা। প্রয়োজনে বিনা অনুমতিতেই ঘর বাঁধব আমরা। তবে, কারো জন্যই তোমাকে বিসর্জন দিতে পারব না। একটু ভরসা রাখো….”

শুভ্রতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

—-” আমার বাবা-মা এবং তুমি দুটোকেই চাই।”

—-” আর আমি তোমার খুশিটা চাই। এবার চুপচাপ খাওয়া-দাওয়া সারো। আমার বউয়ের হালকা অযত্নের কথা কানে এলেও খবর আছে তোমার। আমারটা আমার আনায় আনায় দশ আনায় চাই। এতটুকুও ছাড় চলবে না। সো, বি কেয়ারফুল।”

শুভ্রতা হাসল। সাদাফের সাথে টুকটাক দু’একটা কথা বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। শাহিনুজ্জামানসহ বাকি সদস্যরা মাত্রই খেতে বসেছিল। শুভ্রতাকে দেখে প্রত্যেকেই মুখ তুলে তাকাল। শুভ্রতার ওপর কড়া দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে আবারও খাবারে মন দিল। বাসার এমন থমথমে আবহাওয়ায় শুভ্রতার অস্বস্তিটা যেন দ্বিগুণ হল। শুভ্রতাকে দেখে কেউ তেমন প্রতিক্রিয়া না দেখালেও শফিক মৃদু হাসল। আদুরে গলায় বলল,

—-” দাঁড়িয়ে আছিস কেন শুভি? বসে পড়।”

‘খাবো না’ কথাটা বলতে গিয়েও বলতে পারল না শুভ্রতা। অস্বস্তি নিয়ে চেয়ার টেনে বসল। রাদিবা নিঃশব্দে খাবার দিলেন। শুভ্রতার হঠাৎই মনে হল, অনেকদিনের পরিচিত এই পরিবারটা হঠাৎ ভীষণ তিক্ত আর অচেনা লাগছে তার। এক একটা দম ফেলতেও হাজারও ভয় আর অস্বস্তিকে পাল্লা দিতে হচ্ছে তাকে। খাওয়ার মাঝ পথে হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করলেন শহিদুজ্জামান সাহেব। শুভ্রতাকে উদ্দেশ্য করে শীতল গলায় বললেন,

—-” শুভি?”

শুভ্রতা হকচকিয়ে গেল। প্লেট থেকে মুখ উঠিয়ে বড় চাচার দিকে একবার দৃষ্টি দিয়েই চোখ নামাল। মৃদু গলায় বলল,

—-” জ্বি।”

শহিদুজ্জামান সাহেব কোনো ভূমিকা না করেই বললেন,

—-” তুমি যথেষ্টই বড় হয়েছ শুভি মা। নিজের ভালোটা বুঝতে শিখেছ। তারমানে এই নয় যে বাবা-মার থেকে বেশি বুঝো। সন্তানের জন্য বাবা-মার থেকে ভালো সিদ্ধান্ত আর কেউ নিতে পারে না। এতো বছর ধরে আদর ভালোবাসা দিয়ে লালন-পালন করার পর সন্তানের থেকে অনুগত্য আশা করাটা কিন্তু ভুল নয়। প্রেম-ভালোবাসা বিষয়টা আপেক্ষিক। আমিও বিয়ের আগে অন্য কাউকে ভালোবাসতাম তাই বলে কি আমি সুখী নই? সময়ের সাথে সাথে সবই পাল্টে যায় শুভি। কারো জন্য কারো জীবন থেমে থাকে না। তোমার দাদু ফারদিনের বাবাকে ওয়াদা না দিয়ে গেলে তোমার পছন্দকে মেনে নিতে কোনোরকম আপত্তি আমাদের ছিল না। কিন্তু মৃত বাবার ওয়াদা ভঙ্গ করার ক্ষমতা বা সাহস কোনটাই আমাদের নেই। পরিস্থিতির মুখে ফারদিনের সাথে তোমার বিয়ে দেওয়াটা আমাদের কর্তব্য আর তোমার বাবা-মার মুখের দিকে তাকিয়ে সেই সিদ্ধান্তটা মেনে নেওয়া তোমারও কর্তব্য।”

শুভ্রতা প্লেটের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে রইল। গলায় আটকে থাকা খাবারগুলো কোনরকম গিলে নিয়ে মৃদু গলায় বলল,

—-” আমার মুখের দিকে তাকিয়ে, আমার সুখের কথা চিন্তা করাটা কি বাবা-মার কর্তব্য নয় বড় চাচা?”

শহিদুজ্জামান সাহেব ভ্রু কুঁচকে বললেন,

—-” তোমার সুখের কথা ভাবছি না এমনটা তোমায় কে বলল?ফারদিনের সাথে বিয়ে হওয়াতে তুমি কোনো দিক থেকে অসুখী হবে বলে তো মনে হচ্ছে না।”

শুভ্রতা জবাব দিল না। এই কঠিন যুক্তিবাদী মানুষগুলো কোনো কিছুর বিনিময়েই তাকে বুঝবে না। শুভ্রতা চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল। শহিদুজ্জামান সাহেবের স্ত্রী তাড়াহুড়ো করে বললেন,

—-” উঠছ যে? খাবে না?”

—-” আমার খাওয়া শেষ চাচী।”

শহিদুজ্জামান শক্ত গলায় বললেন,

—-” কিন্তু আমার কথা শেষ হয় নি, শুভি মা।”

শুভ্রতা হঠাৎই উগ্র গলায় বলে উঠল,

—-” আপনাদের এই কথা কোনো দিনই শেষ হবে না বড় চাচা। এটলিস্ট আমাকে কুরবানির মাঠে নামানোর আগ পর্যন্ত তো নয়ই। তার থেকে বরং আমি ভার্সিটি ক্লাসগুলো শেষ করে আসি। এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশের চেয়ে আপাতত ক্লাসগুলোই আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”

শুভ্রতা কথাগুলো শেষ করার আগেই ক্ষিপ্র গতিতে চড় বসালেন রাদিবা। শুভ্রতা গালে হাত দিয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। বিস্মিত চোখদুটোতে ধীরে ধীরে জমে এলো জল। শহিদুজ্জামান সাহেব হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। শুভ্রতার এমন উত্তরের পাশাপাশি রাদিবার এমন ব্যবহারও আশা করেন নি তিনি।

—-” কি? এভাবে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে আছিস কেন? চোখ নামা , নামা বলছি! ছোট থেকে যা বলেছিস সব সব মেনেছি। একটা প্রশ্ন পর্যন্ত করি নি। অথচ, আজ আমাদের একটা সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছিস না? কোন ছাইপাস ছেলের সাথে জড়িয়ে বড়দের সাথে যা-তা ব্যবহার করছিস। কি প্রমাণ করতে চাইছিস তুই? বল, কি প্রমাণ করতে চাইছিস? দুনিয়াকে দেখাতে চাইছিস যে আমি তোদের ভালো শিক্ষা দিই নি?”

কথাটা বলে আবারও তেড়ে গিয়ে শুভ্রতার বাহুতে চড় বসালেন রাদিবা। শহিদুজ্জামান সাহেবের স্ত্রী আর শুভ্রতার মামি উঠে আসতে আসতে আরো দু-এক ঘা পড়ল শুভ্রতার গায়ে। লজ্জায়, অপমানে কাঁদতেও ভুলে গেল শুভ্রতা। সবকিছু কেমন ঝাপসা, মিথ্যে দুঃস্বপ্ন বলে বোধ হতে লাগল। রাদিবা তেতে উঠে বললেন,

—-” দেখো কি জেদ মেয়ের। এখনও কেমন বেহায়ার মত দাঁড়িয়ে আছে। এই ফাজিল মেয়ে, বড় চাচার কাছে ক্ষমা চা। ক্ষমা চা বলছি। নয়ত বটি দিয়ে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেব তোকে। যে মেয়ে মানুষকে বাবা-মার শিক্ষার ওপর আঙ্গুল তোলার সুযোগ করে দেয় সেই মেয়েকে আমার চাই না। ভার্সিটি যাবি না? যাওয়াচ্ছি তোকে ভার্সিটি।”

মায়ের অগ্নিরূপে শুভ্রতা যেন বাকশূন্য হয়ে পড়ল। ছোট-বড় সবার সামনে মায়ের এমন ব্যবহারে লজ্জায়,অপমানে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাও যেন লোপ পেতে লাগল। শহিদুজ্জামান সাহেব জোর গলায় বললেন,

—-” শুধু শুধু এতবড় মেয়ের গায়ে হাত তুলছেন কেন ভাবি? শুভি মা? যাও ভার্সিটি যাও। তুমি ফিরলেই নাহয় কথা বলব আমরা। যাও। ”

শুভ্রতা ব্যাগটা তুলে নিয়ে দৌঁড়ে বেরিয়ে গেল। বাসা থেকে বেরুতেই কান্নায় গলা ভেঙে এলো তার। উফ্ এতোটা কষ্ট, এতোটা অপমানও তার পাওনা ছিল?

____________________

ভার্সিটির ক্যাফিটেরিয়াতে টেবিলে মাথা রেখে বসে আছে শুভ্রতা। শরীরটা হালকা-মৃদু কাঁপছে। ওর পাশে বসে থাকা বান্ধবীদের মুখগুলোও রক্তশূণ্য।

—-” আর কাঁদিস না প্লিজ। এবার কিন্তু আমিও কেঁদে দেব শুভি। এতো কান্নাকাটির কি আছে? আমি তো আম্মুর হাতে দিনরাত থাপড়া খাই।”

শুভ্রতা উত্তর দিল না। ফোলে যাওয়া লাল চোখ দুটো তুলে তাকাল। পুষ্পি চিন্তিত গলায় বলল,

—-” সবকিছু শুনে যা বুঝলাম, আংকেল আন্টিকে এভাবে রাজি করানো সম্ভব হবে না। আংকেল এখন শুধু এবং শুধুই নিজের বাবার শেষ ইচ্ছের কথা ভাবছেন। পৃথিবী উল্টে গেলেও উনি তার মত পাল্টাবেন না।”

প্রেমা কপাল কুঁচকে বলল,

—-” তাহলে কিভাবে কি করব আমরা? আমার আর এসব ভালো লাগছে না। তনুর সাথে হওয়া ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি ঘটছে। শুভি? তুই বরং সাদাফ ভাইয়ের সাথে চলে যা। সাদাফ ভাই মানা করবে বলে মনে হয় না।”

শুভ্রতা দু’হাতে চোখ মুছল। বসে যাওয়া গলায় বলল,

—-” তা হয় না। ছোট থেকে আদর-ভালোবাসা দিয়ে বড় করা বাবা-মাকে মাঝপথে ছেড়ে দিতে পারি না। ওরা সহ্য করতে পারবে না। আর না আমি পারব। আমার দুই ভালোবাসায় চাই প্রেমা। দুটোই!”

প্রেমা কিছু বলতে গিয়েও বলল না। অর্পন তিক্ত মুখে বলল,

—-” এই ফারদিন টারদিন থাকে কই? এইটাকে কিডন্যাপ করলে কেমন হয়? ঢাকার কোনো গলি থেকে নকল পিস্তল জোগাড় করে ব্যাটার মাথায় ঠেকিয়ে বলব, ব্যাটা বিয়ে করবি তো মরবি। এক কবুলে তিন গুলি। বল রাজি?”

প্রেমা বিরক্ত হয়ে বলল,

—-” সবসময় ফাউল কথা ভালো লাগে না অর্পন। এমন একটা সিরিয়াস মোমেন্টে….”

প্রেমার কথার মাঝেই চেঁচিয়ে উঠল পুষ্পি। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,

—-” অর্পন কিন্তু না বুঝেও দারুন একটা বুদ্ধি দিয়ে দিয়েছে গাইস।”

অর্পন ভ্রু কুঁচকালো। অবাক হয়ে বলল,

—-” আমি? আমি কখন বুদ্ধি দিলাম?”

—–” ফারদিন সাহেব কলেজের শিক্ষক। একজন শিক্ষক হয়ে এমন জবরদস্তি টাইপ বিয়ে হয়ত উনি করবেন না। টিচার টাইপ মানুষগুলো অলওয়েজ ঝামেলাহীন থাকতে চায়। আর এখানে তো বিশদ ঝামেলা। আমরা যদি কোনোভাবে ফারদিন সাহেবকে বিয়ে ভাঙার জন্য রাজি করাতে পারি তাহলেই কেল্লা ফতে। ছেলেপক্ষ নিজ থেকে বিয়ে ভেঙে দিলে আংকেল নিশ্চয় কোনো ঝামেলা করবে না।”

পুষ্পির কথায় তিনজনের মুখই চকচক করে উঠল। অর্পন উচ্ছাস নিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেও পরক্ষণেই বলে উঠল,

—-” কিন্তু, এই ব্যাটাকে পাবটা কই?”

#চলবে….

[ দেরি হওয়ার জন্য দুঃখিত। তিনদিন একটানা গল্প দিতে না পারায় এবং পাঠকদের জানিয়ে দিতে না পারায় আমি লজ্জিত। আমি এডমিশনের প্রিপারেশন নিচ্ছি। বাসা থেকে ফোনটা প্রিফার করছে না। তাছাড়া, একটু চাপেও আছি। ব্যাপারটার জন্য আবারও দুঃখ প্রকাশ করছি। ভালোবাসা ❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here