আরশিযুগল প্রেম # লেখনীতে — নৌশিন আহমেদ রোদেলা # পর্ব – শেষ পর্ব

0
1103

# আরশিযুগল প্রেম
# লেখনীতে — নৌশিন আহমেদ রোদেলা
# পর্ব – শেষ পর্ব

ঘড়িতে দশটা বাজে। নামায শেষ করে জানালার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সাদাফ। নিচের অলি-গলির রাস্তাটিতে ব্যস্ত মানুষের পদচারণ। রিক্সা,ভ্যান, প্রাইভেট কার সব মিলিয়ে হুলস্থুল কান্ড। সাদাফ ঘাড় ঘুরিয়ে আবারও ঘড়ির দিকে তাকাল। অর্পণদের ফিরে আসার সময় হয়ে এসেছে। নিশ্চয় রাজ্যের খাবার-দাবার নিয়ে হাজির হবে মেয়েগুলো। শুভ্রতার শরীরের ঠিক নেই। বাইরের ফাস্টফুড তার শরীরে রুচবে না। কিন্তু সাদাফের কথা সে শুনলে তো? সাদাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালা থেকে সরে দাঁড়াতেই তীব্র শব্দে চমকে উঠল। পুরু ভ্রুজোড়া কুঁচকে এলো। কপালে ভাঁজ ফেলে জানালার বাইরে উঁকি দিল। তাদের বিল্ডিং থেকে কিছুটা দূরে আগুনের গোলা চোখে পড়ছে। সাদাফের বিচক্ষণ মস্তিষ্ক মুহূর্তেই সজাগ হয়ে উঠল। শুভ্রতা ওয়াশরুমে মনে পড়তেই দৌঁড়ে গিয়ে ওয়াশরুমের দরজায় করাঘাত করল। ব্যস্ত গলায় বলল,

‘ শুভ্রা? জলদি বের হও। শুভ্রা?’

দরজার ওপাশ থেকে উত্তর এলো,

‘ কি হয়েছে? একটু আগে কিসের শব্দ হলো?’

সাদাফ তাড়া দিয়ে বলল,

‘ পাশের বিল্ডিং-এ আগুন লেগেছে। সময় নেই শুভ্রা। নিচে নামতে হবে। বের হও জলদি।’

কথাটা শোনার কয়েক সেকেন্ডের মাঝে দরজা খুললো শুভ্রতা। কপাল কুঁচকে বলল,

‘ পাশের বিল্ডিং- এ আগুন লেগেছে তো আমরা নামব কেন?’

সাদাফ শুভ্রতার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে দরজার দিকে দৌঁড় লাগাল। শান্ত গলায় বলল,

‘ পাগলের মতো কথা বলো না শুভ্রা। এই বিল্ডিং-এ আগুন ছড়াতে খুব বেশি সময় লাগবে না।’

শুভ্রতার মুখ আতঙ্কে সাদা হয়ে গেল। ভারী শরীর নিয়ে সিঁড়ির কয়েক ধাপ অতিক্রম করেই ক্লান্ত হয়ে পড়ল সে। সিঁড়ি ঘরের কাঁচের ছোট্ট জানালাটা দিয়ে আগুনের লেলিহান শিখা দেখা যাচ্ছে। জোরে জোরে শ্বাস টেনে সাদাফের হাত আকঁড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল শুভ্রতা। সাদাফের হাতটা নিজের কব্জির ওপর থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই ফিরে তাকাল সাদাফ। ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘ কি হলো? দাঁড়িয়ে পড়লে কেন? জলদি চল।’

শুভ্রতা সিঁড়ির ওপর বসে পড়ল। পেটে প্রচন্ড ব্যথা হচ্ছে। এটাকেই প্রসব ব্যথা বলে কিনা বুঝতে পারছে না শুভ্রতা। শুভ্রতা দেয়াল ঠেস দিয়ে করুণ গলায় বলল,

‘ তুমি চলে যাও, প্লিজ। আমি নিচে নামতে পারব না।’

সাদাফ শুভ্রতার পাশে হাঁটু ভেঙে বসল। শান্ত সাদাফের চোখে- মুখে উদ্বেগ খেলা করছে। সাদাফ নিজেও জানে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো সাদাফের পক্ষে বেঁচে যাওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়। চারতলার সিঁড়ি ভাঙতে তিন থেকে চার মিনিটের বেশি লাগারও কথা নয়। কিন্তু শুভ্রতার জন্য প্রয়োজন পনেরো মিনিটেরও বেশি। এতোটা সময় কি আদৌ তাদের হাতে আছে? সাদাফের বিচক্ষণ মস্তিষ্ক উত্তর দিল, নেই। সাদাফ তড়িৎ গতিতে শুভ্রতাকে কোলে তুলে নিল। শুভ্রতার পেটে হাঁড় ভাঙার থেকেও তীক্ষ্ণ ব্যথা। আর্ত-চিৎকারগুলো গলার কাছে এসে আটকে যাচ্ছে। শুভ্রতা ক্লান্ত গলায় বলল,

‘ আমাকে নিয়ে পারবে না তুমি। আমার কথাটা শুনো একটু।’

সাদাফ শুনল না। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে কোলে তুলে একের পর এক সিঁড়ি ভাঙতে লাগল। শুভ্রতার ওজন নেহাৎই কম নয়। প্রেগনেন্সির জন্য শরীরের ভার তার তিনগুণে এসে ঠেকেছে। সাদাফের মতো শক্তিশালী পুরুষের জন্য তাকে কোলে তোলাটা খুব একটা কঠিন নয়। কিন্তু বাধ সাধছে ধোঁয়া। চারপাশটা ততক্ষণে বিষাক্ত ধোঁয়ায় পরিপূর্ণ। দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনে ধোঁয়া হওয়ার কথা নয়। এই ধোঁয়ার উৎসটা কোথায় হতে পারে বুঝতে পারছে না সাদাফ। চারতলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত পৌঁছাতেই বাজেভাবে কাশতে লাগল শুভ্রতা। পেটে তীব্র ব্যথা আর নাকে মুখে ধোঁয়া ঢোকায় রীতিমতো কাহিল হয়ে পড়েছে সে। শুভ্রতার মৃদু আর্তনাদ আর গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া জল দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল সাদাফ। চোখদুটো জ্বলছে তার। ভারী শুভ্রতাকে নিয়ে নিচে নামার জন্য তার দমের প্রয়োজন। কিন্তু নিঃশ্বাসটাই নেওয়া যাচ্ছে না। শ্বাস টানার সাথে সাথেই বিষাক্ত ধোঁয়ায় বুক ভরে যাচ্ছে। সাদাফ শুভ্রতাকে সিঁড়ির এক কোণায় বসাল। পকেট থেকে রুমাল বের করে শুভ্রতার নাক-মুখে বেঁধে দিল। শুভ্রতা সাদাফের হাতটা চেপে ধরে কাতর গলায় বলল,

‘ আমার শেষ চাওয়াটা রাখো। চলে যাও প্লিজ। আমাকে কোলে নিয়ে কতক্ষণ পারবে তুমি, বলো? এখনও সময় আছে চলে যাও। আমার জন্য বসে থেকো না। পায়ে ধরছি। কেন শুনছো না আমার কথা? দয়া করো একটু।’

চোখে ধোঁয়া লাগায় চোখদুটো লাল টকটক করছে সাদাফের। জ্বালাপোড়া করা চোখে চারপাশটা স্পষ্ট দেখাও সম্ভব হচ্ছে না। একটু খাঁটি অক্সিজেনের জন্য ভেতরটা হাসফাস করছে। সাদাফ শুভ্রতার কপালে চুমু দিয়ে আবারও কোলে তুলে নিল। শুভ্রতা একদৃষ্টিতে সাদাফের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ক্লান্তিতে লাল হয়ে গিয়েছে তার ফর্সা মুখ। সিঁড়ির ধাপ ভাঙতে ভাঙতেই জবাব দিল সাদাফ। কন্ঠে তার গভীর মায়া,

‘ আমি যে তোমাকে কতটা ভালোবাসি তা হয়ত কখনও বলা হয় নি শুভ্রা। জেনে রেখো, তোমার প্রতি আমার ভালোবাসাটা খুব বেশি তীব্র ছিল। আগুনের তীব্রতা তাকে হার মানাতে পারে নি।’

কথাটুকু বলে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করল সাদাফ। পরমুহূর্তেই বুঝতে পারল, খুব বেশি বোকামো করে ফেলেছে সে। চারপাশে ধোঁয়ার ঘনত্বটা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। কমে এসেছে অক্সিজেনের মাত্রা। শ্বাসনালীতে ধোঁয়া প্রবেশের সাথে সাথে প্রচন্ড কাশি হচ্ছে। চোখ জ্বালা করছে। মুখটা ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় রাঙা হয়ে উঠেছে। শুভ্রতা টলমলে চোখে সাদাফের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে তার হাজারও আকুতি আর তৃষ্ণা। আকস্মিক এই তীব্র কাশির ফলে মনোযোগে হেরফের হল সাদাফের। পায়ের টাল সামলাতে না পেরে ছিটকে পড়ে যেতে নিয়েও সামলে নিল। শুভ্রতাকে নিয়ে কোনোরকমে বসে পড়ল নিচে। চারপাশে সাদা-কালো বিষাক্ত ধোঁয়ায় ঢাকা পড়েছে সব। আগুনের ধ্বংসাত্মক শব্দ, মানুষের দমফাটা আর্তনাদ আর বাঁচার আকুতি ছাড়া আর কিছুই কানে আসছে না। নিঃশ্বাসটাও যেন বন্ধ হয়ে আসছে। শরীরটা থেমে থেমে আসছে।তবুও মাথায় ঘুরছে একটিই চিন্তা। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আর অনাগত সন্তানটিকে বাঁচাতে হবে। যেভাবেই হোক বাঁচাতে হবে। আকস্মিক ঝাঁকিতে শুভ্রতার পেটের ব্যথাটা যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। পেটের ব্যথায় পৃথিবীটা কেমন অন্ধকার লাগছে। একটু অক্সিজেনের জন্য বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে। শুভ্রতা ব্যথাটা সহ্য করতে না পেরে আর্তনাদ করে উঠল। সাদাফ ব্যস্ত হয়ে শুভ্রতাকে বুকের সাথে চেপে ধরল,

‘ খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে? আল্লাহকে ডাকো। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

শুভ্রতাকে কথাটা বলল ঠিক কিন্তু নিজের মনেই কোনো জোর খুঁজে পেলো না সাদাফ। এতোক্ষণ শুধু ধোঁয়া থাকলেও এখন ধোঁয়াটা কেটে গিয়ে আগুনের তাপ লাগছে গায়ে। সাদাফের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে কাছে কোথাও ভয়াবহ আগুন লেগেছে। আগুনটা যদি নিচের তলায় লেগে থাকে তাহলে নিচে নেমে লাভ নেই। নিচে নামার ব্যর্থ চেষ্টা করেও লাভ নেই। শুভ্রতা কিছুক্ষণ স্থির বসে থাকার পর সাদাফের বুকে ঠোঁট ছোঁয়াল। দুর্বল গলায় বলল,

‘ তুমি এখনও বের হতে পারবে আমি জানি। চলে যাও না প্লিজ। আমার মাধ্যমে না হোক। অন্যকারো মাধ্যমে তুতুন আসবে। তুমি আনবে। রাখো কথাটা।’

জবাবে হাতের বাঁধনটা আরো শক্ত করল সাদাফ। কপালে তার চিন্তার ভাঁজ। চোখে ভাসছে বাবা-মা আর ছোট বোনটার মুখ। ওর অনুপস্থিতিতে ওরা কেমন থাকবে, কে জানে? সাদাফ দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করল। হঠাৎ করেই তুতুনের কথা মনে পড়ল তার। চোখ খুলে শুভ্রতার পেটের দিকে তাকাল। চোখদুটো ছলছল করে উঠল। শুভ্রতার পেটের ওপর ডানহাতটা রেখে ভীষণ আদুরে গলায় বলল,

‘ তুতুন? সরি বাবা। এই সুন্দর পৃথিবীটা বাবা তোমাকে দেখাতে পারছে না। বাবা চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পারল না। তোমার বাবা খুব খারাপ। বাবাকে তুমি ক্ষমা করো না। কক্ষনো না।’

সাদাফের কথায় ফুঁপিয়ে উঠলো শুভ্রতা। শরীরটা খুব বেশিই দুর্বল লাগছে তার। জীবনীশক্তি এবার শেষের কোঠায়। শুভ্রতা থেমে থেমে মৃদু গলায় বলল,

‘ তোমার-আমার ছোট্ট সংসারটা আগুনে ঝলসে গেল তুতুনের আব্বু। তোমার সাথে একশো বছর বাঁচাটা আমার হলো না। দু’বছরের মাথায়….’

শুভ্রতার কথা থেমে গেল। আগুনের উত্তাপ বাড়ছে। সাদাফ শুভ্রতার মুখটা দুহাতের মাঝে নিয়ে দুর্বল গলায় ডাকল,

‘ শুভ্রা? এই শুভ্রা? শুভ্রণী?’

শুভ্রতা কথা বলল না। তবে সাদাফের হাতটা ধরল শক্ত করে। এই প্রথম সাদাফের গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে অসহায় বলে বোধ হতে লাগল। শুভ্রতাকে নিজের সাথে চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল,

‘ তুমি ঘুমাও শুভ্রা। এই উত্তাপ তুমি সহ্য করতে পারবে না। আমি তোমাকে সেই কষ্টে আর্তনাদ করতে দেখতে পারব না। তাহলে আমার মৃত্যু যন্ত্রণাটা আরো বেশি কষ্টের হবে শুভ্রা।’

শুভ্রতার সাড়া পাওয়া গেল না। অক্সিজেনের অভাব আর ব্যথায় জ্ঞান হারিয়েছে সে। সাদাফ মুখটা নিচু করে শুভ্রতার গালে, কপালে, ঠোঁটে চুমু খেল। সাদাফের গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলে মাখামাখি হল শুভ্রতার ফর্সা গাল। সাদাফ আবারও চুমু খেল শুভ্রতার পাতলা ঠোঁটে। শুভ্রতা আজ আর লজ্জা পেল না। সাদাফের লাজুক শুভ্রাণী লজ্জায় লাল হয়ে বুকে মুখ গুঁজল না। সাজানো, গোছানো স্বপ্নগুলো ধোঁয়ার মতো বাতাসে উড়ে গেল। পূরণ হওয়ার জন্য বিন্দুমাত্র অপেক্ষাও তাদের সইল না।

______________________

আকাশটা কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে আছে। চারদিকে বিকেলের নরম, বিষণ্ন আলো। সারিবদ্ধ বাড়িগুলো যেন আগুনে ঝলসানো এক একটা কলঙ্ক। পোড়া যাওয়া গাড়ি, দোকানপাট থেকে এখনও ধোঁয়া উড়ছে। চারপাশে স্বজনহারা মানুষের আর্তনাদ। ফায়ার সার্ভিস আর দমকলের তীক্ষ্ণ সাইরেন। অসংখ্য সমাজসেবা কর্মী। স্টেচারে স্টেচারে পুড়ে যাওয়া বিধ্বস্ত দেহ। শুভ্রব শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে। দেহে তার একবিন্দু শক্তি নেই। মাথাটা ফাঁকা কাগজের মতোই শূন্য। বুকের ভেতর থাকা হৃৎপিণ্ডটা ভয়াবহ গতিতে ছুটছে। কাল রাত থেকে এখন পর্যন্ত বোনের বা বোন জামাইয়ের কোনো খবর পায় নি সে। তার পাশেই হতবিহ্বল দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অর্পণদের পুরো পল্টন। চোখে-মুখে তীব্র ভয়। বুকে অবিশ্বাস। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। সন্ধ্যায় দেখা হাস্যোজ্জল মুখগুলো কয়েকঘন্টার ব্যবধানে ধ্বংসস্তুপের মাঝে হারিয়ে যেতে পারে না। আচ্ছা? মৃত্যু কি এতোটাই সহজ? এতো এতো ভালোবাসাগুলোকে চোখের পলকে ভিত্তিহীন করে দেওয়াটাই কি পৃথিবীর নিয়ম? হঠাৎই তাদের পেছনে বেজে উঠল এক কন্ঠস্বর। সেই কন্ঠটা শুভ্রবের মাথায় গিয়ে বাজতে লাগলে তীব্রভাবে,

‘ ওই চারতলা থেকে আরো দুইটা লাশ পাইছে শুনলাম। মহিলাটা প্রেগন্যান্ট। নামার সময় পাই নাই বোধহয়। বেচারা! আরেকটু হলেই বাঁচতে পারত।’

শুভ্রবের সারা শরীর টলে উঠল। বুকের মাঝে এই প্রথম অসহনীয় এক ব্যথা অনুভব করছে সে। বিস্ময় নিয়ে উপলব্ধি করল, এই তীব্র ব্যথাটা আর কখনো হয় নি তার। তনয়াকে হারিয়েও না। দাদুর মৃত্যুতেও না। আচ্ছা? বড় ভাইয়ের কাছে ছোট বোনের মৃত্যুর খবর যে কতটা ভয়াবহ তা কি এই পৃথিবী জানে? হয়ত জানে না। জানলে এই ভয়াবহ খবরটা ভাইয়ের কানে পৌঁছে দেওয়ার মতো সাহস হয়ত এই পৃথিবীর হতো না। পোড়া রাস্তাটা ধরে দুর্বল পায়ে হাঁটতে লাগল শুভ্রব। হাঁটতে হাঁটতেই কানে এলো কয়েকজন মানুষের কথোপকথন। সাংবাদিকদের আকর্ষণীয় খবরের স্তুপ। কিন্তু কোনো শব্দই তার মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছাল না। হাতে থাকা মুঠোফোনটা বাজছে। শুভ্রব ঘোরলাগা চোখে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাল। ফোন রিসিভ করবে না করবে না করেও ফোনটা রিসিভ করল শুভ্রব। সাথে সাথেই ওপাশ থেকে ব্যস্ত, ক্লান্ত কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লেন রাদিবা,

‘ শুভ্রব? বাবু? শুভি… শুভি কই?’

শুভ্রবের শেষ শক্তিটুকুও নিঃশেষ হল এবার। বুকের মাঝে ভয়ানক ভাঙচুরে দিশেহারা হয়ে পড়ল। মাকে কি করে বুঝ দিবে এবার সে? রাদিবা আবারও আকুল কন্ঠে বলে উঠলেন,

‘ কথা বলছিস না কেন বাবা? শুভিকে পাইছিস?’

‘ আমি হসপিটালে যাচ্ছি মা। চিন্তা করো না।’

‘ হসপিটালে যাচ্ছিস! আমার মেয়েটা বেঁচে আছে তো বাবা?’

শুভ্রবের চোখ টলমল করে উঠল। প্রথম বারের মতোই উপলব্ধি করল, মাকে মেয়ের মৃত্যুর খবর জানানোর মতো কঠিন কাজ পৃথিবীতে দ্বিতীয় কিছু হতে পারে না। শুভ্রব কাঁপা গলায় বলল,

‘ জানি না।’

ওপাশ থেকে রাদিবার বুক ফাঁটা হাহাকার কানে এলো। শুভ্রব ফোন কেটে জোড়ে শ্বাস নিল। আকাশের দিকে তাকিয়ে একটি কথায় মনে হল, ‘এই কষ্টময় পৃথিবী তার ভালো লাগছে না।’

হসপিটালের মেঝেতে আগুনে ঝলসে যাওয়া পোড়া দেহগুলো সারিবদ্ধভাবে শুইয়ে রাখা হয়েছে। সেই ঝলসানো দেহগুলোর মাঝেই পরম শান্তিতে শুয়ে আছে আরো দুটি দেহ। দু’জনের হাত এখনও একে অপরের হাতে আবদ্ধ। হাতের বন্ধন দেখে মনে হচ্ছে , একে অপরের পাশে থাকার জন্য তারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এ যেন কোনো নিয়তি নয়। ভালোবাসাময় স্বেচ্ছা মৃত্যু। শুভ্রবের বুকে উথাল-পাতাল কান্নারা আছড়ে পড়লেও চোখ থেকে জল গড়াল না। বোবা দৃষ্টিতে নির্ণিমেষ তাকিয়ে দেখতে লাগল ফর্সাটে কোমল বোনটার পুড়ে যাওয়া কালো দেহ। ইশ! খুব বেশি কষ্ট হয়েছিল কি বোনটার? অবুঝের মতো কেঁদেছিল? শুভ্রবের কষ্ট হয়। ভীষণ কষ্টে দমবন্ধ হয়ে আসে। বোনের কান্নার বিপরীতে কান্না পায় না। সারা শরীরে সুচের মতো বিঁধতে থাকে বিশ্রী এক ব্যথা। মস্তিষ্ক জানান দেয়, ছেলেদের কাঁদার নিয়ম নেই। শুভ্রবের কাঁদার অধিকার নেই। পুরুষানুক্রমিক সেই নিয়মকে মুহূর্তেই ভেঙে গুড়িয়ে দেয় শুভ্রব। হঠাৎই মাথা চেপে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে সে। দুনিয়া ভেসে যায় যাক। তার এই ছোট্ট,অবুঝ বোনটাকে কেউ ফিরিয়ে দিক। শুভ্রবের জন্য কাঁদার মানুষটা হারিয়ে গেলে, শুভ্রব এই এতো এতো কষ্ট একা বইবে কি করে? ওর যে কাঁদতে নেই। ওর জন্য কাঁদার মানুষ নেই।

___________________

জনমানবহীন ফাঁকা ফ্ল্যাটটাতে দাঁড়িয়ে আছে শুভ্রব। ফ্ল্যাটের সাজানো গোছানো আসবাব আর দেয়াল দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই ঘরটিতে নতুন এক অতিথির আগমন ঘটবে। চারদিকে তাকে নিয়ে ব্যস্ত মানুষের পদচারণ থাকবে। মা-বাবার শাসন আর আদরে খিলখিলিয়ে হাসবে ছোট্ট একটা প্রাণ। এইতো কদিন আগেও এমনই স্বপ্ন দেখেছিল সবাই। নতুনকে গ্রহণ করার জন্য ক্যালেন্ডারে দিন গুণছিল প্রতিটি প্রাণ। সবার মুখে ছিল একটাই কথা, আর তো মাত্র দশদিন! আজ সেই দশ নাম্বার দিন। কিন্তু অতিথিটি আসেনি। যে ঘরগুলো হাসি-আনন্দে ভরপুর থাকার কথা ছিলো সেই ঘরগুলোতে কেউ হাসেনি। কিন্তু শুভ্রব শুনতে পায়। দেয়ালে দেয়ালে শুভ্রতার খিলখিল হাসি তার কানে বাজে। সংসার সামলাতে ব্যস্ত শুভ্রতা যেন হঠাৎই বলে উঠে,

‘ তুমি কাঁদছ নাকি ভাইয়া? কেঁদো না তো। তুমি কাঁদলে অযথায় আমার কান্না পায়।’

শুভ্রবের বুক ভার হয়ে আসে। মনে তীব্র ইচ্ছে থাকা সত্বেও এই ফাঁকা বুকটায় বোনকে টেনে নেওয়া হয় নি তার। অস্বস্তি কাটিয়ে বলা হয় নি, ‘ আমি যে তোকে প্রচন্ড ভালোবাসি এই কথাটা কি তুই বিশ্বাস করিস শুভি?’ আজ শুভ্রবের বড় আফসোস হচ্ছে। এক সময় গুরুত্ব না দেওয়া ইচ্ছেটা পূরণ করতে না পেরে বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সাদাফের সেদিনের কথাটা হঠাৎই কানে বাজল শুভ্রবের,

‘ আরে চলোই না। মানুষের হায়াত মউতের কোনো ঠিক আছে? অন্য কোনোদিন আমাদের জীবনে আসবে তারই তো কোনো নিশ্চয়তা নেই।’

সত্যিই নিশ্চয়তা নেই। আর নেই বলেই সাদাফের সাথে খাবার খাওয়ার প্রতিশ্রুতিটা বাস্তবে রূপ নেয় নি। শুভ্রবকে বড় ভাইয়ের মতো ছায়া দেওয়ার জন্য, ভরসা দেওয়ার জন্য সাদাফকে ধন্যবাদ দেওয়াটা হয়ে উঠে নি। বোনকে নিজের অনুভূতির কথা বলাটা হয়ে উঠে নি। শুভ্রবের অনেক কথায় না-বলা থেকে গিয়েছে। বলব বলব করেও সময় হয়ে উঠে নি। সময়টা আসলে কখনোই হয় না। আর যখন সময়ের খেয়াল হয় তখন মানুষগুলোই থাকে না। শুভ্রবের ভাবনার মাঝেই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো পৃথা। শুভ্রবের পেছনে দাঁড়িয়ে টলমলে চোখে তাকিয়ে রইল দেয়ালে লাগানো সাদাফ-শুভ্রতার ছবিটির দিকে। মৃদু গলায় জিগ্যেস করল,

‘ আরশিযুগল প্রেম বলে কি কিছু হয়?’

শুভ্রব ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘ মানে?’

‘ আরশিযুগল প্রেম নামটা শুনেছেন কখনো? সত্যিই কি এমন কিছু হয়?’

শুভ্রব এমন কোনো শব্দ আগে কখনো শুনেছে বলে মনে পড়ল না। হালকা ঘাড় নেড়ে বলল,

‘ জানি না।’

পৃথা আচ্ছন্নের মতো বলল,

‘ ভাবি বলত। সবসময় বলত ভাইয়া আর তার প্রেমটা নাকি আরশিযুগল প্রেম। এই যুগল কখনও ভাঙে না। দুটো মন একে অপরের আরশিতে জড়িয়ে থাকে সবসময়। ভাবির কথাটা যদি সত্যি হয় তাহলে আমিও চাই এমন একটা প্রেম। যে প্রেমটা কখনো শেষ হবে না। মৃত্যুতেও না। আপনি কি তনয়া আপুকে ততটাই ভালোবাসেন?’

শুভ্রব পৃথার চোখের দিকে তাকাল। পৃথার উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে গভীর শোক, হাহাকার। শুভ্রব মৃদু গলায় বলল,

‘ জানি না।’

পৃথার আকুল আবেদন,

‘ আমি ভাবির মতোই কাউকে ভালোবাসতে চাই। যে আমাকে ঠিক তেমনভাবেই ভালোবাসবে। যেমনভাবে ভাইয়া ভাবিকে বেসেছিল।’

শুভ্রব জবাব দিল না। ঘাড় ফিরিয়ে আবারও শুভ্রতার হাসিমাখা ছবিটির দিকে তাকাল। বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। পাশে দাঁড়ানো মেয়েটিকে সে কখনো ভালোবাসবে কিনা জানা নেই। সময়ের আবর্তনে, সৃষ্টির প্রয়োজনে ভালোবাসার স্বপ্নগুলো কখনো নতুন করে হানা দেবে কিনা তাও জানে না শুভ্রব। তবুও সে চায় পৃথার ইচ্ছে পূরণ হোক। প্রয়োজনে শুভ্রবের মাধ্যমেই হোক তবুও আরশিযুগল প্রেমগুলো বেঁচে থাকুক। পৃথিবী শুনতে থাকুক আরশিতে ঢাকা ভালোবাসার গল্প।

_______________ সমাপ্ত _______________

[ বিঃদ্রঃ এটা চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিদগ্ধ হওয়া দম্পতিদের নিয়ে লেখা গল্প নয়। তাদের সম্পর্কে খুব বেশি জানিও না আমি। তবে, এখানে তাদের স্মৃতিচারণ করা হয়েছে। এমনও হতে পারে তাদের গল্পটা আরো সুন্দর ছিল। তাদের সাজানো স্বপ্নগুলো আরও রঙিন ছিল। তাদের জন্য দোয়া রইলো। ভালোবাসাগুলো এভাবেই বেঁচে থাকুক।

বিঃদ্রঃ২ এই গল্পটি লেখার সময় খুব বাজে কিছু পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে আমায়। মাঝে মাঝেই লেখা থামাতে হয়েছে। অনেক গ্যাপে গ্যাপে গল্প দিতে হয়েছে যা এর আগে কখনো করি নি আমি। যার ফলে লেখায় তাল কেটেছে। বিভিন্ন জায়গায় অহেতুক কাহিনী টানা হয়েছে। অনেক জায়গায় কাহিনী বিশ্লেষণ কম হয়েছে। গল্পটা হয়ত আরও সুন্দর, গোছালো এবং কম পর্বে লেখা যেত। কিন্তু বারবার লেখায় তাল কাটার ফলে এই সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারি নি আমি। সেজন্য দুঃখিত। সেইসাথে পাঠকদের প্রতি ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা। এতোগুলো দিন পাশে থাকার জন্য, ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করার জন্য এবং আমাকে সাপোর্ট করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। গল্পের ভুল-ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here