আরশিযুগল প্রেম # লেখনীতে — নৌশিন আহমেদ রোদেলা #পর্ব — ৩৫

0
1319

# আরশিযুগল প্রেম
# লেখনীতে — নৌশিন আহমেদ রোদেলা
#পর্ব — ৩৫

সাদাফের মেজো ভাবির কথাকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে এলেন মধ্যবয়স্কা একজন মহিলা। গোলগাল, ছোটখাটো মানুষটির গায়ের রঙটা চাপা। চোখে-মুখে মৃদু কাঠিন্য। দেখে মনে হয় এই বুঝি রেগে গেলেন, এই বুঝি ধমকে উঠলেন। শুভ্রতা ভেতর ভেতর আরও খানিকটা গুটিয়ে গেল। কিন্তু শুভ্রতার ধারণা মিথ্যে প্রমাণ করে, শুভ্রতার অস্বস্তি আর ভয় কাটিয়ে বেশ মিষ্টি করে হাসলেন উনি। শুভ্রতার বামহাতটা নিজের হাতে টেনে নিয়ে বললেন,

—-” কেমন আছ,মা?”

শুভ্রতা মায়া ভরা চোখে তাকাল। চোখ-মুখে ফুটে উঠল চাপা স্বস্তি। মৃদু গলায় বলল,

—-” আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”

সাদাফের মা, সাহেরা বেগম মৃদু হাসলেন,

—-” বাইরে দাঁড়িয়ে আছ কেন? ভেতরে আসো।”

শুভ্রতা ধুরুধুরু বুক নিয়ে ভেতরের দিকে পা বাড়াল। সাহেরা বেগম শুভ্রতাকে সোফায় বসিয়ে দিতেই মাথা নিচু করে বসে রইল সে। ঘরভর্তি অপরিচিত চোখগুলো নিঃসংকোচ কৌতূহলে পর্যবেক্ষন করে চলেছে সেই কখন থেকে। অস্বস্তি আর বিরক্তিতে রীতিমতো হাসফাস করছে শুভ্রতা। এত মানুষের ভীড়ে, এমন একটা বিশ্রী পরিস্থিতির শিকার কখন হয় নি সে। ছোটবেলা থেকেই ঢাকার আবাসিক এলাকার নিজস্ব ফ্ল্যাটেই বেড়ে উঠেছে শুভ্রতা। গ্রামের বাড়িও খুব একটা যাওয়া হয় নি তার। বড় খালামণির বাসায় মাঝে মাঝে এমন ভীড়বাট্টার শিকার হলেও সেটা ছিল সাময়িক। কারো মনযুগিয়ে চলা বা কারো ধার ধারার প্রয়োজন শুভ্রতার ছিল না। কিন্তু এখানের পরিবেশটা ভিন্ন। এই পরিবেশেই সারাটা জীবন কাটাতে হবে তাকে। এই এত এত মানুষগুলোর মনযুগীয়ে চলতে হবে ভাবতেই আতঙ্কে কুঁকড়ে উঠল শুভ্রতা। বেশ কিছুক্ষণ পর শুভ্রতাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে মোলায়েম গলায় বলে উঠলেন সাহেরা বেগম,

—-” ও কি! তোমার জামা তো অনেকটাই ভিজে গিয়েছে মা। একটা কাজ কর, পৃথার রুমে গিয়ে ঝটপট কাপড় পাল্টে নাও। হাতে-মুখে পানি দাও। যাও…”

শুভ্রতা ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল। সাহেরা বেগম আদেশের সুরে বললেন,

—-” পৃথা? শুভ্রতাকে তোর ঘরে নিয়ে যা। শুভ্রতা মা? শাড়ি পড়তে পারো তো?”

শুভ্রতা আবারও ঘাড় কাত করে বলল,

—-” হ্যাঁ পারি।”

সাহেরা বেগম মিষ্টি হেসে বললেন,

—-” বেশ তো। পৃথা? শুভ্রতাকে তোর একটা শাড়ি বের করে দে। যাও মা। পৃথার সাথে যাও….. ফ্রেশ হওয়ার পর সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেব কেমন?”

শুভ্রতা মুচকি হেসে মাথা নাড়ল। পৃথার সাথে পৃথার রুমে এসে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল সে। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ক্লান্ত গলায় বলল,

—-” তোমরা অনেকে একসাথে থাকো তাই না? বসার ঘরে অনেক মানুষ দেখলাম।”

পৃথা আলমারি থেকে শাড়ি বের করছিল। শুভ্রতার কথায় আলমারির পাল্লা টানতে টানতে তার দিকে তাকাল পৃথা। মৃদু হেসে বলল,

—-” এজন্যই তো তোমায় আসতে বললাম। সবাই মিলে এত্ত এত্ত মজা করব আজ। মেজো ভাইয়া ভীষণ মজার মানুষ। বড় ভাইয়াও হৈচৈ পছন্দ করে… বাবা আর ছোট ভাইয়াই ভীষণ গম্ভীর।”

কথাগুলো বলতে বলতে শুভ্রতার কাছাকাছি এসে দাঁড়াল পৃথা। নীল সুতোর তাঁতের শাড়ি এগিয়ে দিয়ে বলল,

—-” ফ্রেশ হয়ে নাও জলদি। একটু পরই মেজো ভাবির বাপের বাড়ি থেকে লোক আসবে বাবু দেখতে । মা নিশ্চয় ডাকবে তখন। জলদি জলদি কর।”

শুভ্রতা ক্লান্ত ভঙ্গিতে উঠে বসল। শরীর নয় মনটা ভীষণ ক্লান্ত লাগছে তার। মনের ভেতরে জমিয়ে রাখা অনিশ্চয়তাগুলোই যেন ধীরে ধীরে ক্লান্ত থেকে ভয়ানক ক্লান্ত করে তুলছে তাকে। শাড়ির ভেতর থাকা ব্লাউজটা নেড়ে চেড়ে বলল,

—-” এটা আমার গায়ে লাগবে?”

—-” মনে হচ্ছে লাগবে। তুমিও তো আমার মতই দূর্ভিক্ষের দিনের মানুষ।”

এটুকু বলে নিজেই খিলখিল করে হেসে উঠল পৃথা। শুভ্রতা মৃদু হেসে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেল। দরজার কাছাকাছি গিয়েও হঠাৎ ফিরে তাকিয়ে বলল,

—-” পৃথা? শাড়ির কুঁচি গুলো একটু ঠিক করে দিতে হবে বোন। শাড়ি পরার খুব একটা অভ্যাস নেই।”

পৃথা মিষ্টি হেসে বলল,

—-” আমি থাকতে কিসের চিন্তা ভাবি সাহেবা?আপনার আগমন উপলক্ষে আপনার প্রেমে আপ্লুত পুরুষ আমাকে আপনার পার্সোনাল সেক্রেটারি হিসেবে নিযুক্ত করেছেন। আপনি শুধু আদেশ করুন ভাবিসাহেবা!”

পৃথার কথার ভঙ্গি দেখে হেসে ফেলল শুভ্রতা। পৃথা নামক মেয়েটাকে ভীষণ পছন্দ হয়েছে তার। একদম সহজ-সরল আন্তরিক ব্যবহার তার। একদম নিজের বোনের প্রতিরূপ। শুভ্রতার ছোট বোন থাকলে বুঝি এমনটাই হত? ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বিছানার উপর তাকিয়েই বিস্মিত হল শুভ্রতা। তোয়ালেটা পাশে রাখতে রাখতে বলল,

—-” এ কি? এত কিছু কেন?”

পৃথা দাঁত বের করে হাসল। নিচে বসে শুভ্রতার কুঁচি ঠিক করতে করতে বলল,

—-” আজকে ভাইয়ার হার্ট অ্যাটাক করিয়েই ছাড়ব ভাবি। তোমাকে দেখে আমার রসকষহীন ভাই জাস্ট ‘হা’ করে তাকিয়ে থাকবে। আচ্ছা ভাবি? তোমার আর ভাইয়ার প্রেম কি করে হল বল তো?”

শুভ্রতা লজ্জা পেয়ে বলল,

—-” এই বাচ্চা একটা মেয়ের মুখে এত প্রেম প্রেম কিসের, হুম?”

কুঁচিগুলো গুছিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল পৃথা। শুভ্রতাকে টেনে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসিয়ে দিয়ে বিস্ময় নিয়ে বলল,

—-” আমি ছোট?”

শুভ্রতা হেসে বলল,

—-” কেন তুমি ছোট না?”

শুভ্রতা সাজাতে সাজাতেই উত্তর দিল পৃথা,

—-” একদমই নয়। আমি এবার এইট্টিন প্লাস হচ্ছি। ওই স্লোগানটা শুনো নি? ‘আঠারোর আগে বিয়ে বিশের আগে বাচ্চা’। সেই হিসেবে আমার তো বাচ্চার মা হওয়ার কথা। আমার বর বোধহয় তোমাদের ঢাকার জ্যামে ফেঁসে গিয়েছে। সেজন্য বাচ্চার মা হতে পারছি না…. আহ্ কি দুঃখ।”

শুভ্রতা হেসে ফেলল। স্বচ্ছ হাসি নিয়ে বলল,

—-” এমন কোন স্লোগান নেই পৃথামণি। স্লোগানটা হল, ‘আঠারোর আগে বিয়ে নয়, বিশের আগে সন্তান নয়’। ”

—-” ধুর ভাবি! যার যেমন প্রয়োজন তার তো সেভাবেই বলতে হবে নাকি?”

শুভ্রতা দুষ্টু হেসে বলল,

—-” তারমানে আমাদের পৃথামণি বউ সাজার খুব ইচ্ছে। তোমার ভাইয়াকে বলব নাকি?”

পৃথা হাসল। ফাজলামো করে বলল,

—-” বিয়ের ইচ্ছে আমার একশের মাঝে একশ পাঁচ পার্সেন্ট ভাবি। তবে, ছোট ভাইয়া বলে কোণ লাভ নেই। বললে মেজো ভাইয়াকে বলতে হবে। মেজো ভাইয়া দারুণ মজার মানুষ….. দেখা যাবে হুট করেই কোন ছেলে ধরে এনে বিয়ে দিয়ে দিল। ব্যাপারটা দারুন এক্সাইটিং হবে না?”

পৃথার কথায় খিলখিল করে হেসে উঠল শুভ্রতা। পৃথা নিজেও শুভ্রতার হাসিতে যোগ দিল। পৃথার আন্তরিকতা, স্বচ্ছ চঞ্চলতা যেন মুহূর্তেই শুভ্রতার সকল অনিশ্চয়তাগুলো ভুলিয়ে দিয়ে গেল। সাজানো শেষ করে আয়নার দিকে তাকিয়ে আনন্দিত গলায় বলে উঠল পৃথা,

—-” ওয়াহ্ কি ভীষণ মিষ্টি লাগছে তোমায়। আজ তো ভাইয়া শেষষষষ….”

শুভ্রতা লাজুক হেসে বলল,

—-” তুমি খুব পেকে গেছ পৃথা। তোমার ভাইয়াকে বলছি দাঁড়াও….”

পৃথা কিছু বলবে তার আগেই দরজার কড়া নড়ল। বাইরে থেকে গম্ভীর ভরাট গলায় বলে উঠল সাদাফ,

—-” পৃথা? দরজাটা খোল।”

পৃথা দাঁত বের করে হাসল।

—-” এসে গিয়েছে তোমার হিরো..”

কথাটা বলে ডান চোখ টিপল পৃথা। দরজাটা খুলে দিয়ে ভাব নিয়ে বলল,

—-” কি চায়?”

সাদাফ ধমকে উঠে বলল,

—-” পোলিও রুগীর মত বেঁকে যাচ্ছিস কেন? সোজা হয়ে দাঁড়া।”

সাদাফের ধমকে চুপসে গেল পৃথা। মুহূর্তেই খিলখিলিয়ে উঠে বলল,

—-” আমার রুমে তোমার কিসের উঁকিঝুঁকি ভাইয়া? চারদিকে সন্দেহ সন্দেহ গন্ধ।”

সাদাফ গাঢ় গলায় বলল,

—-” একটা চড় খাবি। মা ডাকছে তোকে, যা।”

পৃথা মুখ ভেঙিয়ে বলল,

—-” মা ডাকছে..হুহ! ভাবি? চল তো।”

শুভ্রতা উঠে দাঁড়াতেই গম্ভীর গলায় বলে উঠল সাদাফ,

—-” মা তোকে ডেকেছে তোর ভাবিকে নয়। পাকামো না করে ভাগ….”

পৃথা এবার সরু চোখে তাকাল। দাঁত বের করে বলল,

—-” বাহ্ ভাইয়া! প্রেমে পড়ে কূটনীতি করাটাও শিখে গেছ দেখি। মাকে তো বলতে হয়….”

পৃথার মাথায় চাটি মেরে চোখ রাঙিয়ে তাকাল সাদাফ,

—-” এক থাপ্পড়ে দাঁত ফেলে দেব। বড়দের সাথে এসব কেমন কথা? যা এক্ষুনি।”

পৃথা একবার শুভ্রতার দিকে তাকাল। ডান চোখটা টিপে দিয়ে হেলেদুলে বেরিয়ে গেল। দরজা পেরুতেই জোরে জোরে গেয়ে উঠল,

—-” জাতি কুল মান সবই গেল
এখন শুধু বাকি প্রাণ।
তোমার সাথে প্রেম করিয়া,
হইলাম কত অপমান।।
আহা! আহা! আহা!”

সাদাফ দরাজ গলায় বলল,

—-” এই দাঁড়া তুই…বেয়াদব….”

সাদাফের গলা পেয়েই দাঁত কেলিয়ে দৌড়ে পালাল পৃথা। পৃথার কান্ড দেখে খিলখিল করে হেসে উঠল শুভ্রতা। শুভ্রতার হাসি কানে যেতেই অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে তাকাল সাদাফ। নীল শাড়ি পরিহিতা শুভ্রতাকে দেখেই চোখ আটকে গেল তার। অন্যমনস্ক দৃষ্টি ধীরে ধীরে গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে লাগল। সাদাফকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু নাচাল শুভ্রতা,

—-” কি দেখছ?”

সাদাফ জবাব না দিয়ে বাঁকা হাসল। শুভ্রতার দিকে এগিয়ে গিয়ে একদম কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। শুভ্রতা সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই একহাতে কোমর আঁকড়ে ধরল সাদাফ। শুভ্রতা প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাতেই হাসল সাদাফ। ফিসফিস করে বলল,

—-” যা পড়েছ না! তোমাকে শাড়িতে দেখেই শুধু কালকের কথা মনে পড়ছে। আহা কি…”

এটুকু বলে চোখ টিপল সাদাফ। সাথে সাথেই বিষম খেলো শুভ্রতা। আমতাআমতা করে বলল,

—-” পৃথা বলছিল তুমি নাকি কথায় বলতে পার না? অথচ আমি বলব তোমার মতো অসভ্য কথা এই দুনিয়াতে দ্বিতীয় কেউ বলতে জানে না। তোমার এই রূপ দেখলে তোমার বোন নির্ঘাত সেন্স হারাত।”

সাদাফ হাসল। দুইহাতে কোমর জড়িয়ে নিয়ে বলল,

—-” তোমার ধারণা আমি অসভ্য কথা বলি? কিন্তু আমার ধারণা তুমি সবসময় আমাকে নিয়ে অসভ্য অসভ্য চিন্তা কর।”

শুভ্রতা চোখ বড় বড় করে বলল,

—-” কি? ছিহ! কক্ষনও না।”

—-” কক্ষনও না?”

শুভ্রতা মাথা নাড়ল। সাদাফ স্থির চাহনিতে মুখে এগিয়ে আনতেই নিজের মাথাটা পিছিয়ে নিল শুভ্রতা। সাদাফ আরও এগিয়ে আসতেই ফিসফিস করে বলে উঠল শুভ্রতা,

—-” কি হচ্ছেটা কি?”

সাথে সাথেই শব্দ করে হাসল সাদাফ। হাসতে হাসতেই বলল,

—-” দেখলে তো? সত্যি করে বল তো? এই মুহুর্তে কি ভেবেছিলে তুমি?”

শুভ্রতা নাক ফুলিয়ে বলল,

—-” তুমি আসলেই একটা অসভ্য। আমি মোটেও তেমন কিছু ভাবি নি।”

সাদাফ ভ্রু নাচিয়ে বলল,

—-” কেমন কিছু ভাবেন নি?”

শুভ্রতা কিছু বলার আগেই দরজার কাছ থেকে বিদ্রুপ করে বলে উঠল কেউ,

—-” বিয়ের আগেই এত রোমান্স? তাও আবার দরজা জানালা খুলে?”

কন্ঠটা কানে যেতেই শুভ্রতাকে ছেড়ে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়াল সাদাফ। শুভ্রতা লজ্জায় মিঁইয়ে গেল। শুভ্রতা আড়চোখে সামনে দাঁড়ান মানুষটিকে দেখল। সাদাফের মেজো ভাবি নামক মানুষটিকে একদমই ভালো লাগে না শুভ্রতার। মেয়েটা অতিরিক্ত করে। শুভ্রতা তার বরের সাথে যা ইচ্ছে তা করুক তাতে এই মহিলার কি? কারো রুমে ঢুকার জন্য যে নক করার প্রয়োজন হয় তা কি সে জানে না? মেজো ভাবি আরও কিছু বলতেন তার আগেই মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেল সাদাফ। শুভ্রতা যেন অথৈ সাগরে পড়ল। অস্থির চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজেকে ঢাকার, এই মানুষটি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার ছোট্ট কোন আশ্রয় খুঁজতে লাগল সে। মেজো ভাবি হেসে বলল,

—-” আমার দেবরকে তো ভালোই আঁচলে বেঁধেছ দেখি। চুপচাপ দেবর এখন উত্তাল প্রেমিক হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আঁচলে বাঁধাবাঁধির কাজটা চার দেয়ালের মাঝে করলে হয় না?”

প্রথম দিনেই মেজো ভাবির এমন সব কথায় মেজাজ চটে গেল শুভ্রতার। আশ্চর্য! একটা মানুষ এতটা ঠোঁটকাটা স্বভাবের কি করে হতে পারে? আর চার দেয়াল মানে কি? এই মহিলার ধারণা মতে শুভ্রতা আর সাদাফ কি মেইন রোডে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল নাকি? রাগে,বিরক্তিতে মনে থাকা অনিশ্চয়তাগুলো আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। বার বার মনে হতে লাগল, এমন একটা ফ্যামিলিতে পার্সোনাল স্পেস পাওয়া সম্ভব নয়। মানসিক শান্তি পাওয়া সম্ভব নয়। মেজো ভাবি আরও কিছু বলার আগেই দৌড়ে এলো পৃথা। ‘মা ডাকছে’ বলে টেনে বসার রুমে নিয়ে এলো শুভ্রতাকে। বসার রুমে আরও কিছু নতুন মুখ চোখে পড়ল শুভ্রতার। সাহেরা বেগম শুভ্রতাকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন,

—-” এটা আমার ছোট ছেলের হবু বউ। একদম লাখে এক মেয়ে পেয়েছি ছেলের জন্য। একটু ঘরকোনা স্বভাবের বলেই ওর বাবা-মাকে বলে ডেকে পাঠিয়েছি এখানে। বিয়ে যেহেতু হবেই সেহেতু আগে থেকেই যোগাযোগ বাড়ান ভালো। যত মিশবে তত সহজে আপন করে নিবে সব।”

শুভ্রতা একপলক সাহেরা বেগমের দিকে তাকালেন। মহিলাটাকে বেশ পছন্দ হয়েছে তার। চেহারা দেখে মনে না হলেও কথাগুলো ভীষণ মায়া মায়া। যেন, ভেতরের সমস্ত ভালোবাসাটাই ঢেলে দেন কথায়। শুভ্রতাকে প্রায় দু’ঘন্টার মত একই জায়গায় ঠাঁই বসে থাকতে হল। হাসিমুখে হাজার প্রশ্নের উত্তর দিতে হল। খাবার টেবিলেও একঝাঁক মানুষকে দেখে কন্ঠনালী শক্ত হয়ে এলো। বাবু দেখতে গিয়েও সেই একই অবস্থা। সব মিলিয়ে শুভ্রতার যেন দমবন্ধ দমবন্ধ লাগতে লাগল। চারদিকে অপরিচিত কন্ঠস্বর, অপরিচিত চেহারা….পরিচিত সাদাফটা কই? শেষ বিকেলের দিকে সবার থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এল সাদাফ-শুভ্রতা। সিএনজিতে উঠেই সিটে গা এলিয়ে দিয়ে বুক ভরে শ্বাস নিল শুভ্রতা। কিছুক্ষণ পরই হুট করে থেমে গেল সিএনজি। শুভ্রতা ভ্রু কুঁচকে বলল,

—-” এসে গিয়েছে নাকি? এতো তাড়াতাড়ি? ”

সাদাফ মৃদু গলায় বলল,

—-” হু। নামো।”

শুভ্রতা সিএনজি থেকে নেমেই বিস্ময় নিয়ে বলল,

—-” আরেহ! এটা তো মামুর বাসা নয়। এখানে কেন নামলে?”

সাদাফ ভাড়া মিটিয়ে শুভ্রতার ডান হাতটা চেপে ধরল। বিনাবাক্যে একটা রেস্টুরেন্টের ভেতর ঢুকলো সে। শুভ্রতাকে একটা চেয়ার টেনে দিয়ে বলল,

—-” বস।”

সাদাফের মতিগতি ঠিক বুঝতে পারছে না শুভ্রতা। সাদাফের গম্ভীর মুখের কারণটাও ভীষণ অজানা তার। সাদাফ শুভ্রতার মুখোমুখি বসতেই উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করল শুভ্রতা,

—-” কি হল? আমরা হঠাৎ এখানে এলাম কেন? বাসায় ফিরতে দেরি হয়ে যাবে তো।”

সাদাফ ছোট্ট করে উত্তর দিল,

—-” খাব তাই। কি খাবে বল।”

শুভ্রতা বিস্ময় নিয়ে বলল,

—-” খাব মানে কি? খেয়ে এলাম না মাত্র?”

সাদাফ শুভ্রতার চোখে চোখ রেখে বলল,

—-” তুমি যে কিছুই খেতে পারো নি তা আমি জানি শুভ্রা। কথা না বাড়িয়ে অর্ডার দাও। তোমাকে খালি পেটে বাসায় ফিরতে দেব না আমি।”

শুভ্রতা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। খাবার অর্ডার দেওয়া শেষে শুভ্রতার ডান হাতটা আলতো করে নিজের হাতে নিল সাদাফ। শুভ্রতার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

—-” তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী শুভ্রা। অর্থাৎ, তুমি আমার সত্তার অর্ধেক। আমার শরীরে কোথাও হালকা ব্যাথা লাগলেও আমি বুঝতে পারি শুভ্রা। উপলব্ধি করতে পারি। তুমিও তো আমার একটা অংশ তাহলে তোমার সমস্যাটা আমায় কেন বুঝতে দিচ্ছ না?”

শুভ্রতা চকিতে তাকাল। হাসার চেষ্টা করে বলল,

—-” কি বলছ? আমার আবার কিসের সমস্যা?”

সাদাফ ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুভ্রতার রক্তশূণ্য ফ্যাকাসে মুখের দিকে তাকাল। ওর সেই অন্যমনস্ক দৃষ্টির মেকি আনন্দ আর অনিশ্চয়তাটা খুব সহজেই ধরা পড়ে গেল সাদাফের চোখে। শুভ্রতার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বলল,

—-” আমাদের শরীরের কোথাও কেটে গেলে ক্ষতটা সারিয়ে তোলার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ি আমরা। কিন্তু কেউ যদি বেখেয়ালিপনায় বা অবহেলায় কাটা জায়গাটা এমনিই ফেলে রাখে তাহলে একসময় তাতে পচন ধরে….ধীরে ধীরে ক্ষতের আকার বাড়ে। ‘শুভ্রা’ নামক আমার এই অঙ্গটাকে আমি বেখেয়ালিপনায় বা অবহেলায় হারাতে চাই না। প্রতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে তার তাপমাত্রা জানতে চাই আমি। আমার শরীরের ‘সাদাফ’ নামক অংশ থেকে ‘শুভ্রা’ নামক অংশটা যে আমার বেশি প্রিয়। তাই তার সমস্যাগুলো, ছোট ছোট কথাগুলোও আমায় জানতে দাও। যেন কাটা স্থানগুলোতে ঔষধ লাগাতে কখনও দেরি না হয়ে যায়। মাঝে মাঝে ছোট্ট ছোট্ট বিষয়গুলোর জন্যই সম্পর্কে পঁচন ধরে। তাই মনটা অতি সূক্ষ্ম কোন বিষয়ে খচখচ করে উঠলেও আমায় জানাবে….তুমি আমার অর্ধাঙ্গী হলে আমিও তোমার অর্ধাঙ্গ শুভ্রা। আমাদের মধ্যে এমন কোন কথা থাকবে না যার জন্য ভবিষ্যতে এক মুহূর্তের জন্যও আমাদের আফসোস করতে হয়….এক মুহূর্তের জন্যও ভাবতে হয় যে, কেন বললাম না?”

এটুকু বলে থামল সাদাফ। শুভ্রতার মুখে কোমল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

—-” তোমার আরশিটা আমি কিনতে চাই শুভ্রণী। সেই আরশিতে থাকা তোমার সকল প্রশ্ন, উদ্বেগ, ভয়, দুশ্চিন্তা, সুখ , দুঃখ সবকিছুকে আমার আরশির সাথে বাঁধতে চাই। বেঁচবে না সেই আরশি?”

শুভ্রতা টলমলে অনুভূতিতে অভিভূত হল। মৃদু গলায় বলল,

—-” আমার ভীষণ ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে, তোমার পরিবারের সবার মনযোগিয়ে চলতে পারব না আমি। আমি ছোট থেকেই ছোট্ট একটা গন্ডিতে বড় হয়েছি। ওদের সাথে ওদের মত প্রাণভরে কি মিশতে পারব? আমার শান্তি লাগছে না….অস্থির লাগছে। নিজের উপর কিছুতেই ভরসা পাচ্ছি না।”

সাদাফ মৃদু হাসল। আচমকাই ডানহাতটায় ঠোঁট ছোঁয়াল। সাদাফের অপ্রত্যাশিত ছোঁয়ায় কেঁপে উঠল শুভ্রতা। সাদাফ গাঢ় দৃষ্টিতে তাকাল,

—-” আমি তো আছি শুভ্রাণী। কাউকে এক্সট্রাভাবে খুশি করতে হবে না তোমায়। তুমি শুধু ভালোবাসো। শুধু এবং শুধুই ভালোবাসা। আমার বাবা-মাকে নিজের মতো করে ভালোবাসো। তোমার কাছে শুধু এটুকুই চাওয়া…বাবা-মাকে খুশি করতে হবে এমনটা ভেবে নয় তাদেরকে নিজের বাবা-মা ভেবে ভালোবাসো শুভ্রা। যেন আমার থাকা না থাকাতে তাদের গুরুত্বটা তোমার কাছে কমে না যায়। আর আমি তো আছিই তোমার পাশে…..তোমার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখার জন্য হলেও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পাশে থাকব শুভ্রা। অস্থির হওয়ার কিছু নেই…..শুধু নিজের মধ্যে কিছু চেপে রেখো না। তোমার আরশিটা কখনও ঢাকার চেষ্টা কর না। তাকে আমার কাছে উন্মুক্ত থাকতে দিও। ব্যস! বাকিসব সামলে নেওয়ার জন্য আমি আছি।”

#চলবে….

[ সরি ফর লেইট। বাসায় একটা পিচ্চি আসছে। এত চেঁচায় আল্লাহ…. মাথা শেষ করে ফেলছে। এদিক-ওদিক হাঁটাহাঁটি করে লিখতে হয়েছে আজ। 😔]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here