আরশিযুগল প্রেম❤ # লেখিকাঃ নৌশিন আহমেদ রোদেলা ❤ #পর্ব- ৯

0
1124

# আরশিযুগল প্রেম❤
# লেখিকাঃ নৌশিন আহমেদ রোদেলা ❤
#পর্ব- ৯

শেফার কাবিন উপলক্ষে বাড়িতে হুলস্থুল কান্ড। এককালে শেফারা রক্ষণশীল পরিবার বলেই খ্যাত ছিলো। কালের প্রবাহে সেই খ্যাতিটা খানিক মিইয়ে গেলেও সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে যায় নি। তারই রেশ ধরে এ যুগে এসেও বাড়ির ছোট খাটো ব্যাপারেও উপচে পড়ে আত্মীয়দের ভীর। শেফার বড় চাচা,ছোট চাচা, বড় ফুপু, খালা, মামা এমনকি তাঁদের শশুড় বাড়ির লোকেরাও বাদ পড়ে না এতে। এবারও তাই হলো। বরপক্ষ থেকে মাত্র দশজন এলেও কনেপক্ষের নিকটাত্মীয় মিলেই হয়ে গেলো প্রায় পঞ্চাশ জন। উত্তরার অত্যাধুনিক ফ্ল্যাটে পঞ্চাশজন মানুষের বসবার, খাওয়ার যোগান দেওয়াটা অসম্ভব না হলেও বেশ কঠিনই বটে। ড্রয়িংরুমসহ বাসার চার চারটা বেডরুমেই ছেলে, বু্ড়ো,বাচ্চা আর মহিলাদের নিয়ে গিজগিজে ভীর। বাচ্চাদের চিল্লাচিল্লি, মুরব্বিদের গল্প, মহিলাদের ফিসফিস সব মিলিয়ে বাসায় যেন এক দমবন্ধকর অবস্থার সৃষ্টি। এই দমবন্ধকর পরিবেশের এক কোণে সোফায় মাথা নিচু করে বসে আছে সাদাফ। চারপাশের চিল্লাচিল্লি আর অতিরঞ্জিত বাড়াবাড়িতে অসম্ভব রকম বিরক্ত সে। সামান্য একটা কাবিনের জন্য এতো আলোড়নের কি প্রয়োজন বুঝতে পারছে না সাদাফ। দেড় ঘন্টা যাবৎ এই অস্থির পরিবেশে মিথ্যা হাসি নিয়ে ঠাঁই বসে থাকাটাও সাদাফের জন্য রীতিমতো যুদ্ধ। মনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ! “অতিরঞ্জিত” শব্দটা সাদাফের স্বভাব বিরোধী। অতিরিক্ত উশৃংখলতা, অতিরিক্ত চেঁচামেচি কিছুই পছন্দ নয় তার। তার পছন্দ পাহাড়,মেঘে ঢাকা গোমট আকাশ। ছোট বেলা থেকেই পাহাড়ের প্রতি অদ্ভুত টান তার। বাবা বন বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকতা হওয়ায় পাহাড়ের সাথে সম্পর্ক গড়ার সুযোগটাও হয়েছে বেশ। চারদিকে নিস্তব্ধ গাছপালা, পাহাড়ি মাটির গন্ধ, বেপরোয়া ঝর্ণা তারসাথে মেঘলা আকাশ। আরো কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে বিরক্তিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠে দাঁড়ালো সাদাফ। আরাফকে ইশারায় আশেপাশেই আছে বুঝিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো সে। সিঁড়ি বেয়ে ছাঁদের দরজার কাছাকাছি আসতেই কানে এলো নারীকন্ঠের সূক্ষ্ম আওয়াজ। সাদাফ থমকে দাঁড়ালো। কপাল কুঁচকে কিছু একটা ভেবে দরজা পেরিয়ে ছাঁদে পা রাখলো। ছাঁদের দক্ষিণ দিকের রেলিঙে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো। পাঞ্জাবির উপরের দুটো বোতাম খুলে হাতদুটো ভাঁজ করে তারায় পূর্ণ ঝকঝকে আকাশের দিকে তাকালো সে। ভেতরের গোমট ভাবটা বাইরের ঠান্ডার ছোঁয়ায় খানিকটা কেটে যেতেই সিগারেট ধরালো সাদাফ। সিগারেটে কয়েক টান দিতেই কানে এলো কারো খিলখিল হাসির শব্দ। আবারও ভ্রু কুঁচকে এলো সাদাফের। সিগারেটটা ফেলে দিয়ে চোখ ফিরিয়ে এদিক ওদিক তাকালো। কাউকে দেখতে না পেলেও পরিচিত নারী কন্ঠ কানে ভেসে এলো তার। আধ জ্বলা সিগারেটটা পা দিয়ে পিষে ফেলে ডানদিকে মাথা হেলিয়ে ছাঁদের ওপাশে চোখ রাখতেই ফোনে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে এলো শুভ্রতা।

—-” টেইক ইট ইজি জানু। এতো মন খারাপ করতে হবে না সোনা। আরে, আমি…..”

এটুকু বলতেই সামনে কোনো পুরুষের অবয়ব দেখে থমকে গেলো শুভ্রতা। আধো অন্ধকারে, কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেই সামনে দাঁড়ানো লোকটি যে সাদাফ তা আবিষ্কার করলো শুভ্রতা। অপ্রত্যাশিতভাবে সাদাফের মুখোমুখি হওয়ায় খানিকটা অপ্রস্তুত হলো সে। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে “পরে কথা বলছি” বলে ফোনটা কেটে মুচকি হাসলো সে। সাদাফও সূক্ষ্ম ঠোঁট মেললো। তারার মিটমিট আলোতে সেই সূক্ষ্ম হাসি ঠিক চোখে পড়লো না শুভ্রতার। ডান কাঁধের ওড়নাটা আরো খানিকটা টেনে দিয়ে অস্বস্তিভরা পায়ে দু- একপা এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো শুভ্রতা,

—” আপনি এখানে?”

সাদাফ হাসিমুখে জবাব দিলো,

—” এমনি। অনেকক্ষণ যাবৎ বসে আছি তাই ভাবলাম একটু হাঁটাহাঁটি করে আসি। কিন্তু আপনি এখানে? রাতের বেলা একা ছাঁদে?”

শুভ্রতা হাসার চেষ্টা করে বললো,

—” একটা ফোনকল এটেন্ট করতে এসেছিলাম। নিচে যা অবস্থা তাতে তো…”

এটুকু বলতেই আবারও ফোন বেজে উঠলো শুভ্রতার। ফোন ধরে রাখা হাতটা রেলিঙের উপর থাকায় সাদাফের বেখেয়ালি চোখটা আটকে গেলো স্ক্রিনে। স্ক্রিনে “অর্পন” নামটা দেখেই চোখ ফেরালো সে। শুভ্রতা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে ফোনটা রিসিভ করে নিচু গলায় বললো,

—” বললাম তো পরে ফোন দিবো। পরে মানে পরে, ওকে?”

শুভ্রতার মৃদুস্বর কানে আসতেই চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সাদাফ। একটু আগে তাহলে ওসব বলে সম্বোধন করা মানুষটি অর্পনই ছিলো? অর্পন কি শুভ্রতার স্পেশাল কেউ? এতটুকু ভাবতেই মাথা ঝাড়লো সাদাফ। শুভ্রতার পার্সোনাল লাইফে কে আছে বা কে নেই সেটা তার দেখার বিষয় নয়। কখনোই নয়। ফোন কেটে অপ্রতিভ হেসে বলে উঠলো শুভ্রতা,

—” সরি! আ..তো, নিচে যাবেন এখন?”

সাদাফ মাথা নেড়ে অসম্মতি জানিয়ে বললো,

—” উহুম! নিস্তব্ধতা ভালো লাগছে।”

শুভ্রতা হালকা হাসলো। একরাশ অস্বস্তি নিয়ে সাদাফ থেকে খানিকটা দূরত্বে এক হাতে ভর দিয়ে রেলিঙে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো। আকাশে চোখ রেখে হুট করেই প্রশ্ন করলো,

—” আপনি কি সবসময়ই কম কথা বলেন?”

সাদাফ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। মৃদু হেসে বললো,

—” না তো। কম কথা বলি না তবে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই বলি।”

শুভ্রতা আড়চোখে তাকালো। ছেলেমানুষি গলায় বললো,

—” আপনার প্রয়োজনটাই হয়তো খুব সীমিত। মাঝে মাঝে মন হয় গুণে গুণে কথা বলছেন। একটা শব্দ বেশি বলে ফেললোও বিরাট লস।”

সাদাফ হাসলো। সাদাফের হাসির মৃদু ঝংকারটা শুভ্রতার কানে যেতেই সচেতন চোখে তাকালো সে। আধো অন্ধকারে সাদাফের হাসি মুখটা দেখার ব্যর্থ চেষ্টা করে কপাল কুঁচকালো শুভ্রতা। সাদাফ ঠোঁটে হাসি মেখে বললো,

—” মানুষভেদে প্রয়োজনের আকার পরিবর্তন হয় শুভ্রতা। তাছাড়া, মানুষভেদে প্রয়োজনের সীমাবদ্ধতাও থাকা প্রয়োজন। সীমার বাইরে চলে যাওয়াটা আসলেই কিন্তু বিরাট লস।”

শুভ্রতা ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। মাথা দুলিয়ে বললো,

—” গুরুগম্ভীর কথাবার্তা! আপনারা বড়রা সবসময় এমন সাধুভাষা টাইপ কথা কেন বলেন, বলুন তো? এসব কথাবার্তার অর্ধেক অর্থ আমার মাথার উপর দিয়েই যায়।”

সাদাফ আমোদিত গলায় বললো,

—” আমরা বড়রা? তারমানে আপনি বড়দের মাঝে পড়ছেন না? আপনি ভীষণ ছোট বুঝি?”

শুভ্রতা বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো,

—” অবশ্যই ছোট। ভীষণ ছোট না হলেও সীমিত আকারের ছোট।”

শুভ্রতার মুখে এমন কথা শুনে হেসে ফেললো সাদাফ। সাদাফের হাসিতে খানিক বিব্রতবোধ করলো শুভ্রতা। বোকা বোকা গলায় বললো,

—” এতে হাসির কি হলো? আমি বুঝাতে চাইছিলাম যে, আমি মোটামুটি ধরনের ছোট।”

সাদাফ হাসি চেপে মজার ছলে বললো,

—” ও আচ্ছা, বুঝলাম। তো, কোন ক্লাসে পড়েন? না মানে, মোটামুটি ছোটরা তো সাধারণত ইন্টার ফাস্ট ইয়ার বা সেকেন্ট ইয়ারে পড়ে। আপনি কোন ইয়ার?”

—” সেকেন্ড ইয়ার।”

শুভ্রতার উত্তরে কেশে উঠলো সাদাফ। অবাক চোখে তাকালো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজের বিস্ময়টা চেপে নিয়ে বিরবির করে বলে উঠলো ,

—” সত্যিই? আপনাকে এতোটা ছোটও ভাবি নি আমি। মনে হচ্ছে বাল্যবিবাহ করে ফেলেছি।”

সাদাফের কথাগুলো বুঝতে না পেরে কপাল কুঁচকে বলে উঠলো শুভ্রতা,

—” জি?”

—” কিছু না। বলছিলাম, এবার সেকেন্ড ইয়ার হলে তো নেক্সট ইয়ার এক্সাম তাই না? পড়াশোনা কেমন চলছে? এইচএসসি এক্সামটা কিন্তু ক্যারিয়ারের ফার্স্ট পিলার। অল দ্যা বেস্ট।”

শুভ্রতা মুখ গোমরা করে বললো,

—” আমি বিবিএ সেকেন্ড ইয়ার।”

সাদাফ এবার অদ্ভুত চোখে তাকালো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মৃদু হেসে বললো,

—” নাও পার্ফেক্ট।”

—” মানে?”

সাদাফ উত্তর না দিয়ে বললো,

—“অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি। চলুন নিচে যাওয়া যাক। সবাই খুঁজছে হয়তো।”

কথা শেষ করে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো সাদাফ। দরজার কাছাকাছি গিয়ে একপাশে চেপে দাঁড়িয়ে শুভ্রতাকে যাওয়ার রাস্তা করে দিলো সে। শুভ্রতা সামনে সামনে হাঁটছে আর তার পেছনে হাঁটছে সাদাফ। সিঁড়ির লাইটগুলো হাতের ডানপাশে হওয়ায় দু’জনের ছায়াটা গিয়ে পড়ছে বামপাশের দেয়ালে। ছায়াতে দু’জনকে খুব কাছাকাছি দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে,দুটো মানুষ যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে ওই কালো প্রতিচ্ছবিটির আড়ালে। শুভ্রতা গভীর মনোযোগে ছায়াগুলো খেয়াল করছে। উঁচুনিচু সিঁড়ি পাড়ি দেওয়ার সময় মনে হচ্ছিলো দুটো ভালোবাসাময় আত্মা নেচে বেড়াচ্ছে ওই দেয়ালে। কথাগুলো ভেবে নিজে নিজেই চমকে উঠছিলো শুভ্রতা। মনের ভেতর চলা কথাগুলো সাদাফের কান পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে পড়ছিলো বারবার। মনকে একবার বকছিলো তো আবারও একই ভাবনায় মত্ত হচ্ছিলো। হঠাৎ করেই কারো ডাকে ঘোড় কাটলো শুভ্রতার,

—” শুভ্রতা? ঠিক আছেন? এভাবে দাঁড়িয়ে পড়লেন কেন? শুভ্রতা?”

শুভ্রতা হকচকিয়ে তাকালো। এসব ছাইপাঁশ ভাবতে গিয়ে কখন যে সিঁড়ির মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে পড়েছে খেয়ালই ছিলো না তার। ইশ! সাদাফ কি ভাবছে কে জানে? কথাগুলো ভেবে সাদাফের দিকে না তাকিয়েই এক দৌঁড়ে বাকি সিঁড়িগুলো পাড় করে ভেতরে ঢুকে গেলো শুভ্রতা। শুভ্রতার এমন অদ্ভুত আচরণে বেশ অবাক হলো সাদাফ। কিছুক্ষণ বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থেকে স্বাভাবিকভাবেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো সে। নিজের মনে সিঁড়ির বাকি ধাপগুলো পাড়ি দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো সে। ততক্ষণে কাবিনের শেষ কাজগুলোও সমাধা হয়ে গেছে প্রায়। সাদাফ ধীর পায়ে আরাফের পাশে সোফায় গিয়ে বসতেই মুখ ফুলিয়ে গো গো করে বলে উঠলো আরাফ,

—” কই গেছিলি তুই? ফ্রেন্ড হিসেবে আমার পাশে থাকাটা তোর বন্ধুগত কর্তব্য অথচ প্রয়োজনের সময়ই তুই নাই। তোর কোনো ধারনা আছে কতোটা নার্ভাস হয়ে পড়েছিলাম আমি? জীবনের প্রথম বিয়ে আমার অথচ তুই পাশে নাই….”

আরাফকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলো সাদাফ,

—” চিন্তা করিস না। তোর জীবনের প্রথম বাসর রাতে অবশ্যই তোর পাশে থাকবো আমি। বন্ধুগত কর্তব্যটা সেদিন পালন করবোই করবো। সেদিন তো তুই আরো বেশি নার্ভাস থাকবি। তাই না দোস্ত?”

আরাফ অসহায় চোখে তাকালো। সাদাফের এই অভ্যাসটা মোটেও ভালো লাগে না তার। আরাফ কিছু বললেই কথার মারপেঁচে তাকে থামিয়ে দেওয়াটা যেন সাদাফের চাই-ই চাই। সবসময় এমন করাটা কি সাজে সাদাফের? একটা দিনও কি চুপচাপ আরাফের কথাগুলো গিলে নিতে পারে না সে? আরাফ গম্ভীর মুখে বসে রইলো। যদিও জানে তাতে সাদাফের কোনো ভাবাবেগ হবে না তবুও গম্ভীর মুখে বসে রইলো সে। সাদাফ পাত্তা না দিলেও এই সময়ে মন খারাপ করাটা তার নৈতিক দায়িত্ব!

#চলবে…

(ছোট হয়েছে জানি। পরবর্তীতে বড় করে লেখার চেষ্টা করবো। আজ মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here