# আরশিযুগল প্রেম❤
# লেখিকাঃ নৌশিন আহমেদ রোদেলা ❤
# পর্ব- ১৩
—” দেখ, একদম পেঁচিয়ে কথা বলবি না। যা বলার ডিরেক্ট বল। কি চাই?”
—” তোকে।”
আরাফের কথায় চোখ বড় বড় করে তাকালো সাদাফ। সন্দেহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
—” কিহ? বিয়ে করার পর তোর মধ্যে গে টাইপ বৈশিষ্ট্য দেখা দিচ্ছে দেখছি।”
আরাফ তাড়াহুড়ো করে বললো,
—” আরে ধেৎ! ওসব কিছু নয়। তোর একটা হেল্পের প্রয়োজন, দোস্ত। মানা করিস না প্লিজ।”
সাদাফ এবার সোফায় গা এলিয়ে আরাম করে বসলো। নিচের ঠোঁট কামড়ে টিভির চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে বললো,
—” তোদের কি আমাকে হেল্পলাইন মনে হয়? যখন তখন হেল্প চাস। ”
আরাফ সোফায় একপা তুলে সাদাফের দিকে ঘুরে বসলো। আবেগী গলায় বললো,
—” এমন করিস কেন? তুই ছাড়া আর আমার কে আছে বল?”
সাদাফ টিভি থেকে চোখ সরিয়ে আরাফের দিকে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে বললো,
—” হইছে। আর সেন্টি খাইও না। কি হেল্প তাই বল।”
আরাফ এবার নড়েচড়ে বসলো। গলা খাঁকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে ভয়ে ভয়ে বললো,
—” পরশু শেফার ভার্সিটি থেকে ট্যুরে যাচ্ছে। তিন দিনের জন্য।”
সাদাফ কপাল কুঁচকে বললো,
—” তো? ট্যুরে যাচ্ছে ভালো কথা। এতে আমি কি করবো?”
আরাফ আমতা আমতা করে বললো,
—” না মানে। আসলে..”
সাদাফ এবার বিরক্তি নিয়ে তাকালো। কপালের রগ ফুলিয়ে বললো,
—” লাথি না খেতে চাইলে বনিতা না করে আসল কাহিনী বল। কি সমস্যা?”
—” শেফা ওর বাসায় পাঁচদিনের ট্যুরের কথা বলেছে।”
সাদাফ ভ্রু বাঁকিয়ে বললো,
—” কেন? বাকি দু’দিন তোর সাথে থাকবে নাকি?”
আরাফ এবার সরাসরি সাদাফের দিকে তাকালো। সাদাফের চোখে চোখ রেখে বললো,
—“আমাদের বিয়ের তো প্রায় একমাস হলো তবুও দু’জনে একসাথে কোথাও ঘুরতেও যেতে পারলাম না। ওর ফ্যামিলি বিশেষ করে ওর বড়চাচা রাজি হচ্ছেন না। উনার এক কথা বউ তুলে নিয়ে যাওয়ার পর যত ঘুরার ঘুরবে কিন্তু এখন দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ। বল তো? এটা কি ঠিক?”
সাদাফের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো। আরাফ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে বললো,
—” বউ কে নিয়ে ভাগতে চাইছিস নাকি? এটাই প্ল্যান?”
আরাফ মাথা দুলিয়ে বললো,
—” হু। পাঁচ দিনের জন্য। ওর ভার্সিটি থেকে ট্যুরে যাবে সিলেটে। আর ও ট্যুরের নাম করে পারমিশন নিয়ে আমার সাথে চলে যাবে বান্দরবান।”
সাদাফ টিভিটা অফ করে উঠে দাঁড়ালো। ডাইনিং টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে এক চুমুক পানি খেলো। গ্লাসটা টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বললো,
—” তো যা। তোর বউ তুই নিয়ে যাবি এতে এতো ভাবাভাবির কি আছে?”
আরাফ ঢোক গিলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। সাদাফ তার বেস্টফ্রেন্ড হলেও সাদাফকে মাঝে মাঝেই ভয় পায় আরাফ। তাছাড়া,এখন যে কথাটা বলতে চাইছে সেই কথাটা সাদাফের জন্য খুব একটা শ্রুতিমধুর নয়। আরাফ কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে নিয়ে বললো,
—” তুই আমাদের সাথে যাবি? প্লিজ?”
সাদাফ বিস্ময় নিয়ে বললো,
—” হোয়াট? পাগল তুই? তুই বউ নিয়ে হানিমুনে যাবি। সেখানে আমার কি কাজ?”
আরাফ আহত গলায় বললো,
—” লুকিয়ে লুকিয়ে যাচ্ছি তো তাই তেমন কনফিডেন্স পাচ্ছি না৷ তুই তো জানিস? আমি এন্ড মোমেন্টেগুলোতে উলোট পালোট কিছু করে ফেলি। এর আগে বান্দরবান মাত্র ১ বার গিয়েছি আমি। যদি ওখানে গিয়ে কোনো সমস্যায় পড়ি? শেফা সাথে থাকায় ভয়টা আরো বেশি। তাছাড়া কোনো কারণে বাড়িতে জানাজানি হলে আমি ব্যাপারটা সামাল না দিয়ে আরো গুলিয়ে ফেলবো। তুই সাথে থাকলে একটা ভরসা পাবো। প্লিজ দোস্ত। তোর তো বান্দরবানের নকশাও মুখস্থ। রাজি হয়ে যা না?”
সাদাফ মাছি তাড়ানোর মতো হাত নাড়িয়ে বললো,
—” ইম্পসিবল! বান্দরবান আহামরি কিছু নয় যে হারিয়ে যাবি। দরকার পড়লে গাইড নিয়ে নিবি বাট আমি যাচ্ছি না। তুই বউয়ের সাথে রোমাঞ্চ করে বেড়াবি সেখানে শালা আমি গিয়ে কি করবো? সেধে গিয়ে ইম্বারেসড হওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। তাছাড়া আমার অফিস আছে।”
আরাফ যুক্তি দেওয়ার মতো ভঙ্গি করে বললো,
—” তোর তো এমনিতেও একা একা পাহাড়ে ঘুরতে ভালো লাগে। আমাদের সাথে গেলে সেই প্রাইভেসিটা তুই পাচ্ছিস। আমরা তো শুধু হোটেল থেকে এদিক ওদিক ঘুরবো বাকিটা সময় তো তুই নিজের মতোই ঘুরে বেড়াতে পারবি। প্লিজ, দোস্ত।”
সাদাফ মুখ দিয়ে বিরক্তিদায়ক শিস তুলে বললো,
—” দেখ আরাফ, অযথা রিকুয়েষ্ট করিস না প্লিজ। তোদের সাথে এভাবে আমি….! দেখতে কেমন দেখায় না? তাছাড়া, আমি খুবই ইম্বারেস্ড ফিল করবো। অফিসও আছে। অযথা পাঁচ দিনের জন্য ছুঁটি নিতে পারবো না আমি। তোরা যা।”
আরাফ মুখ কালো করে বললো,
—” বন্ধুর জন্য ছুটি নেওয়াটা অযথা? তাছাড়া পাঁচদিন তো ছুটি নিতে হচ্ছে না তোকে। আজ তো ২৩ তারিখ। আমরা রওনা দিবো ২৫ তারিখ রাতের গাড়িতে। ২৬ মার্চ তো সরকারি ছুটি। আর ২৭, ২৮ হলো শুক্র-শনিবার। তুই শুধু ২৯ তারিখে ছুটিটা নিয়ে নে তাহলেই হবে। তুইও তো অনেকদিন পাহাড়ে যাস না। তিনদিন যখন একটানা ছুটি পাচ্ছিস তা কি ওয়েস্ট করা ঠিক হবে? চল না সাথে। তোর সব খরচও আমার যা।”
সাদাফ মৃদু হেসে বললো,
—” বেশ ভালো কনভেন্স করা শিখে গেছিস। ঢাকা থেকে বান্দরবান যেতে কি এমন খরচ পড়ে যে আমার খরচ উঠাতে চাইছিস তুই? ইডিয়ট।”
আরাফ বাঁকা চোখে তাকিয়ে বললো,
—” তারমানে তুই কনভেন্স হয়েছিস।”
সাদাফ হেসে বললো,
—” অলমোস্ট! ”
সাথে সাথেই সাদাফকে জাপ্টে ধরলো আরাফ। খুশি খুশি গলায় বললো,
—” লাভ ইউ দোস্ত!”
আরাফের পেটে ঘুষি দিয়ে তাকে সরানোর চেষ্টা করে বলে উঠলো সাদাফ,
—” সর। সর শালা। তোর চরিত্রে সমস্যা আছে নির্ঘাত। মাইয়াদের মতো কথায় কথায় গায়ে ল্যাপ্টাস কেন?”
—” কি যে কস বন্ধু। তুই যে খুশি দিছিস আমায় তার লাইগা তোরে একটা চুম্মা দিতে মন চাইতাছে। দিমু নাকি?”
আরাফকে দু’হাতে ঠেলে দিয়ে ভ্রু কুঁচকালো সাদাফ। কোমর বরাবর একটা লাথি বসিয়ে দিয়ে বললো,
—” তুই আসলেই গে বাট আই ওয়ান্ট আ মেয়ে। দূরে থাক।”
সাদাফের কথায় হেসে ফেললো আরাফ। সোফায় ধপ করে বসে গা এলিয়ে দিয়ে বললো,
—” আজ তুই যায় বলিস না কেন আই ডোন্ট মাইন্ড। বিরাট আনন্দ আনন্দ অনুভূতি হচ্ছে বন্ধু। আহহহহ….”
_________________
“বন্ধু তিন দিন
তোর বাড়িতে গেলাম
দেখা পাইলাম না
বন্ধু তিন দিন
গাঙ পাড় হইতে ছয় আনা
ফিরা আইতে ছয় আনা
গাঙ পাড় হইতে ছয় আনা
ফিরা আইতে ছয় আনা
আইতে যাইতে বারো আনা
উশুল হইলো না
বন্ধু তিন দিন
বন্ধু তিন দিন
তোর বাড়িতে গেলাম
দেখা পাইলাম না
বন্ধু তিন দিন”
জানালার গ্রিল ধরে বাইরে তাকিয়ে ছিলো শুভ্রতা। ছাঁদে শুভ্রব তার বন্ধুদের সাথে গানের আসর জমিয়েছে। তাদের গিটারের টুংটাং আর গানের আওয়াজটাই ঘুরেফিরে কানে এসে লাগছে শুভ্রতার। বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এক গাদা জামা কাপড়। তারপাশেই পড়ে আছে মাঝারি আকারের লাগেজ। কাল শেফার সাথে ট্যুরে যাচ্ছে সে। তার এই যাত্রা যতটা না নিজের ইচ্ছেই তার থেকে বেশি মা আর বড় খালামনির আগ্রহে। শুভ্রতার মার মাথায় একটা বদ্ধমূল ধারনা জন্মেছে যে, শুভ্রতা এই ঢাকা শহরে আটকে থাকতে থাকতে দিন দিন অসামাজিক এবং বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। আর তার এই অবস্থার উন্নতি একমাত্র ঢাকার বাইরেই সম্ভব। বড় খালামনির মহান উক্তি মতেই শেফার সাথে যেতে রাজি হতে হয়েছে তাকে। তবে, শেফা ব্যাপারটাই খুব একটা খুশি বলে মনে হচ্ছে না৷ যখন থেকে শুভ্রতাকে সাথে নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে তখন থেকেই চোখ-মুখ কুঁচকে মুখ ভার করে বসে আছে সে। কেন এমন করছে কে জানে? একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালায় পর্দা টেনে দিয়ে বিছানায় গিয়ে বসলো শুভ্রতা। প্রায় সাথে সাথেই কল করলো শেফা। ফোনটা রিসিভ করে হ্যালো বলার আগেই ওপাশ থেকে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে উঠলো শেফা,
—” এই শুভি? শোন..তোকে আমি একটা গোপন তথ্য দিচ্ছি। সো মাচ সিক্রেট বুঝলি? খবরদার কারো সামনে মুখ খুলবি না। ”
শেফার কথা শুনে মুখের ভেতর কিছুটা অম্লভাব হলো শুভ্রতার। বিরক্তি ভাব নিয়ে বললো,
—” আগে সিক্রেট কথাটা কি সেটা তো বলো।”
—” বলছি তো। বলার স্পেস না দিলে কি করে বলবো? কথার মাঝে কথা কাটবি না। চুপচাপ শোন।”
এটুকু বলে থামলো শেফা। শুভ্রতার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে বললো,
—” কথাটা হলো, আমরা ট্যুরে যাচ্ছি না। ”
শুভ্রতা অবাক হয়ে বললো,
—” যাচ্ছি না? আচ্ছা ঠিক আছে। আমি আম্মুকে বলে দিচ্ছি যে যাচ্ছি না।”
শেফা তাড়াহুড়ো করে বললো,
—” তুই আসলেই একটা গবেট। খালামনিকে যদি বলে দিতেই হয় তাহলে এটাকে টপ সিক্রেট বললাম কেনো শুনি? খালামনি আর আম্মুর জানামতে আমরা ট্যুরে যাচ্ছি কিন্তু আমাদের জানা মতে আমরা ট্যুরে যাচ্ছি না।”
শুভ্রতা ভ্রু কুঁচকে বললো,
—” মানে কি? বনিতা বন্ধ করে সরাসরি বলো তো। যাচ্ছি না আবার যাচ্ছি এসবের মানেটা কি?”
—” মানেটা খুব স্পষ্ট। আমরা ট্যুরে যাচ্ছি কিন্তু ভার্সিটি থেকে সিলেটে নয় বান্দরবানে।”
—” বান্দরবানে? কিন্তু কেন? আর ওখানে কি তুমি একা যাবে নাকি?”
শেফা বিরক্ত হয়ে বললো,
—” তুই খুব বেশি প্রশ্ন করিস। অতো দূরে আমি একা যাবো কেন? তোর ভাইয়া আছে না? তাছাড়া তুইও তো যাচ্ছিস।”
শুভ্রতা চেঁচিয়ে ওঠেও গলা নিচু করে নিয়ে বললো,
—” হোয়াট? তারমানে তুমি ট্যুরের নাম করে ভাইয়ার সাথে ঘুরতে যেতে চাইছো? মাই গড! আচ্ছা..বেশ। যেতে চাইলে যাও কিন্তু সাথে আমি কেন? আমি আম্মুকে বলছি আমি যাবো না। তোমাদের দু’জনের সাথে এক্সট্রা আমি। নো ওয়ে!”
শেফা রাগী গলায় বললো,
—” একদম বেশি বুঝবি না। যদিও তোকে নিয়ে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই। কিন্তু আমার মায়ের মতো মহিলা তোর এই হুট করে না যাওয়ার কারণটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঠিক বের করে ফেলবে। তাই অনিচ্ছা সত্যেও তোকে নিয়ে যেতেই হবে।”
শুভ্রতা কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
—” প্লিজ আপু। তোমরা হাজবেন্ড ওয়াইফ একসাথে টাইম স্পেন্ড করবে সেখানে আমি কিভাবে? নিজেকে খুব উটকো উটকো লাগবে। আর আমি একা একা ওখানে কি-ই বা করবো?”
শেফা দায় সারা গলায় বললো,
—” এতো টেনশন নিস না তো। আমি তো আছিই। আর তোর ভাইয়াও খুব ফ্রি মাইন্ডের। তাছাড়া, তোর জন্য আলাদা রুম তো বুক করা হবেই। বেশি খারাপ লাগলে নাহয় ঘুমিয়ে, টিভি দেখেই কাটিয়ে দিবি সময়। আমার জন্য এইটুকু তো করতেই পারিস বোন। প্লিজ..!”
আরো কিছু টুকিটাকি কথা বলে ফোন রাখলো শেফা। শুভ্রতা মুখ কালো করে বসে রইলো। নেক্সট চারটা দিন যে খুবই বাজে কাটতে চলেছে তা বেশ বুঝতে পারছে শুভ্রতা। এমনিতেই মন মেজাজ ভালো না তারওপর এমন উটকো ঝামেলা একদমই সহ্য হচ্ছে না শুভ্রতার। বিছানায় পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে নয়তো আরাফের সব চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। একমাত্র এই ছেলেটার জন্যই মনের এই বিধ্বস্ত হাল শুভ্রতার। এই ছেলেটার জন্যই এক্সিডেন্টলি বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হলো। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বারের মতো সাদাফের সাথে দেখা হলো। এখন আবার এই ট্যুর! শুভ্রতা বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে মুখ ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়লো। চোখ বুজে আগামী চারটি দিনের কথা ভাবতে লাগলো। কে জানে কতোটা বিরক্তির হবে সেই দিনগুলো!
__________________
ঘড়িতে দশটা বাজে। বাসস্ট্যান্ডের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে সাদাফ। গায়ে ছাই রঙের টি-শার্ট তারওপর সাদা-কালো চেইক শার্ট। শার্টের বোতামগুলো খোলা। টি-শার্টের গলায় ঝুলানো সানগ্লাস। পরনে হালকা ব্রাউন জিন্স এন্ড ব্ল্যাক কেডস্। পিঠে ঝুলানো ফুলে ফেঁপে ওঠা ট্রাভেল ব্যাগ। ডানহাতে জলন্ত সিগারেট। অন্ধকারে সিগারেটের আগুনটা তারার মতো মিটমিট করে ওঠানামা করছে। কিছুক্ষণ পরই দ্রুত পায়ে পাশে এসে দাঁড়ালো আরাফ। সাদাফ আড়চোখে তাকিয়ে বললো,
—” তোর বউ কই? ভাবি রে নিতেই না ভার্সিটির ওদিকে গিয়েছিলি?”
আরাফ হতাশ ভঙ্গিতে বললো,
—” আর বলিস না। আমার শশুড় মশাই নিজে এসেছেন মেয়েকে দিতে। আমি সামনে গেলেই তো এই সেই প্রশ্ন করতেন তাই সরে এসেছি। ওদের বাস ছাড়লে কিছুটা দূরে এসেই নেমে আসবে ওরা।”
সাদাফ ভ্রু কুঁচকে বললো,
—” দায়িত্বরত স্যাররা এতো সহজে আসতে দেবে? আটকাবে না?”
আরাফ মৃদু হেসে বললো,
—” বহুত মেহনতে ওসব ঠিকঠাক করেছি বস।”
সাদাফ বাঁকা হাসলো। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললো,
—” বউকে পেতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে তোকে।”
ওদের কথার মাঝেই অন্ধকার ভেদ করে গুটি গুটি পায়ে এদিকে এগিয়ে এলো দু’জন মেয়ে। ওদের দেখতে পেয়ে মুচকি হাসলো আরাফ। কিন্তু সাদাফের ভ্রু দুটো কুঁচকে এলো মুহূর্তেই। আরো একটু সামনে এগিয়ে সাদাফকে দেখতে পেয়ে থমকে গেলো শুভ্রতা। সাদাফও বিস্ময় নিয়ে দেখে চলেছে তাকে। শুভ্রতা আর সাদাফকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কথা বললো আরাফ,
—” ওহ্। শুভ্রতা যে যাচ্ছে তা তো তোকে বলাই হয়নি সাদাফ। আসলে আমিও কাল রাতেই জেনেছি তারপর আর মাথাতেই ছিলো না ব্যাপারটা। শুভ্রতাও জানো না নাকি কিছু?”
শুভ্রতা মাথা নাড়লো। সাদাফ আড়চোখে একবার শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে বললো,
—” বাস ছাড়ার টাইম হয়ে গেছে। চল জলদি।”
কথাটা বলে বাসের দিকে এগিয়ে গেলো সাদাফ। তার সাথে এগিয়ে গেলো আরাফও। শুভ্রতা-শেফা গুটি গুটি পায়ে ওদের অনুসরণ করলো। বাসে ওঠার আগমুহূর্তে শুভ্রতার হাত টেনে ধরে ফিসফিস করে বলে উঠলো শেফা,
—” এই শুভি? তোর সিটটা কিন্তু সাদাফ ভাইয়ের সাথে কাটা হয়েছে। একটু ম্যানেজ করে নিস কেমন? সাদাফ ভাই যে যাচ্ছে সেটা আমি আজ বিকেলে টিকেট কাটার সময় জেনেছি বুঝলি? তোর ভাইয়া নাকি বলতে ভুলে গিয়েছিলো। তবে একদিকে ভালোই হয়েছে, একজন সঙ্গী তো জুটলো তোর।”
শুভ্রতা জবাব দিলো না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাসে উঠে গেলো। ডান পাশের সারির প্রথম সিটটা আরাফদের আর বাম পাশের সারির চার নম্বর সিটটা সাদাফদের। সাদাফ সিটের পাশে হাত রেখে দাঁড়িয়ে ছিলো। শুভ্রতা কাছাকাছি আসতেই বললো,
—” আপনি কি জানালার পাশের সিটটায় বসবেন শুভ্রতা? না মানে…দূরের জার্নি তো যদি এপাশে বসে খারাপ লাগে তাই বলছিলাম।”
শুভ্রতা কিছু না বলেই জানালার পাশের সিটটায় বসে পড়লো। সাদাফ শুভ্রতার বিহেভিয়ারে খানিকটা অবাক হলো। শুভ্রতার লাগেজটা তুলে রেখে পাশের সিটটায় বসলো। শুভ্রতা মুখ ভার করে বসে আছে। শুভ্রতার মুখ-চোখের এই গোমট ভাবের অর্থটা বুঝতে পারছে না সাদাফ। শুভ্রতা কি অসুস্থ? সাদাফ মৃদু গলায় প্রশ্ন করলো,
—” আপনি কি অসুস্থ শুভ্রতা?”
শুভ্রতা জবাব দিলো না। সামনে থেকে শুভ্রতাকে উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে বলে উঠলো শেফা,
—” এই শুভি? তোর কেনা চাটনীগুলো তো আমার ব্যাগে। নিলি না?”
শুভ্রতা হালকা উঁচু গলায় বললো,
—” তোমার কাছেই রাখো। এখন আর নিতে ইচ্ছে করছে না।”
সাদাফ এবার সরাসরি শুভ্রতার দিকে তাকালো। তার কেন জানি মনে হতে লাগলো শুভ্রতা শুধু তার সাথেই কথা বলছে না। অথবা, বলতে চাইছে না। কিন্তু কেন? শুভ্রতা কি কোনো কারণে রেগে আছে তার উপর? এই প্রশ্নটা নিজের কাছেই ভীষণ অদ্ভুত লাগলো সাদাফের। শুভ্রতার সাথে তো ঠিকঠাক দেখাই হয় নি তার। তাহলে রাগ হওয়ার প্রসঙ্গটাই আসছে কিভাবে? তবুও মুখ কাঁচুমাচু করে দ্বিধাভরা কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
—” আপনি কি কোনো কারণ আমার ওপর রেগে আছেন শুভ্রতা?”
সাদাফের প্রশ্নে শুভ্রতা এমনভাবে তাকালো যেন প্রশ্নটা করে মরাত্মক রকম অন্যায় করে ফেলেছে সাদাফ। শুভ্রতার চাহনীতে খানিকটা দ্বিধার মাঝে পড়ে গেলো সাদাফ। শুভ্রতার এমন আচরণের কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণই যেন খুঁজে পাচ্ছে না সে। কি তার অপরাধ?
#চলবে…