# আরশিযুগল প্রেম
# লেখনীতে — নৌশিন আহমেদ রোদেলা
#পর্ব — ৩৭
রুম্পি লাল ফ্রক গায়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। হাতে মস্ত একটা কাগজ। শুভ্রতা কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে থেকে মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়ল। হাতের ইশারায় রুম্পিকে ভেতরে আসতে বলে বলল,
—-” কি ব্যাপার, রুম্পি বেগম?”
রুম্পি বড় বড় চোখ মেলে শুভ্রতার দিকে তাকাল। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাতের কাগজটা শুভ্রতার দিকে এগিয়ে দিল। শুভ্রতা ভ্রু কুঁচকে কাগজটার দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ কাগজে চোখ রেখে বিস্ময় নিয়ে বলল,
—-” এটা আমি?”
রুম্পি ঠোঁট টিপে হাসল। শুভ্রতা বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
—-” পাশের ছেলেটা কে?”
—-” এটা ওই লম্বা করে ভাইয়াটা। তোমরা বুঝি প্রেম কর?”
রুম্পির কথায় চমকে উঠল শুভ্রতা। কাগজটার দিকে আরেক নজর তাকাতেই খেয়াল করল ছেলেটার গায়ে নীল-সাদা রঙের জামা আঁকা। সাদাফ যে শার্টটা পড়েছিল ঠিক সেরকম। শুভ্রতা চোখ বড়বড় করে বলল,
—-” কোন লম্বা ভাইয়াটা?”
রুম্পি গা দুলিয়ে দুলিয়ে হাসল। বলল,
—-” তোমরা দু’জন হাত ধরে হাঁটছিলে, আমি দেখেছি। আমি তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে টুনিকে খাওয়াচ্ছিলাম। টুনিও দেখেছে। কি সুন্দর দেখতে। সে তোমার বয়ফ্রেন্ড,না?”
শুভ্রতা তাড়াহুড়ো করে রুম্পির মুখ চেপে ধরল। ফিসফিস করে বলল,
—-” এই কথাগুলো একদম বাইরে কাউকে বলবি না। তুই যদি মামু-মামিকে না বলিস তাহলে তোকে অনেকগুলো চকলেট কিনে দেব, ওকে?”
রুম্পি হেসে বলল,
—-” আমাদের ক্লাসের নন্দিতাও প্রেম করে। আমি কাউকে বলি না। তোমার আর লম্বা ভাইয়ারটাও কাউকে বলব না।”
শুভ্রতা বিস্ফারিত চোখে তাকাল। দশ বছরের বাচ্চার মুখে ‘প্রেম’ ‘প্রেম’ শুনেই মাথা ঘুরছে তার। শুভ্রতা হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করল। সচেতন গলায় বলল,
—-” তুই প্রেমও বুঝিস?”
রুম্পি অবাক হয়ে বলল,
—-” কেন বুঝব না? আমাদের ক্লাসে অনেকেই তো প্রেম করে। একসাথে আইসক্রিম খায়। তারপর চিঠি দেয়।”
রুম্পির কথায় শুভ্রতা যেন চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেল। বিস্ময়ে চোয়ালটা সামনের দিকটা ঝুলে পড়ল তার। হঠাৎ করেই শুভ্রতা কোন কথা খুঁজে পেল না। রুম্পি উৎসাহ নিয়ে বলল,
—-” তুমি ওই লম্বা ভাইয়াকে বিয়ে করবে শুভিদি?”
শুভ্রতা অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল,
—-” হু।”
—-” কিন্তু তোমায় তো ফারদিন ভাইয়া বিয়ে করবে। তাহলে ওই লম্বা ভাইয়াটা কাকে বিয়ে করবে? অন্য একটা আপুকে?”
শুভ্রতা ভ্রু কুঁচকে বলল,
—-” আমাকে তোর ফারদিন ভাইয়া কেন বিয়ে করবে?”
রুম্পি খানিকক্ষণ ভাবল। তারপর ঠোঁট উল্টে বলল,
—-” জানি না তো। তুমি ওই লম্বা ভাইয়াটাকে কেন বিয়ে করবে?”
—-” তোর লম্বা ভাইয়াটা অনেক ভালো। আমাকে খুব আদর করে তাই… ”
রুম্পি উৎফুল্ল হয়ে বলল,
—-” তুমিও তো অনেক ভালো শুভিদি। তুমি আমায় কত্ত আদর কর তাই ফারদিন ভাইয়া তোমায় বিয়ে করবে। ফারদিন ভাইয়াও খুব ভালো। আমাকে সেদিন পাঁচটা আইসক্রিম কিনে দিয়েছিল।”
শুভ্রতা ভ্রু কুঁচকে বলল,
—-” তোর ওই লম্বা ভাইয়াটা ভালো না?”
—-” ভালো তো। কি সুন্দর হাসে!”
—-” আমি তোর লম্বা ভাইয়াকেই বিয়ে করব। তাহলে সে তোকে শুধু পাঁচটা নয় এত এত আইসক্রিম, চকলেট কিনে দেবে।”
রুম্পি চিন্তিত গলায় বলল,
—-” কিন্তু বাবা যে বলে…. ”
রুম্পির কথার মাঝেই দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন রাইসুর সাহেবের স্ত্রী। গাঢ় গলায় বললেন,
—-” শুভি-রুম্পি? জলদি খেতে এসো। বাবা টেবিলে অপেক্ষা করছেন।”
রুম্পি তার বাকি কথাটা শেষ না করেই দৌঁড়ে বেরিয়ে গেল। শুভ্রতাও কাগজে আঁকা ছবিটিতে বার কয়েক চোখ বুলিয়ে নিয়ে খাবার রুমের দিকে পা বাড়াল।
নিশ্চুপ খাবার টেবিলে রাইসুর সাহেবের স্ত্রীর চাপা ধমকগুলোই ঘুরেফিরে বাজছিল। রুম্পিকে খাওয়া নিয়ে মাঝেমাঝেই চোখ রাঙিয়ে ধমকে উঠছেন তিনি। রাইসুর সাহেব মাঝেমাঝে স্ত্রীর দিকে বিরক্ত মুখে তাকিয়ে আবারও খাবারে মনোযোগী হচ্ছেন।
—-” আমি পরশুই ঢাকায় ফিরব মামু।”
শুভ্রতার কথায় মুখ তুলে তাকালেন রাইসুর সাহেব। রাইসুর সাহেবের স্ত্রী আহ্লাদী গলায় বললেন,
—-” সে কি? প্রায় একবছর পর এলে, দু’দিনেই চলে যাবে? আর ক’টা দিন থাকো। সামনের সোমবার নাকি ফারদিনের জন্মদিন। রুম্পিকে নিয়ে ঘুরতে বেরুবে তুমিও সাথে যাবে না’হয়। শহর ঘুরাও হয়ে যাবে।”
শুভ্রতা তাড়াহুড়ো করে বলল,
—-” না না মামি। আসলে আমার শরীরটা একটু খারাপ লাগছে। তাছাড়া ভার্সিটিতেও ইম্পোর্টেন্ট ক্লাস আছে। পারলে কালই চলে যেতাম কিন্তু শরীরের কথা চিন্তা করে….”
এতোক্ষণ মনোযোগ দিয়ে শুভ্রতার বলা কথাগুলো শুনলেন রাইসুর সাহেব। ভারী গলায় বললেন,
—-” বেশ তো। আমারও কাল-পরশু ঢাকা যাওয়ার প্রয়োজন ছিল। তুমি যেহেতু অসুস্থ ফিল করছ তাহলে তোমাকে আর একা ছাড়া চলে না। আমি যেহেতু যাচ্ছিই তো তুমি আমার সাথেই যাবে। আমি বরং পরশু দিনের দুটো টিকেট কাটি।”
শুভ্রতা ইনিয়ে বিনিয়ে হাজার কথা বললেও রাইসুর সাহেবের মত পরিবর্তন হল না। খাওয়া শেষে সাদাফকে ফোন করে এক দফা কান্নাকাটিও সারলো সে। সাদাফের কথায় কান্না থামলেও সারারাতই মন খারাপ করে বসে রইল শুভ্রতা। পরের দুটো দিন শুভ্রতা রুমের দরজায় খুলল না। ‘আমি অসুস্থ’ বলেই সারাদিন বন্ধ ঘরে বসে রইল। শুভ্রতাকে নিয়ে বেরুবে বলে ফারদিন বার দুই এ বাড়িতে এলেও শুভ্রতার শরীর খারাপের বাহানাকে পুঁজি করে ব্যর্থ হয়েই ফিরতে হল তাকে। সাদাফের সাথে ফোনালাপ আর ঘুম দিয়েই কেটে গেল বাকি দু’দুটো দিন। অনেক চেষ্টা করেও মামুর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না করতে পেরে অগত্যায় মামুর সাথে বাসে উঠতে হল তাকে। বাসস্ট্যান্ডে ফারদিনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই মেজাজটা চটে গেল শুভ্রতার। বাস ছাড়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত ফারদিনের এটা ওটা নিয়ে গল্প করাটা একদমই পছন্দ হল না তার। বাস ছাড়ার পর মুহূর্তে ফারদিনের বিদায় সম্ভাষণ শুনে তাকে বাসের নিচে চেপে মারার এক পৈশাচিক ইচ্ছেকে দমন করে মৃদু হাসল শুভ্রতা। রাতের অন্ধকারকে চিরে দিয়ে উদ্যম গতিতে ছুটে চলেছে ঢাকাগামী বাস। শুভ্রতার রেশমী চুলগুলো বাতাসের তোড়ে এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। রাতের আকাশটা কালো মেঘে ঢেকে গিয়ে মাঝে মাঝেই দমফাঁটা শব্দে গর্জে উঠছে। বিদ্যুৎ চকমকানো আলোয় থেকে থেকেই জ্বলজ্বল করে উঠছে শুভ্রতার চকচকে ছোট নাকফুল। শুভ্রতা বাসের সিটে গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করল। সেদিন রাতেও ঠিক এভাবেই বাতাসের ঝাপ্টা লাগছিল তাদের গায়ে। শুভ্রতা-সাদাফ কতশত পাগলামোই না করেছিল সেদিন!
—-” বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছে। ভীষণ ইচ্ছে করছে। সারা শরীরে বৃষ্টি ছুঁয়ে গেলে দারুণ হবে তাই না?”
শুভ্রতার কথায় কোল থেকে মুখ উঠিয়ে তাকাল সাদাফ। ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
—-” আর আমি ছুঁয়ে দিলে?”
শুভ্রতা ভ্রু কুঁচকাল। সাদাফের বাহুতে হালকা চড় বসিয়ে বলল,
—-” একদম বাজে কথা বলবে না। আমি সিরিয়াস!”
সাদাফ হাসল। শুভ্রতা উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,
—-” আমরা যদি ট্রেনের ছাদে চড়ে ভ্রমণ করতাম তাহলে কেমন হত? বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ট্রেন জার্নি। আহা!”
শুভ্রতার এমন কথায় সরু চোখে তাকাল সাদাফ। হুট করেই উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বলল,
—-” চলো।”
শুভ্রতা অবাক হয়ে বলল,
—-” কোথায়?”
—-” ট্রেনের ছাঁদে। বউকে বৃষ্টিবিলাস করাব।”
শুভ্রতা চোখ বড়বড় করে তাকাল। বিস্ময় নিয়ে বলল,
—-” পাগল হয়েছ তুমি? চলন্ত ট্রেন থেকে ছাঁদে ওঠা সম্ভব নাকি? আর ওটা তো কথার কথা ছিল।”
সাদাফ গম্ভীর গলায় বললে,
—-” তুমি চল তো।”
—-” কিন্তু…”
সাদাফ নিচু হয়ে আঙ্গুল দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে বলল,
—-” একদম চুপ। বলেছিলাম না? আমার শুভ্রাণী চাইলে সব সম্ভব।”
শুভ্রতা অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। সাদাফ শুভ্রতার হাতটা নিজের হাতে টেনে নিয়েই কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। ট্রেনের মূল দরজার ঠিক সামনে গিয়ে দাঁড়াল ওরা। ট্রেনের খোলা দরজার একদম পাশ ঘেঁষে দাঁড় করিয়ে দুহাতে শুভ্রতার কোমর চেপে ধরল সাদাফ। শুভ্রতাকে আরো একটু সামনের দিকে এগিয়ে দিতেই উলোটপালোট বাতাসে উড়তে লাগল শুভ্রতার নীলরঙা শাড়ির আঁচল, রেশমি চুল। বৃষ্টির বড় বড় ছাঁটে ভিজতে লাগল শুভ্রতার সারা অঙ্গ। সাদাফ ধীরে ধীরে শুভ্রতার ঘাড়ে মুখ গুজল। উড়ন্ত চুলে নাক ডুবিয়ে বলল,
—-” নিজেকে হাওয়ায় ভাসিয়ে দাও শুভ্রা। তোমাকে আঁকড়ে রাখার জন্য আমি তো আছি।”
সাদাফের গরম নিঃশ্বাস শুভ্রতার ঘাড়ে আছড়ে পড়তেই কেঁপে উঠল শুভ্রতা। দু’হাত বাড়িয়ে দিয়ে হাতের খাঁজে বৃষ্টি জমালো। বাতাসের তালে নিজেকে ছেড়ে দিতেই মনে হল সে যেন উড়ছে। মেঘকন্যারা বৃষ্টি হয়ে তাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। বৃষ্টির ছোঁয়ার প্রখরতার সাথে সাথেই প্রখর হতে লাগল সাদাফের উষ্ণ হাতের ছোঁয়া। বাতাসের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে কাঁপিয়ে দিতে লাগল প্রতিটি অঙ্গ, প্রতিটি লোমকূপ।
—-” শুভি মা? শুভি মা?”
মামুর হঠাৎ ডাকে চোখ মেলে তাকাল শুভ্রতা। সাদাফকে ভাবতে ভাবতে চোখদুটো অনেকটাই লেগে এসেছিল তার। প্রথম দিকটাই কিছু বুঝতে না পেরে চোখ পিটপিট করে তাকাল শুভ্রতা। রাইসুর সাহেব তাড়া দিয়ে বললেন,
—-” জানালাটা লাগাও মা। ভিজে যাচ্ছ তো।”
শুভ্রতা মামুর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মাথা নাড়ল। মাথাটা ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার। মন-শরীর জুড়ে সাদাফ নামক রোগটা যেন বুক ফুলিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। বার বারই চিৎকার করে বলছে, সাদাফ চাই, সাদাফকেই চাই।
____________________
ঢাকায় ফেরার পর দেখতে দেখতেই কেটে গেল প্রায় একটা মাস। সাদাফের সাথে খুনশুটি, নিস্তব্ধ নদীর পাড়ে উত্তাল প্রেম। ধানমন্ডি লেক, রবীন্দ্র সরোবর সব জায়গাতেই প্রেমময় স্মৃতি ফেলেই কেটে গেল পুরো বর্ষা! ধীরে ধীরেই ঘনিয়ে এলো আনিমুল হকের দেশে ফেরার দিন।
#চলবে…..