গল্প:- সি অফ মারমেইড
লেখনীতে:- যাবেদ খাঁন আবু বকর
ষোড়শ পর্ব
উনপঞ্চাশ.
চৈতন্য ফিরে পেতেই পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায় যুবরাজ রন ইওহার্ড। চোখ মেলে রাখতে পারছে না। বহু কষ্ট হচ্ছে তার। মাথাটা যেন ব্যথায় টনটনে হয়ে আছে। যুবরাজ রন ইওহার্ড চোখ মেলতেই চোখমুখে হাসি ফুটে ওঠে রাজকুমারী ডায়ানার। যেন এতক্ষণ তার প্রাণপাখী খাচায় আবদ্ধ ছিল না। ভালোবাসাকে হারানোর ভয়টা কেবল তারই থাকে, যে ভালোবাসে! রানি নিয়ানো নিজেও হতভম্ব হয়ে গেছেন নিজের মেয়ের খুশি দেখে। তবে কী যেন ভেবে হাসি দিলেন তিনি! কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই রাজকুমারী ডায়ানার। যুবরাজ রন ইওহার্ড কিছুক্ষণ পরপর চোখ মেলে এবং সাথে সাথে বুজিয়ে নেয়। অনুভব করে সমস্ত শরীর যেন ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। কিন্তু মুখ থেকে কোনো বুলি বের করতে সক্ষম নন। কিছু সময় এভাবেই অতিবাহিত হয়ে যায়।
চোখ বন্ধ অবস্থাতেই আছে যুবরাজ। বেশখানিকটা সময় অতিবাহিত হবার পর পুনরায় আস্তে আস্তে চোখের পাপড়িগুলো নাড়িয়ে চোখ মেলে তাকায়। চোখ দুটো গাড় নীল বর্ণের! ডান গালের উপর এবং চোখের থেকে কিছুটা দূরে লাল হয়ে আছে। ক্ষত সৃষ্টি না হলেও এখানে যে আঘাত পেয়েছে তা বুঝাতে সক্ষম। এবং বাম গালের মধ্যভাগে লাল হয়ে থাকার পাশাপাশি একটি লম্বাটে স্থান নিয়ে চামড়া চিঁড়ে গেছে। দেহের রঙ দুধে আলতা বললেও কম হবে না। একজন সুন্দরী মেয়ের সাথে ফরসা ত্বকের জন্য প্রতিযোগিতা করলে হয়তো যুবরাজ রন ইওহার্ড জিতে যাবে। তার মতো এরকম সুদর্শন পুরুষ দেখতে খুব একটা পাওয়া যায় না। তার সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে নীল বর্ণের চোখ দুটো। যা যে কোনো নারীকে দুর্বল করে দিতে সক্ষম। তাছাড়া ধবধবে সাদা ফরসা ত্বকের সাথে নীল বর্ণের চোখজোড়া বেশ মানিয়েছে। বুকের উপর ক্ষত চিহ্নগুলো থেকে এখন আর রক্ত গড়িয়ে না পড়লেও ক্ষতের চারপাশ লাল হয়ে আছে। ক্ষত চিহ্নগুলো বিদায়ের পথে। এর কারণস্বরূপ বলা যায় ঔষধের প্রভাব। তবে ঔষধগুলো ক্ষত চিহ্নগুলোকে নিশ্চিহ্ন করতে পারলেও আঘাতের তীব্র যন্ত্রণা থেকে বিরত রাখতে পারেনি।
যুবরাজ রন ইওহার্ড চোখ মেলে তাকাতেই কক্ষের উপর দিকে দৃষ্টি পড়ে। উপরে ঝুলে আছে মোমবাতি জাতীয় আধুনিক ঝাড়। ঘাড়টা ডান দিকে ঘুড়াতে নেয়। বহু কষ্ট হচ্ছে তবু নিজের উপস্থিতি বুঝতে ঘাড়টা সামান্য কাত করতেই কক্ষের ডান পাঁচিলে দৃষ্টি পড়ে। দৃষ্টির গোচর হয় কারু খচিত চিত্রকর্ম। অবশ্য কারু খচিত চিত্রকর্ম নজরে আসার আগে কেউ একজনের চেহারা সামনে পড়েছিল। কিন্তু তা তার কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি। কক্ষটা মোমবাতি ধরণের ঝাড়ের আলোতে আলোকিত হয়ে আছে। আলোকিত হবার অন্যতম কারণ হচ্ছে, সুরক্ষা কবচে শোষিত আলোর থেকে সামান্য আলো রাজপ্রাসাদের কক্ষগুলোতে লাগানো হয়েছে। চিত্রকর্ম এবং আলোকিত হওয়া দেখে বুঝতে সক্ষম হয় এটা তার জন্য বরাদ্দকৃত নিজস্ব কক্ষ। ডান দিক থেকে সামান্য ঘাড় ঘোরাতেই দৃষ্টিতে দৃশ্যমান হয় রাজকুমারী ডায়ানার মায়া মাখা মায়াবী মুখখানা। চোখের কোটরে অশ্রুজল দেখে বুঝতে বেশি সময়ের প্রয়োজন হয় না যে, রাজকুমারী ডায়ানা কাঁদছিল।
রাজকুমারী ডায়ানা এবং যুবরাজকে একান্ত সময় অতিবাহিত করতে দেওয়া প্রয়োজন ভেবে রানি নিয়ানো বিছানায় বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। রাজকুমারী ডায়ানাকে লক্ষ্য করে বাক্য বিনিময়ে বললেন,
‘ তাহলে তোমরা কথা বলো। আমি আসছি। ‘ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কক্ষ থেকে প্রস্তান করতে চাইছেন তিনি। তার কণ্ঠস্বর শুনে শব্দের উৎস অনুভব করতে শুরু করে। ঘাড়টা কষ্ট করে বাম দিকে নিতেই দৃষ্টিতে আসে রানি নিয়ানোর চেহারা। ভেবে হতবাক হয়ে যায় যুবরাজ রন ইওহার্ড।’ রানি নিয়ানো এতক্ষণ তার কক্ষেই ছিল!’
রানি নিয়ানোর কথায় সম্মতি প্রদান করে বলল রাজকুমারী ডায়ানা ,
‘ যথা আজ্ঞা মহারানি। ‘ কণ্ঠের আড়ালে চাপা পড়ে আছে প্রফুল্লতা। যেন রানি নিয়ানোর এ ব্যবহার তাকে বেশ তুষ্ট করেছে।
রাজকুমারী ডায়ানার সম্মতি পেয়ে মেঝেতে দাঁড়িয়ে না থেকে দ্রুত পায়ে হেঁটে কক্ষের প্রবেশদ্বারের কাছে চলে আসেন রানি নিয়ানো। প্রবেশদ্বারে দুইবার টোকা দিতেই ওপাশ থেকে একজন প্রহরী প্রবেশদ্বারের পাল্লা খুলে দেয়। তাৎক্ষণিক সময়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে রানি নিয়ানো কক্ষ ত্যাগ করতেই প্রহরীটি পুনরায় প্রবেশদ্বারের পাল্লাগুলো টেনে কক্ষটি আবদ্ধ করে দেয়।
রাজকুমারী ডায়ানার চোখের কোনে এখনো অশ্রুজলের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। রানি নিয়ানো কক্ষ ত্যাগ করতেই ডান দিকে ঘাড় ফিরিয়ে নেয় যুবরাজ। দৃষ্টির গোচরে আসে রাজকুমারী ডায়ানার দুই চোখের কোণে চিকচিক করছে অশ্রুসিক্ত লোচন। ডায়ানাকে এভাবে কাঁদতে দেখে হতবিহ্বল হয়ে যায় সে। বহু কষ্টে বাকযন্ত্রর সাহায্য দুই ঠোঁট কাঁপিয়ে মৃদু কণ্ঠস্বরে প্রশ্ন তুলে দিল যুবরাজ রন ইওহার্ড।
‘ ডায়ানা, তুমি কাঁদছ কেন? আমার তো তেমন কিছুই হয়নি। কেবল কিছু সময়ের জন্য চৈতন্য হারিয়ে ফেলেছিলাম। ‘ কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে প্রশ্ন করল যুবরাজ। এখনো পুরোপুরিভাবে সে সুস্থ নয়, এটাই তার একমাত্র প্রমাণ!
এবার রাজকুমারী ডায়ানার কান্নার বেগটা আরও বৃদ্ধি পেল। এতক্ষণ বহু কষ্টে চেপে রাখতে সক্ষম হলেও এখন আর সম্ভব হয়নি। এরকম পরিস্থিতিতে নিজেকে অনুভব করে সম্পূর্ণরূপে বিচলিত হয়ে যায় যুবরাজ রন ইওহার্ড। তবু রাজকুমারীকে সামাল দিতে দেহে আঘাতের ফলে ব্যথা নিয়েই শোয়া থেকে উঠে বসার চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যথার রেশ অধিকতর হওয়ার দরুন উঠে বসতে ব্যর্থ হয়। তাকে নড়াচড়া করতে দেখে তাৎক্ষণিক সময়ে নিজের কান্না থামিয়ে প্রশ্ন করে রাজকুমারী,
‘ কী হয়েছে যুবরাজ? খুব বেশি ব্যথা করছে আপনার? রাজ বৈদ্যকে ডাক দেবো?’ উৎকণ্ঠা হয়ে প্রশ্ন করে রাজকুমারী ডায়ানা। যুবরাজ রন ইওহার্ডের ব্যথায় সেও ব্যথিত!
রাজকুমারীর এরকম একের পর এক প্রশ্ন শুনে মৃদুস্বরে হেসে দেয় যুবরাজ রন ইওহার্ড। দুই ঠোঁটের কোণে একটি মুচকি হাসি তুলে বলতে লাগে,
‘ আমি তো আগেও বলেছি আমার কিছু হয়নি। এত অস্থির হবার কিছু নেই। ‘ রাজকুমারী ডায়ানাকে স্বাভাবিক রাখতে আস্বস্ত করল যুবরাজ। তবে এবার আর উৎকণ্ঠা হয়ে নয়, বরং অভিমান নিয়ে প্রত্যুত্তর করল রাজকুমারী ডায়ানা।
‘ হ্যাঁ! আর কিছু হলেই-বা আমার কী? আমার খবর কেউ রাখে নাকি? ‘ অভিমানী কন্ঠস্বরে ব্যক্ত করল রাজকুমারী ডায়ানা। একরাশ চাপা রাগের প্রকাশ পাচ্ছে দুটি বাক্যের মাঝে। রাজকুমারী ডায়ানাকে স্বাভাবিক করতে সাধারণ কণ্ঠস্বর ফুটিয়ে বলল যুবরাজ রন ইওহার্ড।
‘ কে বলেছে কেউ রাখে না? আমি আছি না! আমি রাখি তো! ‘ ওষ্ঠধর ফাঁকা না রেখে পুনরায় একটি হাসি দিয়ে প্রত্যুত্তর করল যুবরাজ। তার হাসিতে লেগে আছে আস্বস্ত করার নেশা।
কক্ষে মুহূর্তেই নেমে এলো নীরবতার রাজত্ব। নীরবতার রাজত্বে রাজকার্যে ব্যাঘাত ঘটিয়ে প্রশ্ন রাখল রাজকুমারী।
‘ আচ্ছা! আপনাকে আক্রমণ করেছিল কে? আর এরকম আঘাতপ্রাপ্ত হলেন কী করে?’ আকুলিত হয়ে প্রশ্ন করল। সাথে লেগে ছিল চাপা রাগ। আক্রমণকারীকে সামনে পেলে হয়তো ভয়ানক কিছু ঘটে যেতে পারে।
এতটুক প্রশ্ন করতেই যুবরাজের মস্তিষ্কে পুরোনো ঘটনাগুলো একের পর এক দৃশ্যমান হচ্ছে। কোনো কথা না বলে ভাবনার ঘোরে এক দৃষ্টিতে কক্ষের উপর দিকে তাকিয়ে আছে। তা দেখে খানিকটা থমকে যায় রাজকুমারী। হঠাৎ করে তারই-বা কী হলো ভেবে পাচ্ছে না! আর এরকম আচরণই-বা করছে কেন? সকল ভাবনা চিন্তার অবসাদ ঘটিয়ে রাজকুমারী ডায়ানার প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে বলল যুবরাজ,
‘ সেনাপতি রিবিয়ান! ‘ অনুভূতি শূন্য অবস্থায় প্রশ্নের জবাব প্রদান করল সে। জবাবে না আছে রাগ না আছে কৌতূহল!
আচমকা এরকম প্রশ্নের উত্তরে থমকে যায় রাজকুমারী। কী বলল যুবরাজ! সেনাপতি রিজওনাল তার গায়ে আঘাত করেছে! এতটা আস্পর্ধা হয়ে গেছে তার! একজন যুবরাজের উপর আক্রমণ করতে সাহস পায় কী করে! আকস্মিকভাবে তার মনে পড়ে যায় কিছু মুহূর্ত পূর্বের কথা। একজন রক্ষী কক্ষে এসে জানিয়ে গিয়েছিল, ‘ সেনাপতি রিবিয়ান দেহের অবস্থা খুব বেশি একটা ভালো নয়। গুরুতর আহত অবস্থায় রাজপ্রাসাদের অতিথিশালায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ‘ কথাটি মাথায় আসতেই চট করে পুনরায় কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করে রাজকুমারী,
‘ কিছুক্ষণ পূর্বে একজন রক্ষী এসে জানায় সেনাপতি রিবিয়ান গুরুতরভাবে আহত হয়ে। তবে আপনার উপর আক্রমণ চালায় কী করে? আর তার উপরেই-বা আক্রমণ করেছে কে?’ কণ্ঠের মাঝে উদ্বিগ্নতা ভাব ফুটন্ত। জানার জন্য প্রবল ইচ্ছে শক্তির উপস্থিতি রয়েছে।
প্রত্যুত্তরে ঝটপট জবাব দিল যুবরাজ রন ইওহার্ড।
‘ সেনাপতি রিজওনাল আমাকে প্রথম আক্রমণ করে এবং আহত করে। পরবর্তীতে আমি যখন পালটা আক্রমণ চালাই, তখন সেনাপতি আমার আক্রমণের ঘাতে গুরুতর আহত হয়।’ স্বাভাবিক স্বর ফুটিয়ে জবাব দেয় যুবরাজ। তার মাঝে কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি।
‘ আপনি গিয়েছিলেন যুদ্ধ প্রশিক্ষণ প্রান্তরে! তবে সেখানে সেনাপতি রিবিয়ান এলো কী করে?’ জানতে চেয়ে প্রশ্ন করল রাজকুমারী ডায়ানা। তার জানতে চাওয়া অবুঝ মন থেকে যেন একেরপর এক প্রশ্ন খুটিয়ে খুটিয়ে বেরিয়ে আসছে। যতক্ষণ পর্যন্ত পুরো ঘটনা সম্পর্কে অবগত না হবে, ততক্ষণ তার মাঝে শান্তি মিলবে না।
এবার যুবরাজ খানিকটা বিরক্ত। বিরক্তিমাখা কণ্ঠস্বর ভাব ফুটিয়ে বলতে লাগল যুবরাজ,
‘ আচ্ছা, এখন এসকল আলাপ-আলোচনা রাখি। পরে একসময় করা যাবে। ‘ কণ্ঠের আড়ালে চাপা পড়ে আছে ভীষণ বিরক্তি ভাব।
যুবরাজের কথা শুনে দ্বিতীয় আর কোনো প্রশ্ন করেনি রাজকুমারী ডায়ানা। চুপ করে বসে থাকতে দেখে যুবরাজ বিছানার উপরে রাখা রাজকুমারীর ডান হাত নিজের ডান হাত দিয়ে আকড়ে ধরে আচমকা টান দেয়। আকস্মিক ঘটনায় কিছুই বুঝতে পারল না রাজকুমারী। দেহের টাল সামলাতে না পেরে যুবরাজের বুকের উপর আছড়ে পড়ে রাজকুমারী। বুকে ব্যথা অনুভব হবার পরেও বুকের উপর থেকে রাজকুমারী উঠে যাবার আগেই যুবরাজের তার ব্যথাযুক্ত হাত দিয়ে জাপটে ধরে। বুকের উপর থেকে উঠে যাবার জন্য ছোটাছুটি করলেও লাভ হয় না রাজকুমারী। বরংচ উলটো ব্যথা অনুভব করে যুবরাজ। শেষে হার মেনে যুবরাজের বুকের উপর আধশোয়া অবস্থায় রইল রাজকুমারী ডায়ানা।
পঞ্চাশ.
কক্ষের মঝে নীরবতার রাজত্ব। নীরবতার রাজ্যতে রাজকার্যে ব্যাঘ্যাত ঘটিয়ে পুনরায় বলতে আরম্ভ করলেন উপদেষ্টা নিওরিয়ান,
‘ সেনাপতি রিবিয়ান যুবরাজ রন ইওহার্ডের আক্রমণে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মাটি থেকে উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। একটা আঘাতেই যেন তার দেহের তিন-চতুর্থাংশ শক্তি অকৃতকার্য হয়ে গেছে। সেনাপতি রিবিয়ানের ব্যক্তিগত সৈন্যদের মুখের হাসি উড়ে গেছে। চেহারায় লেগে আছে ভীতিকর ভাব। এবং সাথে আছে ভাবনাযুক্ত অস্থির মন। কয়েক মুহূর্তের মাঝে কী থেকে কী ঘটে গেল তা এখনো তাদের বোধগম্য নয়। আর আগামীতে কী ঘটবে তাও অনুমান করতে সক্ষম না। ‘ এতটুকু বলে নিশ্বাস ছাড়লেন উপদেষ্টা নিওরিয়ান। একটি দম নিয়ে সেই কখন থেকে বলে যাচ্ছেন তিনি। হয়রান বোধ করে থামতে হয় তাকে। কিছু সময় চুপ থেকে পুনরায় বলতে আরম্ভ করেন।
‘ আচমাকাই যুবরাজ রন ইওহার্ড…! ‘ এতটুকু বলেই থেমে যেতে হয় তাকে। নিশ্বাস ছেড়ে দেন তিনি। প্রবেশদ্বারের দিকে তাকান রাজা অরগাড এবং উপদেষ্টা নিওরিয়ান।
নজরে আসে প্রবেশদ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন রানি নিয়ানো। খট করে প্রবেশদ্বার লাগানোর শব্দে উপদেষ্টা নিওরিয়ানের উপস্থাপনায় ব্যাঘাত ঘটান তিনি। প্রবেশদ্বার লাগানোর শব্দ কানে আসতেই কথন উপস্থাপন বন্ধ করে সেদিকে তাকান উপদেষ্টা নিওরিয়ান। রানি নিয়ানোকে দেখে তাদের উপস্থাপন সেখানেই স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়।স্মৃতিচারণ শুনতে এবং করতে ব্যস্ত থাকায় রানি নিয়ানোর কক্ষে প্রবেশ নজরে আসেনি। তাছাড়া রাজা অরগাড এবং উপদেষ্টা নিওরিয়ান এই সময়ে রানি নিয়ানোর উপস্থিতি মোটেও আশা করেননি তা তাদের মুখের বর্ণনা ভঙ্গি দেখলেই বুঝা যায়। রানি নিয়ানো কক্ষে প্রবেশ করে তাদের দুজনের মুখের অবস্থা বিকৃত দেখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকান। এ দেখে আরও ঘাবড়ে যান উপদেষ্টা নিওরিয়ান। তবে এক্ষেত্রে রাজা অরগাডকে যথেষ্ট চুপচাপ এবং স্বাভাবিক দেখা যাচ্ছে। ঈষৎ সন্দেহের নজরে দেখে দুজনের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রাখলেন রানি নিয়ানো।
‘ কী হলো? আমাকে দেখেই তোমাদের মুখখানা বাংলার পাঁচের মতো হয়ে গেল কেন! ‘ কৌতূহল কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন। তবে স্বরটা একদম নিচু বলা বাহুল্য।
প্রত্যুত্তরে ঝটপট জবাব দিলেন উপদেষ্টা নিওরিয়ান,
‘ না! কোথায়? আপনাকে দেখে আমাদের আবার কী হবে?’ প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে ভিন্ন প্রশ্ন রাখেন তিনি। রন ইওহার্ডের বিষয়টা ধামাচাপা দেওয়া অধিক জরুরি।
‘ আপনি হয়তো ভুলে গিয়েছেন, রানি নিয়ানো লোকের চোখ দেখে বুঝতে পারে কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা।’ ওষ্ঠধর দুটো চেপে রেখে একটি হাসি দিলেন রানি নিয়ানো। মিথ্যা ধরতে পেরে তিনি অত্যন্ত খুশি বোধ করছেন। উপদেষ্টা নিওরিয়ান তাকে কিছু বলতে চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তার আগেই তাকে চোখের গরম ইশারায় থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলেন তিনি,
‘ কী নিয়ে আলোচনা করছিলেন দুজন?’ প্রশ্নের চাপাতলে ছোঁয়া লেগে আছে শোনার অধিক আগ্রহান্বিত মনোভাব।
‘ তেমন কিছু না! এই রাজ্যের বিষয় নিয়ে মহারাজের সাথে আলোচনা করছিলাম। ‘ কিছুটা চিন্তিত হয়ে প্রশ্নের জবাব উপস্থাপন করেন উপদেষ্টা নিওরিয়ান। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা রাখছেন তিনি।
‘ আমি আগেও বলেছি, মিথ্যা কথা আমি খুব সহজে ধরে ফেলতে পারি। একটু আগে আমি যখন দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতে নিই, আর তখনই আপনার মুখ থেকে শুনেছি যুবরাজ রন ইওহার্ড এরপর কিছু একটা বলতে চেয়েছিলেন। এবং কথা বলার সময় গভীর ভাবনায় আবদ্ধ ছিলেন। আমার উপস্থিতি পর্যন্ত টের পাননি। বলুন, কী এমন ভাবনার ঘোরে উপস্থাপন করছিলেন?’ গম্ভীরমুখে প্রশ্ন করলেন রানি নিয়ানো। পরিস্থিতি ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যাচ্ছে।
‘ কথা ঘুরিয়ে লাভ হবে না উপদেষ্টা নিওরিয়ান। তার থেকে ভালো হবে রানিকে সাথে নিয়ে বিষয়টা খোলামেলা আলোচনা করো। নয়তো খামোখা কেবল কথা ঘুরবেই। ‘ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বিরক্তিমাখা স্বরে কথাটি সমাপ্ত করলেন রাজা অরগাড।
‘ আচ্ছা তবে বলছি! ‘ সম্মতি দিলেন উপদেষ্টা নিওরিয়ান।
‘ আমি আপনাদের কথার আদি বা অন্ত কিছুই বুঝতে সক্ষম হচ্ছি না! যুবরাজ রন ইওহার্ডের কী হয়েছে? আমি তো দেখে আসলাম মাত্র চৈতন্যতা ফিরে পেয়েছে। তাই তো সেখানে রাজকুমারীকে একা রেখে এলাম তাদের কিছু একান্ত সময় কাটানো দরকার বলে। ‘ কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলেন রানি নিয়ানো। সাথে একটি হাসি দিয়ে কথাগুলো উপস্থাপন করলেন।
‘ যাক! অবশেষে যুবরাজের চৈতন্যতা ফিরল তবে। ‘ একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রাজা অরগাড।
‘ তাহলে প্রথম থেকেই শুরু করি আবার..!’ প্রশ্ন করে জানতে চাইলেন উপদেষ্টা নিওরিয়ান। রাজা অরগাড এবং রানি নিয়ানো উভয়েই সম্মতি দিলেন।
‘ আমি যখন মহারাজ অরগাড সঙ্গে কথা বলে যুদ্ধ প্রশিক্ষণ প্রান্তরে উপস্থিত হই। তার ক্ষণিক সময় পূর্বেই সেখানে এসে উপস্থিত হয় সেনাপতি রিজওনাল…! ‘
পুরোনো ঘটনাগুলো পুনরায় উপস্থাপন করতে লাগলেন উপদেষ্টা নিওরিয়ান। এক পর্যায়ে থামলেন তিনি। রানি নিয়ানোকে লক্ষ্য করে ব্যক্ত করতে থাকেন,
‘ এর পরপরই কক্ষে প্রবেশ করে কথায় ব্যাঘাত ঘটান আপনি। ‘ বিরক্তিকর কণ্ঠে কথাটি বললেন।
তার শেষ কথা গুরুত্ব না দিয়ে পুনরায় প্রশ্ন করলেন রানি নিয়ানো,
‘ এরপর কী হলো?’ যুবরাজের ঘটনাটি উপস্থাপনের সময় কঠিন দৃষ্টিতে উপদেষ্টা নিওরিয়ানের মুখপানে তাকিয়ে ছিলেন। অধিক মনোযোগী হয়ে কান দিয়ে শ্রবণ করেছেন তিনি। তাই থেমে যেতেই প্রশ্ন করেন।
‘ পরপর দুইবার সেনাপতি রিবিয়ানের উপর আক্রমণ করে যুবরাজ রন ইওহার্ড। আক্রমণে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে তলদেশে মাটিতে চৈতন্য হারিয়ে শুয়ে থাকেন। উপস্থিত সবার মস্তিষ্কে কোনো কিছুই চলছে না। যেন মস্তিষ্ক তার কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে আচমকাই প্রান্তরের তলদেশ থেকে ভেসে পান্তরের ঠিক পানির মাঝখানে চলে আসে যুবরাজ রন ইওহার্ড। হাত দুটো সামনের দিকে নিয়ে বুক সমপরিমাণ করে তার আশে-পাশের পানিগুলো নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার চেষ্টা করে। উপস্থিত সৈন্যগুলো তখনো বুঝে উঠতে পারেনি কী হতে যাচ্ছে। আমি নিজেও ভেবে উঠতে সক্ষম হইনি। প্রথমে ভেবেছিলাম এতক্ষণে এত চেষ্টা করেও যেহেতু যুবরাজ পারেনি, তবে নিশ্চয়ই এখনো পারবে না। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে গেল, সেনাপতি রিবিয়ানকে পানি দিয়েই আক্রমণ করেছিল। আমার মাথায় নতুন করে চিন্তা ঘুরতে লাগল। তবে সব বুঝতে না সক্ষম না হলেও অন্তত এতটুকু বুঝতে সক্ষম হয়েছিলাম, ‘ এতক্ষণ যা হয়েছে তা খুব সাধারণ। কিন্তু এখন যা হতে যাচ্ছে, তা হবে খুব ভয়ংকর হবে।’ চিন্তা শেষ করতেই আমার ভাবনাকে সত্য প্রমাণিত করে দেয়। বিশাল একটি জলরাশি ধীরে ধীরে তার চারদিকে জমাট বাঁধতে আরম্ভ করে। প্রান্তের অর্ধেক পানিই তার শাষণে। সবাই হতবিহ্বল করে দিয়ে আচমকাই তার হাত দুটো বুকের উপর থেকে একটি ঝাঁকুনিয়ে দিয়ে সোজা করে ছেড়ে দেয়। জমাটবদ্ধ পানিগুলো আছড়ে পড়ে স্বাভাবিক পানিগুলোর দিকে। মুহূর্তের মাঝে প্রান্তরে সৃষ্টি হয় প্রলয়ঙ্কর জলধারার। এবং দুই পানি একত্রে মিলিয়ে সংঘর্ষের ফলে সৃষ্টি হয়ে ভূমিকম্পের। এতে সমস্ত রাজ্যসহ পৃথিবীটাও ঝিম ধরে যায়। এতটা ভয়ানক ভূমিকম্প বিগত শতবছরে হয়েছে বলে মনে হয় না। আমি আগে থেকে সামান্য অবগত থাকার কারণে কোনোরকমে নিজেকে সুরক্ষা দিয়ে বেঁচে ফিরি। সেনাপতি রিবিয়ান এবং তার সৈন্যগুলো নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত না করতে পারার হেতু গুরুতর আহত হয়।’
একান্ন.
রাজ বৈদ্য এবং সেনাপতি রিবিয়ানের সাথে দেখা করতে এসেছেন রাজা অরগাড। ক্ষণিক পূর্বেই একজন রক্ষী তার কক্ষের সামনে গিয়ে জানায়, রাজ বৈদ্য তাকে তলব করেছেন। তাকে তলব করেছে শুনে দৌড়ে ছুটে এসেছেন। প্রবেশদ্বার দিয়ে অতিথিশালার ভেতরে প্রবেশ করতে তার দিকে তাকান রাজ বৈদ্য। ধীর পায়ে হেঁটে রাজা অরগাড তার সামনে এসে উপস্থিত হয়। কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে বলতে লাগলেন,
‘ আমি ঔষধ লাগিয়ে দিয়েছি। এবং কক্ষে আরও কিছু ঔষধ রেখে দিয়েছি। সময় মতো তা রক্ষীদের দিয়ে দেওয়াবেন। এতে করে দ্রুত সেরে উঠবেন সেনাপতি রিবিয়ান। আর চিন্তার কোনো কারণ নেই। খুব শীঘ্রই সেনাপতি রিবিয়ান সুস্থ হয়ে যাবেন। তবে আমি এখন আসছি! আবার প্রয়োজন হলে তলব করবেন। ‘ মাথা নিচু করে কথাগুলো উপস্থাপন করলেন রাজ বৈদ্য। যাবার অনুমতি প্রদান করলেন রাজা অরগাড। মাথাটা আরেকটু নিচু করে কুর্নিশ জানিয়ে দ্রুত রাজা অরগাডের কাছ থেকে প্রস্থান নেন তিনি। রাজ বৈদ্য ফিরে যেতেই রাজা অরগাড তার কক্ষে ফিরে আসেন। উপদেষ্টা নিওরিয়ান অনেক আগেই কক্ষ থেকে চলে গেছেন। এত নিশ্চিন্তে থাকার কথা তবু থাকতে পারছেন না তিনি। নিজ কক্ষে প্রবেশ করেন চিন্তিত মনে। কিন্তু রানি নিয়ানোর দিকে তাকাতেই চিন্তার অবসাদ ঘটিয়ে নেন। রাজা অরগাডের চিন্তিত চেহারা দেখতে পেলে তিনি নিজেও চিন্তিত থাকবেন। আর রাজা অরগাড রানি নিয়ানোকে কোনোভাবেই চিন্তিত রাখতে ইচ্ছুক নন।
[– চলবে –]
• সেনাপতির বিচার হবে?
• তার কৃতকার্যর জন্য কি মাফ চাওয়া হবে?
• রাজা অরগাডের চিন্তিত হবার কারণ কী?