গল্প:- সি অফ মারমেইড লেখনীতে:- যাবেদ খাঁন আবু বকর পঞ্চদশ পর্ব

0
130

গল্প:- সি অফ মারমেইড
লেখনীতে:- যাবেদ খাঁন আবু বকর
পঞ্চদশ পর্ব

সাতচল্লিশ.
রাজ বৈদ্য এবং উপদেষ্টা নিওরিয়ানকে নিয়ে অতিথিশালায় উপস্থিত হতেই রাজা অরগাডের চোখ ছানাবড়া। উপদেষ্টা নিওরিয়ানও কোনো অংশে কম অভিঘাত হননি। রাজ বৈদ্য কেবল হতভম্ব হয়ে দেখে যাচ্ছেন সব। চেহারা ভাব ভঙ্গিমা স্বাভাবিক রাখার প্রচেষ্টা করলেও সম্পূর্ণ আড়াল করতে অক্ষম। উপদেষ্টা নিওরিয়ান ভেবেছিলেন, সেনাপতি রিবিয়ান দেহে আঘাতের পরিমাণ খুব সামান্য হবে। যাকে স্বল্প পরিসরে আঘাত বলে। কেননা মাত্র দুটো আক্রমণ করেছে যুবরাজ রন ইওহার্ড। এবং রিবিয়ানের সাথে থাকা সৈন্যদের দেহে স্বল্প পরিমাণে ক্ষতবিক্ষত হবে। কিন্তু তার ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে।

সেনাপতি রিবিয়ানকে একটি বিছানায় শুয়ে রাখা আছে। দেহ সম্পূর্ণ চৈতন্যহীন অবস্থায় আছে। এবং তার সাথে থাকা সৈন্যগুলোকে অতিথি কক্ষের অপর বিছানায় রাখা হয়েছে। কিছুটা গাদাগাদি হলেও এক বিছানাতেই চারজনকে শুইয়ে রেখেছে। কক্ষের এমন পরিস্থিতি দেখে মৎস্য রাজা অরগাড কিছু ভেবে উঠতে সক্ষম হচ্ছেন না।

সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগছে তার সেনাপতি রিবিয়ানের আঘাত দেখে। দেহে অসংখ্য ক্ষত চিহ্ন! যেন কাচের টুকরো দিয়ে কাটাছেঁড়া করা হয়েছে দেহের আঘাতপ্রাপ্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো। চেহারায় অসংখ্য মারের দাগ। যেন অর্ধেক আঘাত চেহারাতেই করেছে। তাছাড়া পরিহিত কাপড় ছিঁড়ে গেছে তার। যে যে স্থান দিয়ে স্থান দিয়ে কাপড় ছিঁড়ে গেছে, সে সে স্থানগুলো বড় ভয়ংকরভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। রাজ বৈদ্য নিজেও সেনাপতি রিজওনালের দেহের এ অবস্থা দেখে খানিক সময়ের জন্য থমকে গিয়েছিলেন। তিনি ভেবে উঠতে সক্ষম হচ্ছেন না, কে এতটা বাজেভাবে আঘাত করেছে? এবং এই ভেবে আরও হতবাক, যেখানে সেনাপতির শৌর্য ছিল বিকট। শত্রু পক্ষের সহস্রাধিক সৈন্যকে একাই কতল করে দিতে সক্ষম তিনি।
যেখানে অক্টোপাস রাজা অক্টাইস তার শৌর্যের কারণে এখন পর্যন্ত পুরোপুরিভাবে রাজ্যে আক্রমণ করতে এগিয়ে আসেনি, সেখানে কে তাকে আঘাত করে এমন গুরুতর আহত করে দিল! এছাডা সেনাপতি রিবিয়ানের বীরত্ব ছিল ভয়ানক! কিন্তু তাকেই এভাবে আহত করা হয়েছে ভেবে ভড়কে আছেন সবাই। দ্রুত পায়ে হেঁটে সেনাপতি রিবিয়ানের দিকে এগিয়ে যান রাজ বৈদ্য। উপস্থিত দুজন সৈন্যকে সেনাপতি রিবিয়ানের দেহে থাকা সমস্ত পোশাক খুলে ফেলার আদেশ করেন তিনি। দ্রুত দুজন সৈন্য এগিয়ে এসে সেনাপতি রিবিয়ানের দেহে থাকা সকল পোশাক খুলে উলঙ্গ করে ফেলল। একটি ছোটো কাপড়ের টুকরো দিয়ে কেবল লজ্জা স্থান ঢেকে রাখা হয়েছে। সেনাপতি রিবিয়ানের কাঁধ থেকে শুরু করে পা অবধি আঘাতের চিহ্ন কেবল। কোনো কোনো স্থানের আঘাত দেখে মনে হচ্ছে, হয়তো ব্লেড দিয়ে আঘাত করে চিঁড়ে ফেলা হয়েছে। আবার কোনো কোনো স্থানের আঘাত দেখে মনে হচ্ছে যেন কাচের টুকরো দিয়ে পোঁচ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সবচেয়ে বেশি এবং গুরুতর আঘাত স্থান হচ্ছে রিবিয়ানের চেস্ট। ফিনকি দিয়ে এখনো রক্ত ঝড়ছে দেহ থেকে। সেনাপতি রিবিয়ানের দেহ উলঙ্গ করতেই আর দেরি না করে শয়ন করা চৈতন্যহীন দেহের আঘাত স্থলে পাত্রে রাখা সবুজ বর্ণের ঔষধগুলো নিজ হাতে লাগিয়ে দিতে লাগলেন।

রাজা অরগাড সম্পূর্ণ বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন। বাকযন্ত্র তার কার্য চালাতে অক্ষম। তার মুখ থেকে একটা বুলি বেরিয়ে আসছে না। যেন থমকে গেছে বুলি! খানিকটা সন্দেহের দৃষ্টি নিয়ে উপদেষ্টা নিওরিয়ানের দিকে চোখ ফেরাতেই পূর্বের মতো পুনরায় সাথে সাথে মাথা নিচু করে ফেলেন। এবার সন্দেহের তীব্রতা জোড়ালো আকার ধারণ করল রাজা অরগাডের কাছে। তবু কিছু সময় চুপ করে থেকে রাজ বৈদ্যর উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখলেন তিনি।
‘ রাজ বৈদ্য, আপনি সেনাপতি এবং তার ব্যক্তিগত সৈন্যদের একটু ভালোভাবে চিকিৎসা করার ব্যবস্থা করুন। আর যতদ্রুত সম্ভব সুস্থ করে তুলতে চেষ্টা করুন। ‘ কঠিন স্বরে উপস্থাপন করলেন।
প্রত্যুত্তরে ঔষধগুলো সেনাপতি রিবিয়ানের দেহে মাখানো অবস্থাতেই ঝটপট সম্মতি দিয়ে বললেন রাজ বৈদ্য,
‘ যথা আজ্ঞা মহারাজ। ‘ তার সম্মতির আড়ালে লুকায়িত ছিল একরাশ ভক্তি।

সম্মতিসূচক বাক্য শুনে দ্রুত কক্ষ থেকে বের হয়ে চলে আসার প্রস্তুতি নেন রাজা অরগাড। অতিথিশালার প্রবেশদ্বার পর্যন্ত এসে গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভাব ফুটিয়ে বলতে লাগলেন,
‘ উপদেষ্টা নিওরিয়ান, আমার সাথে আমার কক্ষে আসুন। ‘
রাজা অরগাডের এরকম কথা শুনে ভড়কে যান তিনি। যা সন্দেহ করেছিলেন তাই ঘটেছে। তিনি একটু আগে ভেবেছিলেন, রাজা অরগাড কক্ষ থেকে যাবার সময় তাকে ডাক দেবেন। তার সন্দেহ বা ভাবনাকেই সঠিক প্রমাণ করে তাকে তার সাথে ডেকে নিলেন। এবং তার এও জানা আছে, রাজা অরগাড তাকে কক্ষে নিয়ে কী কী প্রশ্ন করবেন!

উপদেষ্টা নিওরিয়ান আর কিছু না বলে চুপচাপ রাজা অরগাডের পেছনে এসে দাঁড়ালেন। প্রবেশদ্বারে টোকা দিতেই বাহির থেকে প্রবেশদ্বারের পাল্লা খুলে দিল রক্ষীদের মাঝে একজন। রাজা অরগাড দ্রুত পায়ে হেঁটে কক্ষ ত্যাগ করলেন। তার পিছুপিছু অনুসরণ করে হেঁটে আসছেন উপদেষ্টা নিওরিয়ান। এবং তাদের দুজনের পেছনে হাঁটছেন চারজন চৌকস দেহরক্ষী। যাদের দেহে যুদ্ধের পোষাক পরিধান করা। সবার হাতে রয়েছে তীক্ষ্ণ এবং ভয়ানক ধারালো বল্লম। এবং কোমড়ে ঝুলানো রয়েছে খাপে আবদ্ধ প্রচণ্ড ধারালো তলোয়ার। রাজপ্রাসাদের বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রাজা অরগাড তার ব্যক্তিগত কক্ষের সামনে উপস্থিত হন সবাই। রাজা অরগাডকে দেখে প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে থাকা প্রহরী দুটো দ্রুত প্রবেশদ্বারের পাল্লা দুটো খুলে দেয়। কোনোদিকে দৃষ্টিপাত না করে সোজা নিজ কক্ষে প্রবেশ করেন রাজা অরগাড। তার পিছুপিছু কক্ষে প্রবেশ করেন উপদেষ্টা নিওরিয়ান। তারা দুজন কক্ষে প্রবেশ করতেই বাহিরে দাঁড়িয়ে পাহারায় নিয়োজিত থাকা দুজন প্রহরী পুনরায় দ্বার টেনে প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দেয়। রাজা অরগাডের সুরক্ষায় তাদের পিছুপিছু আসা চারজন সৈন্য নিজেদের মাঝে আলাপন করতে করতে বারান্দা দিয়ে হাঁটতে থাকে।

কক্ষে প্রবেশ করে দ্রুত পায়ে হেঁটে অলিন্দতে চলে আসেন রাজা অরগাড। তার পিছুপিছু কোনো আওয়াজ না করে সেখানে এসে উপস্থিত হন উপদেষ্টা নিওরিয়ান। সূর্য প্রায় ডুবুডুবু পর্যায়। পানির তলদেশ থেকে সরাসরি আকাশ দেখা সম্ভব নয়। তবে অনুভব করা সম্ভব। সমুদ্রের তলদেশে সূর্যের আলো না পৌঁছাতে সক্ষম হলেও নিষ্কাশন পদ্ধতির মাধ্যমে কোনো বাধা-বিপত্তি ছাড়াই মারমেইড শহরে সূর্যের আলোতে আলোকিত করা সম্ভব। এবং সূর্য অস্ত গেলেও কোনো অসুবিধা নেই। ইতোমধ্যেই সুরক্ষা কবচ থেকে সূর্যের আলোর থেকে একটু নিম্ন এবং চাঁদের চেয়ে তীব্র আলো ছড়িয়ে সমগ্র মারমেইড শহরকে আলোকিত করে তুলছে। এক্ষেত্রে সুরক্ষা কবচকে চাঁদের মতো কৃত্রিম উপগ্রহ বললে ভুল হবে না। দিনের বেলায় সূর্যের আলো শোষণ করে সুরক্ষা কবচ সাথে সুর্যের আলোতে আলোকিত করতে থাকে মারমেইড শহর। আবার সন্ধ্যা হতেই উক্ত শোষণকৃত আলোগুলো পুনরায় চাঁদের চেয়ে আরও আলোকিত করে দেয়। দেখতে দেখতে সূর্য তার অস্তিত্ব বিলিন করে হারিয়ে গেল পরদিন ধরা দেবার আসায়। মারমেইড শহর যেন পুনরায় আলোকিত হয়ে উঠেছে সুরক্ষা কবচের শোষিত আলোর বলে।

আটচল্লিশ.
বেশ সময় যাবত অলিন্দতে এসে উপস্থিত হয়েছেন রাজা অরগাড। নিশ্চুপ হয়ে কেবল শহরের দৃশ্য উপভোগ করছিলেন। উপদেষ্টা নিওরিয়ান এত সময় যাবত চুপ করে কাটিয়ে দিলেও এখন তার বিরক্তি অনুভব হচ্ছে। আর কত সময় এভাবে নিশ্চুপ করে কাটাবেন তারা? নীরবতাকে অরাজকতা সৃষ্টি করে তুললেন।
‘ মহারাজ, কিছু হয়েছে কি?’ কৌতূহলী হয়ে জনতে চেয়ে প্রশ্ন করলেন উপদেষ্টা নিওরিয়ান।
বেশ খানিকটা সময় বাকরুদ্ধ হয়ে থাকেন রাজা অরগাড। সাথে নড়াচড়া এবং নিঃশ্বাস নেওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দেন। কিছু সময় বাদে সমস্ত নিঃশ্বাস এক সাথে নির্গত করেন তিনি। হতাশায় নিমজ্জিত কণ্ঠস্বরে বলে উঠলেন।
‘ রাজ্য নিয়ে চিন্তিত! ‘ চিন্তিত ভাবনা চেহারা এবং কণ্ঠে ফুটিয়ে তুলে বললেন।
রাজা অরগাডের কর্মকাণ্ড উপদেষ্টা নিওরিয়ানকে যতটা না হতভম্ব করেছে তারচেয়ে রাজ্য নিয়ে চিন্তিত কথাটা আরও বেশি হতবাক করেছে। সাথে তার ভাবনাতেও থামকে দিয়েছে। রাজ্য নিয়ে চিন্তিত হবার কোনো কারণ দেখছেন না তিনি। কিন্তু ঠিক কী কারণে রাজ্য নিয়ে চিন্তিত রাজা অরগাড! বিষয়টি জানার অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে তার মাঝে। পুনরায় উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করলেন,
‘ কী বলছেন মহারাজ! রাজ্য নিয়ে চিন্তা বলতে? আপনি রাজ্য নিয়ে কী এমন চিন্তা করছেন?’ কণ্ঠে রাশভারি কৌতূহলের ছোঁয়া লেগে আছে। সাথে কথাটি খানিক অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলেন।

পুনরায় কিছু সময়ের জন্য চুপ হয়ে যান রাজা অরগাড। উপর দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক চিন্তা ভাব ঘোর হয়ে বলতে লাগলেন,
‘ প্রথমে যুবরাজের আহত দেহ তার কক্ষে নেওয়া হলো। খানিক বাদেই সেনাপতি রিজওনালের ভয়ানকভাবে ক্ষতবিক্ষত হওয়া আহত দেহটা অতিথি কক্ষে নেওয়া হয়। সেনাপতি রিবিয়ানের এরকম বাজেভাবে আহত দেহের খবর যদি অক্টোপাস রাজা অক্টাইসের কাছে চলে যায়! তবে যেন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। এরপর কী হবে সেই চিন্তাতেই আছি। ‘ চিন্তিত মনোভাব ব্যক্ত করে মন হালকা করলেন রাজা অরগাড। হাজারো চিন্তা মাথায় চেপে আছে তার। সাথে রাজ্য হারাবার এবং যুদ্ধের ভয় মনকে কাবু করে রেখেছে।
রাজা অরগাডের বক্তব্য শেষ হতেই মৃদুস্বরে অট্টহাসিতে মেতে ওঠলেন উপদেষ্টা নিওরিয়ান। তা দেখে কিঞ্চিৎ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকান রাজা অরগাড। কিন্তু তার এই রাগান্বিত অথবা গম্ভীর মুখ থেকে থেমে যায়নি নিওরিয়ান। বরংচ আরও জোরেশোরে হাসতে লাগলেন তিনি। তা দেখে এবার আর চুপ থাকতে পারলেন না রাজা অরগাড।রাগান্বিত স্বর সাথে কিছুটা গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভাব নিয়ে বললেন।
‘ এখানে হাসার মতো কোনো কারণ দেখছি না। আমি আমার সমস্যার কথা বললাম, আর তুমি আমার মজা উড়াচ্ছ!’ রাগ যেন উপচে পড়ছে তার। তার বলা গুরুত্বপূর্ণ কথার কেউ মজা উড়ালে সহ্য করতে পারেন না।

রাজা অরগাডের রাগী ভাব দেখে হাসি থামানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করেন উপদেষ্টা নিওরিয়ান। তবু যেন হাসি থামাতে পারছেন না তিনি। বহু কষ্টে হাসি থামিয়ে গম্ভীর ভাব কণ্ঠে ফুটিয়ে বলতে আরম্ভ করলেন।
‘ হাসব না তো কী করব শুনি! যার রাজ্যে এত বড় একটি বীর আছে, সে নাকি আবার অক্টাইসের মতো চুনোপুঁটির সাথে যুদ্ধের ভয় পায়! ‘ কথাটি বলে হাসি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে আবার হেসে দেন তিনি।
রাজা অরগাড উপদেষ্টা নিওরিয়ানের কথার আগামাথা কিছু বুঝতে সক্ষম হলেন না। তবে দ্বিতীয় কথার প্রেক্ষিতে প্রাশ্ন করলেন,
‘ এত বড় বীর বলতে! অক্টাইসের ক্ষমতা হচ্ছে হাঙর। হাঙরদের রাজা অক্টাইসের সেনাপতি করডাল। এছাড়া হাঙরদের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে সক্ষম হবে না মৎস্য সৈনিকেরা। ফলস্বরূপ অক্টাইসের সাথে যুদ্ধের প্রতিশ্রুতি দিতে পারছি না। ‘ শেষ কথাটা বুক ভরা দুঃখ নিয়ে ব্যক্ত করলেন। কথাগুলোর ওজনে বুঝা যাচ্ছে কতটা কাতর হয়ে বললেছেন তিনি।
‘ এরকম সহস্রাধিক হাঙরকে মুহূর্তের মাঝেই পরাস্ত করে দিতে সক্ষম আপনার বীর! হ্যাঁ আপনার বীর! যে অক্টাইসের মতো দশজনের সাথে একাই লড়াই করে বিজয় ছিনিয়ে আনতে সক্ষম। ‘ গর্ববোধ করে কথাগুলো উপস্থাপন করলেন উপদেষ্টা নিওরিয়ান।
উপদেষ্টা নিওরিয়ানের কথাগুলো শুনে চমকে যান রাজা অরগাড। কী বলছেন উপদেষ্টা! আদৌ কি এমনটা ঘটা সম্ভব! সময় খরচ না করে পুনরায় কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলেন তিনি,
‘ কে সেই বীর? এখন কোথায় আছে? ‘ কৌতূহল যেন উপচে পড়ছে। তর সইছে না আর তার।
প্রত্যুত্তরে কথা ঘুরিয়ে পালটা প্রশ্ন করলেন উপদেষ্টা নিওরিয়ান,
‘ আপনি কি জানেন সেনাপতি রিবিয়ানের এরকম অবস্থার জন্য কে দায়ী? কে করেছে এমন হাল? ‘ গম্ভীর ভাব কণ্ঠে ফুটিয়ে প্রশ্ন করলেন তিনি।
প্রত্যুত্তরে হতাশ কণ্ঠে জবাব দিলেন রাজা অরগাড।
‘ না! জানতে পারিনি কে আক্রমণ করেছি। এখন বলো কে সেই বীর?’ হতাশ হয়ে প্রথম প্রশ্নের জবাব দিলেও শেষ প্রশ্ন পুনরায় কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলেন তিনি।

একটি মুচকি হাসি দিয়ে জ্ঞাপন করলেন,
‘ যুবরাজ রন ইওহার্ড। ‘ প্রত্যুত্তর করলেন উপদেষ্টা নিওরিয়ান। তবে কণ্ঠের আড়ালে গর্বিত অনুভব করার ছাপ লেগে আছে।

রন ইওহার্ডের নাম শুনতেই থমকে যান রাজা অরগাড। কান দুটো খাড়া করে ফেলেন তিনি। ‘ কী বললেন উপদেষ্টা নিওরিয়ান! যুবরাজ রন ইওহার্ড! সেই বীর! ‘ নিজের মনকে নিজেই লোক চক্ষুর আড়ালে অন্যের থেকে লুকিয়ে প্রশ্ন করেন। উত্তর স্বরূপ মনের অন্তস্তল থেকে সম্মতি আসে। কিন্তু সম্মতি আসার কারণ তার অজানা। ইতিহাসের পাতায় রন ইওহার্ডের নাম লেখা থাকলেও তার চমকের বার্তা উপস্থিত নয়। আর এত দ্রুতই তা উপস্থাপন হবে তাও কল্পনা করেননি রাজা অরগাড।
কৌতূহলতা উপেক্ষা করতে না পেরে সাথে নিয়েই দ্বিতীয় প্রশ্ন নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েন রাজা অরগাড।
‘ কিন্তু কী করে? কয়েক মুহূর্ত পূর্বেই তো তুমি আমার কাছে এসেছিলে, যুবরাজের সময়ের প্রয়োজন। হয়তো তা বছরখানেক লাগবে। কিন্তু তা কী করে এমন চমকে দিল?’ তার ভাবনার পাহাড় দিনদিন বাড়তেই আছে। সাথে উচ্চতা হাতের নাগালে থাকলেও বারবার ছুঁয়ে দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন।

লজ্জায় রাজা অরগাডের চেহারায় না তাকিয়ে মাথাটা নিচের দিক করে প্রত্যুত্তর করেন উপদেষ্টা নিওরিয়ান,
‘ আমার অনুমানে ভুল ছিল মহারাজ! বারুদের গায়ে আগুন ছোঁয়ালে তা যেমন মুহূর্তের মাঝেই বিস্তৃত হয়ে বিস্ফোরণ ঘটে যাবে। তার অনুরূপ যুবরাজ রন ইওহার্ড বলা যায়। ‘ পুনরায় গর্বের সহিত কথা বলতে লাগলেন। কথার ওজনে প্রকাশ পায় তিনি বড্ড খুশি হয়েছেন।
রাজা অরগাড কথার ভাবমূর্তি সম্পূর্ণ বুঝে উঠতে সক্ষম না হতে পেরে পুনরায় প্রশ্ন করলেন,
‘ বুঝতে সক্ষম হলাম না তোমার কথা!’ উদ্বিগ্নযুক্ত স্বর কণ্ঠে ভাসিয়ে প্রশ্ন করলেন।
‘ যুবরাজ রন ইওহার্ডকে অগ্নিশিখা বলা যায়। ‘ পুনরায় গর্বে বুক চওড়া করে প্রত্যুত্তর করেন উপদেষ্টা নিওরিয়ান।
খানিকটা বিরক্ত হয়ে বললেন রাজা অরগাড,
‘ আচ্ছা এসকল প্রবচন এখন বাদ দাও। পরবর্তী সময়ে দিও। এখন বলো কীভাবে কী হলো? সেনাপতি রিজওনালকে এমনভাবে মারার কোনো কারণ দেখছি না আমি। আর যুবরাজ রন ইওহার্ড যদি সেনাপতি রিজওনালকে মেরে থাকে। তবে সে অজ্ঞান কেন হলো? আর তার মুখে আঘাতের চিহ্ন কেন?’ অনেকটা প্রত্যাশা নিয়ে প্রশ্ন করলেন রাজা অরগাড। সাথে কণ্ঠে উদ্বিগ্ন ভাব ফুটিয়ে তুলে প্রশ্ন করলেন।
একটি বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলতে লাগলেন উপদেষ্টা নিওরিয়ান,
‘ আমি যখন আপনার সঙ্গে কথা বলে প্রশিক্ষণ প্রান্তরে উপস্থিত হই। তার ক্ষণিক সময় পূর্বেই সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছেন সেনাপতি রিজওনাল। অবশ্য তাকে খবর দিয়েছিল নিশ্চয়ই কোনো রক্ষী। কারণ আমি তখন সেখানে ছিলাম না। আর যেহেতু আমি নেই, সেহেতু সেখানে আর কোনো সমস্যা হবার কথা না। সেই হিসেব করেই সেনাপতি রিবিয়ান প্রশিক্ষণ প্রান্তরে এসে উপস্থিত হয়। আমি গিয়ে দেখতে পাই, সেনাপতি রিবিয়ান যুবরাজ রন ইওহার্ডের সামনে গিয়ে কটুকথা শোনাচ্ছে। সাথে তার সৈন্যরাও হাসছিল। কিন্তু অবাক আমি তখন হই, যখন দেখি যুবরাজ এ সকল বিষয় কানে না নিয়ে সে তার কর্মচর্চা করতে লাগল! কিন্তু বিষয়টা আমার কাছে দৃষ্টিকটু লেগেছিল। ভেবেছিলাম যুবরাজ হয়তো প্রত্যুত্তর করতে জানে না। ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষ সে। কিন্তু রণক্ষেত্রে যদি এরকমটা থাকে তবে তো বিরাট সমস্যা। তাছাড়া তাৎক্ষণিক সময়ে আমার আরেকটি ভাবনা মস্তিষ্কে জড়ো হতে শুরু করে। আর তা হলো, ‘ যুবরাজ কি তবে লড়াই করতে ভয় পাচ্ছে?’ এই প্রশ্নটাও যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত ছিল। কিন্তু আমার মন বারবার কেন যেন আমাকে বলছিল, ‘ কিছু একটা হতে যাচ্ছে। ঝড় আসার পূর্বে পরিবেশ যেমন ঠান্ডা থাকে। তেমনটাই হতে যাচ্ছে। কেবল চুপচাপ দেখে যাও। ‘ আমি মনের কথা মান্য করে সকলে যখন হাসিঠাট্টায় মত্ত। তাদের দৃষ্টির আড়ালে প্রান্তরের উপরে চলে যাই। এবং সেখানে গিয়ে দেখতে থাকি কী ঘটতে যাচ্ছে!

কিছু সময় এভাবে চলল। কিন্তু সেনাপতি রিবিয়ান ভেবেছিল যুবরাজের কাছে সে পাত্তা পাবেন। কিন্তু পাত্তা না পেয়ে রেগে ফেটে পড়তে লাগলেন তিনি। আচমকাই সেনাপতি রিবিয়ান হতভম্ব করে দিয়ে পানির বুক চিঁড়ে সোজা যুবরাজের মুখ বরাবর আঘাত করে। এতে করে ছিটকে গিয়ে পড়ে যুবরাজ। যদিও আমি তখনই সেখানে গিয়ে ঝগড়া মিটমাট করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মন কঠিন করে বলেছিল, ‘ থেমে যাও যুবরাজ কী করে তা দেখার জন্য। যুবরাজ কি এর জবাব দেবে? নাকি সহ্য করে নেবে?’ আমার মনের দ্বিতীয় ভাবনাটাই সঠিক হল। তখনও কিছু বলেনি যুবরাজ রন ইওহার্ড। মাটিতে পড়ে থাকা অবস্থা থেকে উঠে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তা দেখে সেনাপতি এবং তার সৈন্যরা হাসাহাসি শুরু করে দেয়। আচমকাই যুবরাজ উঠে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতে সেনাপতি রিবিয়ান তার পায়ের সামনে লেজ দিয়ে জলরাশি সৃষ্টি করে সোজা যুবরাজের বুকে আঘাত করে। যুবরাজের আঘাতপ্রাপ্ত অবস্থা দেখে আমি প্রায় বাকরুদ্ধ হয়েছিলাম। সেনাপতি রিবিয়ানের আঘাতের জোর আমার বেশ ভালো করেই জানে আছে। আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে এবারও যুবরাজ রন ইওহার্ড ছিটকে পড়ে কয়েক মিটার দূরে। ভেবেছিলাম যুবরাজ আর উঠে দাঁড়াতে পারবে না। এই ভেবে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আমাকে হতভম্ব করে দিয়ে একটু ক্লান্তিকর অবস্থা নিয়ে ধীরে ধীরে মাটিতে শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ায়। তা দেখে আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে যাই। কিন্তু কেন থেমে গেছিলাম সে প্রশ্নের জবাব আমার নিজের কাছেও নেই। কিন্তু যুবরাজ রন ইওহার্ড মাটি থেকে উঠে দাঁড়াতেই চোখের পলকের মাঝে পানির বুক চিঁড়ে গিয়ে পুনরায় বিষাক্ত বিষ এবং পানি দিয়ে তৈরি অস্ত্র দিয়ে তার বুকে আঘাত করে। আঘাতের তীব্রতা দেখে আমি নিজেই ভয় পেয়ে গেছি। আক্রমণটা এতদ্রুতই করেছিল, যে মুহূর্তের মাঝেই সব নড়েচড়ে হয়ে গেল! আঘাত পেয়ে পূর্বের মতো এবারও ছিটকে গিয়ে পড়ে সে। ভেবেছিলাম এবার আর উঠে দাঁড়াবার সক্ষমতা নেই। দ্রুত এগিয়ে যেতে লাগলাম তার দিকে। আমার মনে হচ্ছিল এবার অন্তত বিবাদ বন্ধ করা দরকার। নয়তো যুবরাজ রন ইওহার্ডের প্রাণও যেতে পারে। কিন্তু আমার এগিয়ে যাওয়াকে থামিয়ে দেয় সেনাপতি রিবিয়ানের একটি কথায়। তুচ্ছতাচ্ছিল্য স্বর বানিয়ে হাসিতে মত্ত হয়ে সেনাপতি বলে ওঠেন ” আসছে রাজা হতে। বাবা-মায়ের ঠিক নেই। আবার সে হবে নাকি মারমেইড শহরের রাজা! ”
এই কথা শুনে আমি নিজেই আমার স্থানে থেমে গেলাম।

কথাটি বলতেই সেনাপতিসহ তার সৈন্যরা হাসির বেগ বাড়িয়ে দিল। যেন এটা শুনে তারা বেশ আনন্দ পেয়েছে। কিন্তু আমি অনুভব করলাম, পরিবেশের কেমন পরিবর্তন ঘটেছে। পরিবেশ পরিস্থিতি যেন স্বাভাবিক অবস্থাতে নেই। যুবরাজ রন ইওহার্ড কথাটি শুনতেই সাথে সাথে তার কান দুটো খাড়া হয়ে যায়। চোয়াল দুটো বেরিয়ে আসছে। চোখ দুটো উত্তপ্ত লাভায় পরিনত হয়ে গেছে নেন। মুহূর্তের মাঝে মাটি থেকে উঠে চোখমুখ শক্ত করে সেনাপতি রিবিয়ানের দিকে তাকায়। চোখ বুজে কী যেন অনুধাবন করতে লাগল সে। আমি নিজেও বুঝে উঠতে পারছিলাম না সে কী করতে যাচ্ছে! আচককাই চোখ দুটো মেলে হাতের আঙুল দিয়ে ইশারা করে সেনাপতিকে আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে আসতে বলে। আমি যেন সেই মুহূর্তে জমে গেছিলাম। আমার হাত-পা কিছুই চলছিল না। বাকযন্ত্র তার কার্য ক্ষমতা হারিয়ে ফেছে। হার্টবিটের পরিমাণ একদম কমে গিয়েছিল। ভেবে পাচ্ছিলাম না যুবরাজ রন ইওহার্ড কী করতে যাচ্ছে সে!

স্মৃতিচারণে ব্যাঘাত ঘটিয়ে বলে উঠলেন রাজা অরগাড,
‘ বলতে চাচ্ছ, যুবরাজ নিজেই সেনাপতিকে তার উপর আক্রমণ করার জন্য ডেকেছে? ‘ চোখ দুটো বড় বড় করে অবিশ্বাসের ভঙ্গিমায় প্রশ্নটি করলেন। তিনি বিশ্বাসই করতে পারছেন না।
প্রত্যুত্তরে পুনরায় স্মৃতিচারণে লিপ্ত হয়ে যান উপদেষ্টা নিওরিয়ান,
‘ হ্যাঁ! তখন আমিও হতভম্ব হয়ে গেছিলাম। ভেবে পাচ্ছিলাম না কী করতে যাচ্ছে যুবরাজ! কিন্তু সেনাপতি যেন এতক্ষণ এর অপক্ষাতেই ছিল। নিজের দেহের সর্বশক্তি দিয়ে আক্রমণের লক্ষ্যে পানির মাঝে বুক চিঁড়ে পানি দিয়ে ভয়ানক অস্ত্র নিয়ে সোজা যুবরাজ রন ইওহার্ডের বুকে আঘাত করতে নেয়। তার এগিয়ে আসা দেখে চোখ বন্ধ করে ফেলে যুবরাজ। সেনাপতি যুবরাজের একদম নিকটে আসতেই চোখ দুটো দপ করে খুলে ফেলে।চোখের পলকের মাঝে তার অবস্থান থেকে ঘুরে যায় সে। তার অবস্থান থেকে নড়ে যেতেই সেনাপতি তার লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে ব্যর্থ হয়। উপস্থিত সেনাপতির সৈন্যগুলোও যেন হতভম্ব হয়ে গেছে। কিন্তু সুযোগ হাতছাড়া না করে চোখের পলেকে পুনরায় নিজের দেহ ঘুরিয়ে নিয়ে হাতের সামনে জলরাশির জমাট বাঁধিয়ে সোজা আঘাত করে সেনাপতি রিবিয়ানের বুকে। ঘটনা এত দ্রুত ঘটে গেল যে কী থেকে কী হলো তা আর বোধগম্য হলো না কারো। তবে এরকম আক্রমণ দেখে আমি সেখানেই বাকহারা হয়ে গিয়েছিলাম। কী চমকটাই ন্ব দেখাল যুবরাজ! সেনাপতি রিবিয়ানের মতো চৌকস এবং এত শৌর্যশালী একজন বীরকে মুহূর্তেই ধরাশায়ী করে ফেলল! ‘

[– চলবে –]

• রাজা অরগাড কি রন ইওহার্ডের আক্রমণ শুনে খুশি হবে?
• নাকি সেনাপতিকে আক্রমণ করার কারণে শাস্তি পেতে হবে?
• যদি যুবরাজকে কিছু না বলে তবে সেনাপতি রিবিয়ানকে কি কিছু বলবে?
• সেনাপতি রিবিয়ানের শাস্তি কি দেওয়া দরকার?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here