কৃষ্ণময়ীর_অলংকার #রাহনুমা_রাহা #পর্বঃ০৭

0
1105

#কৃষ্ণময়ীর_অলংকার
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ০৭

“কৃষ্ণময়ী তোমার মেঘবরণ কেশের মাতাল করা গন্ধে মাতোয়ারা হতে চাই বারংবার। ।”

সকাল ছয়টার সময় এরকম একটা মেসেজ দেখে আপনাআপনি দু তিনটে ভাজ পরে গেল তপার কপালে। ডিলিট করতে গিয়ে নজরে এলো অনেক দিন আগের একটি মেসেজ।
” আমার কৃষ্ণময়ী। মেয়েদের নাকি লম্বা চুলে সুন্দর দেখতে লাগে। আজ আমি নিশ্চিত।”

তপা গুনে গুনে দেখল দুই মাস আটাশ দিন আগের মেসেজ। আনমনে ভাবতে লাগল, কে লোকটা? আমি কি চিনি? আমার নাম্বারই বা কোথায় পেল। আর সকাল সকালই কেন মেসেজ এলো? লোকটা কি আমাকে দেখতে পাচ্ছে?
নাম্বার আর দেখতে পাওয়ার কথা মনে হতেই তাজমহলের কথা মনে হলো। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবল লোকটা তো কিছুদিন আগে কেক অর্ডার দিয়েছিল। সে কেন হবে? কিন্তু কে সে?
এমন হাজারো ভাবনা ঠেলে ফেলে দিয়ে মন দিল নিজের কাজে। ডিমের ফোম তৈরি করে তাতে ময়দা মিশিয়ে নিল। ব্যাটার প্রস্তুত করে মোল্ডে ঢেলে ওভেনে দিয়ে বই নিয়ে বসল। আজ ছয়টা কেকের অর্ডার রয়েছে। এছাড়াও দুটো সুপার শপে দিতে হবে কিছু। ব্যস্ত তপার সময় কোথায় এসব নিয়ে ভাবার।
জীবনটা এখন নতুন লাগে তপার কাছে। এইতো সেদিনও হাহুতাশ করে মরছিল। কিভাবে খেয়ে পড়ে বাঁচবে সে? কিভাবেই বা লেখাপড়ার খরচ চালাবে? কিন্তু আল্লাহ তো আছেন। তিনিই একটা পথ দেখিয়েছেন। পৃথার উছিলায় তার কর্মসংস্থানের একটা সুযোগ করে দিয়েছেন। এখন আগের মত ভাবতে হয় না। চিন্তা করতে হয় না রাত পোহালে সকালে কি খাব? আদৌ খাবার পাব তো?

একটা ক্লাস শেষে বেরিয়ে এলো তপা। মাথাটা প্রচন্ড ধরেছে তার। লাইব্রেরীতে গিয়ে একটু বসবে সে। মাথা নিচু করে হাঁটতে হাঁটতে সামনে কতগুলো পা দেখে থেমে গেল। মাথা উঁচু করে দেখল রাত্রি দাঁড়িয়ে। সাথে আরও পাঁচ ছয় জন। তপা বিরক্তি ভঙ্গিতে তাকাল। রাত্রি তপার পা থেকে মাথা অবধি একবার চোখ বুলিয়ে বলল,
“দেখতে তো হাভাতে, হাবাগোবাই মনে হয়। তলে তলে এতকিছু করছিস কিভাবে তুই?”
তপা বিক্ষিপ্ত নয়নে তাকিয়ে বলল,
“কি করেছি আমি?”
রাত্রি অট্টহাসি দিয়ে পাশের জনের কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“এই দেখ এমন ভাব করছে যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না। তলে তলে যে আস্ত পুকুরটাই খেয়ে নিচ্ছে। বেয়াদব মেয়ে কোথাকার।”
তপা নিজেকে কন্ট্রোল করে বলল,
“মুখ সামলে কথা বলুন। কি বলছিলেন পুকুর খেয়ে নিচ্ছি? খেলে পুরো সমুদ্রটাই গিলে ফেলব, পুকুর ছুঁয়ে হাত নোংরা করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। এখন ঝেড়ে কাশুন তো দেখি ঝটপট। নয়তো বিদেয় হন চোখের সামনে থেকে।”
রাত্রি নিজের দু’হাত মুঠো করে ফেলল। কাটকাট গলায় বলল,
“পলক কে কি দেখিয়ে পাগল করেছিস তুই? এই শরীর? বিছানায় গিয়েছিস ওর সাথে? যে পলক আমার দিকে ফিরেও তাকায় না সে তোর মত কালির সাথে কিভাবে থাকে? বল এই শরীরটা দিয়েই পাগল করেছিস ওকে তাই না?”
তপার মাথা জলন্ত আগ্নেয়গিরির মত টগবগ করছে। চোখ কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। কানের ভেতরে মনে হচ্ছে ফুটন্ত সীসা ঢেলে দিয়েছে।
নিজের রাগটা সংবরণ করার চেষ্টা করে বলল,
“আপনার দিকে ফিরে তাকায় না কেন আপনার পেয়ারী পলক তাজওয়ার? আপনি শরীর দেখাতে পারেন না? দেখতে তো ভালোই মনে হচ্ছে। তাহলে তাকে দেখাতে কি সমস্যা? বিছানায় যেতেও নিশ্চয়ই আপত্তি নেই? আপনার সো কল্ড পলক তাজওয়ার এত সুন্দর ফিগার দেখে নিশ্চয়ই ছেড়ে দেবে না আপনাকে। তাহলে যাচ্ছেন না কেন? নাকি আপনার মধ্যেই কোনো ঘাপলা আছে। আছে নাকি? এরকম কিছু থাকলে আপনি আমাকে নিঃসংকোচে বলতে পারেন। আমার এক পরিচিত ডাক্তার আছে। তাকে বলে এই সমস্যা বিশেষজ্ঞ কোনো ডাক্তারের অ্যাপয়েনমেন্ট নিতে বলবো। যাবেন তো মিস রাত্রি?”
রাত্রি সবটা শুনে তেড়ে এসে তপার গালে চড় মারতে উদ্যত হয়। তপা হাত মুচড়ে ধরে পিঠে ঠেকিয়ে বলল,
“আমাকে অবলা ভেবে ভুল করবেন না। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে সবাই ঘুরে দাঁড়াতে পারে। আর চড় আমিও মারতে পারি। কিন্তু আমার পরিবার আমাকে সেই শিক্ষা দেয় নি। কিন্তু আর একবার যদি এই হাত আমাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করে তবে হাত আর হাতের জায়গায় থাকবে না। মাইন্ড ইট।”
রাত্রি আবারও হেসে উঠল।
“পরিবারের বড়াই করছিস? তা তোর পরিবার তোকে কি শিক্ষা দিয়েছে? লাইব্রেরীতে লটরপটর করতে? লিফটে গিয়ে জড়াজড়ি করতে? নাকি ছেলেদের সাথে চিপকে থাকতে? আরও তো ছেলে আছে কিন্তু পলকই কেন? পলক হ্যান্ডসাম বলে নাকি ওর টাকা আছে বলে? প্রস্টিটিউটের মত ওর থেকে টাকা নিয়ে নিজের পরিবার চালাচ্ছিস? লজ্জা করে না। শালী প্রস্টিটিউট কোথাকার। আবার পরিবারের ডায়লগ শোনাতে আসে।”

তপার চোখের কার্নিশ বেয়ে পানি পড়তে শুরু করল। বা হাতে চোখ মুছে কিছু বলার আগেই সশব্দে রাত্রির গালে ছুঁয়ে দিল একটি ফর্সা ইস্পাত কঠিন হাত। রাত্রি হঠাৎ আক্রমণ সামলাতে না পেরে দুপা পিছিয়ে গেল। তপা অবাক হয়ে চেয়ে রইল সামনে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে।

পলক রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে তপার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আল্লাহ মুখ দেয় নি সাথে? পটরপটর কি কেবল আমার সাথেই করতে পারো?আমার একটা কথাও তো মাটিতে পড়তে দাও না তুমি। তাহলে ওর বেলায় মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছো কেন? দু ঘা লাগিয়ে দিতে পারো নি?”
তপা ঈষৎ রেগে বলল,
“সবকিছু আপনার জন্য হয়েছে। না আপনার সাথে দেখা হতো আর না রাত্রির সাথে কোনো ঝামেলা হতো। সেই প্রথম দিন থেকে আপনি আমার মাথায় উঠে নেচে যাচ্ছেন। আমি বলেছিলাম লাইব্রেরীতে আসতে? আমি বলেছিলাম লিফটে আমার সাথে যেতে? না তো? তাহলে নোংরা কথাগুলো আমাকেই কেন শুনতে হবে? আমি মেয়ে বলে? নাকি আমি অসহায় বলে? কোনটা মিস্টার পলক তাজওয়ার? ঝামেলা আপনার আর আপনার রাত্রির। কিন্তু এর মাঝে আমি কেন? কেন আপনারা আমাকেই পেলেন আপনাদের দাবার গুটি বানানোর জন্য? আর আপনার রাত্রি? সে যদি আপনাকে এতই চায় তবে কেন সেদিন আমাকে পাঠালো ওই চিরকুট দিয়ে। নিজেই যেতে পারতো। আর যখন আমাকে পাঠালোই আপনি কেন এসে ওর সাথে ঝামেলা করলেন? করবেনই তো। সমস্যা তো আপনার হচ্ছে না। ঝামেলা তো আমাকেই পোহাতে হচ্ছে। অসহায় তো আমি। আপনি নন।”
রাত্রির দিকে তাকিয়ে আঙুল তুলে বলল,
“মিস রাত্রি। লাস্ট একটা সুযোগ দিচ্ছি। এরপর আমার পেছনে লাগতে আসলে আমার মুখ নয় হাত চলবে। এটা শুধু কথার কথা নয়। সময় আসলে বাস্তবে রূপ নেবে। আর হ্যা আমি কালো। এটা একান্তই আমার গায়ের রঙ। না আমি আপনার গায়ের সাথে ঢলাঢলি করে আপনার ফর্সা রঙকে কালো বানিয়ে দিচ্ছি আর না আপনার ভাইয়ের বউ হচ্ছি। তাই আমার গায়ের রঙ নিয়ে আপনার সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এটা একান্তই আমার। আর আমি এতেই সুখী। আমার তো বাইরেটা কালো। কিন্তু আপনার তো অন্তর পর্যন্ত কালো। নোংরা। জঘন্য। দুর্গন্ধযুক্ত।”
বলে আর একমুহূর্তও দেরি না করে পলকের দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে হনহন করে লাইব্রেরীর দিকে চলে গেল।
রাত্রি ক্রোধে ফেটে পড়লেও পলক অপলক তাকিয়ে রইল তপার পশ্চাৎগমনের দিকে।

লাইব্রেরীতে গিয়ে নীরব অশ্রু বিসর্জন দিল অনেকটা সময় নিয়ে। নিজের ভাগ্যের উপর ভীষণ রাগ হয় তপার। কি হতো যদি একটুখানি সুখ লেখা হতো সেখানে? কি হতো যদি একান্তই আপন বলে কেউ থাকতো তার? কি হতো যদি ছোট বেলাটা ভয়ংকর না হয়ে একটুখানি মধুর হতো? কি হতো যদি ওই নোংরা হাতটা ছুঁয়ে না দিত ওর ছোট্ট কোমলমতি শরীরটা?
আর নিতে পারছে না তপা। ছোট্ট জীবনটা ভীষণ ভারী লাগছে নিজের কাছে। না পারছে নিজের মৃত্যু কামনা করতে আর না পারছে সহ্য করতে।
পলক ঘন্টা খানেক সময় ধরে অপেক্ষা করছে তপার বের হওয়ার। কিন্তু সে তো বের হওয়ার নামই নিচ্ছে না। লাইব্রেরীর কোন কোণায় ঘাপটি মেরে আছে কে জানে? এই মেয়ে যে এত লাইব্রেরীতে কি করে ভেবে পায় না পলক। সময় পেলেই ছুট লাগায় লাইব্রেরীতে।

দীর্ঘ সময় পর ধীর পায়ে বের হলো তপা। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেল পলকের দিকে। তপাকে আসতে দেখে পলক নড়েচড়ে দাঁড়ালো। কিন্তু তপা সেদিকে পাত্তা না দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে গেল গেটের দিকে। পলকের মুখটা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল। দ্রুত গতিতে হেঁটে এসে তপার সাথে পা মিলিয়ে বলল,
“তিয়াশা কথা শোনা আমার। রাত্রির ব্যবহারের পেছনে আমার কোনো হাত নেই। আমাকে ভুল বুঝো না তুমি।”
আরও কিছু বলার আগেই তপা পলকের দিকে তাকিয়ে বলল,
“থামুন আপনি। আমি কিছু শুনতে চেয়েছি আপনার কাছে? চাইনি তো? তাহলে? ভার্সিটিতে এত স্টুডেন্ট সবার সাথেই কি একই ব্যবহার করেন? না তো? তবে আমার বেলায় কেন? আমি চাই না তো আপনার এত মনোযোগ। সত্যিই চাই না। আমি হাত জোর করছি, প্লিজ আপনি আমার থেকে দূরে থাকুন। আমি সাধারণ। সাধারণ হয়েই বাঁচতে দিন। দয়া করে আমার সামনে আর এভাবে আসবেন না। অন্য দশটা স্টুডেন্টের মতই ব্যবহার করুন আমার সাথে। দয়া করুন আমাকে। দোহাই লাগে।”

পলক অবাক হয়ে চেয়ে দেখল তপার নিঃসংকোচ আবদার। একবারও বুক কাঁপলো না এভাবে বলতে। একবারও ভাবল না পলক থাকবে কি করে তার কৃষ্ণময়ীকে না দেখে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here