শবনম(পর্ব ১২) সায়লা সুলতানা লাকী

0
192

#শবনম(পর্ব ১২)
সায়লা সুলতানা লাকী

একদিন গঞ্জে থেকে বেশ কয়েকজন আড়ৎদার এলেন শবনমের সাথে দেখা করতে।
তাদেরকে দেখে শবনম প্রথমেই তাদের আসার কারন বুঝতে পারে না। পরে তারাই বলেন
“ভাবিসাব, দুলাল ভাইয়ের লগে আমাগো ব্যবসা আছিল জমজমাট। তার লগে আমাগো লেনদেনও আছিল স্বচ্ছ। তার জায়গায় এহন ওই ব্যবসা যদি তার সৎ ভাইয়েরা করতে চায় তাইলে কইলাম আমরা আর তাগো লগে থাকতে পারুম না। তাইলে আমরা আমগো হিসাবপত্র এখানেই ক্ষান্ত দিমু। আপনে এহন দুলাল ভাইয়ের অংশ বুইঝ্যা নিয়া আমগো দায় মুক্ত করেন। ”

শবনমের মা এখনও শবনমের সাথেই আছেন। শবনম চুপ করে বসে আছে দেখে তিনিই আগ বাড়িয়ে কথা বলেন তাদের সাথে। ব্যবসার কিছুই তিনি বোঝেন না। তাই তাদের সাথে হিসাব নিকাশ শেষ করতে দুই একটা দিন সময় চেয়ে নেন আর সেই হিসাবটা যেন শবনমের বাবার সাথেই তারা করেন তেমনটাও বুঝিয়ে বললেন। তার কথা শেষ না হতেই জহির এসে দাঁড়ায় সবার সামনে।

“ভাই সাহেবেরা, আপনারা হিসাব আমগো লগে করবেন। ব্যবসা আমার বাপের, হিসাব আমার বাপের লগে করবেন। আর ব্যবসাতো বন্ধ অইব না। ওইডা অহন থেইক্যা আমি চালামু। আপনেগো হিসাব কিতাব অহন থেইক্যা আমার লগে অইব। এইসবের মইধ্যে আবার মাইয়া মাইনষেরে টানেন ক্যা?”
হঠাৎ করেই শবনম এইবার জবাব দিয়ে উঠল
“ওই জহির, তুই ছন্দার বাপের কারবার নিবি ক্যা? ওইডা কি তুই গতর খাডাইয়া দাঁড় করাইছোস? ওই কারবার ছন্দার বাপের স্বপন, হের পরিশ্রম আর ঘামের সাক্ষী অইয়া আছে। ওইডা তুই নিবি ক্যা? খবরদার যদি ছন্দার বাপের কারবারে হাত দেছ, তাইলে কইলাম আর তোর হাত থাকব না। মানুষটার একটা জিনিসও তোরা ধরতে পারবি না। যেইডা যেমন আছে তেমনই থাকব। যেইদিন মানুষটা ফিরব, হের সব কিছু ঠিক তেমনই পাইব।”

“হ মরা মানুষ আইব, ভুত অইয়া আইব৷ হাছা কইলাম, এই বেডি সত্যি সত্যিই একটা পাগল অইয়া গেছে।” কথাটা শেষ করেই ব্যঙ্গ করে খিকখিক করে হাসতে লাগল জহির।

আড়ৎদাররা আর কথা বাড়ায় না। শবনমের মায়ের সাথে কথা বলে তারা ফিরে আসে। জহিরের সাথেও আর কথায় জড়ায় না। এমনিতেই গঞ্জে জহির আর জব্বারের বেশ দুর্নাম রয়েছে ওদের ব্যবহারের কারনে। জব্বারতো পড়াশোনাই করে নাই। আর জহির ছাত্র মধ্যম গোছের হলেও ভালো গাইডের অভাবে নষ্ট হওয়ার পথে নেমেছে এমনই ধারনা করে গন্য মান্যরা। জমির শুধু নিজের আখের গোছাতেই ব্যস্ত, বড় ভাই হিসাবে ছোট দুইটার দিকে তেমন কোন নজরদারি নাই। পারতপক্ষে কেউ ওদের সাথে জড়ায় না। কিন্তু দুলাল ছিল সবার প্রিয় শুধু মাত্র ওর ব্যবহার আর সৎ গুনাবলীর জন্যই।

এভাবেই মাস গড়িয়ে গেল। এবার আর শবনমের ঢাকা যাওয়া হল না। ওর মা নিজেদের বাড়িতে আনতে চাইল কিন্তু তা-ও রাজি হল না। মাটি কামড়ে পড়ে রইল এই ঘরেই শবনম।
একটা সময় পর শবনমের মা নিজের ঘরে ফিরে আসেন, শবনমের দাদি অসুস্থ হয়ে পড়ায় । অসুস্থ শাশুড়িকে দেখাশোনা তাকেই করতে হবে শিউলি নিজের মেয়ে নিয়েই কুলিয়ে উঠতে পারে না তার উপর রান্নাও তদারকি করতে হয় ওর। এদিকে বকুলের ঘন ঘন বিয়ের প্রস্তাব আসে তাই ওকে ওর দাদি রাত জাগতে দেয় না। জবার দেখাশোনা করা ছাড়া আপাতত বকুলের আর কোন কাজ নেই। শবনমের প্রতি ওর মায়ের টানটা বেশি হলেও এই সময়তে সংসারের প্রতি দায়িত্বটারই ওজন বেশি বলে মনে করলেন। তবে তিনি শবনমের বাবাকে দিয়ে সারামাসের বাজার সদাই করে দিয়ে গেলেন, যাতে মেয়ের এই সময়তে খেতে পরতে তেমন কোন অসুবিধা না হয়। মাঝেমধ্যে সবুজের সাথেও বিভিন্ন আনাজপাতি দিয়ে পাঠাবেন তেমনটাও জানিয়ে গেলেন।

শবনমের স্বামীর প্রতি অপেক্ষাকৃত মনকে ছাপিয়ে এবার মাতৃত্বের মন উঠে এল। দুলালের আদরে আসক্ত মেয়ে ছন্দা দিনকে দিন শুকিয়ে যেতে লাগল। খাওয়া দাওয়ায় অরুচি আর ঘুমহীন হয়ে গেল ওর চোখ। রাতে সে চোখ শুধু ওর বাবাকেই খোঁজে। বাবার বুকে শুয়েই ঘুমিয়ে যাওয়া মেয়েটা এখন বালিশে শুয়ে ঘুমকে হারায়। গঞ্জে থেকে ফেরার পথে হাতে করে কখনও মুরুলি, কখনও বাদাম কিংবা কোন বিস্কুট নিয়া আসা বাবাটার পথ চেয়ে থাকতে থাকতে ছন্দার চোখগুলো যেন নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে ইদানিং ।

শবনম নিজের সংসারের হাল ধরতে কিছুটা সময় নিল। কিন্তু শেষ অবধি আবার আগের মতো সাহস আর শক্তি জুগিয়ে সংসারের চাকা চালাতে সক্ষম হল শুধু এই আশায় যে দুলাল একদিন ঠিকই ফিরে আসবে ওর কাছে, ছন্দার কাছে, অনাগত ওর সন্তানের কাছে।
বানুই এসে থাকে রাতে শবনমের সাথে তাই আর রাতে ভয় করে না।
এরই মধ্যে একদিন শাহ আলম এসে উপস্থিত হয় বাড়িতে। বানু চলে যায় ওর ঘরে। শবনম ছন্দাকে নিয়ে সন্ধ্যার পরপরই ঘরে দোর লাগায় একা থাকার জন্য । ছন্দা ঘুমালেও শবনমের চোখে ঘুম থাকে না। শারীরিক জটিলতার চেয়ে মানসিক চাপটাই বেশি ভোগায় যার কারনে আর ঘুম হয় না।
রাত যত বাড়ে ততই চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে উঠে। এরই মধ্যে হঠাৎ করেই দরজায় টোকার শব্দ কানে আসে শবনমের। তড়াক করে উঠে বসে, এক মন বলে দুলাল ফিরছে। খুশিতে পালঙ্ক থেকে নামতে গিয়ে হঠাৎ করেই মনে খটকা লাগে। দুলালের টোকার সাথে তাল মিলে না এই টোকায়। স্থির হয়ে বসে, মুখে কোন শব্দ করতে পারে না। কেমন জানি একটা ভয় এসে কড়া নাড়ে মনে। আবার যখন টোকার শব্দ হয় তখন আস্তে করে পালঙ্ক ছেড়ে নিচে পা রাখে। দরজার নিচ দিয়ে তাকায়। লুঙ্গির নিচে একজোড়া পায়ে চোখ আটকে যায়। এই পা দুলালের না। মনে করতে চেষ্টা করে এমন চপ্পল কার পায়ে দেখেছে ও। কিছুতেই আর মনে করতে পারে না।
একবার ভাবে কঠিন গলায় কিছু বলবে কি না! আবার নিজেই ঝেড়ে ফেলে এমন চিন্তা। শব্দ করলে যদি হুমকি ধামকি দেয় তবে ও কী করবে? এসব ভেবে কান চোখ খোলা রেখে ঝিমমেরে বসে থাকে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে সারারাত। যদিওবা বেশি কয়েকবার টোকা দেওয়ার পর সেই চপ্পল পরা পা জোড়া সরে গিয়েছিল শবনমের দোর থেকে।

সকালে উঠে ওর সন্ধানী চোখ সারাবাড়ি খুঁজতে নেমে গেল সেই চপ্পলের।
তন্নতন্ন করে খুজলে আবার না মেলে না কি? ও ঠিকই পেয়ে গেল সেই চপ্পল সহ লুঙ্গি ওয়ালাকে। সারাদিন এই বিষয় নিয়ে শুধু চিন্তাই করেছে কীভাবে এর জবাব দিবে। এরই মধ্যে বাড়িতে কানাঘুঁষা শুনেছে কয়েকবার যে শবনমের উচিৎ হবে ওর বাবার বাড়ি চলে যাওয়ার। দুলাল নাই, ওর আর এই বাড়িতে থাকার কী দরকার?
ও নিজেও আন্দাজ করছে যে ওকে বাড়ি থেকে তাড়াতে কিছু মানুষ উঠে পড়ে লেগেছে কিন্তু ও তাদের ইচ্ছার কোন মূল্য দেয় না। ও বুঝেছে দুলাল যে ওকে সবসময় বলত, এখানে ওকে ওর শক্তি ও বুদ্ধি প্রয়োগ করেই টিকে থাকতে হবে।
ও সেই ভাবেই চলবে বলে মনকে বোঝাল।

আজ সন্ধ্যায় নিজের দোর লাগানোর সময় গলা ছেড়ে চিৎকার দিয়ে বলল
“কোন হারামজাদায় জানি আমার দোরে জুতা পইড়া আইছিলো, জুতার দাগ লাগায় থুইয়া গেছে। হেই দাগ উডাইতে আমার বহুত কষ্ট অইছে। হারামজাদারা আর কষ্ট দেওনের জায়গা পায় না। বুঝলাম না এমন কামডা কেডা করল?”

ওর চিৎকার শুনে এবার বানু নড়েচড়ে বসল। নিজের ঘর থেকে গলা চড়িয়ে জবাব দিল
“ওই শবনম তুই দাগ উডাইলি ক্যা ছেমরি? থাকতো দাগ আমিও দেখতাম কেমন জুতাজোড়া তোর দুয়ারে যায়।”

“ঘাট খালি থাকলে যে কেউ নোঙর ফালায়রে বানু, তুই কি হেইডা জানাস না? ঘাট খালি অইলে বুইঝ্যা চলন লাগে।”
শেষ কথাটা একেবারে তীরের মতো বিঁধল শবনমের গায়ে। মনকে সান্ত্বনা দিল, এরা মানুষ হিসেবে কোনদিনও ভালো ছিলো না। এদের কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করাই যে ওর বড় ভুল।
কথা আর না বাড়িয়ে ও ঘরে ঢুকে গেল মেয়েকে নিয়ে। দুজনে ভাত খেয়ে শুয়ে পড়ল। ছন্দাকে গল্প বলেবলে ঘুম পারিয়ে নিজে উঠে আগেই বুদ্ধি মতো কাজ সেরে নিল আর অপেক্ষায় থাকল যেন আজ রাতেও খালি ঘাটে কেউ নোঙর ফেলতে আসে। ওর চোখে ঘুম নেই, এমন সময়তে শুধু দুলালের কথাই মনে করে সময় কাটায় শবনম।

রাত যখন গভীর হল, চার পাশে সুনসান নীরবতা নামল। ঠিক তখনই আবার পাওয়া গেল দরজায় সেই টোকার শব্দ। পর পর দুই টোকা দিয়ে থেমে যায়। এবার শবনম নিঃশব্দে পা ফেলে পালঙ্ক থেকে নামে। প্রথমই দরজার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখে পা জোড়া। আজ আর কোন চপ্পল নাই পায়ে। লুঙ্গিও বেশ উঁচু করে রাখা। পা দুটো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বড় বড় এবড়োথেবড়ো নখগুলো দেখে একবার মনে হল এরা সত্যি সত্যিই মানুষরুপি কোন অমানুষ। কাল বিলম্ব করল না। মনে ভয় যদি বেশিক্ষণ অপেক্ষা না করে আবার চলে যায়!

বড় ঢেকচিটা শাড়ির আঁচল দিয়ে ধরে স্টোভের উপর থেকে নামিয়ে সোজা চালান করে দিল দরজার নিচ দিয়ে।
আর তখন দরজার অপর প্রান্ত থেকে চাঁপা আর্তনাদ ভেসে এল
“ও আল্লাহগো, ও আল্লাহগো! পা পুইড়া গেল।”
আর তখনই কানে এল আরেক শব্দ
“চুপ শয়তান চুপ, একদম চুপ। আমি সন্ধ্যা কালেই আন্দাজ করছিলাম। গোলামের পুত গোলাম আর মানুষ অইলি না। আর শব্দ করিস না। জলদি আয় ঘরে আয়। শব্দ করলে আর মান ইজ্জত থাকব না। আয় আয় জলদি আয়।”

এমন দুঃখের মাঝেও এইবার শবনমের কেবল হাসিই পেল মানুষের এমন তামাশা দেখে।
ছন্দার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে অবচেতন মনে বলে উঠল
“আপনে কই আছেন ছন্দার বাপ, আপনে ছাড়া যে আমার ঘাট খালি। আমারে অঘাট বানাইতে যে মাইনষে উইঠ্যা পইড়া লাগছে। আপনে জলদি আহেন। আমার ঘাট ভরায় দেন আগের মতন। আমি যে আপনে ছাড়া বড় অসহায়। ”

সকাল হতেই শবনমের গলা বেড়ে গেল। চিৎকার করে বলতে লাগল
“আইজও আইছিল মাইনষে আমার ঘাটে নোঙর ফেলাইতে। আর আমিও দেহাইছি আমার ঘাট খালি না ভরা। খালি মনে কইরা যে কেউ নোঙর ফালাইতে চাইলেই ফালাইতে পারব না। আমার ঘাট বড় কঠিন ঘাট, এইহানে যে কেউ চাইলেই নোঙর ফালাইতে পারে না।”

“হায় হায় কস কি! ওই দুলালের বৌ, তুই কইলাম রাইতে একলা একলা ঘরের বাইরে আইবি না। যে কেউ ডাকলেই খুলবি না। কয় কি আল্লাহগো, চাইরডা মাইয়া পাইল্যা বিয়া দিছি৷ কোনদিনওতো এমন সর্বনাইশ্যা কতা হুনি নাই। কেডা আইছিলোরে? তুই দেখছোসনি? দেখলে নামডা ক খালি, দেহিস হেইডারে কি করি!”
বড় চাচিআম্মা বেশ জোর তোর দিয়েই কথাগুলো বললেন কোমরে আচঁল বেঁধে।

বানুও চুলায় আগুন ধরাচ্ছিল। এক লাকড়ির মাথায় আগুন সহ বের করে বলল
“নামডা ক বইন, হের মুখটায় আগুন ছেঁকা দিয়া আহি।”

“আমিতো হের মুখ দেহি নাই। নাম কমু কেমনে? তয় হেরে জব্বর এক শিক্ষা দিছি। মনে থাকলে আর জীবনও দুলালের বৌয়ের দিকে চক্ষু তুইল্যা তাকাইতে সাহস পাইব না।”
শবনম এক গাল হেসে উত্তর দিল

“ওই দুলালের বৌ তুই কি করছোস? না ভেটকাইয়া জলদি ক।”

“অমানুষের পা পুইড়া দিছিগো চাচিআম্মা , গরম পানি ঢাইল্যা দিছি।” বলেই খিলখিলিয়ে হাসতে শুরু করল শবনম।

সাথে সাথেই বানু বুঝে গেল, কার কাজ এইটা। তখন দাতে দাত চেপে বলল
“উচিৎ কামডাই করছোস বইন, উচিৎ শিক্ষাডাই দিছোস। দিলডায় বড় শান্তি পাইলাম।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here