#রোদেলা,পর্ব: ৬১
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু
সুফিয়ান রাত সাড়ে নয়টায় ফোন করে রোদেলাকে। ফোনটা বেজে কেটে যায়, আরেক বার কল দিবে ভেবেও দেয়া না ও। তাকিয়ে থাকে স্ক্রিনের দিকে। মনে মনে ভাবে নিশ্চয় কোন কাজে ব্যাস্ত তাই কল রিসিভ করতে পারছে না, কিংবা ফোনের কাছে নেই হয়তো….
ছোট্ট একটা টেক্সট করে সুফিয়ান,
রোদ,
আমি আবু-সুফিয়ান….
যদি কোন কারনে ফোন চেক করতে দেরিও হয়, তাহলে যেন দ্বিধা না হয় কল ব্যাক করতে। ফোনটা পাশে রেখে একটা বই পড়ার চেষ্টা করে। দ্যা আর্ট অব ওয়্যার…
চীনা সমরবিদ সান’জু এর লেখা বইটা অনেক আগে একবার পড়েছিলো সুফিয়ান, এবং ও মনে করে ২৫০০ বছর আগে লেখা এই ছোট্ট বইটা প্রত্যোকের পড়া উচিত।
অনেক চেষ্টা করেও বইটা পড়তে পারছে না, ভিতরে কেমন অস্থিরতা কাজ করছে। এই বুঝি ফোন এলো….
ঘন্টা-দুয়েক পরও যখন ফোন এলো না, সুফিয়ান তখন ফোন দিবে ঠিক করতেই ডাক আসে পরশের। ডিনার করতে। এর আগে একবার ডেকে গিয়েছে ছোট মেয়েটা। এখন পরশ নিজেই এসেছে। ফোনটাকে পকেটে নিয়ে নিচে ডিনারের জন্য যায় সুফিয়ান। ভেবেছিলো রাতের খাওয়াটা স্কিপ করবে। কিন্তু বাসায় আজ মোহমান এসেছে, তাই না যাওয়াটা কেমন অসৌজন্য মূলক লাগবে তাই নিচে গিয়ে কোনমতে খাবার খেয়ে উঠে আসে শরীর অসুস্থ এই বাহানা করে। তা না হলে সবার সাথে কথা বলতে বলতে অনেক রাত হয়ে যেতো।
রুমে ঢুকেই ফোন চেক করে। না কোন ফোন, ম্যাসেজ কিছুই আসে নি। ধৈর্যের চুড়ান্ত পরীক্ষা দিয়ে ফোন দিতে ডায়াল লিস্ট খুলতেই ওপাশ থেকে কল আসে…..
হুম….
কলটা রোদেলার……
সুফিয়ান কিছুসময় তাকিয়ে থাকে স্ক্রিনের দিকে। অন্য কেও এরকম সময়ে অপেক্ষা করতে পারতো কি না তা আমি জানি না, কিন্তু সুফিয়ান…..
সবকিছু একটু রয়ে সয়ে গ্রহণ করবার মানসিকতা ওর কেমন মজ্জাগত স্বভাব। কোন কিছুতে তাড়াহুড়ো নাই,প্যানিক না কোন বিষয় নিয়েই সেটা যতবড় বিষয়ই হোক না কেন….
সবকিছুতেই শান্ত নদী সে….
হঠাৎ হার্টবিট বেড়ে গেছে তা ও বুঝতে পারছে, শেষ রিং এর শুরুতেই কলটা রিসিভ করে ও….
পুরো ঘটনাটা কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার ছিলো কিন্তু ওর মনে হচ্ছিল সেটা অনন্তকাল ধরে বাজছিলো ফোনটা….
কলটা রিসিভ করলো ও।
: আসসালামু আলাইকুম সুফিয়ান,
: ওয়ালাইকুম আসসালাম….
: সরি, আমি একটা জটিল কাজে ব্যাস্ত ছিলাম, কাজের সময় ফোন কাছে রাখি না আমি। তাই আপনার কল, ম্যাসেজ কোনটাই পাইনি…
: ইট’স ওকে…
: আসলে আজ একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিলো, সেটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম, আপনার ওখান থেকে এসে সেটা শেষ করলাম। কাল আবার ওটা জমা করতে হবে।
: ও আচ্ছা…
: তারপর, খাওয়াদাওয়া হয়েছে…
: হ্যা…., তোমার….?
: আমি রান্না করছি আর কথা বলছি, নানু তার ছেলের বাড়ি গিয়েছে গত পরশু, নাতনী হয়েছে তাকে দেখতে। আমি তাকে পৌঁছে দিয়ে চলে এসেছি এ কাজটা শেষ করবার জন্য। তিনি কালপরশু এসে পরবে হয়তো…
: ওহ্…, আচ্ছা তুমি খাওয়া শেষ করে কল দিও, আমি জেগে আছি…
: না না, সমস্যা নেই, মাল্টি টাস্কিং এ আমি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি, আপনি বলুন…
: কি রান্না হচ্ছে…
: রাত করে আর কি করবো, নুডলস রান্না করছি।
: ওহ্
: তারপর….
: তারপর আর কি…. এই তো বিশাল রকমের একটা এক্সপেরিমেন্ট শেষে আমি এখন রিল্যাক্স মুডে আছি, ভাবছি লন্ডন শহরটা ঘুরতে যাবো…
একটা হাসির শব্দ শোনা গেলো…
: ওহ্ আচ্ছা….
তা কোন জার্নালে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে সেটা….
: জার্নাল….!
মানুষের সব গবেষণা, অনুসন্ধান, এক্সপেরিমেন্ট
কি জার্নালে প্রকাশ হওয়া বাধ্যতামূলক…?
: তা না….
: আচ্ছা একটা প্রশ্ন করবো…?
: হুম করুন…
: তুমি যদি চাও উত্তর দিয়ো, মন না চাইলে স্কিপ করো…
: হুম.. বলুন…
বেশ কিছু সময় মৌন থেকে সুফিয়ান বলে-
: তোমার বাড়ি থেকে বের হওয়ার কারন ছিলো শোভনকে বিয়ে করতে রাজি না হওয়া….
শোভন কেমন ছেলে তা আমি জনি, আত্মীয় হওয়ার সুবাদে আমার চেয়ে ভালো জানো তুমি…
তোমার রাজি না হওয়ার কারনটা কি ছিলো….
রোদেলা কেমন চুপ মেরে যায়, হয়তো এমন প্রশ্নের জন্য ও প্রস্তুত ছিলো না…
কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বলে-
: ইউ আর মাইন… আর
আই এম ইউরস…
এই দুটি বাক্য ভালোবাসাময় হওয়া সত্ত্বেও এদের মধ্যে কিন্তু অনেক পার্থক্য আছে….
শোভন সবসময় এমন সব কাজ করতো যাতে ও জানান দিতো -” ইউ আর মাইন ” মানে আমি ওর…
যে ভাবেই হোক আমাকে ওর পেতেই হবে, তাতে আমি সমাজের চোখে ছোট হই কি না, সমাজ আমাকে কি বলবে এসবে ও ডোন্ট কেয়ার ছিলো, আই মিন অলয়েজ একটা ক্রেজিনেস…
বর্তমানে নব্বই শতাংশ মেয়েরা এমন ক্রেজি পিপলস্ পছন্দ করে। আমার যে ওর প্রতি একটা সফটনেস ছিলো না তা আমি অস্বীকার করতে পারবো না। কিন্তু আমি তো ঐ নব্বই শতাংশ মেয়ের মতো না, আমাকে এক পা ফেলতে দশবার ভাবতে হতো। ফ্যান্টাসিতে আমি কখনোই গা ভাসাতাম না…
একটা সময় আমি খেয়াল করলাম ও শুধু আমাকে পেতে চায়, এট এনি কস্ট….
কিন্তু আমাকে বোঝার, আমাকে পড়ার, আমাকে খোঁজার সময়, ধৈর্য কিছুই ওর নেই…
এসব ক্রেজিনেস একটা সময় উবে যায়, জানেন তো… তার বাস্তব উদাহরণ আমার বাবা মা।
মেয়েরা জীবনসঙ্গী হিসেবে এমন একজনকে খুঁজে
যে বলবে “আই এম ইউরস্…. ” যাকে মন খুলে সব বলা যায়, খোলা বইয়ের মতো পড়া যায়…
অথচ ওকে কেন আমি গ্রহণ করতে পারছি না, আমি তা-ই খুলে বলতে পারি নি ওকে। অর্থনৈতিক, সামাজিক আরো অনেক ব্যাপারেই এ সম্পর্কটা অসামঞ্জস্যতাপূর্ণ ছিলো।
তাছাড়া আরো একটা কারনও আছে ওকে ফিরিয়ে দেবার। সেটা হচ্ছে আমার মা….
ওকে যদি আমি বিয়ে করতামও সারাটা জীবণ আমার মা-খালাদের কথা শুনতে হতো। যে সারাজীবন খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করে বিয়েটাও তারা দিয়ে দিয়েছে। না হলে আমার উপায় কি হতো…..
তারউপর সে পরিবারের বৌ হয়ে আমি আমার পরিবারকে ফিন্যান্সিয়ালি দেখতে পারতাম না।
সব মিলিয়ে দেখলাম এ সম্পর্কটা আমার স্কিপ করা উচিত।
অপর পাশের নিরবতায় রোদেলা ভেবেছিলো কলটা কেটে গেছে হয়তো, কান থেকে ফোন সরাতেই ও দেখলো আলোকিত স্ক্রিনে যোগ হচ্ছে এক এক সেকেন্ড…, অখন্ড মনোযোগে রোদেলার কথাগুলো শুনছিলো সুফিয়ান।
আবার কানে ফোন ধরে রোদেলা বললো-
: আপনি আছেন…?
: হুম…
: আর কোন প্রশ্ন…?
: অনেক কথা, জিজ্ঞাসা, প্রশ্ন জমেছে গত দিনগুলোতে….
কিন্তু তুমি এত উচ্চতায় পৌঁছে গেছো যে সেসব এখন……
: সেসব কি….?
: নাহ্ কিছু না….
: এড়িয়ে যাচ্ছেন…?
: আচ্ছা… কাল কি আমাদের দেখা হচ্ছে?
: আপনি অনেক স্মার্ট…., ওকে….
আই গট ইট…, কাল আমার পেপারসগুলো জমা করতে হবে ডিপার্টমেন্টে….কালই শেষ দিন…
: ও আচ্ছা….
: তিনটার পর আমি ফ্রী…
: আমি তাহলে এসে পরবো নি ইউনিভার্সিটির সামনে…
: ঠিক আছে…
: অনেক রাত হয়ে গেছে, রাখি তাহলে…
: আচ্ছা, আমিও ভীষণ ক্লান্ত…
: হুম, বারবার হাই তুলছো… তাতেই বুঝছি…
: আপনার ওখান থেকে এসে পাঁচঘন্টা এক টানা কাজ করতে হয়েছে আজ… এই নুডলসই আমার লাঞ্চ প্লাস ডিনার….
: এখান থেকে খেয়ে গেলেই পারতে…
: আরে নাহ্ সমস্যা নাই, এসবে আমার অভ্যাস আছে….
: আচ্ছা থাকো তাহলে….
: আচ্ছা ফোন রেখেই একটা লম্বা ঘুম দিবো..
: আচ্ছা ঘুমাও তুমি, শুভ রাত্রি…
: শুভরাত্রি….
রোদেলা বিছানায় শুয়েই কথা বলছিলো এতক্ষণ। কলটা কেটে সুফিয়ানের নম্বরটা সেভ করলো ও, তারপর ফোনটা বালিশের পাশে রেখেই কম্ফোর্টারটা গায়ে টেনে ডুব দিলো ঘুমের সাগরে…
সুফিয়ান বিছানায় বসে ভাবছে ওর উত্তরটা…. হঠাৎ ওর মনে হলো একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা ওকে জিজ্ঞেস করা হয় নি…? ও বললো শোভনের প্রতি ওর অনুভূতি ছিলো, এখনো তা আছে কি না…..?
বুক পকেট থেকে কলম নিয়ে কাগজে কিছু একটা লিখলো সুফিয়ান, হাতের ঘড়ি খুলে কাগজটা চাপা দিয়ে রাখলো যাতে সকালে কথাটা মনে পরে….
এতদিনে আজ শান্তিতে ঘুমাবে ও। এতদিনের সাধনা,কষ্ট,পরিশ্রম আজ সার্থক…..
যাকে খুঁজেছে এতো দিন সে আজ তাকে খুঁজে নিয়েছে….
জীবণ আমাদের মাঝে মাঝে এমন সারপ্রাইজ ও দেয়… জীবণে এমনও হয়…..!
কাল কি বলবে তা গুছাতে চেষ্টা করে ও, কাল একটা অন্যরকম দিনের শুরু হবে ওর জীবনে। এসব ভাবতে ভাবতে একসময় সুফিয়ান ঢলে পরে গভীর ঘুমে…..
চলবে…..