অপেক্ষার_বৌ-০১

0
625

#অপেক্ষার_বৌ-০১
#Tahmina_Akhter

—আমার বয়স কত হয়েছে?মাত্র, ক্লাস নাইনে পড়ি। এত বিয়ের তাড়া কিসের, বুঝলাম না আমি!দেখো বাবা, তুমি মা’কে বুঝিয়ে বলো আমি এখন বিয়ে-টিয়ে করতে পারব না।

কথাগুলো বেশ চিৎকার করে বলে উঠলো একটি পনেরো বছর বয়সী মেয়ে। রিডিং টেবিলের উপর থেকে কলমদানি নিয়ে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো বাইরের দিকে।

মেয়ের এমন আচরণে মোটেও অবাক হননি মইনুল হোসেন।ঠিকই তো, এই যুগে এসে কেউ নিজের পনেরো বছর বয়সী কন্যাকে বিয়ে দেয়? কিন্তু, উনার স্ত্রীকে বোঝানোর ক্ষমতা কারো নেই। কলেজের শিক্ষিকা যদি এমন আচরণ করে তাহলে আর কি বা বলার থাকে!

বিয়ের বারো বছর পরও উনাদের ঘর আলো করে কোনো সন্তান আসেনি। মইনুল হোসেনের দাদী একদিন বললেন,

— আল্লাহর ঘর কাবা শরিফ ঘুরে আয় দেখবি, আল্লাহ তোর ঘরে ফুটফুটে সন্তান দান করবে। আমার অন্তর বলছে তোরা দু’জন হজ্জ্ব করে এলে তোদের মনোবাসনা পূরণ হবে।

সেদিন মইনুল হোসেন উনার স্ত্রী আফরোজের সঙ্গে আলাপ করে। একটি সন্তানের আশায় সেদিন আফরোজ-মইনুল দম্পতি সিদ্ধান্ত নেয় সৌদি আরবে হজ্জ্বের জন্য যাবে।সে-বছরই উনারা হজ্জ্বে যায়। আল্লাহর অশেষ রহমতে সেবছর ডিসেম্বরে মইনুল হোসেনের স্ত্রী আফরোজ সন্তানসম্ভাবা হলেন। দীর্ঘ নয়মাসের অপেক্ষার পর উনাদের কোল জুড়ে এলো কন্যা সিথিঁ হোসেন। বড্ড আদরের মেয়ে, মইনুল হোসেনের জান যে সিথিঁর দেহে সমর্পিত। মেয়ের শরীরের একটু ব্যাথা মইনুল হোসেন সহ্য করতে পারে না। আর আজ সেই এতটুকুন কন্যাকে বিয়ে দেবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন আফরোজ। বিষয়টা মইনুল হোসেন কোনোভাবেই মানতে পারছেন না।

—বাবা, তুমি মা’কে বলো আমি এখন বিয়ে করতে রাজি নই। আমি পড়াশোনা করে মায়ের মতো একজন স্ট্রিক্ট টিচার হতে চাই।

মেয়ের কথার প্রতিউত্তরে কি জবাব দিবেন সেই উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না মইনুল হোসেন তবুও তিনি শেষ চেষ্টা করবেন। আজ দুপুরের পর আফরোজ কলেজ থেকে ফিরে এলে সিঁথির ব্যাপারে কথা বলবে।আজ একটা ফয়সালা হবে। সবসময় নিজের সিদ্ধান্ত এভাবে মেয়ের ওপর চাপিয়ে দেয়া ঠিক নয়।

—আমি তোর মাকে বুঝিয়ে বলব। তুই চিন্তা করিস না। ব্রেকফাস্ট শেষ করে স্কুলে যা। আমি দুপুরে অফিস থেকে এসে তোর মাকে বলব আমার মেয়ের এখনও বিয়ের বয়স হয়নি। তুমি যেখানে আলাপ করেছো, সেখানে না করে দিবে। এবার খুশি?

মেয়ের মাথায় হাত রেখে প্রশ্ন করলেন মইনুল।

—অনেক খুশি। আই লাভ ইউ সো মাচ, বাবা। এই পৃথিবীতে তুমি একমাত্র আমাকে ভালোবাসা আর কেউ না।বায়, বাবা।

সিঁথি একদৌঁড়ে ওর দাদীর ঘরে চলে গেছে। মইনুল হোসেন মেয়ের যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়ের ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেলেন।

দুপুরে কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে এলেন আফরোজ খানম। ফ্ল্যাটে প্রবেশ করতেই দেখতে পেলেন উনার স্বামী মইনুল হোসেন ড্রইংরুমের সোফায় বসে উপন্যাসের বই পড়ছেন। খুব সম্ভবত হুমায়ুন আহমেদ স্যার লিখিত “দেবী” বইটি।আফরোজ মুচকি হেসে পায়ের জুতো জোড়া খুলে ড্রইংরুমে প্রবেশ করে মইনুল হোসেনকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

—আজ এই সময়ে তোমার উপস্থিতি আমাকে অন্যকিছুর পূর্বাভাস দিচ্ছে।

স্ত্রী আফরোজের গলা শুনতে পেয়ে মইনুল হোসেন বই একপাশে রেখে উপরে তাকিয়ে দেখেন উনার স্ত্রী সবে মাত্র এলেন দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ক্লান্ত শরীর,মলিন, ঘর্মাক্ত মুখ, কাঁধের ব্যাগটা এখনো কাঁধেই ঝুলে আছে। মইনুল হোসেন মেকি হাসি দিয়ে স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

—কতদিন হলো তোমার সাথে গল্প করি না। একসাথে বসে চা খেতে খেতে কোনো বিষয় নিয়ে আমাদের মাঝে আলাপ হয় না। তাই ভাবলাম আজ অফিস থেকে ছুটি নিয়ে চলে যাই বাড়িতে। যেই ভাবা সেই কাজ। আধঘন্টা ধরে তোমার ফিরে আসার অপেক্ষায় আমি ক্লান্ত। যাও তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে এসো একসাথে দুপুরের খাবার খাব আজ।

-পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করো, আমি আসছি।
কথাটি বলে নিজের ঘরের দিকে ছুটে চলে যায় আফরোজ।

মইনুল হোসেন এই ফাঁকে রান্নাঘর থেকে রান্না করা ভাত, তরকারী,ডালের বাটি এনে টেবিলে সাজিয়ে চেয়ার টেনে বসে পরলেন। মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে রাখছেন। খাওয়াদাওয়া শেষ হলে আফরোজের সামনে মেয়ের ইচ্ছের ব্যাপারটা খুব ভালো করে উপস্থাপন করতে হবে।

আফরোজ ফ্রেশ হয়ে চলে এলেন ডাইনিং টেবিলের কাছে। এসে দেখলেন মইনুল হোসেন খাবার সাজিয়ে বসে আছেন। আফরোজ ভ্রু কুচকে স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছে পলকহীন চোখে। কারণ,এত আদিখ্যেতা করার মতো মানুষ নয় মইনুল। তবুও নিজের মনোভাব নিজের মধ্যে আবদ্ধ রেখে আফরোজ চেয়ার টেনে বসে পড়লো। মইনুল মুচকি হেসে খাবার বেড়ে এগিয়ে দেয় আফরোজের দিকে। আফরোজ বিনাবাক্য খাবার খাচ্ছে। খাওয়া দাওয়া শেষ হবার পর আফরোজ একটু রিল্যাক্স হবার জন্য সোফায় পা উঠিয়ে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। মইনুল শব্দহীন পায়ে হেটে আফরোজের পায়ের কাছে বসে পড়লো। আফরোজ উঠে নড়েচড়ে বসে পড়লো তারপর মইনুলকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলো,

—কিছু বলবে, তুমি?আসার পর থেকে দেখছি তুমি কিছু বলতে চাও আমাকে ; কিন্তু বলছো না।

-আফু, এখন সিঁথির বিয়ে না দিলে হয় না?

মইনুল সাহস করে নিজের স্ত্রীর কাছে প্রস্তাব উপস্থাপন করে দিল।আফরোজ মইনুলের কথার উত্তর দিতে চায় না তবুও বলতে হবে। তাই দীর্ঘশ্বাস চেপে বললো,

—মানুষ যখন বিপদ থেকে উদ্ধার হয় তখন সকল ওয়াদা-প্রতিশ্রুতিকে ভুলে যায়, তাই না মইন?তুমিও তো সেই সব ক্যাটাগরির মানুষের সঙ্গে মিশে গেলে।

আফরোজের মুখ থেকে এমন কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মইনুল। কি বলছে আফরোজ, এই সব প্যাচানো কথা মইনুলের মাথায় ঢুকছে না। কিসের ওয়াদা?কার প্রতিশ্রুতি?

***************‌‌‌‌‍

স্কুলের ব্রেকটাইম চলাকালীন সময়ে রোজ বান্ধবীদের নিয়ে স্কুল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ফুচকার স্টল থেকে ফুচকা খায় সিঁথি। একদিন বাদ দিলে ওর কাছে মনে হয় আজ বুঝি একবেলা ভাত না খেয়ে ছিল সে। সিথিঁ চৈতিকে সঙ্গে নিয়ে বের হলো স্কুল থেকে। বের হয়ে সোজা স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে ফুচকাওয়ালা মামাকে উদ্দেশ্য করে সিথিঁ বলে,

—মামা,খুব বেশি টক এবং ঝাল দিয়ে দুই প্লেট ফুচকা দিন তো। জলদি বানিয়ে দিন ক্লাস শুরু হয়ে যাবে দশমিনিটের মধ্যে।

—একটু অপেক্ষা করেন মামনি।

ফুচকাওয়ালা মামার কথায় সিঁথি আর চৈতি অপেক্ষা করার সঙ্গে সঙ্গে এক্সাম নিয়ে আলোচনা করছিল। এমনসময় কোত্থেকে এসে একটি চলন্ত বাইক ফুচকার স্টলের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। আকস্মিক ঘটনায় সিঁথি আর চৈতি বোবা বনে যায়।ফুচকাওয়ালা মামার কিছুই হয়নি কিন্তু বাইকওয়ালার মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। সিঁথি ভয়ে কাঁপছে। কারণ,দুই বান্ধবী থেকে মাত্র দুই ইঞ্চি দূরত্বে এই দূর্ঘটনা ঘটেছে।আশেপাশের সকল লোকজন এগিয়ে এসে ধরাধরি করে আহত বাইকের ছেলেটাকে পাশের হসপিটালে নিয়ে যায়।

সিথিঁর মানসিক অবস্থা বুঝতে পারে চৈতি।তাই সিথিঁকে বুঝিয়ে, হেডটিচারের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হয় চৈতি আর সিঁথি।

চৈতির বাড়ি সিঁথির বাড়ির আগে তাই চৈতি রিকশা থেকে নেমে পরে সিথিঁকে বুঝিয়ে শুনিয়ে। সিঁথির আগের থেকে কিছুটা ভয় কমে গিয়েছে। সিঁথি ওদের বিল্ডিংয়ের গেটের সামনে নেমে পড়লো। রিকশা ভাড়া মিটিয়ে দশতলা বিল্ডিংয়ের ভেতরে প্রবেশ করেছে। এই দশতলা বিল্ডিংয়ের ছয়তলায় থাকে সিঁথির পরিবার।লিফটের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই লিফটের দরজা খুলে যায়। সিঁথি লিফটে ঢুকে পড়ে কিন্তু সিঁথি এতটাই বেখেয়ালি ছিল যে ওর পাশে একটি যুবক দাঁড়িয়ে আছে ও টের পায়নি।

ছয়তলায় এসে লিফটের দরজা খুলে যায়। সিঁথি তড়িঘড়ি করে বের হয়ে একদৌঁড়ে ওদের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল বাজায়।

সিথিঁ পেছনে তাকালে হয়তো দেখতে পেত, মাথায় ব্যান্ডেজ করা এক আগুন্তক ওর দিকে তাকিয়ে অনিমেষ দৃষ্টিতে। চোখে তার ভালোবাসা নাকি লালসা?চোখের খড়াক মেটাতে ব্যস্ত নাকি ভাললাগার প্রথম মূহুর্তকে উপভোগ করছে?

দরজা খুলে গেলে সিঁথি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ওদের ফ্ল্যাটে ঢুকে পরলো।সেই আগুন্তুক আড়াল হতে থাকে হয়তো আবারও ফিরে আসবে যখন ফিরে আসার সঠিক সময় আসবে!

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here