তৃনভূমি,পার্ট-৫

0
229

#তৃনভূমি,পার্ট-৫
#ফারহানা_কবীর_মানাল

–“সুমনা ভাবি চলেন আপনাকে চেকাপ করিয়ে দেখবো আপনি আদো অন্তঃসত্ত্বা কিনা!”

সুমনার মুখটা মলিন হয়ে গেলো। সোহাগ কৃতজ্ঞ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আশেপাশের সকলেই আমার কথার সাথে সহমত হলো।
সুমনাও রাজি হলো তবে সে ঘরোয়া পদ্ধতিতে পরীক্ষা করবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সকলের কথা মতো হাসপাতালে যেতে বাধ্য হলো। সুমনা আর বিল্ডিংয়ের কয়েকজন লোক একটা অটো রিকশা করে হাসপাতালের দিকে রওনা দিলো। আমি আর সোহাগ দু’জন একটা রিকশা করে যাচ্ছি। সোহাগ মলিন মুখে বসে আছে। আমি সোহাগের ডান হাতটা চেপে ধরে বললাম, ” মন খারাপ করো না। আল্লাহ নানান ভাবে মানুষের পরীক্ষা নেয়। তুমি এখন ভেঙে পড়লে হবে না। ”

সোহাগের চোখ ছলছল করছে, হয়তো এখনই অশ্রু কণা কপল গড়িয়ে মাটিতে পড়বে। সোহাগ আমাকে কিছুই বলতে পারলো না শুধু আমার ডান হাতটা নিজের হাতের ভিতর নিয়ে রাখলো। কয়েক মুহুর্তে ধরে রাখার পর তাতে চুম্বন করলো।

–” আমি বিশ্বাস করি তোমায়!”

সোহাগের মলিন মুখে এক চিলতে হাসির রেখা দেখা গেলো তবে তা সাময়িক সময়ের জন্য। রিকশা থেকে নেমে সোহাগ ভাড়া মিটালো, তারপর দুইজন মিলে হাসপাতালের ভিতর গেলাম। সুমনারা তখনও এসে পৌঁছায়নি। সোহাগ আর আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে রাখলাম। এই মেয়েকে আমি একটুও বিশ্বাস করি না। হতে পারে ডাক্তারকে টাকা দিয়ে নিজের দলে টেনে নিলো। সোহাগের পরে ও-র কেন এতো নজর পড়ছে আল্লাহই ভালো বলতে পারবে।

সুমনাসহ বাকি সকলে হাসপাতালে এসে উপস্থিত হয়েছে, সুমনাকে ডাক্তার দেখছে, হয়তো বুঝতে চেষ্টা করছে, সাধারণভাবে ঘরোয়া পদ্ধতিতে পরীক্ষা করছে প্রথমে, ফলাফল এখনো ঠিক বলতে পারবো না। সুমনা সহ সকলে অধীর আগ্রহে বসে আছে। আমি কেমন পরিস্থিতিতে আছি বলে বোঝাতে পারবো না। যদি সুমনা সত্যি গর্ভবতী হয় তাহলে আমি কি করবো? যদিও আমি জানি এটা হতে পারে না, তবুও সোহাগ চুপচাপ বসে আছে। কিসব আকাশ পাতাল ভেবে চলেছে, আমি সোহাগকে বিশ্বাস করলেও সোহাগের এই নিস্তব্ধতা আমার মনের কোথাও বারবার নাড়া দিচ্ছে। প্রিয় মানুষকে হারানো ভয়টা কোথাও তীব্র যন্ত্রণায় পরিনত হচ্ছে।

সকলের অপেক্ষার প্রহর শেষ করে একজন নার্স রিপোর্ট নিয়ে আসলেন। হাসপাতালে সচারাচর এতো তাড়াতাড়ি রিপোর্ট দেয় না। তবে আমাদের সকলের অনুরোধে এমনটা করছে, তাছাড়া ঘরোয়া পদ্ধতিতে পরীক্ষা করতে খুব একটা বেশি সময় লাগে না।

–” আসসালামু আলাইকুম। সুমনা আপনাদের রোগী? ”

–” জ্বী বলুক। ”

–” আমরা অনেক দুঃখের সাথে বলছি যে উনি প্রেগন্যান্ট না। অন্তত রিপোর্টে তাই লেখা আছে। আপনারা আবারও চেষ্টা করতে পারেন। আল্লাহ চাইলে উনি মা হবেন। ”

–” ধন্যবাদ সিস্টার। ”

সিস্টার মাথা নেড়ে চলে গেলেন। আমি এতো সময় এই মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এগিয়ে গিয়ে সুমনার গালে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে একটা চ/ড় মারলাম। ব্যাপারটা এতো দূর হলো যে সুমনা হতভম্ব হয়ে গালে হাত দিয়ে বসে আছে।

–” নিজের স্বামী থাকতে অন্যের স্বামীর দিকে নজর দিতে লজ্জা করে না তোর? তোকে চাইলে আগেও এই চ**ড়টা মারতে পারতাম কিন্তু তখন তুই সকলের সমবেদনা চাইতি। এখন কি বলবি বল!”

হাসাপাতালের পরিবেশ থমথমে হয়ে আছে। আমাদের সাথে যারা গেছিলো সকলেই সুমনাকে খারাপ বলছে আর সোহাগের সুনাম করছে, সোহাগ হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে আমাকে এতোটা রেগে যেতে আগে কখনো দেখিনি সোহাগ। যার জন্য হয়তো মেনে নিতে অসুবিধা হচ্ছে। সুমনা চোখের পানি নাকের পানি এক করে বলছে রিপোর্ট ভুল আছে। আমরা ডাক্তারের টাকা দিয়ে এমন করেছি। অন্য হাসপাতালে গিয়ে পরীক্ষা করলে বোঝা যাবে কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা! সুমনার কথা মতো সকলে অন্য একটা হাসপাতালে যাওয়ার জন্য রওনা দিলো। আমি বুঝতে পারছি না সুমনা একটা মিথ্যাকে কি করে সত্যি করবে?


চেয়ারের উপর বসে লিটার লিটার পানি খাচ্ছে সুমনা। এবার সে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করে দেখবে কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা। আমি একরাশ বিরক্তি নিয়ে একটু দূরে বসে আছি। সোহাগ কেমন জানি নির্জীব হয়ে গেছে। কোনো কথা বলছে না। ঘন্টা দুয়েক বসে থাকার পর সব কাজ শেষ হলো। তবে আজ আর রিপোর্ট দিবে না। কাল বিকালে রিপোর্ট নিতে আসতে হবে। সুমনা সহ সকলে ফিরে গেলো। আমি আর সোহাগ নদীর পাড়ে যাওয়ার জন্য রিকশায় উঠলাম।

–” মোনালিসা বাড়িতে চলো না প্লিজ। আমাকে এসব ভালো লাগছে না। ”

–” শুধু নদী দেখে বাড়িতে চলে যাবো। ”

–” আচ্ছা চলো। ”

সারা পথ সোহাগ চুপ করে বসে রইলো। নদীর পাড়ে মিনিট পাঁচেক থেকে আমরা বাড়িতে ফিরে এলাম। শরীর আবারও গরম হয়ে আসছে আমার। বাইরে শক্ত থাকলেও ভিতরে ভিতরে অনেক কষ্ট হচ্ছে। কারণটা বুঝতে পারছি না তবে কষ্টটা অনুভব করতে পারছি। বাড়িতে যাওয়ার পর দুইজনে গোসল করে নিলাম। আজ সারাদিন ওই সুমনার জন্য মাটি হলো। তারপরও যে ও-কে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করতে পেরেছি এটাই অনেক।

–” মোনালিসা তুমি বিশ্বাস করো আমার কোনো মেয়ের সাথে এ ধরনের সম্পর্ক নেই। সিমনার সাথে দু-এক দিন স্বাভাবিক ভাবে কথা বলেছি মাত্র। ও কেন এমন করছে আমি জানি না। এতে অপমান আমি নিতে পারছি না। ”

সোহাগ আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কথাগুলো বলছে। ও-র চোখ থেকে পানি পড়ছে, কথা জড়িয়ে যাচ্ছে বারবার। ছেলেরা চাইলেও সকলের সামনে কাঁদতে পারে না। মানুষ হয়তো মনে করে ছেলেদের কাঁদতে নেই, তাদের হয়তো অনুভূতি নেই। কিন্তু তারাও মানুষ।

–” আমি তো বিশ্বাস করি তোমাকে। এমন করো না। তুমি ভেঙে পড়লে আমাকে কে সাহস দিবে বলো? আমি জানি সুমনা ইচ্ছে করে এসব করছে। হয়তো আমাদের সুখের সংসার ও-র সহ্য হয়নি। ”

সোহাগ কোনো কথা না বলে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রইলো। ও-র কান্না তখনও থামেনি। আমিও ও-কে চুপ করতে বললাম না। কাঁদতে দিলাম। কখনো কখনো কাঁদলে বুকের কষ্টগুলো হালকা হয়। যারা কাঁদতে পারে তারা অনেক ভাগ্যবান। যাদের চোখে সহজে পানি আসে না ওরা ভিতরে ভিতরে কষ্টে পুড়ে মরে, চাইলেও কাউকে বলতে পারে না। নিজের কষ্ট কাউকে বুঝতে দিতে পারে না। শুধু নিজের ভিতরের কষ্টে নিজেই কষ্ট পায়।


মাগরিবের নামাজের পরে আমি আর সোহাগ ছাঁদে গেলাম। সন্ধ্যায় পরিবেশ আমার খুব ভালো লাগে। আকাশের তারাগুলো গুনতে চেষ্টা করি, তবে প্রতিবারই ব্যর্থ হই। ছাঁদে গিয়ে দেখলাম সুমনা কারো সাথে মোবাইলে কথা বলছে,

–” আমি তোমার কথা মতো সোহাগে ফাঁসিয়ে দিয়েছি, কিন্তু আমি কি করে প্রমাণ করবো আমি গর্ভবতী? তুমি কেন এমন করছো বলো তো। ”

আমি আর সোহাগ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। ও-র কথাগুলো শোনা অনেক জরুরি। ওপাশ থেকে কি বলছে ঠিক বুঝতে পারলাম না। সুমনা কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, ” আমি তোমার সব কথা শুনবো, তুমি প্লিজ এমন বলো না। ”

আর কিছু না বলে কল কেটে দিলো। সুমনা মোবাইলটা রেলিং এ-র উপর রেখে কাঁদতে লাগলো। এতো সময় মনে করেছিলাম সুমনা এসব করছে কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে এসবের পিছনে অন্যকেউ আছে। তবে কি সোহাগের কোনো শত্রু! কিন্তু সোহাগের শত্রু আসবে কি করে! ও-র মা বাবার একমাত্র ছেলে। একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। কর্মক্ষেত্রে সকলের সাথেই ওর সম্পর্ক ভালো।

ছাঁদে না গিয়ে দু’জনেই আবার ঘরে চলে আসলাম। কিসব হচ্ছে আমাদের জানতেই হবে। সোহাগ নিজেই অবাক হয়ে গেছে সুমনার কথাগুলো শুনে।

–” আচ্ছা সোহাগ তোমার কি কোনো শত্রু আছে? কোনো প্রাক্তন প্রেমিকা বা এমন কিছু?”

–” আহ্! মোনালিসা আমি কি তোমার কাছে কিছু লুকিয়ে রাখি বলো? তুমি তো জানো সবকিছু। আমি বিয়ের আগে কখনো প্রেম করিনি। আর আমাকে কেউ পছন্দ করতো বলেও জানি না। ”

–” কিসব যে হচ্ছে আমি কিছু বুঝতে পারছি না। তবে এতটুকু নিশ্চিত যে সুমনা একা কিছু করছে না। বা নিজের ইচ্ছায় কিছু করছে না। কেউ ও-কে দিয়ে এসব করাচ্ছে। কিন্তু কে?”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here