তৃনভূমি,শেষ পার্ট (১ম অংশ)

0
169

#তৃনভূমি,শেষ পার্ট (১ম অংশ)
#ফারহানা_কবীর_মানাল

–” কিসব যে হচ্ছে আমি কিছু বুঝতে পারছি না। তবে এতটুকু নিশ্চিত যে সুমনা একা কিছু করছে না। বা নিজের ইচ্ছায় কিছু করছে না। কেউ ও-কে দিয়ে এসব করাচ্ছে। কিন্তু কে?”

–” বিশ্বাস করো মোনালিসা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তোমারও তো কোনো প্রাক্তন প্রেমিক নেই যে আমাদের আলাদা করতে চাইবে!”

চিন্তার মধ্যে সারারাত পার করলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে সবকিছুর জন্য সাহায্য চাইলাম। আল্লাহ ছাড়া কেউ আমাদের এই গোলকধাঁধা থেকে বের করতে পারবে না। ফজরের নামাজ পড়ে সোহাগ ঘুমিয়ে আছে। দুইদিন অফিস ছুটি নিয়েছে। সোহাগ হয়তো একটু বেশিই চিন্তা করছে। নয়তো অনেক কষ্ট পেয়েছে। ছোটবেলা থেকে অনেক আদরে বড় হয়েছে, এসব কষ্ট ও-কে কখনো ছুঁয়ে যেতে পারেনি। আমার শশুর আব্বু আর শাশুড়ি মা খুব ভালো মানুষ। দুইজনের প্রতি দুইজনের ভালোবাসাও অনেক। এখন কেউ কাউকে রেখে খাবার খেতে চায় না। মাঝে মাঝে উনাদের দেখে আমার হিংসা হয়।

সকালের দিকে একটু ছাঁদে হাঁটতে গেলাম। সোহাগ ঘুমিয়েই ছিলো। সারা রাত দুচোখের পাতা এক করেনি ছেলেটা। কেমন একটা স্তব্ধ হয়ে গেছে। শুধু মেয়েদের চরিত্রে দাগ লাগলেই মেয়েরা ভেঙে পড়ে না। সৎ ছেলেগুলোও চরিত্রের দোষ সহ্য করতে পারে না।

–” তুমি আমাকে দিয়ে এসব কেন করাচ্ছ বলো তো? একজন স্বামী তার স্ত্রীকে দিয়ে এসব কাজ… ‘

আমাকে দেখে সুমনা চুপ হয়ে গেলো। হয়তো ও-র স্বামীর সাথে কথা বলছে, হ্যাঁ স্বামী কথাটা ও নিজেই বলেছে, তার মানে এসবের পিছনে ও-র স্বামী জড়িত! যে মানুষটা বছর বছর দেশের বাইরে পড়ে থাকে সে কি করে এসবের সাথে যুক্ত থাকতে পারে?

–” কে আপনাকে দিয়ে কি করাচ্ছে ভাবি?”

–” কিছু না, আপনি এখানে?”

–” ছাঁদ তো শুধু আপনার একার নয় তাই না? আমিও যখন ইচ্ছে ছাঁদে আসতে পারি। তা বলুন তো দেখি সোহাগের নামে এমন মিথ্যা দোষ দিয়ে আপনার কি লাভ?”

সুমনা আনমনে হেসে দিলো। তারপর ব্যঙ্গ করে বললো, ” লাভ! জানেন তো মেয়েরা নিজের সংসারটা বাঁচাতে সবকিছু করতে পারে। ”

–” হ্যাঁ জানি, তবে এসব কথা তাদের মুখে মানায় না যারা অন্যের সংসার নষ্ট করে। আপনি চাইলেও আমার আর সোহাগের সংসার নষ্ট করতে পারবেন না। আল্লাহ আমাদের ঠিক সাহায্য করবে। ”

–” আমি আপনাদের সংসার নষ্ট করতেও চাই না। শুধু নিজের জন্যই! আপনি অনেক ভাগ্যবতী।”

সুমনা আর কিছু না বলে ছাঁদ থেকে চলে গেলো। এই সুমনা নামের মেয়েটা আমার কাছে রহস্য মনে হচ্ছে। কোনো এক চাপা কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছে যেন। আমাকে আগে এই সুমনার খোঁজ করতে হবে তাহলে রহস্য কিছুটা হলেও সমাধান করতে পারবো।

ছাঁদ থেকে নেমে এলাম। রান্না বসাতে হবে। সুমনার কথায় যতদূর বুঝতে পারলাম এসব ও-র বর করছে। কিন্তু ও-র বরের আমাদের সাথে কি শত্রুতা?
সোহাগ তখনও কোল বালিশ জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। বুড়ো বাচ্চাদের মতো লাগছে অনেকটা। মানে বুড়ো হয়েও বাচ্চাদের মতো ভাব ধরেছে এটা মনে হচ্ছে।

–” মোনালিসা কয়টা বাজে এখন?”

–” সাড়ে ছয়টা। কেন উঠবে তুমি?”

–” উহ্ না। তুমি এদিকে এসো তো। ”

–” এই সকাল বেলা আমি তোমার কাছে এসে কি করবো? আমার এখন রান্না করতে হবে। ”

–” কেন বরের কাছে কি শুধু রাতে আসা যায় নাকি?”

–” তুমি দিন দিন অনেক অসভ্য হয়ে যাচ্ছো কিন্তু! এসব কি ধরনের কথা?”

–” থাক লাগবে না। আমার কোল বালিশই ঠিক আছে। তুমি তেমার মতো থাকো বাপু। শরীর ভালো না উনার তাই একটু বিশ্রাম নিতে বললাম আর আমার মতো ভালো ছেলের ধাড়ে কিসব দোষ দিলো! ”

আমি সোহাগের কানের কাছে গিয়ে বললাম, ” কি দোষ দিচ্ছি আমি তোমাকে? তুমি কি কম ফাজিল নাকি?”

–” তোমার বুঝি আনরোমান্টিক বুড়ো বর পছন্দ? ”

—” যত্তসব! ”

–” হা হা হা… ”

সোহাগের পাশে বসে সোহাগের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললাম, ” তার বর এখন তো ঘুম ভেঙে গেছে। এখন উঠে পড়েন। ”

সোহাগ উঠে এসে আমার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লো। তারপর মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করে নিলো। আমি সোহাগের কপালে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। ইচ্ছে করে সুমনার কথাগুলো এড়িয়ে গেলাম। ও-কে এখন টেনশন দেওয়া হয়তো উচিত হবে না। কিন্তু সোহাগের কাছে জানতে হবে সুমনার বরের সাথে ও-র কোনো ঝামেলা হয়েছিলো নাকি! হলেও তা কত আগে।


সকাল দশটার দিকে বাবুর ঘুম ভাঙলো। এতো সময় বসে থাকতে থাকতে আমার কোমর ব্যাথা হয়ে গেছে।

–” তুমি এখনও বসে আছো?”

–” তো কি করবো আর!”

সোহাগ মুচকি হাসলো। আমি সকল খুশি যেন এই হাসির মাঝে সীমাবদ্ধ। এই হাসি দেখতে আমি শত কষ্ট করতে পারি।

–” আচ্ছা আজ সকালে আমি তোমাকে রান্না করে খাওয়াবো। ”

সোহাগ খুব মন দিয়ে রান্না করছে, বেশ কয়েকবার ও-র হাতের রান্না খেয়েছি আমি। ও খুব ভালো রান্না করে, কি করে শিখেছে কে জানে। সকালের খাবারের মেনুতে খিচুড়ি আর আচার। সোহাগ শুধু খিচুড়ি রান্না করবে, আচার শাশুড়ি মা বানিয়ে দিয়েছিলো। এখনও বেশ কিছুটা অবশিষ্ট আছে।
খুব তৃপ্তির সাথে সকালের খাওয়া শেষ করলাম। তারপর সোহাগ ল্যাপটপ নিয়ে বসলো আর আমি নিজের মতো ঘরের কাজ করতে লাগলাম। সুমনার ব্যাপারটা মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে একদম। বিকালের দিকে বিল্ডিংয়ের কয়েকজন মিলে হাসপাতাল থেকে রিপোর্ট নিয়ে আসলো। আমিও যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু সোহাগ যেতে দিলো না। সুমনা দুপুর থেকে বেপাত্তা হয়ে গেছে। সকলে মনে করেছিলো হাসপাতালে গেছে, কিন্তু ওরা হাসপাতালে যাওয়ার পর জানতে পারে সুমনা সেখানে যায়নি। কিন্তু সুমনা সেই দুপুর দুপুর ঘরে তালা মেরে কোথাও একটা গেছে এখনও আসেনি।

–” সোহাগ সাহেব আমরা সকলে দুঃখিত সুমনা মেয়েটির কথা বিশ্বাস করার জন্য। আসলে সমাজে এসব নতুন কিছু নয় তো তাই আমরা আপনাকে ভুল বুঝেছিলাম। ”

বিল্ডিংয়ের মালিকের কথায় খবরের কাগজ থেকে চোখ তুলে তাকালো সোহাগ। ওরা রিপোর্ট আনার পর জানতে পেরেছে সুমনা অন্তঃসত্ত্বা নয়। সুমনা সোহাগের নামে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, সকলে মিলে সুমনার কাছে জবাব চাইবে বলেছিলো কিন্তু সুমনা কোথাও নেই।
পুলিশ কেস করার কথাও দুই-একজন বলেছিলো বটে তবে সোহাগ এসব ঝামেলা করতে নিষেধ করেছে। সে যে কোনো অন্যায় করেনি এটা প্রমানিত হয়েছে এতেই সে খুশি। সত্যি বলতে সোহাগ খুব শান্ত প্রকৃতির একজন ছেলে। এসব ঝামেলা ও-র এতোটাও পছন্দ নয়। সোহাগের সাড়া না পেয়ে সকলে যার যার নিজের কাজে চলে গেলো।

আমি রান্নাঘরে দুপুরে খাওয়ার আয়োজন করছি। এমন সময় সোহাগ আমার কাছে গেলো।

–” তোমার ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না। শুধু বলবো তুমি আমার যোগ্য জীবনসঙ্গী। সুমনা এতো বড় একটা কথা বলার পরেও তুমি একবারও আমাকে সন্দেহ করোনি। আমাকে বিন্দুমাত্র অবিশ্বাস করোনি। আমি যেন আজীবন তোমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারি। ”

আমি মুচকি হেসে সোহাগের একটা হাত ধরে বললাম, ” এই তুমিটা বদলে না গেলে আমিও তোমাকে অবিশ্বাস করবো না। ”

সোহাগ মুচকি হেসে আমাকে ও-র বাহুর মাঝে আবদ্ধ করে নিলো। হালাল সম্পর্কগুলো এমনই হওয়ার উচিত। শত বাঁধার পরেও যেন তা টিকে থাকে। দু’জন মানুষ যেন শুধু দু’জনের হয়ে বেঁচে থাকে।

তারপর কেটে গেছে প্রায় দুইবছর। গতমাসে জানতে পেরেছি আল্লাহ আমাদের ঘরে নতুন মেহমান দান করেছে। সেদিনের পর সুমনার আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। ও-র শাশুড়ি বা কেউ ঘরের জিনিসগুলো পর্যন্ত নিতে আসেনি। হয়তো কেউ কখনো ও-র খোঁজ করেনি, যেমন আমরাও ফিরে দেখিনি আমাদের জীবনের কালো অধ্যায়কে! তবুও জানতে ইচ্ছে করে কেন করেছিলো এমন সুমনা নামের মেয়েটি! কি জন্য ও-র স্বামী এমন করেছিলো ও-কে দিয়ে? লোকটা কি ও-র স্বামী নাকি অন্যকেউ! এতোসব প্রশ্ন এড়িয়ে বেশ সুখেই আছে সোহাগ মোনালিসা।

–” আজকে আসার সময় আমার জন্য একটু আইসক্রিম নিয়ে আসবে?”

–” এতো আইসক্রিম খেলে বাবুর ক্ষতি হবে, তুমি বরং ফল খেতে চাও। আমি নিশ্চয়ই নিয়ে আসবো। ”

মোনালিসা মন খারাপ করে কল কেটে দেয়। তারপরই মুচকি হেসে ওঠে। মুখে না বললেও মানুষটা ঠিক আমার জন্য আইসক্রিম নিয়ে আসবে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here