#তৃনভূমি,শেষ পার্ট (শেষ অংশ)
#ফারহানা_কবীর_মানাল
–” আজকে আসার সময় আমার জন্য একটু আইসক্রিম নিয়ে আসবে?”
–” এতো আইসক্রিম খেলে বাবুর ক্ষতি হবে, তুমি বরং ফল খেতে চাও। আমি নিশ্চয়ই নিয়ে আসবো। ”
মোনালিসা মন খারাপ করে কল কেটে দেয়। তারপরই মুচকি হেসে ওঠে। মুখে না বললেও মানুষটা ঠিক আমার জন্য আইসক্রিম নিয়ে আসবে।
।
আজ তিনমাস হলো জানতে পেরেছি আমাদের ঘরে নতুন মেহমান আসছে। আজ সকালে সোহাগ জোর করেই আমাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। বেশ কয়েকদিন ধরে শুধু বমি হচ্ছিল, কোনো খাবার মুখে তুলতে পারছিলাম না। তাই সোহাগ কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না।
হাসপাতালের বারান্দায় বসে আছি। সোহাগ ডাক্তারের সাথে কথা বলতে গেছে, কখন কি খেতে হবে কেমন থাকতে হবে সব কিছুর লিস্ট লাগবে তার। সাথে শাশুড়ি মাও আছে একজন, ছেলেকে কল দিয়ে দিয়ে সবকিছুর নির্দেশনা দিচ্ছে। এদের অবস্থা দেখে আমার খুব হাসি পাচ্ছে।
–” মোনালিসা কেমন আছো? ”
অপরিচিত একটা মেয়ের ডাকে চোখ তুলে তাকালাম। মেয়েটার শরীর বোরকা হিজাবে ঢাকা। তবে চোখ দুইটা বেশ পরিচিত লাগছে। কোথাও দেখেছি যেন। কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছি না।
আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেয়েটা আবারও বলে উঠলো,
–” আমাকে হয়তো তুমি চিনতে পারোনি। আমি সুমনা। ”
সুমনা! নামটা শোনার পর আত্মাটা কেন জানি কেঁপে উঠলো। মনের মাঝে ঘুমিয়ে থাকা প্রশ্নগুলো এক এক করে জেগে উঠতে লাগলো।
–” তুমি কোথায় চলে গেছিলে? আর এখানে কেন?’
–” আমার স্বামীর সাথে এসেছি। আল্লাহ আমাদের ঘরে নতুন মেহমান দিয়েছে। তার জন্যই। ”
–” তোমার স্বামী বিদেশ থেকে চলে এসেছে?”
–” নাহ! এ আমার দ্বিতীয় স্বামী। তার সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে। নতুন বিয়ে করেছি ছয়মাস হতে চললো। ”
–” সুমনা কিছু মনে না করলে একটা কথা বলবে। তুমি সোহাগের নামে এমন মিথ্যা কথা রটিয়েছিলে কেন?”
সুমনা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আমার দিকে তাকালো। তারপর বললো, ” নিজের সংসার বাঁচাতে। আমার প্রাক্তন স্বামী আমাকে এসব করতে বলেছিলো। পাগলের মতো ভালোবাসতাম তাকে তাই সব মেনে নিয়েছিলাম। ”
–” আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। ”
–“অনেক বড় ঘটনা। দুই এক মিনিটে তুমি বুঝতে পারবে না। ”
–” সমস্যা নেই। তুমি বলো। ”
সুমনার চোখের কোণে অশ্রুকণা দেখা দিলো। তবে তা গুরুত্ব না দিয়ে বলতে শুরু করলো,
কলেজে পড়ার সময় প্রেম করে বিয়ে হয় আমার প্রাক্তন স্বামীর সাথে। কিন্তু তার পরিবার কখনো আমাকে মেনে নেয়নি। মানুষটা প্রথম প্রথম আমাকে খুব ভালোবাসতো জানো। তারপর টাকার প্রয়োজনে বিদেশে পাড়ি জমালো। অনেক কষ্ট করেছি আমরা তবু দুইজন হাত ছেড়ে চলে যাইনি। কিন্তু সমস্যা হয় গতবার দেশে আসলে, আমার শাশুড়ি ও-র হাত পা ধরে তার বোনের সাথে বিয়ে দেয়। ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অজানা ছিলো আমার কাছে। পরে একদিন কল দিয়ে বলে সোহাগের সাথে মিথ্যা প্রেমের অভিনয় করতে হবে আমাকে। সোহাগের সাথে তার নাকি কিসব পুরনো শত্রুতা আছে। আমি যদি এমনটা না করি তাহলে আমাকে ছেড়ে দিবে। জানো তো মোনালিসা আমার মা বাবা কেউ নেই। তাকেও পাগলের মতো ভালোবাসতাম তাই আমিও বোকার মতো রাজি হয়ে যাই। এরপর সবকিছু তার কথা মতো করতে থাকি। সে-ই আমাকে সব বুদ্ধি দিতো। তার পরিকল্পনা ছিলো আমার চরিত্রে দোষ দিয়ে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে, আর এদিকে তোমরা তো সাক্ষী রইলেই! কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব সত্যি আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। সেদিন সকালে তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর পরই তার নতুন স্ত্রী আমাকে কল দিয়ে তাদের পথ থেকে সরে যেতে বলে, আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না এসব তাই শাশুড়ি মা’য়ের কাছে ছুটে যাই। সেখানেই সবটা জানতে পারি। জীবনের প্রতি ঘৃণা ধরে গেছিলো। আর কখনো ফিরে আসতে ইচ্ছে করেনি। সোহাগের কোনো দোষ নেই। আমাকে পারলে তুমি মাফ করে দিও। আমি-ই বা কি করবো বলো কিছু মেয়েরা নিজের সংসার বাঁচাতে সবকিছু করতে পারে, আবার কেউ কেউ অন্যের সংসার নষ্ট করে। আমিও তোমাদের সংসার নষ্ট করতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারিনি। নিজের সংসারাটাও বাঁচাতে পারিনি। ছয়মাস আগে আবার বিয়ে হয়েছে আমার। নতুন স্বামীও খুব ভালেবাসে আমাকে কিন্তু কাউকে আর বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। ”
কথাগুলো বলে চোখের পানি মুছলো সুমনা। মেয়েটাকে কত খারাপ ভেবেছিলাম কিন্তু ও-র জীবনেও এমন কষ্ট লুকিয়ে আছে কে জানতো! কারো ব্যাপারে না জেনে কোনো কিছু অনুমান করা ঠিক নয়। এমন সময় কেউ সুমনার নাম ধরে ডাকলো। সুমনা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো, ” আমাকে ডাকছে, তুমি ভালো থেকো। দোয়া করি। সময় পেলে অন্যকোনো দিন সবকিছু খুলে বলবো। আমার জীবনও সিনেমার থেকে কম নয়। গল্পের থেকেও নিষ্ঠুর বাস্তবতা! ”
সুমনা ও-র স্বামীর সাথে চলে গেলো। মেয়েটার ভিতর কত কষ্ট চেপে রেখেছে অথচ কিছু বোঝাই গেলো না। সোহাগের মতো ভালো ছেলে যেমন আছে তেমনই সুমনার বরের মতো খারাপ লোকও আছে। আল্লাহ যে কার ভাগ্যে কাকে লিখে রেখেছে কে জানে! আমি যে সোহাগের মতো ভালো একটা মানুষকে পেয়েছি আল্লাহ কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া।
–” কি হলো তুমি কাঁদছো কেন? শরীর খারাপ লাগছে নাকি?’
সোহাগের কথায় হুঁশ ফিরে এলো। সোহাগের দিকে তাকিয়ে ও-কে জড়িয়ে ধরলাম।
–” আমি তোমাকে কখনো হারাতে চাই না। কখনোই না। ”
সোহাগ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, ” এ পাগলী কি হলো তোমার?”
–” জানো তো সুমনার সাথে দেখা হয়েছিলো। ”
–” আচ্ছা যার সাথেই দেখা হোক তুমি কাঁদছো কেন? আমি শুধু তোমারই। কান্না করো না প্লিজ।”
হঠাৎ করেই খেয়াল এলো এটা হাসপাতাল। আমি লজ্জা পেয়ে সোহাগকে ছেড়ে দিলাম। তারপর সুমনার কথা খুলে বললাম। সোহাগ শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর আমার হাত ধরে বললো, ” তোমাকে ধন্যবাদ সেদিন আমাকে বিশ্বাস করার জন্য। ”
–” এই তুমি না বলেছিলে ধন্যবাদ দিয়ে আমাকে ছোট করবে না। ”
–” কি মেয়ে রে বাবা! দুই বছর আগের কথা ভোলে না। আবার উনিই নাকি সুমনাকে চিনতে পারেনি। ”
–” ভালোবাসার মানুষগুলো একটু বিশেষ হয় প্রিয়। তোমার কথা আমার ভুলে যেতে ইচ্ছে করে না গো।
সোহাগ মুচকি হাসলো। তারপর এতো বড় একটা লিস্ট দেখিয়ে বললো, ” এসব তোমার রুটিন। কেমন হলো পড়ে বলো তো। ”
আমি হতাশ দৃষ্টিতে ও-র দিকে তাকিয়ে রইলাম। এসব আমাকে মেমে চলতে হবে। আর পারি না বাপু!
–” কি হলো?”
— কিছুই হয়নি হুহ। শুধু এতো বড় লিস্ট দেখে আমি হতাশ
খুবই হতাশ। ”
–” জানো আমি ডাক্তারকে বলেছি লিস্টে জানি আইসক্রিম না রাখে, তাহলে তুমি রোজই আইসক্রিম খেতে বায়না করবে। ”
–” একটু আইসক্রিম খেলে কি হয় শুনি? আমি তো বাচ্চা মানুষ নাকি!”
–” দুইদিন পর বাচ্চার মা হবে উনি নাকি এখনো বাচ্চা! ”
–” ইমমমম!”
আমি মুখ গোমড়া করে সোহাগের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সোহাগ আমার হাত ধরে হাসপাতালের বাইরে নিয়ে এলো। তারপর দোকানে গিয়ে একটা আইসক্রিম নিয়ে এসে আমার হাতে দিলো। যদিও নিজেই বেশিরভাগ খেয়ে ফেলবে তবুই এই এনে দেওয়াটাই আমার পরম প্রাপ্তি।
দিন শেষে প্রিয় মানুষের সাথে ভালো থাকার মাঝে এক অদ্ভুত শান্তি রয়েছে। সকলে এই সুখটা পায় না। অবশ্য সুখ জিনিসটা কিছুটা চাহিদার উপর সীমাবদ্ধ। এখন আইসক্রিমের বদলে যদি আমি হীরার আংটি চাইতাম হয়তো সোহাগের সামর্থ্যের বাইরে চলে যেতো। তখনই শুরু হতো সমস্যা। তবে আমি সত্যিই আর কিছু চাই না। শুধু সোহাগের সাথে ভালো থাকতে চাই।
সমাপ্ত