অভিশপ্ত জীবন
পার্ট ৩
লেখিকা #Fabiha_Busra_Borno
এইসব কথা ভাবতে ভাবতে দরজা খুলে দেখি মুহিত বিছানায় সুয়ে আছে আর ভাবি মুহিতের ঠিক কোমরের কাছে পা বিছানায় তুলে বসে আছে। মুহিত বলছিল, তোমার ওই বোনের বাড়ির মুহুর্ত গুলোর কথা মনে হলেই শরীরে কেমন যেন বিদ্যুৎ-শক লাগে। আবারও নতুন প্ল্যান করবে দুই মাসের মধ্যে।
আমাকে দেখে সাথে সাথে ভুত দেখার মতো চমকে উঠেছে দুজন। আর আমি ও নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছি না। কিভাবে এটা সম্ভব,, এতো দিনের মনের সন্দেহ টাই ঠিক। উউফফঃ জানালা এবং ঘরের জিনিসপত্র গুলো কেমন যেন চারিদিকে ঘুরছে,,দৃষ্টি নিভে আসছে, মনে হচ্ছে আমি মারা যাচ্ছি। মনে হয় মা আব্বাকে আর দেখতে পাবো না,,,,,,,,,,,
আমার পাশে মা আর চাচিরা বসে আছে। মুহিত পাশের একটা চেয়ারে,, হাতে স্যালাইন দেওয়া। বুঝতে পারছি না এটা কি স্বপ্ন নাকি বাস্তব। মাকে ডাক দিতেই মা বললেন,, ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করবি কবে বলতো,, সন্তান অসুস্থ এই কথা শোনার পরে মায়ের মনে কি হয় তা তো বুঝিস না। মুহিতের চোখের দিকে তাকালাম,, ভয় এবং চিন্তা দুটোই স্পষ্ট। মনে মনে হাসলাম শুধু,, হায়রে অভিশপ্ত জীবন আমার। এই কুৎসিত মনের মানুষকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করছিলাম। সকালের ঝলমলে রোদের কিরণ পড়েছে পুব জানালা দিয়ে। বুঝতে পারলাম রাতে জ্ঞান হারিয়েছিলাম। শাশুড়ী মা বললেন, কয়দিন থেকে কোন কিছু খায় না, আর প্রায় সব সময় সুয়ে থাকে শরীর খারাপ বলে। এভাবে মাথা ঘোরার কারণ মনে হয় সু-খবর!!!!!
গত মাসে তো পিরিয়ড হয় নি, আজ কত তারিখ? ভাবতেই দেওয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারে তাকালাম। ওহ!! আল্লাহ আজ প্রায় এক মাস পঁচিশ দিন,, কি হবে আমার সাথে। জীবনের কোন মুহুর্তে কি হতে চলেছে আমার সাথে?? আল্লাহ তুমি এমন কিছু যেন বাস্তবে দিওনা,,,,
মনে মনে এইসব দোয়া করছিলাম। মা তো খুশিতে বললো, বিয়ান তাহলে ডাক্তার কে আসতে বলেন আবারও, প্রসাব পরিক্ষা করলেই বোঝা যাবে। মুহিত ডাক্তার কে কল দিয়ে আসতে বলে। কিছু বলার মতো অবস্থা নাই,, শুধু মুহিতের দিকে তাকাতে ঘিন্না করছে আমার। ডাক্তার চলে আসছে, মা আমাকে নিয়ে টয়লেটে গেলেন,, আমি বারবার চাইছি সব যেন মিথ্যা হয়। আমি চাইনা এই পরিস্থিতিতে এমন কোন সংবাদ শুনতে। কিন্তু আমার সব আশায় বালি দিয়ে রেজাল্ট পজিটিভ হলো। সবাই অনেক খুশি শুধু খুশি নই আমি। হয়তো আল্লাহর দানে অখুশি হওয়ার শাস্তি পাচ্ছি সারা জীবন।
কেটে গেছে দুইদিন। মা চলে যাওয়ার পরে মুহিত আমাকে নানা আবল-তাবল বুঝাই। কিছু কথা বিশ্বাস হলেও পুরো টা বিশ্বাস হচ্ছে না। মুহিত চলে গেছে মেডিক্যালে। দেখতে দেখতে আরো তিন মাস অতিবাহিত হলো। পাঁচ মাস চলছে,, এর মাঝে মুহিত আর ভাবির অনেক কিছুই আমার চোখে পড়েছে। মাঝে মাঝে প্রতিবাদ করতাম, কিন্তু বিনিময়ে মাইর উপহার পেতাম। মুহিত আব্বার থেকে বাইক চাইছে আমাকে নিয়ে মেডিক্যালে যাবে বলে। ভ্যান বা অন্য গাড়িতে ঝাকুনি বেশি লাগবে তাই বাইক চাইছে। আব্বা মুহিত কে বাইক নিয়ে যেতে বললে, সে বাইক নিয়ে আসে আর আমাকে নিয়ে ওর মেডিক্যালে যায়। এই প্রথম ওর কাজের যায়গা তে আসছি। মুহিত ল্যাবে কাজ করে। কিছু কিছু নার্স মেয়েরা কেমন ভাবে যেন আমাকে দেখছিল।
যায়হোক,, বাচ্চার পজিশন ভালো কিন্তু কি বাচ্চা তা বোঝা যাচ্ছে না। আগামী মাসে আবারও আসতে বলেছেন। কেটে যায় আরো ১৫/২০ দিন,, মুহিত বাইক ফেরত দেয় নি। আব্বা আজ কল করে বলেছে বাইক দিয়ে আসতে আর বেড়িয়ে যেতে। রাতে মুহিত চরম মেজাজে বাড়ি ফেরে। এসেই বাইক চাইছে তাই নিয়ে আমার উপর রাগ ঝাড়তে শুরু করে। আগুনে কেরোসিন ঢালে শাশুড়ী।
খারাপের সাথে মুখ নাড়া টা বোকামি ভেবে চুপ করে আছি। আমার আব্বা কে আমি কখনোই বলতে পারবো না মুহিত কে বাইক দেওয়ার কথা। এমন দুশ্চরিত্র মানুষের জন্য আব্বার কাছে কোন কিছু দাবি করতে বিবেকে বাঁধে। আমি চুপ থাকলেও মা ছেলের চুপ থাকার নাম গন্ধ নেই। রাত পার হয়ে সকাল হয়েছে কিন্তু তাদের মুখ থামেনি। রাত থেকে অশান্তি, কিছুই খায় নি সকালে। বারান্দার খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে নিরবে কান্না করছি। এমন সময় মুহিত বলে,, অন্যের টাকা মেরে খায় ওর বাপ, চিটারী করে ইটের ঘর দিলেই কেউ জমিদার হয় না। দেখলেই কেমন চোর চোর মনে হয়। দিবো না ফেরত মোটরসাইকেল,, দেখি তোর কোন বাপ নিয়ে যায়। সাথে সাথে ভাবি বলে,, ওর গোষ্ঠীর কেউ বোঝে মেয়ে জামাই কে কি কি দিতে হয়,, আমার আব্বা নগদ ৭০,০০০ হাজার টাকা সহ ঘর সাজানোর সব কিছু দিছে,,,,,,,
আরো কিছু বলতে যাবে তখনই আমি চেঁচিয়ে বলে উঠি,,,এক মেয়ে দিয়ে যখন দুই জামাই আদর পাচ্ছে তাহলে এক জামাই কে এতো কিছু দিচ্ছে কিন্তু অন্য জামাই কে কেন দিচ্ছে না??তুমি নিজের সাথে আমার তুলনা করো কোন মুখে? লজ্জা করে না?দুশ্চরিত্রা মেয়ে,,,,,,,
সাথে সাথে মুহিত আমাকে লাত্থি মারে আর আমি উঁচু বারান্দা থেকে উপর হয়ে উঠোনে পড়ে যায়। এলোপাতাড়ি কিল ঘুষির পাশাপাশি রান্না ঘর থেকে জ্বালানি খড়ি হিসেবে রাখা মোটা বাঁশ দিয়ে পাঁয়ে এবং উরুতে আঘাত করে। উপর হয়ে পড়ার জন্য দাঁত লেগে ঠোঁট কেটে গেছে এবং নাক দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। উঠান রক্তে রাঙা হয়ে গেছে। হৈচৈ শুনে পাশের বাড়ির লোকজন আমাকে বাঁচায়। অবস্থা খুব খারাপ। আব্বা মা কে খবর দেওয়া হয়েছে। উপর হয়ে পড়া বা এলোপাতাড়ি মাইরের সময় হয়তো পেটেও আঘাত লাগছিলো তাই রক্তক্ষরণ হচ্ছে। মুহিতের মেডিক্যালে আনা হয়েছে আমাকে। দুই ব্যাগ রক্ত দেওয়া লাগছে আমাকে কিন্তু বাচ্চা টা নষ্ট হয়ে গেলো।
এ কোন শূন্যতা,,, কিভাবে এই শূন্যতা পুরোন হবে। কবে কখন বাচ্চার উপর এতো মায়া জন্মেছিলো বুঝতেও পারিনি। হায় আল্লাহ!! আমি তো মন থেকে বলিনি বাচ্চা টা পৃথিবীতে না আসুক। মেনে নিয়েছিলাম আমার নিয়তি কে। কেন জীবন টা এমন অভিশপ্ত করে দিলে,,কি পাপ করছিলাম আমি। যদি পাপ করেই থাকি তাহলে সেই শাস্তি কেন আমার পেটের সন্তানকে দিলে।
কিছুতেই শান্ত হতে পারছি না।
মেডিক্যাল থেকে সোজা বাপের বাড়িতে চলে আসছি। আর যাবো না ওখানে। কিসের জন্য যাবো কার জন্য যাবো। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলিয়েছি,
আমার এমন পরিস্থিতির কারণ জানতে পেরে মেডিক্যালের চাকরিটা চলে গেছে মুহিতের। বাবার বাড়িতে আসছি ৫/৬ মাস হলো। মাঝে মাঝে মুহিত গ্রামের এর ওর মোবাইলে কল দিয়ে আমার সাথে কথা বলতে চাই প্রথমে আমি কথা বলতে চাইতাম না। কিন্তু সময়ের সাথে রাগের পরিমাণ কমে যায়। তাই মাঝে মাঝে আমি ও দুই এক দিন কথা বলতাম। তারপর হুট করেই একদিন সন্ধ্যার পরে মুহিত আমাদের বাড়িতে চলে আসে,, আব্বা মোরের দোকানে ছিলো। মুহিত আমার ঘরে বসে আছে। মা আব্বাকে খবর দেওয়ার জন্য শামিম কে বলে। চাতক পাখির মতো ছটফট করছে আমার মন, মুহিতের কাছে যেতে। সকল দ্বিধা দ্বন্দ্ব দুর করে ঘরে যেতেই মুহিত আমাকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁট তার দখলে নিয়ে নেই। দীর্ঘদিনের ক্ষুধার্ত মন আমার নিমিষেই হারিয়ে যেতে চাইছে মুহিতের বুকের ভেতর। কিন্তু তখনই বাইরে আব্বার কথা শুনতে পায় তাই বাধ্য হয়ে বাইরে আসি। আব্বা গ্রামের বেশ কিছু মাথা মুরোব্বিদের ডাকলেন। নানা মত অভিমতের মধ্যে সিদ্ধান্ত হলো আগামী শুক্রবার মুহিতের গ্রামের চেয়ারম্যান মেম্বার সহ গণ্যমান্য লোকজনদের নিয়ে আসতে হবে।
তারপর ওই রাতেই মুহিত কে ফিরিয়ে দেওয়া হলো। ভিষণ কষ্ট হচ্ছে, যত যায় হোক অন্তত এতো রাতে না পাঠিয়ে সকালে পাঠালে কি হতো। এতো রাতে কোন গাড়ি পাবে না। পুরো রাস্তা হেঁটে যেতে হবে। সময় বহমান,, আজ শুক্রবার, আব্বা আমাদের এইদিকের অনেক লোকজন কে ডেকেছেন, মুহিতের ওখান থেকে লোকজন আসবেন দুপুরের পরে। আমাদের বাগানে বসার আয়োজন করা হয়েছে। যথা সময়ে সবাই উপস্থিত হলেন। শুরু হলো নানা রকম জিজ্ঞাসাপর্ব। মুহিত নিজের ভুল স্বীকার করে সবার সামনে ক্ষমা চাই এবং আমাকে ফিরিয়ে নিতে অনুরোধ করেন। আমাদের লোকজন ওর মুখের কথাকে বিশ্বাস করে নি তাই,, ভবিষ্যতে আমার কোন রকম ক্ষতি বা মানষিক বা শারীরিক নির্যাতন করলে আইনী ব্যবস্থা নেওয়া হবে আর সম্পুর্ণ দোষ হবে মুহিত এবং ওর ফ্যামিলি সদস্যদের উপর এমন লেখা বিশিষ্ট একটা স্টেম্প পেপারে সাইন করে নেন।
তারপর আমাকে নিয়ে যায়। বেশ ভালোই কাটছে দিনকাল। বর্তমানে মুহিত অন্যের ক্ষেতে খামারে দিনমজুর হিসেবে কাজ করে পাশাপাশি চাকরি খুজছে।আব্বা মার সাথে সম্পর্ক ভালো হয়েছে। মুহিত আমাকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে আব্বার থেকে কিছু টাকা নিতে বলে, সে ব্যাবসা শুরু করবে। অন্যের জমিতে কৃষি কাজ করতে তার কষ্ট হয়। আমিও ভাবলাম যেহেতু ভালোই আছি তাই আব্বা যদি টাকা দেয় আমাদেরই ভালো। এইসব ভেবে আব্বা কে টাকার কথা বলি। গতমাসে কোন এক এনজিও থেকে টাকা তুলে এবং একটা গরু বিক্রি করে টাকা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মুহিত টাকা নিয়ে বাইক কিনে নিয়ে চলে আসছে। মেঝো ভাবিকে ভাসুর নিয়ে গেছেন তার কাছে। তেমন কোন অশান্তি নেই। কিন্তু অভাগীর সুখ বলে কিছু নাই। মুহিতের ফোনে আমি তেমন হাত দিইনা আব্বা কল দিলে শুধু কথা বলি। একদিন মোবাইল রেখে মুহিত কোথায় যেন গেছে। ভালোও লাগছে না তাই ভাবলাম মোবাইলে সাপ খেলি। মোবাইল হাতে নিতেই দেখি মেঝো ভাবির মেসেজ। দুনিয়া মস্তষ্ক ঘুরতে লাগলো,, ভয়ে ভয়ে মেসেজ ওপেন করে দেখি ভাবি লিখেছে, সামনে সপ্তাহে তোমার ভাইয়ের রাতে ডিউটি, কাল না এসে রবিবার আসো।
আর কোন মেসেজ নাই সব মনে হয় ডিলিট করে রাখছে। আবারও ধোকা খেলাম। কোন মুখে আব্বার কাছে এইসব কথা বলবো। কয়দিন আগেও বারবার বলেছিল বুঝেশুনে টাকা নিও। টাকা দিতে কোন সমস্যা নেই কিন্তু ভালো মানুষকে দিতে হবে। কিন্তু আমি জোর গলায় বলেছিলাম, এক সময় খারাপ ছিলো কিন্তু এখন সে সম্পুর্ন আলাদা।
মুহিত বাড়িতে আসলে আমি মুহিত কে জিজ্ঞেস করি এইসব কথা। তখনই মুহিত আমাকে মারতে লাগে আর চিল্লায় চিল্লায় বলে আমি নাকি কারো সাথে চুপিচুপি ফোনে কথা বলি। মারতে মারতে আমাকে,,,,,,
চলবে,,,,