অভিশপ্ত_জীবন পার্ট ৬,০৭

0
367

#অভিশপ্ত_জীবন
পার্ট ৬,০৭
লেখিকা #Fabiha_Busra_Borno
০৬

নানান জন নানান ভাবে আমাকে বুঝাতে লাগলো। কি করবো কি সিদ্ধান্ত নিবো কিছুই বুঝতে পারছি না। মন বলছে রাজি না হতে। এর চেয়ে ভালো বর নাকি আমি পাবো না। আমি কি এতোটাই খারাপ, ডিভোর্সি হয়েছি বলেই কি এমন বুড়ো মানুষ কে বিয়ে করতে হবে। কিন্তু কাকে বলবো আমি এ বিয়েতে রাজি না।

আজ আমাদের পরিবার থেকে লোকজন গেছেন,, সব কিছু দেখে ঠিক ঠাক মনে হলে দিন তারিখ ঠিক করে আসবেন। আমি আল্লাহর কাছে বারবার ফরিয়াদ করছি যেন কোন ত্রুটি খুঁজে পায়। রাত হয়ে গেছে কিন্তু এখনো কেউ ফিরে নি। পপি একবার মা কে বলেছিল যে, মা লোকটা অনেক বুড়ো, আপুর সাথে বিয়ে দিও না। তখন মা আশেপাশের ৫/৬ জন কে আঙুলে গুনে দেখিয়ে দিলেন। যাদের বয়স কম কিন্তু স্বামীর বয়স বেশি এবং কিছু কিছু অল্পবয়সী বিধবা মেয়েদের। আমি এইসব শুনে কোন কথা বলতে পারলাম না।

মনে মনে বিয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি,, মনকে বুঝাচ্ছি মায়ের বলা কথার আলোকে। জানি এই জীবনে সুখ বলে কিছু পাবো না। অনেক রাতে আব্বা বাসায় আসছে। ঘুম আসেনি আমার, কান খাড়া করে মা আব্বার কথা শোনার চেষ্টা করছি। আব্বা বললো যে, ছেলে মেয়েরা বিয়ে দিতে অমত করছে কিন্তু উনি বিয়ে করতে চান। একবার বিয়ে হয়ে গেলে সব মেনে নিবে। তাছাড়া সুমি চাইলে নিজের নামে জমিজমা লিখে নিতে পারবে। তখন সুমিকে তাড়ায় কে। আর বয়স্করা বউকে বেশি আদর যত্নে রাখে।

মা অবশ্য ছেলে মেয়ে রাজি নাই এটা শুনে নিষেধ করেছিলো কিন্তু আব্বা উঠে পড়ে লেগেছে। দুইদিন পরে বিয়ে। খাবার মুখ দিয়ে নামছে না। ঘুম যেন হরতাল ডেকেছে। অশান্তি বুকের ভেতর সিডরের মতো আঘাত হানছে। খুব ইচ্ছে করছে মরে যেতে কিন্তু আত্নহত্যা করার জন্য যতটুকু সাহস দরকার তা হয়তো আমার মাঝে নেই। আমার মনের কথা বা কান্না বুঝা বা দেখার কেউ নাই। এভাবে কেটে গেলো এক বেলা,, ঘটক মুখ কালো করে এসে আব্বা কে বললো বিয়ে টা হবে না। উনার ছেলে মেয়েরা নাকি অনেক ঝামেলা শুরু করেছে তারা কিছুতেই বাপ কে বিয়ে দিবে না।

আল্লাহ মনে হয় আমার ডাক শুনেছেন। জীবনে এতো খুশি কখনো হয় নি মনে হচ্ছে। খুশিতে তারাতাড়ি অযু করে দুই রাকাআত নফল নামাজ পড়ে নিলাম। অনেক ভালো লাগছে আমার। জীবনের সব দুঃখ যন্ত্রণা যদি এমন ভাবে দূর হয়ে যেতো তাহলে আমার মতো মহা সুখী পৃথিবীতে আর কেউ থাকতো না।

সেলাইমেশিন এর পাশাপাশি কিছু হাঁস মুরগী রাখা শুরু করলাম। ছোট বোন এখন বড় হয়ে গেছে। শামিম ও ইন্টার পরিক্ষা দিবে। আজ পপি কে নিয়ে বাজারে কিছু কেনাকাটা করতে যাচ্ছি। এ-দোকান ও-দোকান ঘুরাঘুরি করার সময় হঠাৎ করে মুহিতের সাথে দেখা হয়। মুহুর্তেই আমার পুরো পৃথিবী থমকে দাঁড়ালো, মনের মধ্যে কেমন যেন দমকা হাওয়া চলছে। মুহিত ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চাহনিতে ভালোবাসা স্পষ্ট। নিমিষেই হারিয়ে গেলাম তার চোখের সমুদ্রে। আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ পুরুষ সে। কিভাবে ভুলবো তাকে। কোন রকম নিজেকে সামলিয়ে চলে আসছি আমি। কিন্তু ওই মুহুর্তের কথা ভুলতে পারছি না। জমানো কিছু টাকা দিয়ে বেশ কিছু দিন আগে মোবাইল কিনেছিলাম। বারবার ইচ্ছে করছে মুহিতের সাথে কথা বলতে। না কথা বলবো না। আমার জীবনের সব দুঃখ যন্ত্রণা গুলো মনে করতে করতে বৃথা চেষ্টা করছি মুহিত কে ভুলার। কিন্তু মন সে-তো নিজের কথা শোনে না,,,, অবশেষে রাতে মুহিতের নাম্বারে ছোট্ট করে মিস-কল দিলাম। অপর প্রান্ত থেকে মুহিত ও মনে হয় এই মিস-কলের অপেক্ষা করছিলো। সাথে সাথে কল ব্যাক করলো মুহিত। মনে হচ্ছে পরিচিত নাম্বার থেকে মিস-কল গেছে। হাত পা কাপাকাপি শুরু হয়ে গেছে। পপি আর আমি এক সাথে থাকি। কথা বলতে গেলে পপি জেগে যাবে। কিন্তু কল রিসিভ না করে থাকতেও পারছি না। কল কেটে যাওয়ার আগে রিসিভ করে টয়লেটের পিছনে গেলাম। কতদিন পরে সেই পরিচিত কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছি। চোখের পানি এমনই বেড়িয়ে যাচ্ছে।

কেমন আছো সুমি?

ভালো,,,,,

মনে পড়ে এখনো আমাকে?

,,,,,,,

চলনা আবারও নতুন করে শুরু করি,, আমার ভুল গুলো কে ক্ষমা করা যায় না?

তুমি তো একবার ভুল করো নি,, বারবার ভুল করেছো আর বারবার আমি ক্ষমা করেদিয়েছি। একটা মানুষ কে কত বার ক্ষমা করা যায়?

এটাই শেষ!! এই একবার বিশ্বাস করে দেখো, আর ঠকাবো না তোমাকে। আমি আমার ভুল বুঝতে পারছি এখন প্লিজ ফিরে আসো আর একবার।

তুমি কিভাবে ভাবলে তোমার বউ আছে তাও আবার তোমার কাছে আমি যাবো?

ওই বউকে তালাক দিছি প্রায় চার মাস আগে। মায়ের সাথে ওর মিলতো না। সব সময় কিছুনা কিছু নিয়ে ঝামেলা হতো। তার আগে দুইবার বিয়ে হয়েছিল সে কথা গোপন করেছিলো আমার কাছে। এইরকম অনেক মিথ্যা প্রকাশ পাই আমার কাছে তাই তালাক দিছি।

ভালোই তো তোমার সাথে মিলে গেছে,,,,

এমন কিছু কথা বলতে বলতে অনেকক্ষন হয়ে গেছে। আমি কল কেটে ঘরে এসে ঘুমিয়ে পড়ি। কেন জানি না আজ অনেক সুখ সুখ লাগছে। খুব অল্প সময়ে ঘুমিয়ে গেলাম। তারপর মাঝে মাঝে মুহিতের সাথে কথা হতো। আমি বললাম পরিবারের দ্বিমতে আমি আর তোমার কাছে যাবো না। পরিবার রাজি হলে আমি রাজি। তুমি সবাই কে রাজি করানোর ব্যবস্থা করো কিভাবে করবে জানি না।

মুহিত আমার ফুফা কে আবারও অনুরোধ করে এবং আমাদের যত আত্মীয় স্বজন আছে তাদেরকে অনুরোধ করে যেন আমার আব্বাকে বোঝায়। মুহিতের মা নিজে এসে ছেলের কর্মকান্ডের জন্য ক্ষমা চেয়েছে। পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন সবাই আর একবার সুযোগ দেওয়ার কথা বলে। অবশেষে আব্বা রাজি হয়। নতুন করে ২ লক্ষ টাকা কাবিন এবং আমাকে ২ ভরী গহনা দেওয়ার শর্ত দেয় আব্বা। এটা শুনে মুহিত ঘাবড়ে যায় কারণ দুই ভরী সোনা কেনা তার পক্ষে সম্ভব না কিন্তু আমি অভয় দিলাম রাজি হতে। প্রয়োজনে গহনা ভাড়া করে আনতে বলি আর যদি কিনে আনে তাহলে পরে আমি নিজেই বিক্রি করতে দিবো মুহিত কে। সম্পুর্ণ শর্ত মেনে নিয়ে মুহিতের সাথে আবারও বিয়ে হয় আমাদের।

আমি মুহিত দুজনেই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি। সকল বাজে অভ্যাস ত্যাগ করেছে মুহিত। অটোরিকশা কিনেছে আমার গহনা বিক্রি করে। প্রতিদিন ব্যাগ ভর্তি বাজার করে জামা কাপড়ের অভাব নাই। সারা মাসে দুজনের মধ্যে জোরে কথা হয় না। দুজনের ই ভুল বুঝাবুঝি আর ছন্নছাড়া জীবনের জন্য একটা বাচ্চা নাই বলে প্রথম দিন থেকেই একটা বাচ্চার আশায় প্রতিটি মাস শেষে অপেক্ষা করি। কিন্তু পরম করুনাময় হয়তো আরো পরিক্ষা নিবেন বলে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। চার/পাঁচ মাস যাওয়ার পরে গাইনি ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিলাম তারপর প্রায় দুই তিন মাস পরে কন্সিভ করি। খুশিতে মুহিত পুরো পাড়াতে মিষ্টি বিতরণ করে। কিন্তু তিন মাসে বাচ্চা নষ্ট হয়ে যায়।

তারপর দুই/তিনবার কন্সিভ করি কিন্তু বাচ্চা অটোমেটিক নষ্ট হয়ে যায়। কত ডক্টর চেঞ্জ করলাম কত কবিরাজের ঔষধ খেলাম কোন কাজ হলো না।এখন তো তিন/চার বছর থেকে কন্সিভ করি না। বাচ্চার আশা একদম ছেড়ে দিছি। মুহিতের আর বিন্দু পরিমাণ কোন দোষ আমি বা আমার ফ্যামিলি বের করতে পারিনি। কিন্তু আমি বুঝতে পারি বাবা ডাক শুনতে তার মন কতটা ছটফট করে।

মাঝে মাঝে ফাজলামো করে মুহিত কে আবার বিয়ে করার জন্য বলতাম। কিন্তু মুহিত খুব রেগে যেতো আর বলতো, আমার করা পাপের শাস্তি আমি পাচ্ছি,, একটা সন্তান জীবনের সব না। মুহিতের এইসব কথা খুব ভালো লাগতো। আমার চাচাশ্বশুর এর মেয়ের স্বামী রোড এক্সিডেন্ট এ মারা গেছে কিছুদিন আগে। চার বছরের একটা ছেলে আছে। খুব ভালো মানুষ ছিলেন উনি। চাচা শশুরের মেয়ের নাম রুনা। রুনা মেয়েটাও বেশ শান্ত ও নম্র।আগে থেকেই আমার সাথে ভালো সম্পর্ক ছিলো রুনার। হঠাৎ করে এমন কিছু ঘটে যাওয়াতে মেয়েটা প্রায় পাগল হয়ে গেছে। প্রায় সময় আমি রুনার সাথে কথা বলি, বুঝায়, সান্ত্বনা দিই। রুনার ছেলে টাও অনেক সুন্দর, শিহাব নাম। শিহাব কে দেখলেই কেমন যেন আপন আপন লাগে। মনে হয় আল্লাহ চাইলে আমার এই বয়সী বাচ্চা থাকতো।

মুহিত সব সময় খাওয়ার জন্য ফলমূল বিস্কিট মিষ্টি ইত্যাদি কিনে এনে রাখতো বাসায়। আমি সেগুলো শিহাব কে দিতাম। যেহেতু আমি সব সময় একা একা বাড়িতে থাকি তাই শিহাব কে আমার কাছে রাখতাম। স্বামী মারা যাওয়ার কারণে চাচা রুনাকে আর ওর স্বামীর বাড়ি থাকতে দেন নি। অল্প বয়স তারউপর স্বামী নাই, দুষ্টু মানুষের তো আর অভাব নেই তাই এখানে নিয়ে আসছেন। মাঝে মাঝে রুনার শশুর শাশুড়ী এসে শিহাব কে দেখে যায়, রুনাও দুই এক দিন যেয়ে থেকে আসে।

শিহাব এখন আমাকে ছাড়া কিছু বোঝে না,, সব সময় সুমি মামি সুমি মামি করে। আব্বার বাড়িতে আসার সময় শিহাব কে নিয়ে এসে দুই/তিন দিন করে থেকে যায়। রুনাদের বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে দুটো বাড়ি পরে। মাঝে মাঝে সন্ধ্যার পরেও শিহাব যেতে চাইতো না তাই রুনা শিহাব কে নিতে এসে আমার সাথে অনেক গল্পগুজব করতো।এভাবে মাঝে মাঝে রাত আটটা/নয়টা বেজে যেতো গল্প শেষ হতে। তারপর আমি বা মুহিত রুনাকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসতো।

এভাবে একদিন,,,,,,,,,

চলবে,,

#অভিশপ্ত_জীবন
পর্ব – ৭
লেখিকাঃ- #Fabiha_Busra_Borno

এভাবে একদিন দুইদিন করে সময় পার হতে লাগলো। মুহিত সব সময় রুনাকে নিজের ছোট বোনের মতো আদর করতো। তাদের কথা এবং চলাফেরায় কখনো খারাপ কিছুই দেখিনি। হঠাৎ মুহিতের পেটে প্রচুর ব্যাথা শুরু হয়। গ্রামের ডাক্তারের চিকিৎসাতে ভালো কিছু না পেয়ে রাজশাহীর পপুলারে নিয়ে যায়। মুহিতের পেটে টিউমার ধরা পড়েছে। অপারেশন করা লাগবে। প্রয়োজনীয় টাকা পয়সা নিয়ে অপারেশন করার জন্য যায়। মোট ৭ দিন ছিলাম রাজশাহীতে। আমার হাঁস মুরগী সহ পুরো বাড়ির দেখা শোনা এবং আমার অসুস্থ শাশুড়ীর খেদমত সব কিছু রুনা এক হাতে সামলিয়েছে। মুহিত কে নিয়ে বাসায় আসার পরেও নানান ভাবে আমার বিভিন্ন কাজে রুনাকে সাথে পেতাম।

ছোট্ট পপি বড় হয়ে গেছে এমনকি বিয়ে ঠিক হয়েছে। আগামি সপ্তাহে বিয়ে। মুহিতের উপর সমস্ত দ্বায়িত্ব পড়ে। কাকে কিভাবে খাওয়ানো হবে, কি কি আয়োজন হবে, কোথায় কত টাকা খরচ হবে সব কিছু মুহিত সুন্দর ভাবে পরিচালনা করছে।আমরা বিয়ের তিন দিন আগেই আসছি। ছেলেটার বয়স একটু বেশি। প্রাইমারী স্কুলের সহকারীর শিক্ষক তবে ময়লা। আমার বোন টা টুকটুকে ফর্সা, নায়িকাদের মতো হওয়ার জন্য ওর নাম রেখেছিল পপি।আমি আমার জীবনে এমন কোন অধ্যায় নাই যা পার করিনি।মনের মতো পাত্র না পেলে কতটা কষ্ট হয় তাও বুঝি আমি। তাই নিজ অভিজ্ঞতা থেকে ছেলে কালো এটা নিয়ে পপির কোন সমস্যা আছে নাকি জিজ্ঞেস করলাম। বিয়েতে মন থেকে রাজি তার এইসবে কোন চিন্তা নেই, নিজে মুখে বললো পপি। নগদ সাত ভরী গহনা আর সরকারি চাকরি করা বর এইসব কথা বলে বলে হয়তো সবাই পপির কচি ব্রেন-ওয়াশ করেছেন। যায়হোক আমি ও কিছু বললাম না।

মনে মনে আল্লাহর কাছে একটাই দোয়া করে যাচ্ছি যেন আমার মতো কোনো কিছুর সম্মুখীন হতে না হয় আমার ছোট্ট পরীটার। শিহাবকে সাথে নিয়ে আসছি আমি। একটু দুরের আত্মীয়রা যারাই আমার সাথে শিহাব কে দেখছে তারাই ভাবছে আমার ছেলে। অনেকেই জিজ্ঞেস করছে ছেলে এতো বড় হলো কিন্তু তারা জানে না। বিয়ের বিভিন্ন দিক দেখাশোনা করা ও নানান রকম কাজের মধ্যে খুব ব্যাস্ত দিন কাটছে। আজ বিয়ে, বরযাত্রী হিসেবে কয়েকজন মেয়ে এসেছেন। আমি তাদেরকে বসানোর জন্য আলাদা ঘরে আনলাম। তাদের সাথে পরিচয় পর্ব শেষ করে আরো অনেক কথা বার্তা হলো। আমার ছেলেমেয়ে সম্পর্কে জানতে চাইলে আমি বলি, আমার ছেলেমেয়ে হয় নি।এটা শুনেই অনেকের মুখ কালো হয়ে গেলো। আমি কি ভুল কিছু বললাম,, সত্যি কথা বলা কি আমার উচিত হয় নি। আজ মিথ্যা বলার পরে যখন তারা জানবে আমি নিঃসন্তান তখন কি হবে? দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পরে বরপক্ষের একজন আকার ঈঙ্গিতে এটা সেটা বলা শুরু করে। মেয়ের বড় বোনের বাচ্চা নেই এটা সহজ কথা না। যদি বড় বোনের মতো ছোট বোনের অবস্থা হয় তখন কি হবে।

এমন ছোট ছোট নানা গুঞ্জন উপেক্ষা করে অবশেষে বিয়েটা সম্পুর্ন হলো। বিদায়ের সময় সবাই কান্না করছে কিন্তু আমি শান্ত কন্ঠে পপিকে বললাম,, জীবনের সকল বাধা-বিপত্তি ও নানা কূল প্রতিকূলে নিজেকে শান্ত রেখে সিদ্ধান্ত নিবি। আমার মতো হুট হাট করে ভুলভাল কোন সিদ্ধান্ত নিবিনা। আর পারলে যত তারাতাড়ি সম্ভব একটা বাচ্চা নিবি।সামান্যতম কোন ক্ষুতও যেন কেউ বের করতে না পারে।

পরেরদিন বউভাতে সকলের সাথে আমি ও গেলাম। কেন জানি না সবাই আমাকে দেখছে। বুঝতে পারলাম তাদের তাকানোর কারণ, নিজেকে জোকার মনে হচ্ছে। আমি তো বন্ধা নই তাও সবার চোখে আমি বন্ধা নারী। পপিকে নিয়ে আসার পরে জানতে পারলাম,, রাতেই নাকি আমার বন্ধত্বা নিয়ে আলোচনা সমালোচনার পাহাড় বেধেছিল ওবাড়িতে। জীবন টা এমন হয়েছে যে হাজারো আনন্দঘন অনুষ্ঠানে গেলেও আমার জন্য সেখানে বিন্দু পরিমাণ আনন্দ থাকে না।

পপির বিয়ের চার মাস হতে না হতেই মা হতে চলেছে আমার সেই ছোট্ট বোনটা। এটা আমার কাছে অনেক আনন্দের সংবাদ হওয়ার কথা কিন্তু আমার ভিতরে ঈর্ষা অনুভব হচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে এভাবে খবর টা কেন আমি দিতে পারিনা। ছোট বোন মা ডাক শুনতে পাবে অথচ আমি বড় বোন হয়ে প্রতিদিন রাতে বাচ্চার জন্য আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করি। এই খবরটা শুনার পরে সারাদিন কিছু খায় নি। সুয়ে বসে অতীতের স্মৃতিচারণ করে দিন পার করলাম।

শাশুড়ির বয়স হয়ে গেছে, দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ কিন্তু বর্তমানে অবস্থা খুবই করুন। এই মানুষটাও এক সময় আমাকে কম অত্যাচার করেনি কিন্তু সময়ের ব্যবধানে তিনিও মুহিতের মতো পালটে গিয়েছিলেন। আমি নিজের মায়ের মতো যত্ন-আত্তি করি উনার। প্রতিদিনের প্রসাব-পায়খানার বিছানা কাঁথা পরিষ্কার করা সহ আরো অনেক কিছু করি। মনের মধ্যে কখনো বিরক্ত আনি নাই এইসব কাজ করতে। শশুর শাশুড়ী থাকা মানে আলাদা শক্তি থাকা। এমনও অনেক রাত গেছে মুহিত বাসায় ছিলো না কিন্তু শাশুড়ী থাকায় কখনো কেউ দুষ্টু কথা বলার সাহস পায়নি।

বড় ভাসুর এবং মেঝো ভাসুর সহ আরো অনেকে এসেছেন আজ। মায়ের খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝা যাচ্ছে উনার নিশ্বাস ফেলা এবং চোখ মুখের আকৃতি দেখে। সন্ধ্যা থেকে গুরুতর অবস্থার সাথে প্রাণপণ লড়াই করে অবশেষে পরাজিত সৈনিক হলেন। মাথার উপর থেকে ভরসার খুঁটি হারিয়ে গেলো ভেঙে পরলাম অনেক। পরের দিন সকাল দশ-টাই জানাজা শেষ হলো। দূরের আত্মীয়রা চলে গেছে। মা আব্বা, খালাশাশুড়ি আর মেঝো জা আছে শুধু। চারদিন পরে সবাই চলে গেলো। কিন্তু আমি একা বাড়িতে থাকতে পারি না। খুব ভয় করে। কোন ভাবেই শাশুড়ীর ঘরে যেতে পারিনা। মুহিত কোথাও কাজে গেলে আমিও বাইরে অন্যদের বাড়িতে বসে থাকি। মুহিত সারাদিন বাড়িতে থাকলে পেট চলবে না তাই কিছুদিন পরে থেকে অটোরিকশা নিয়ে আগের মতো কাজ শুরু করে দেয়। বাড়ি ফিরতে মাঝে মাঝে রাত ১০ বেজে যেতো। সুমি আর শিহাব কে আমার কাছে রাখতাম। যেদিন তারাতাড়ি মুহিত ফিরতো ওইদিন সুমিকে বাড়িতে রেখে আসতাম আর যেদিন রাত বেশি করে আসতো সেদিন আমি সুমি শিহাব এক সাথে ঘুমাতাম আর মুহিত অন্য ঘরে ঘুমাতো।

ইদানিং সুমিকে বিয়ে দেওয়ার জন্য পাত্র দেখা দেখি শুরু হয়েছে। সারাজীবন তো মেয়েকে ঘরে বসিয়ে রাখা যাবে না। কোথাও না কোথাও বিয়ে দিতেই হবে। অন্য কোথাও সুমির বিয়ে হলে শিহাব কে ওর দাদা দাদি নিয়ে যাবে। যখন ইচ্ছে সুমি বা সুমির বাবা-মাও শিহাব কে নিয়ে আসতে পারবে। সুমির বিয়ের ভালো মন্দের তদারকি সুমির শশুর শাশুড়ীও করছেন। উনারাও চান ভালো কোন ছেলের সাথে সুমির বিয়ে হোক।

আমার মাথায় অত্যাধিক ভালো মানুষ সাজার ভূত চাপছে। কিছুতেই শিহাব কে আমি দূরে রাখতে পারবো না। চোখের সামনে ভেসে ওঠে আমাদের গ্রামের মজিবুর চাচার দুটো বউয়ের মিলে মিশে থাকা স্মৃতি গুলো। একজনের বাচ্চা হয় না বলে আবারও বিয়ে করিয়েছিলেন মজিবুর চাচা কে। আমারও মন চাইছে মুহিত কে বাবা ডাক শোনানোর স্বপ্ন কে বাস্তবে রুপ দিতে। বারবার মনে পড়ছে ঢাকায় যখন প্রেগন্যান্ট হলাম তখন মুহিতের সেই আনন্দের কথা গুলো, বাবা ডাক শুনতে তার কত আকুলতা দেখেছিলাম তার মাঝে। এখনো হয়তো সেই অনুভূতি গুলো আছে মুহিতের কিন্তু আমি কষ্ট পাবো ভেবে কিছু বলে না।

গত দুই দিন থেকে ভাবছি এইসব কথা। মুহিতের সাথে কোন রকম আলাপ আলোচনা না করেই অনেক বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। শিহাব বা রুনা কাউকে আমি দূরে যেতে দিবো না। শাশুড়ি বৃদ্ধা হয়ে পড়ে ছিলো আমরা ছেলে/ছেলের বউরা তার সেবা যত্ন করেছিলাম। কিন্তু আমার বা মুহিতের বৃদ্ধা অবস্থায় কে দেখাশোনা করবে।আর এমন নিশ্চুপ একা বাড়িতে থাকতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। মুহিত যাওয়ার পরে কথা বলার জন্য কাউকে পায় না। তাই আমি আমার চাচা শশুর কে সরাসরি বললাম মুহিতের সাথে রুনাকে বিয়ে দেওয়ার কথা। হঠাৎ আমার মুখে এমন কথা শুনে উনি অবাক হয়ে চেয়ে থাকলেন। আমিও ধিরে ধিরে আমার মনের মধ্যে হওয়া কথা গুলো বুঝিয়ে বললাম। চাচা শুধু বললেন আগে ভেবে চিন্তে দেখি।

দুইদিন পরে মুহিত বাড়ি ফিরে সরাসরি আমাকে থাপ্পড় মারে। বুঝলাম না কেন থাপ্পড় দিলো, সকালেই তো ভালো মানুষ খাওয়া দাওয়া করে অটো নিয়ে বাইরে গেলো। এইসব ভাবতেই মুহিত চিল্লায়ে বলা শুরু করেছে,, খুব শখ তোর সতিনের সাথে সংসার করার তাই না। এতো বার এতো কিছু করলাম তাও তোর সখ মিটেনি? এখন আবারও সখ জাগছে! তোর একবারও কি লজ্জা করলো না যাকে আমি বোন ভাবি তার সাথে এইসব কথা বলতে।

বুঝতে পারলাম কেন এতো বচ্ছর পরে আবারও আমার গায়ে মুহিত হাত তুললো। কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল। মুহিতের সাথে সারাদিন আর তেমন কথা হলো না। রুনা বা শিহাব কেউ আর আসেনি আমাদের বাসায়। আমি আমার বড় ভাসুর কে বললাম মুহিত কে যেনো বুঝায় একটু। বেশ কিছু দিন থেকে মুহিত কে বুঝানোর পরে মুহিত রাজি হয়। রুনার মা বাবা শশুর শাশুড়ী সবাই রাজি। আর রাজি হবেই না বা কেন নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার এবং ছেলে পাচ্ছে।

ঘরোয়া ভাবে বিয়ে টা করাতে হবে। আমি মুহিতের থেকে টাকা চাইলাম আপাতত কিছু কেনাকাটা করার জন্য কিন্তু মুহিত কোন টাকা দিলো না। আমার কাছে জমানো কিছু টাকা ছিলো তা দিয়ে দুটো শাড়ি একটা থ্রি পিস, সেন্ডেল, শিহাবের জন্য শার্ট-প্যান্ট আর দুটো গেঞ্জি নিলাম। বিকালে রুনাদের বাড়িতে গিয়ে মেহেদী লাগিয়ে দিলাম। তারপর বাড়িতে এসে দরজা বন্ধ করে ইচ্ছে মতো কান্না করলাম। প্রথম প্রথম তাই হয়তো খারাপ লাগছে কিছু দিন গেলেই সব কিছু সহনীয় হয়ে যাবে। আর আমি তো অজানা কাউকে স্বামীর ভাগ দিচ্ছি না। রুনা অনেক ভালো মেয়ে সে নিশ্চয়ই কখনো আমাকে সতীন ভাববে না। নিজের বোনের মতো করে থাকবো দুজন। মাগরিবের আজান হচ্ছে অজু করে নামাজ শেষ করে বড় ভাসুরে বাড়িতে গেলাম।

ভাবি আমাকে দেখে বুঝতে পারছে সারাদিন আমি কিছু খায় নি তাই জোর করে খেতে দিলেন। খাবার খেতে মোটেও ইচ্ছে করছে না।ভাবির জোরাজোরিতে কোন মতে দুই লোমকা মুখে নিলাম। ভাবি আমাকে বুঝাতে লাগলেন। সুখে থাকতে নাকি আমাকে ভুতে কিলাচ্ছে। বাকি জীবন কি চোখের সামনে নিজের বর কে অন্য কারো সাথে দেখে সহ্য করতে পারবো?

আমি নিরবে চোখের পানি মুছে বললাম,,

এর আগেও তো মুহিত কে অন্য কারো সাথে একাধিকবার দেখেছি, তখন সহ্য করতে পারলে এখনো পারবো। আর আমি জানি মুহিতের কাছে আমি কতটা আপন। মুহিত আর কখনো আমাকে কষ্ট দিবে না।

অনেক রাতে মুহিত বাড়িতে এসে আমাকে না দেখে এখানে আসছে খোঁজ করতে। আমি আর মুহিত বাড়ি চলে আসছি। মুহিত কে খেতে বললাম, সে খাবে না। আমিও আর জোর করলাম না। সব ঘরে তালা দিয়ে গেইট বন্ধ করে ঘুমানোর বন্দবস্ত করলাম। মুহিত চুপচাপ অন্য দিকে মুখ করে সুয়ে আছে। আমি লাইট নিভিয়ে পাশে সুয়ে পড়ি। কিছুক্ষণ পারেই মুহিত আমাকে জড়িয়ে ধরে ছোট বাচ্চাদের মতো কান্না করতে থাকে আর বলে,, আমার জন্য আর কত ত্যাগ করবে তুমি, জীবনে কখনো তোমার কষ্ট গুলো বুঝিনি, অন্য নারীতে মত্ত্ব থাকা একটা ছেলে তোমার ধৈর্যের কাছে পরাজিত হয়ে, তোমাকে নিয়ে বাকি জীবন কাটাতে চাইছিলো। আমি কখনো চাইনি তুমি ছাড়া অন্য কোন নারীকে স্পর্শ করতে। তোমার মতো মেয়েকে বউ হিসেবে পেয়ে আমি সত্যিই ধন্য।

তুমি যতটা সহজ ভাবছো বাস্তব ততটা সহজ না। তোমার সরল মনে কঠিন চিন্তা ভাবনা কখনো আসে না তাই সব কিছু কে তোমার সহজ মনে হচ্ছে। কাল থেকে হয়তো তোমার যন্ত্রণা গুলো নতুন ভাবে জেগে উঠবে। তুমি বা আমি চাইলেও আর সেই যন্ত্রণা থেকে তোমাকে মুক্তি দিতে পারবো না।

আমি নিরব শ্রোতা,, নিরবে মুহিতের বুকে মাথা রেখে চোখের লোনাপানি ঝাড়াচ্ছি আর ভাবছি, কাল রাতে হয়তো এতোক্ষণ এই বুকে অন্য কেউ মাথা রেখে পরম তৃপ্তিতে নতুন জীবনের সুচনা শুরু করবে।

চলবে,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here