রাত বারোটা ছুঁই ছুঁই। ঝড়বৃষ্টির রাত। কারেন্ট নেই। মোমবাতি জ্বালিয়ে তুলতুলের বিছানা ঠিক করছে সাহেদা বেগম। আবার জ্বর এসেছে তুলতুলের। সাহেদা বেগম অনেক বার তৌফিক রহমানকে ফোন করতে চাইছিলেন কিন্তু তুলতুল করতে দেয় না। বলে বাবা জানলে নিয়ে যাবে তুলতুলকে। কিন্তু এখন তুলতুল এখান যেতে চায় না।
সাহেদা বেগম বেশ বুঝতে পারছে কিছু একটা হয়েছে। যে তুলতুলকে কেউ একটা ধমক দিলে তার আশেপাশে যায় না সপই তুলতুল সায়ানের এতো অত্যাচার সয্য করে এখানে পড়ে আছে। এমনি এমনি? কখনোই না। কিছু একটা হয়েছে?
বছর খানিক আগেও তুলতুলকে বাড়ি থেকে কোথাও যাওয়ার কথা বললে মেয়েটা সোজাসাপ্টা না করে দিতো। বাবাকে ছেড়ে একটা দিনও থাকতে পারতো না মেয়েটা। সেই মেয়েটাই এখন গ্রামে যেতে চায় না। খুব কম কথা বলে বাবার সাথে। ছোট ভাইটারও তেমন খোঁজ নেওয়া হয় না। মায়ের সাথে তো এই কয়দিন কথাই বলা হয় নি। কখনো বাবা মাকে ছেড়ে আসার আর্তনাদও দেখা যায় না মেয়েটার চোখে।
কি হয়েছে মেয়েটার?
“গ্রাম থেকে ঘুরে আয় কদিন।
তাচ্ছিল্য হাসি ফুটে ওঠে তুলতুলের মুখে। সাহেদা বেগম এই হাসির কারণ বুঝতে পারে না। গ্রামে যাওয়ার কথায় হাসার কি হলো?
“হাসছিস যে?
বাবার সাথেও তেমন কথা বলিস না। কল রিসিভ করিস না। কি হয়েছে বল তো তোর?
কম্বল ভাজ করে দিতে দিতে বলেন সাহেদা বেগম। চমকে ওঠে তুলতুল। সাহেদা বেগমের দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়৷ তুলতুল কখনোই চোখে চোখ রেখে মিথ্যা বলতে পারে না।
” বলছিস না যে?
তুলতুলের পাশে বসে জিজ্ঞেস করেন উনি। তুলতুল কোনো কথা না বলে শুয়ে পড়ে ফুপির কোলে। অবাক হয় সাহেদা বেগম। পরে মুচকি হাসে। গায়ে বেশ ভালোই জ্বর। হয়ত খারাপ লাগছে।
“ঠিক করে শো
আমি তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দেবো।
তুলতুল নরে না। ওভাবেই থাকে।
” এভাবেই ভালো লাগছে।
তুলতুল আস্তে করে বলেন।
সাহেদা বেগমও আর ঘাঁটান না। অসুস্থ মেয়েটা। এতো প্রশ্ন করা ঠিক হবে না।
আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয় তুলতুলের মাথায়।
“মা বাবা ডাকছে তোমায়।
সায়ান দৌড়ে রুমে ঢুকে বলে। মেকি হাসি দিয়ে বলে সায়ান
সাহেদা বেগম চোখ ছোট ছোট করে তাকায় সায়ানের দিকে। মায়ের দৃষ্টি দেখে সায়ান গাল ফুলায়।
” এই যে আমার টিশার্ট ছুঁয়ে বলছি বাবা সত্যি ডাকছে তোমায়।
বিশ্বাস করো।
টিশার্ট মুঠো করে ধরে বলে সায়ান।
সাহেদা বেগমের হাসি পায়। তবুও হাসি চেপে রাখে।
“দেখ আব্বা তোকে আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছি। তুলতুলের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। কয়েকদিন পরেই বিয়ে।
চমকে ওঠে তুলতুল। হুরমুর করে সাহেদা বেগমের কোল থেকে মাথা উঠায়। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। গলা ধরে আসছে তুলতুলের। ঠোঁট কামড়ে চোখ বন্ধ করে নেয়।
সাহেদা বেগম তুলতুলের কান্ড খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ করছে।
” আরে মা আমি তো তুলাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছি না বলো?
নেবোও না।
সায়ান এক গাল হেসে বলে।
“তোকে মনে করিয়ে দিলাম।
সাহেদা বেগম দাঁড়িয়ে সায়ানের গালে হাত দিয়ে বলে।
” আমি তুলা ছাড়বো না। এটাও তোমাকে আমি মনে করিয়ে দিলাম। এবার যাও তুমি।
সায়ান মায়ের দুই গালে হাত দিয়ে বলে।
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সাহেদা বেগম। পাগল ছেলে।
“আসছি। তুলতুল এখুনি সুমু চলে আসবে। আমি একটু পরে আসবো কেমন?
তোর ফুপার ঔষধ আছে। মায়েরও ঔষধ দিতে হবে।
সাহেদা বেগম চলে যায়।
সায়ান এক গাল হাসে।
” অবশেষে লাইন ক্লিয়ার।
এক লাফে তুলতুলের পাশে গিয়ে বসে সায়ান। সায়ানের এমন লাফ দেখে ভয় পেয়ে যায় তুলতুল। একটু সরে যায়।
“মা কি বলে এসব?
ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে তুলতুলকে সায়ান।
তুলতুল নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটো চিকচিক করছে। সায়ানের দিকে তাকানোর সাহস নেই।
” কি হলো বল?
ধমক দিয়ে বলে সায়ান। ছিটকে ওঠে তুলতুল। চোখ থেকে টুপটাপ করে পানি গড়াতে থাকে।
“চুপ করে থাকিস না তুলতুল।
চোখ বন্ধ করে বলে সায়ান।
আচমকা তুলতুলের ডান হাতটা টেনে এনে টিশার্টের ভেতর দিয়ে বুকের বা পাশে রাখে সায়ান।
ভরকে যায় তুলতুল। দুই ঠোঁটের মাঝে কিঞ্চিত ফাঁকা হয়ে যায়। চোখ দুটো বড়বড় করে ফেলে। নাকটা হালকা ফুলিয়েছে।
হাতটা গুটিয়ে নিতে চায় পারে না। সায়ানের শক্ত তিক্ত হাত থেকে তুলতুল নিজের নরম তুলতুলের হাতটা ছাড়াতে ব্যর্থ।
” কিছু ফিল করতে পারছিস?
জাস্ট তোর বিয়ের কথাটা শুনেছি এতেই আমার হার্ট কেমন লাফাচ্ছে। যদি তুই অন্য কারো হয়ে যাস তাহলে তো হার্টটা বেড়িয়েই আসবে রে আমার।
তুলতুল চোখ নামিয়ে নেয়। সত্যিই ফিল করতে পারছে সায়ানের বুকের ধুপধাপ আওয়াজ। সায়ান এখনো চোখ বন্ধ করে আছে। হয়ত রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে।
তুলতুল কিছু বলছে না দেখে রাগটা বেরে যায়। দাঁতে দাঁতে চেপে চোখ খুলে সায়ান।
তুলতুলের হাতটা ছেড়ে দেয়। তুলতুল নিজের হাত গুটিয়ে নেয়।
সায়ান কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে গাল চেপে ধরে তুলতুলের। ব্যাথা পেলেও শব্দ করে না তুলতুল। চোখ বন্ধ করে ফেলে। হাত দুটো দেয় সায়ানের হাতের ওপর। চোখের কুর্নিশ বেয়ে এক ফোঁটা পানি জড়িয়ে পড়ে।
“আমি ছাড়া অন্য কোনো ছেলের দিকে তাকালেই আমি তোকে খু*ন করে ফেলবো। বিয়ের কথা ভুলে যা।
” তোর মৃত্যুটা আমি সয্য করে নিতে পারবো
কিন্তু তোকে অন্য কারো পাশে সয্য করতে পারবো না”
মাইন্ড ইট
তুই শুধুই আমার। শুধুই আমার। এই কথাটা তোর মাথায় ঢুকিয়ে নে ইডিয়েট।
দাঁতে দাঁত চেপে বলে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় তুলতুলকে। এটার জন্য প্রস্তুত ছিলো না তুলতুল। খাটে আধশোয়া হয়ে যায় তুলতুল। নিজেকে সামলে নিয়ে বসে। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে তুলতুল।
সায়ান চোখ বন্ধ করে দুই হাতে চুল খামচে ধরে। কিছুতেই মাথা থেকে তুলতুলের বিয়ের কথাটা বের করতে পারছে না। রাগটা মায়ের ওপর হচ্ছে নাকি তুলতুলের ওপর না কি তুলতুলের ফ্যামেলির ওপর বুঝতে পারছে না সায়ান।
“একদম ভালোবাসি না আপনাকে। খুব খারাপ আপনি। খুব খারাপ। আমি কখনোই আপনার হবো না। আই হেট ইউ
কাঁদতে কাঁদতে বলে তুলতুল।
সায়ান চোখ খুলে তুলতুলের দিকে তাকায়। চুপসে যায় তুলতুল। এই বুঝি এখন আবার গাল চেপে ধরে। ঢোক গিলে মুখটা পিছিয়ে নেয়।
মুচকি হাসে সায়ান।
ভালোবাসা শব্দটা কানে বেজে ওঠে।
হাসি চওড়া হয় সায়ানের।
সায়ান তুলতুলের গালের দিকে তাকায়। পাঁচ আঙুলের দাগ বসে গেছে। ডান গালে চারটা আঙুল বাম গালে একটা আঙুল। মারাক্তক ফর্সা মেয়েটা। এতোটা ফর্সা না হলেও পারতো।
এর গায়ে হাত তুলে শান্তি পাওয়া যাবে না। একটা লাভ বাইট দিলে বারো বছর দাগ থাকবে। আর সেই দাগ অন্যদের চোখ পড়ে ভীষণ লজ্জায় পড়তে হবে সায়ানকে।
আনমনে হাসে সায়ান। কিসব ভেবে ফেলছে। সায়ানের হাসি দেখে তুলতুল চোখ ছোট ছোট করে তাকায়।
সায়ান তুলতুলের মাথাটা নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। তুলতুল সরার জন্য নরাচরা করে।
” থাপ্পড় খেতে মন চাইছে?
সায়ানের শান্ত গলার কথায় নরাচরা বন্ধ করে দেয় তুলতুল। শান্ত হয়ে সায়ানের টিশার্টের ওপর আঁকিবুঁকি করে।
এখানে শান্তি খুঁজে পাচ্ছে তুলতুল।
“সব সময় ভয় পাবি আমায়। আমার মুখে মুখে তর্ক করবি না। যা বলবো তাই করবি। বুঝলি?
সায়ান তুলতুলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে।
তুলতুল মুখ বাঁকায়।
” জামাই লাগেন তো আপনি আমার।
বিরবির করে বলে তুলতুল।
“বিরবির না করে মুহুর্তটা উপভোগ কর।
সায়ান আবার ধমক দিয়ে বলে।
তুলতুল চুপচাপ থাকে।
” তুলতুল তুই
সুমু তুলতুলকে ডাকতে ডাকতে রুমে ঢুকে ওদের একসাথে দেখে চোখ বড়বড় করে তাকায়। সায়ান আর তুলতুল ছিটকে দুজন দুরে সরে যায়।
তুলতুলের লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। সায়ান সুমুকে পেছন ঘুরে দাঁড়িয়ে মাথার পেছনের অংশ চুলকায়।
“এই তোরা কি করছিলি?
সুমু চিল্লিয়ে প্রশ্নটা করে। বিষ্ময় এখনো কাটে নি ওর। তুলতুল মুখ ঢেকে বসে আছে।
সায়ান দাঁত কটমট করে তাকায় সুমুর দিকে।
” সাধারণত সবাই বড়দের এক সাথে দেখলে লজ্জায় চোখ ঘুরিয়ে নেয়। আর তুই বড়বড় করে তাকালি কেনো?
সুমুর মাথায় চাটি মেরে বলে সায়ান।
“তোমরা তো এক সাথে ছিলে না। তুমি তুলতুলকে জড়
পেছনে সাহেদা বেগমকে দেখে সায়ান সুমুর মুখ চেপে ধরে।
কপাল কুচকে সাহেদা বেগম এগিয়ে আসে।
” কি বলছিলি তুই সুমু? কথা শেষ কর।
কড়া গলায় বলে।
সায়ান সুমুর মুখ ছেড়ে দেয়। আর চোখের ইশারায় সুমুকে ওয়ার্নিং হয়।
সুমু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
“বলবি ন তো। ঠিক আছে।
তুলতুল আম্মা তুই বল সায়ান তোকে জড়…
তারপর কি? জড় এটার মানে কি?
তুলতুল ঢোক গিলে ফুপির দিকে তাকায়। লজ্জায় মুখটা লাল হয়ে গেছে। মনপ হচ্ছে যে কোনো মুহুর্তে ঙ্গান হারিয়ে ফেলবে।
সায়ান মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
” তুলতুল তুই লাল নীল কেনো হচ্ছিস? কি হয়েছে বল?
খানিকটা ধমক দিয়ে বলে সাহেদা বেগম।
তুলতুল কম্বলের এক কোনা মোচরামুচরি করছে। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। এই রকম অস্বস্তিকর পরিবেশে আগে কখনোই পড়তে হয় নি তুলতুলকে।
“মা হয়েছে কি আমি বলছি তোমায়?
সায়ান একটু হেসে মাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে।
” তোর কাছে কে জিজ্ঞেস করেছে? তুলতুলই বলবে। বল?
সায়ান মাকে ছেড়ে দেয়।
তুলতুল কপাল চাপকে সায়ানের দিকে অসহায় চোখে তাকায়।
“মা আমি তুলাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম
বলেই সায়ান এক দৌড় দেয়৷ সাহেদা বেগম কেশে ওঠে। সুমু হো হো করে হেসে ওঠে। আর তুলতুল কম্বল দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে।
” নিলজ্জ বেহায়া লোক।
চলবে
গঠন মূলক মন্তব্য করবেন। গল্প সম্পর্কে দুলাইন বলে যাবেন। নেক্সট নাইস বলবেন না দয়া করে। নেক্সট নাইস দেখলে কান্না পায় আমার😭😭😭😭😭😭