#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
বর্ধিতাংশ
এই গ্রামের এক নিরব রাস্তায় যদি কাউকে এখন হ’ত্যাও করা হয় তবে কেউ এগিয়ে আসবে না। কারণ আশেপাশে শুধু জঙ্গল আর বড় বড় গাছপালা ছাড়া কোনো জনমানবের চিহ্ন দেখা যায় না। দিনে দুপুরে তবুও যানবাহনের দেখা পাওয়া যায়। তবে বিকেলের পর সেটুকুও নেই। ফলে এখানে খুব সহজেই কাউকে বিপদে ফে’লা যেতে পারে। যেমনটা রাগিনী আজ পড়েছে। গু’লি বর্ষণ হচ্ছে তাকে তাক করেই। অথচ তার গায়ে লাগছে না। চোখ মেলার সাহসটুকু অবধি নেই। বুকটা ধড়ফড় করছে। পা দুটো কাঁপছে। সমস্ত শরীর অসার হয়ে আসছে। ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছে সে। খেয়াল নেই আশেপাশে কে রয়েছে। কোহিনূরের কথাও মাথা থেকে বের হয়ে গিয়েছে। ড্রাইভারও বেরিয়ে আসার সাহস পাচ্ছে না। সে তড়িঘড়ি করে ফোনটা খুঁজে নেয় নিজের। উদ্দেশ্য পুলিশকে ফোন দিয়ে জানানো। তবে সেটা ইচ্ছে অবধি রয়ে যায়। পূরণ হয় না। রাগিনীর গাড়ির সামনে আগলে ধরা গাড়িটি থেকে বেশ কয়েকজন লোক নেমে এসে জানালা দিয়ে ড্রাইভারের কপালে রি’ভলবার ধরে বলে,
“কাউকে ফোন করার চেষ্টা করলে পরিণাম খুব খারাপ হবে।”
ড্রাইভারের হাত থেকে ফোনটা আপনা-আপনি পড়ে যায়। থরথর করে কাঁপতে থাকে। চোখেমুখে অসহায়তার ছাপ পড়ে যায়। ভয় হয় প্রা’ণ হারানোর। এতোক্ষণ অনবরত রাগিনীর উপর রি’ভলবার চালানো হচ্ছিল তবে তাতেও যেন শান্তি পায়নি এই ভয়া’নক দল। তাদের মধ্যে থেকে একজন গাড়ি থেমে নেমে রাগিনীর কাছে এগিয়ে আসে। রাগিনী শব্দ বন্ধ হওয়ায় পিটপিট করে তাকায়। তার মুখটা হা হয়ে আছে এখনো। মুখ দিয়ে শ্বাস নিচ্ছে তবুও যেন আঁটকে আঁটকে যাচ্ছে। কাউকে তার কাছে আসতে দেখতেই চোখটা ভালো করে খোলার চেষ্টা করে রাগিনী। ভয় পেতে পেতে সে যেন ক্লান্ত। দাঁড়িয়ে থাকাও আর সম্ভব হচ্ছে না যেন। আকস্মিকভাবে এবার তার কপালে ঠেকিয়ে ধরা হয় রি’ভলবার। রাগিনী চারিদিকে অন্ধকার দেখতে থাকে। মনে হচ্ছে মৃ’ত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখছে সে। আজই কি তার শেষ দিন? এখন কি তার শেষ মূহুর্ত? এই অবস্থায় তার মস্তিষ্ক জানান দেয় কোহিনূরের কথা। রাগিনী পেছনে তাকানোর চেষ্টা করলে আরেকজন ছুরির মতো কিছু একটা নিয়ে দৌড়ে আসার চেষ্টা করে। ফ্যাকাশে হয়ে আসে রাগিনীর চোখমুখ। এইতো এখনি হয়ত তার শেষ হবে। চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে সে।
চোখ বন্ধ করে কেটে যায় বেশ কিছুক্ষণ। রাগিনীর কোনো আ’ঘাত অনুভূত হয় না। সে চোখ মেলতে চায় তবে কোনো ভয়ানক দৃশ্য যদি দেখতে হয় সেকারণে চোখ মেলতে সাহস পায় না আর। সে দুয়েক ধাপ পিছিয়ে আসে। মাথা ঘুরে আসছে। মাথাটা ধরে আস্তে করে চোখটা খুলল সে। অস্পষ্ট এবং ঝাপসা সব। তবে এতটুকু বুঝতে পেরেছে তাকে আগলে কেউ একজন দাঁড়িয়ে। একহাতে চোখটায় হাত দিয়ে মুছে ভালো করে দেখল কোহিনূর দাঁড়িয়ে তার সামনে। সে এবার মূহুর্তও না দাঁড়িয়ে সামনে কোহিনূরের নিকটে গিয়ে তার কাঁধ চেপে ধরল। ড্রাইভারকে ধরে রাখা লোকটি সামনে এসে সবাইকে ইশারাই থামতে বলল। লোকটি রাগিনীর সামনে মাথা নুইয়ে ফেলতেই ভড়কে গেল রাগিনী। লোকটি বলে ওঠে,
“এক্সট্রিমলি সরি। আসলে আমরা পুলিশ টিম। একটা গাড়িকে ট্র্যাক করছিলাম। আর সামনে আপনাদের গাড়ি এলো। একই রঙের গাড়ি তাই আমরা না বুঝে আপনাদের উপর…”
বলে একটু দম নিলো লোকটা। রাগিনীর বুকটা ঢিপঢিপ করছে। সব কথা দুবার করে শুনছে। ধপ করে সে বসে পড়ল। নিশ্বাস ওঠানামা করতে থাকল তার। তাকে প্যানিক এট্যা’ক করেছে। কোহিনূরও হাঁটু গেঁড়ে রাগিনীর মুখোমুখি বসে। রাগিনী চোখ মেলতে পারছে না। বাকিরা যারা নিজেদের পুলিশের লোক বলে পরিচয় দিয়েছে তারাও রাগিনীকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। কিন্তু কোহিনূর কড়া গলায় বারণ করে বলে ওঠে,
“ডোন্ট টাচ হার। আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”
আর কোনো কথা বাড়ায় না কোহিনূর। তাদের দিকে অগ্নি দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে ইশারায় সেখান থেকে চলে যেতে বলে। আর রাগিনীর নমনীয় এক গালে আলতো করে হাত রাখে কোহিনূর। রাগিনী দুর্বলভাবে তাকায়। এখনো সবটা তার কাছে অস্পষ্ট। সে তার সংলগ্নে থাকা মানুষটির হাত আঁকড়ে ধরে। কোহিনূর চমকে উঠলেও রাগিনীর কাছ থেকে সরে না। বরং একটু ঝুঁকে ধীর সুরে বলে ওঠে,
“আর ইউ ওকে রাগিনী?”
রাগিনী মাথা ঝাঁকায় ধীরে। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। কোহিনূর তার হাতটা আগলে ধরে তাকে ধরে সাহায্য করে। তারা হেঁটে গিয়ে গাড়িতে বসে। কোহিনূর রাগিনীর কপালে হাত রেখে বলে,
“তুমি আসলেই ঠিক আছো তো?”
রাগিনী আবারও মাথা নাড়ায়। তার চোখ এখনো বন্ধ। সেই অবস্থাতেই সে বলে,
“চাচা, আপনি গাড়ি ঘুরান। মেন্টাল হসপিটালের দিকে ব্যাক করুন।”
ড্রাইভার রাগিনীর কথামতো গাড়ি ঘুরিয়ে নেয়। খুব দ্রুত রওনা দেয় আগের পথে।
খানিকক্ষণ পর স্বাভাবিক হয়েছে রাগিনী। আস্তে আস্তে করে বিড়াল ছানার সাথে কথা বলায় মেতেছে সে। ছানাটির উদ্দেশ্যে বলে উঠছে,
“তুমি ভয় পেয়েছিলে লিটল ফেইরি? ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। আমরা আছি তো।”
সিটে কোহিনূরের পাশে পানির বোতল খেয়াল করে সেটা হাতে নিয়ে রাগিনীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
“পানি খেয়ে নাও। তোমার ভালো লাগবে।”
পানির বোতল হাতে নিয়ে তার মুখ খুলে পানিটা খেয়ে গলা ভিজিয়ে নেয় রাগিনী। আসলেই গলা শুঁকিয়ে কাঠ হয়ে ছিল। শরীরে নেই কোনো জোর। অতঃপর বোতলের মুখটা লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। তখনি তাদের গাড়ি বাঁক নেয় বেশ জোরে। তৎক্ষনাৎ নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হয় রাগিনী। আঁচড়ে গিয়ে পড়ে কোহিনূরের বুকে। মূহুর্তেই কোহিনূর হালকা করে ‘উফফ…’ শব্দটি উচ্চারণ করে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে সংকোচ বোধ করে সরে বসে রাগিনী। কোহিনূরের দিকে আকস্মিকভাবে পড়ার কারণে হয়ত সে ব্যথা পেয়েছে। এই ভেবে সরি বলতে তার দিকে ঘুরে তাকায় রাগিনী। তখনি তার নজরে আসে কোহিনূরের ব্লেজার ভেদ করে বেরিয়ে আসা তাজা র’ক্ত। রাগিনী উদ্বিগ্ন হয়ে বলে ওঠে,
“একি! আপনার এভাবে লাগল কি করে?”
“তেমন কিছু না। তখন ছুরির ওই হা’মলা আটকাতে গিয়ে হঠাৎ করেই লেগেছে।”
কোহিনূরের কথার এমন ভাব যেন কিছু হয়নি আদেও। অথচ দরদর করে র’ক্ত বেয়ে পড়ছে। রাগিনী আর দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে তার ব্যাগের চেইন খুলে একটা রুমাল বের করে কোহিনূরের কাঁধে চেপে ধরতেই চমকে চোখমুখ জড়িয়ে তুলল কোহিনূর। অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,
“কি করছো?”
“যা করছি করতে দিন। এতক্ষণ ব্যথা পেয়েও চুপ ছিলেন কি করে? এই রুমালটা ধরে থাকুন। ব্লি’ডিং বন্ধ করতে হবে। তাছাড়া আমি র’ক্ত দেখতে পারি না।”
“সিরিয়াসলি?”
কোহিনূর বেশ বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করে। যেন রাগিনীর এমন হওয়া উচিত নয়। তার র’ক্ত দেখতে না পারা যেন সত্যিই অনুচিত! রাগিনী মাথা দুলিয়ে বলে,
“হু। চাচা, একটু গাড়ি জোরে চালান। এদিকে একজন কান্ড বাঁধিয়ে বসে আছেন। হিরো গিরি করতে গিয়ে নিজেকে জখম করে চুপ করে রয়েছেন।”
রাগিনীর কথায় চোখ দুটো কপালে তুলল কোহিনূর। কোথায় মেয়েটার আরো প্রশংসায় পঞ্চমুখ হওয়া উচিত তা না করে মেয়েটা কিসব ভুলভাল বকে যাচ্ছে। সে জোরে জবাব দিয়ে বলল,
“ওহ হো! তোমাকে বাঁচিয়ে দেখছি ভুলই হয়েছে। সেখানে পড়ে থেকে হামাগুড়ি খেতে সেটাই ভালো ছিল তাই না? কোথায় আমার মতো একটা মানুষ তোমাকে বাঁচিয়েছি সেকারণে আমাকে ধন্যবাদ জানাবে! তা নয়। আরো ইচ্ছেমতো কথা শুনিয়ে যাচ্ছো?”
“কে বলেছিল আমাকে বাঁচাতে?”
জোর গলায় জবাব দেয় রাগিনী। কোহিনূরের দৃষ্টি এবার অন্যরূপ নেয়। সে মাথা ঝুঁকে নিচু হয়ে বলল,
“আমার মন বলেছিল। মনটা খুব জোরে জোরে বলে যাচ্ছিল এই জীবন্ত কাঠগোলাপকে না বাঁচালে কোহিনূর রত্নের জীবনটা বৃথা।”
রাগিনীর দৃষ্টি যেন তখনই স্থির হলো। হৃৎস্পন্দন নিজমনে ছন্দ তুলতে থাকল। এটা যেন কোনো কথা নয় গানের সুর ছিল। যেই সুর বারংবার বেজে উঠল রাগিনীর কানে। কানটা গরম হয়ে গেল তার। সাথে থাকা এই পুরুষটির সাথে দৃষ্টি মেলানো বেশ মুশকিল হয়ে পড়ল। কোহিনূর গলা খাঁকারি দিয়ে সোজা হয়ে বসল। আর বলল,
“আই মিন, তোমার কিছু হলে আমার এভাবে যত্ন করবে কে? আমি যে মাঝে মাঝে ওখানকার খাবার খেতে বোর হয়ে যাই। তখন তোমার হাতের রান্না না খেলে চলেই না। তোমার কিছু হলে তো এসব বৃথা যাবে। আর শোনো, তোমাকে এমনি এমনি বাঁচাইনি আমি। এর বদলে তুমি আমাকে ধন্যবাদ স্বরূপ কালকে পাঁচ ধরনের খাবারের আইটেম নিয়ে আসবে।”
রাগিনীর মেজাজ গেল বিগড়ে। কোহিনূরকে ভেংচি কেটে বিড়বিড় করে বলে উঠল,
“মনে হচ্ছে আমি উনার কত বছরের বিয়ে করা বউ। হুকুম করলেন আর মানতেই হবে আমায়। বয়েই গেল আমার উনার জন্য রান্না করতে।”
কোহিনূরের কানে এলো রাগিনীর বলা কথাগুলো। আঁড়চোখে রাগিনীর দিকে তাকালো সে। মিটমিট করে হাসি দিল। মেয়েটা মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে বিড়াল ছানার গায়ে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। এই অপরূপার পাশাপাশি বসাও যেন ভাগ্যের ব্যাপার। তার রাগের কারণ হওয়াটাও একটা সুন্দর ভাগ্যের ব্যাপার! শিরশিরে বাতাস তাদের ছুঁয়ে যাচ্ছে। গান গাইতে ইচ্ছে করছে, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়। তবে কেমন হতো তুমি বলো তো?’
চলবে….
[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]