গোধূলি বেলায় তুমি এসেছিলে – পর্ব ১১

0
369

#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১১

“আপনার শার্ট খুলুন দেখি।”

সবে গা থেকে ব্লেজার সরিয়ে বিছানার দিকে একপ্রকার ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে কোহিনূর। ইতিমধ্যে পেছন থেকে কোনো নারীকণ্ঠে এমন বাক্য শুনে ধড়ফড় করে উঠল তার বুক। সে আর রাগিনী হসপিটালে ফিরেছে একটু আগেই। তবে ফিরতে ফিরতে বেশ রাতও হয়েছে। কারণ রাস্তায় জ্যাম। প্রায় ২ ঘণ্টা ধরে আঁটকে ছিল তারা। অবশেষে নিজেদের গন্তব্যে পৌঁছাতে পেরে দুজনেই ক্লান্ত। ফলে কোহিনূর ফ্যানের স্পিডটা বাড়িয়ে ব্লেজার খুলে গা এলিয়ে বসতে চাইছিল এমন সময় রাগিনীর কথায় সটান হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। পিছু ফিরে তাকিয়ে দেখলো রাগিনী ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে দাঁড়িয়ে। আর অন্যহাতে হাতে একটা কাপড়। সাথে পানি ভর্তি বাটি। কোহিনূর থতমত খেয়ে বলে উঠল,
“হু?”

“শার্টটা খুলুন। বাকিরা ব্যস্ত এখানকার অন্যদের নিয়ে। তাই অন্য কাউকে ডাকলাম না। আমি কল করতে বলেছি ডক্টরকে। উনার আসতে দেরি হবে। তাই এর মধ্যে যা করার আমাকেই করতে হবে।”

“কি করবে তুমি?”

অবুঝের মতো প্রশ্ন করে কোহিনূর। রীতিমতো ঢক গিলছে সে। রাগিনী চটে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে,
“গাড়িতে যেভাবে ব্লি’ডিং হতে দেখলাম এতোক্ষণ জায়গাটা ওভাবে থাকলে ইনফেকশন হয়ে কান্ড বাঁধিয়ে বসবেন। যখন আপনি আমাকে ম’রা থেকে উদ্ধার করেছেন তাই প্রতিদান হিসেবে আমি আপনাকে উদ্ধার করে দিই? এখন যা বলছি তাই করুন।”

“আমার এসবের দরকার নেই।”

অস্বস্তিতে পড়ে বলে কোহিনূর। এবার রাগিনী রেগেমেগে এগিয়ে আসে তার দিকে। তার এগিয়ে আসা দেখে পিছিয়ে যেতে চেয়ে পায়ের সঙ্গে চেয়ারের নিচের অংশটা লেগে চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে কোহিনূর। রাগিনী তার হাতের জিনিসগুলো বিছানায় রেখে কোহিনূরের সামনে এসে দাঁড়ায়। কোমড়ে হাত রেখে কোহিনূরের মতো মোটা গলার সুর করে ভেংচি কেটে বলে,
“ওহ হো! আসছেন আমার সুপারম্যান। উনার কোথাও কে’টে গেলে আপনাআপনি ঠিক হয়ে যায়। কোনো সাপোর্টা লাগেই না।”

রাগিনীর এমন কথায় গলা খাঁকারি দিয়ে গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে নিজের আঙ্গুল তুলে কোহিনূর আটকা গলায় বলল,
“দেখো, ইনসাল্ট করবে না মোটেও আমাকে। আমি… ”

কথার মাঝখানে বাগড়া দিয়ে রাগিনী কড়া সুরে বলল,
“আপনি শার্ট খুলবেন নাকি আমি টেনে ছিঁড়ে দেব?”

অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল কোহিনূর। ঠোঁট দুটো শুঁকিয়ে গেছে তার। জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে বলে উঠল,
“আশ্চর্য! আমার সাথে থেকে থেকে তুমিও পাগল হয়ে যাচ্ছো বুঝি? এসব কেমন কথাবার্তা? তুমিই যত্ন করে এসব কিনে দিয়ে তুমিই ছিঁড়ে দেওয়ার কথা বলছো?”

ভ্রু উঁচিয়ে দুটো হাত জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইল রাগিনী। কিছুক্ষণ নিরব থেকে উত্তরে বলল,
“আগে জানতাম পাগলরা নিজেদের পাগল বলে স্বীকার করে না। আপনি দেখছি আমার ধারণা পাল্টে দিলেন। আপনি নিজেই বোঝেন তবে আপনি মেন্টালি সিক!”

কোহিনূর ঘনঘন চোখের পাতা ফেলে আবারও নিজের শুষ্ক ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে নিল। কথাটা যেন বলতে চায়নি সে। মুখ ফস্কে বেরিয়ে এসেছে। সে আর কিছু বলার সুযোগ পায় না। রাগিনীর তার দিকে ঝুঁকে পড়ে শার্টের বোতামে হাত দেয়। কোহিনূরের মুখটা হয় দেখার মতো। বিস্ফোরি’ত নয়নে তাকিয়ে থেকে সুযোগ পেলেই যেন আঁটকে ফেলবে। সেই সঙ্গে অসহায় রকম দৃষ্টি যেন চোখে লেগে গিয়েছে। তার এমন ফ্যাকাশে চুপসে যাওয়া চেহারা দেখে নিজেই অবাক রাগিনী। হাসিও পাচ্ছে ভীষণ। কোনোমতে হাসিটা চাপিয়ে রেখেছে সে। যদি হেসেও ফেলে ভুলে তবে হয়ত আর কাজটা করতেই দেবে না তাকে। তবে ধীর কন্ঠে বলে ওঠে,
“মি. কোহিনূর! পুরুষ মানুষ আপনি। এমন রিয়েকশন কেন দিচ্ছেন যেন ইজ্জত হরণ করছি। আপনার এমন চেহারা দেখে আমার নিজেরই ভয় করছে এবার।”

বিষম খায় কোহিনূর এবার। কাশতে থাকে সে। রাগিনী মেয়ে হয়ে তাকে এভাবে ইনসাল্ট করে দিল? এটা মানতে পারছে না। উশখুশ করতে করতে শার্টের সব বোতাম খুলে সেটা কাঁধ থেকে নামিয়ে দিতেই চকিতে তাকায় রাগিনী। নিশ্বাস যেন আঁটকে এসেছে। পুরো শরীরে ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে। কোহিনূরের পুরো শরীর জুড়ে কা’টাছেঁড়ার দাগ। কোথাও যেন বাদ নেই। কোথাও কোথাও সেলাইয়ের দাও এখনো স্পষ্ট। বুকে, পেটে, কাঁধে সবখানে স্পষ্ট কা’টার দাগ। শার্ট খোলার সাথে সাথে চোখমুখ কুঁচকে ফেলল কোহিনূর। কাঁধে চিনচিন ব্যথা করছে। রাগিনীর দিকে দৃঢ় দৃষ্টিপাত করতেই দেখল রাগিনী নিখুঁতভাবে তার আ’ঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়া দেহ দেখছে। থমথমে সুরে সে বলে ওঠে,
“এজন্যই শার্ট খুলতে চাইছিলাম। তুমি বলেছিলে না? তোমার কা’টাছেঁড়া দেখলে ভয় করে? আমার শরীরে এসবের অভাব নেই। তোমার ভয়ের কারণ আমি।”

“আমার বাঁচার কারণও তো আপনি! আপনি আ’ঘাত পেয়েছেন বলেই রাগের রানীর কোনো আঁচড় লাগেনি। তাই এই আ’ঘাত সাড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তো আমারই।”

রাগিনী কোহিনূরের চোখে চোখ রেখে একনাগাড়ে কথাটি বলে থামলো। কোহিনূর চুপ করে রইল এবার। জবাব দেওয়ার মতো কোনো শব্দ খুঁজে পেলো না। রাগিনী তার আনা কাপড়টা বাটিতে ভিজিয়ে তা এগিয়ে এনে কোহিনূরের কাঁধের চারপাশের র’ক্তের দাগ মুছে দিল। থরথর করে কেঁপে উঠল কোহিনূর। জায়গাটা মুছে দিতে রাগিনীও সংকোচ বোধ করলেও নিজেকে সামলেই কাজটা ঠিক মতো করতে করতে বলল,
“এতো আ’ঘাতের দাগ! কি করে একটা মানুষ এতো আ’ঘাত পেয়ে বেঁচে থাকতে পারে? এতো আ’ঘাত পেয়েছেন কি করে?”

কোহিনূর চুপ করেই রইল। যেন মনে মনে উত্তর তৈরি করছে সে। তারপর ফট করেই বলল,
“ওইতো এখানে আসার আগে। যখন আমি সবাইকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। তখন হয়ত এমন হয়েছে। জানি না ঠিক।”

রাগিনী বুঝতে পারল কোহিনূর তার এক্সিডেন্টের কথা বলছে। পুরোটা বিস্তারিত বলতে পারছে না তবুও রাগিনী বুঝে নিয়েছে। তবে এতো আ’ঘাত শুধুমাত্র একটা এক্সিডেন্টে লাগতে পারে তা বিশ্বাস হলো না তার। তবুও পাল্টা কোনো প্রশ্ন করল না সে। সযত্নে ক্ষত স্থানে তুলো লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিল। কাজটা করতে করতে চোখে অস্পষ্ট দেখছে সে। হাতটাও কাঁপছে। সে যে র’ক্ত দেখতে পারে না। এজন্যই হয়ত কোহিনূর বারণ করেছিল। কোনোরকমে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। আর কিছু না বলে বাহিরে চলে এসে করিডোরের সিটে বসে পড়ল। মাথা ঘুরতে শুরু করেছে। র’ক্ত দেখার পর চোখে শুধুমাত্র বিকেলের সেইসব ভয়া’নক ঘটনা মনে পড়ছে। মাথায় হাত দিয়ে বসে সে। অদ্ভুত ভয়াবহ ঝড় যেন তার উপর দিয়ে গেছে। সিটে ঠেস দিয়ে চোখ বুঁজে ফেলে সে।

জায়গাটি গোয়া। ভারতের এক ক্ষুদ্রতম অঙ্গরাজ্য। গোয়ার সমুদ্রসৈকত থেকে শুরু করে ঐতিহ্যবাহী স্থান গুলোর জন্য বেশ বিখ্যাত। জায়গাটি বিখ্যাত হওয়ায় বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এর সৌন্দর্য উপভোগ করবার জন্য ছুটে আসে। বিশেষ করে এখানকার সৌন্দর্যের প্রতীক হচ্ছে সমুদ্র। গোয়া বাজার লোনলি প্ল্যানেট, মেইন পয়েন্ট থেকে বেশ দূরে লোকজনের সমাহার কম। সেখানেই সমুদ্রের ধারে বালির উপর এক ব্র্যান্ডের জুতো পড়ে হেঁটে চলেছে এক যুবক। জুতো মাঝে মাঝে ঢেউ এসে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই তার। দুহাতে গিটার ধরে সুর তুলছে সে। সমুদ্রের তীরে ঢেউয়ের তালে তালে সুরটা আরো মনোরম হয়ে উঠছে। তার মুখের হাসিটা সবসময় স্বভাবসুলভ হাসিটা লেগেই আছে। তীব্র বাতাসে তার যত্নে রাখা সিল্কি চুলগুলোও ঢেউ খেলছে নিজমনে। ফর্সা চোখমুখে স্নিগ্ধতা যেন সবসময়ের সঙ্গী। গিটারের সুরে সুরে এবার তাল মিলিয়ে গান গেয়ে উঠল সে।
“মেঘে মেঘে আজ কেন তারারা ঢাকা!
মনে মনে আজ কেন জেগেছে ব্যথা
গানে গানে নেই যে সুর না কোনো কথা
প্রাণে প্রাণে রামধনু কেন যে আঁকা!”

হঠাৎ করেই ফোনের রিংটোন বেজে উঠল তার। গানের মাঝে থামলো সে। বিরক্তি দেখা গেল চোখমুখের মাঝে। তবুও না থেমে সে বলে উঠল,
“পাগল এ মন সে বোঝে না
ঠিক না ভুল তা জানে না।
কে যেন ডেকে কানে বলে যে বারে বার!

ইয়ার ইটস অনলি পেয়ার
হাওয়া হি পেইলি পেইলি বার
হুম ইয়ার ইটস অনলি পেয়ার
হাওয়া হি পেইলি পেইলি বার”

ফোনটা থেমে আবারও নিজ ছন্দে বেজে উঠল। বিরক্তিতে ‘চ’ এর ন্যায় শব্দ করে গিটার বাজানোর থামিয়ে দিল সে। একহাতে গিটার ধরে গিটারের একপ্রান্ত বালিতে স্পর্শ করল। পকেট থেকে ফোন বের করতেই ওপাশ থেকে কারোর কর্কশ গলা ভেসে এলো!
“অভিরূপ! কোথায় তুই?”

অভিরূপ জানতো তার একমাত্র বেস্টফ্রেন্ড নোমান ফোন করবেই করবে। করেছেও সে। অভিরূপের হাসিটা বাড়ল। আর নরম সুরে জবাব দিল,
“গোয়াতে।”

“তোর মন চাইলো তাই চলে গেলি গোয়ায়? তুই কি জানিস তুই একটা পারফরম্যান্স মিস দিয়ে চলে গেছিস? পারফরম্যান্স হেড ক্ষেপে গেছে একদম।”

ফোনের ওপরপানে উত্তেজিত কথা শুনে হাসলো ছেলেটি। তার হাসির শব্দেও যেন সুর আছে। মনোরঞ্জিত সেই সুর। হাসতে হাসতেই জবাব দিল,
“চিল ইয়ার। একটা গান আছে না? কি যেন একটা লাইন! ওহ ইয়েস, আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাব! হারিয়ে যাব আমি তোমার সাথে।”

শেষে গানের লাইনটি সুর করে গেয়ে থামলো সেই গিটার হাতে ধরে থাকা মানব। আবারও বলল,
“তুমি বলতে তো কেউ নেই। তাই হারিয়ে যাব আমি আমার সাথে।”

বলেই আবারও হেঁসে উঠল সে। ওপরপাশ থেকে শোনা গেল,
“তুই যে কি করিস! যা মন চায় তাই কর। দেখা যাচ্ছে হঠাৎ করে কাউকে একদিন পছন্দ হয়ে গেল। সেদিনই বিয়ে করে এসে আমায় সারপ্রাইজ দিয়ে বললি, দেখ বন্ধু! মন চেয়েছে আজ বিয়ে করতে। তাই করে ফেললাম।”

“করতেই পারি। যদি মনমতো মেয়ে পাই তো।”

ওপরপাশ থেকে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটি রেগেমেগে ফোনটা কেটেই দিল এবার। অভিরূপের বেশ ভালো লাগে নোমানকে রাগাতে। তার মনে যা আসে তাই করে বসে থাকে আর তার বদলে কথা শুনতে হয় নোমানকে। তবুও নোমান তার সঙ্গ ছাড়েনি। আর তারই দাম দিতে হয় বেচারাকে! অভিরূপের পুরো নাম অভিরূপ চৌধুরী অভি। পেশায় একজন প্রফেশনাল সিঙ্গার। গান গেয়ে বেশ নাম করেছে। তার জন্ম ইন্ডিয়াতেই। আজকাল টিনএজারদের মুখে অভিরূপের নামজপ বেশ দেখা যায়। অভিরূপ ছন্নাছাড়া ছেলে। যখন যেটা মাথায় আসে তখন সেটা করতে দেরি করে না। যেমন আজকেই সে পারফরম্যান্স ফেলে গোয়ায় একা একা চলে এসেছে। এভাবেই চলছে তার জীবন। কখনো নিজের জীবন বদলাবে কিনা কে জানে!

চলবে…

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। নতুন চরিত্র হাজির হয়েছে। আস্তে আস্তে বুঝবেন নতুন চরিত্রে কেন আনা হয়েছে।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here