#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৪
রায়ানের গাড়িটা এসে থামল ঠিক ‘আহমেদ মেনশন’ নামক সাধারণভাবে সুসজ্জিত বাড়ির সামনে। গাড়িটা স্থির হওয়ায় সামনের সিটে সোজা হয়ে বসে থাকা রায়ান ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকায়। বাম জানালার কাঁচে গুটিশুটি মে’রে বসে আছে নয়নতাঁরা। চোখ দুটো বন্ধ। ভেজা ঠোঁটজোড়া শুকিয়ে গিয়েছে। তবে কাঁপুনি কমেনি বিন্দুমাত্র। মাথার চুলে এখনো পানিতে নেতিয়ে আছে। যত পানি বসবে আরো ঠান্ডা লাগবে। তাই রায়ান ডাক দিয়ে ওঠে।
“মিস. নয়নতাঁরা!”
নয়ন নড়েচড়ে ওঠে। তবে চোখ মেলে তাকায় না। ক্লান্ত ভঙ্গিতে জানালার পাশ ঘেঁষে মাথা রেখে দুহাতে মুখ ঢেকে বাচ্চাদের মত কাঁচুমাচু মে’রে বসে থাকে। রায়ান তাকে কীভাবে ডাকবে ভেবে উঠতে পারছে না। সে নিজে উসখুস করে আবারও ডাকল,
“হ্যালো! মিস নয়নতাঁরা। আমরা আপনার বাড়ির সামনে এসে গিয়েছি।”
এবার কথাটা নয়নের কান অবধি পৌঁছালো। রায়ান নয়নের বাড়ি চিনলো কীভাবে? নয়ন তো রায়ানকে বলেনি। প্রশ্নটা মস্তিষ্কে খেলে যেতেই নয়নতাঁরা এক ঝটকায় উঠে বসল। হুড়মুড়িয়ে জানলার বাহিরের দিকে নিজের বাড়িটার দিকে তাকাল। আরে হ্যাঁ, এটা তো তারই বাড়ি। এক আকাশ বিস্ময় নিয়ে রায়ানের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই রায়ান বুঝে গেল নয়নের এই চাহনিতে লুকিয়ে থাকা প্রশ্ন। তাই সে সাবলীল ভঙ্গিতে বলল,
“আমি জানি আপনি কী ভাবছেন। আপনি ভাবছেন আমি আপনার বাড়ি চিনলাম কীভাবে। উত্তরটা খুব সহজ মিস. নয়নতাঁরা। সেদিন এয়ারপোর্টে যখন আপনাকে দেখেছিলাম এবং আপনি আপনার নাম বলেছিলেন তখন আপনাকে আমার চেনা চেনা লেগেছিল। আপনার নামের সঙ্গে আহমেদ টাইটেলটা আমার সন্দেহ প্রগাঢ় করেছিল। পরে জানতে পারি আপনি অফিসার নির্জন আহমেদের একমাত্র বোন। অফিসার নির্জনের সাথে আপনাকে আমি একটা ইভেন্টেও দেখেছিলাম অনেক আগে। আমার স্মরণ শক্তি এতটাও দুর্বল নয়।”
নয়নতাঁরার চোখ এবার কপালে। রায়ান নামক ব্যক্তিটিকে সে যতই ভোলাভালা ভাবুক, আসলে লোকটা সাংঘাতিক সেই সাথে বুদ্ধিমান। এখন কি তার ভাইয়ের মতো এই লোকটাও সব সময় খবরদারি করবে? সব খবরদারি করা লোকজন কেন তার কপালেই জোটে। অবশ্য রায়ানকে তো সে ইচ্ছে করে জুটিয়েছে। কী আর করার সত্যিকার অর্থেই যে মানুষটা এতটাই মনোমুগ্ধকর। নয়ন নিজেকে ধাতস্থ করে উত্তর দেয়,
“এই নিয়ে তিনবার আমায় বিপদ থেকে বাঁচালেন আপনি। আপনি মানুষটা এত বিপদের সাথে জড়িত থাকেন কেন? এত বিপদ নিয়ে থাকলে আপনার কাছে কেউ আসবে? আমি নেহাত ভালো মেয়ে তাই আসি।”
রায়ান এবার হতবাক হয়। তার জানামতে সে দুইবার মেয়েটাকে বাঁচিয়েছে। আরো একবার কখন তার সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে? নয়নতাঁরা রায়ানের কোট খুলতে শুরু করে। তা দেখে রায়ান তড়িঘড়ি করে বলে ওঠে,
“খুলতে হবে না আপনাকে। আপনার কাছে রাখুন।”
কোনোরকম বিলম্ব না করেই কোট পুনরায় নিজের গায়ে জড়িয়ে নেয় নয়ন। যেন সেই কোট পেয়ে সে খুশিতেই আটখানা। অতঃপর গাড়ি থেকে নেমে জানালা দিয়ে নয়ন রায়ানকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“আরেকটু সময় দাঁড়াবেন প্লিজ? আমি এক্ষুনি আসছি।”
বলেই মেয়েটা তার বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে। রায়ান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে থাকে। হাঁটার মাঝে বিরতি নিয়ে নয়ন ফের পিছু তাকিয়ে মিষ্টি হেঁসে বলে,
“ওয়েট করবেন কিন্তু।”
রায়ান হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইল তার কোট পরিহিত মেয়েটির দিকে। তার ভেজা চুলগুলো হাঁটার তালে তালে দুলছে। মেয়েটার মনটা এখনো বাচ্চাদের মতোই। বাচ্চা ভাবটা এখনো কাটেনি। না কাটানোই স্বাভাবিক। নির্জনের একমাত্র বোন সে। নির্জনের এই একটাই দুর্বলতা! নয়নতাঁরা। তাকে যেভাবে আগলে রাখার কথা তাতে বাচ্চা ভাবটা কাটবেই না। এসব মনে মাঝে একটু একটু ভাবতে ভাবতে নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে যায় রায়ানের। কতদিন মায়ের সাথে কথা হয় না! মানুষটা কেমন আছে জানা হয় না। চিকিৎসা কতদূর জিজ্ঞেস করা হয় না। ফ্রি হয়ে দ্রুত কথা বলতে হবে।
ভাবনার মাঝে ব্যাঘাত ঘটাল সেই চিকন মেয়েলি সুর। চোখ দুটো নিমজ্জিত হওয়া আবারও পিটপিট করে তাকালো ফুল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নয়নের পানে। ফুল দেখে উসখুস করে উঠল রায়ান। গলা খাঁকারি দিয়ে গাম্ভীর্য রূপটা ধারণ করার চেষ্টা করল। নয়নতাঁরা ফুলটা রায়ানের মুখের সামনে ধরে বলল,
“আমাদের গাছের ফুল। এটা নিন।”
“কেন?”
“ফুল কেন দেয় একটা মানুষ আরেকজন মানুষকে? উপহার হিসেবে? পুরষ্কার হিসেবে? আবার ভালোবাসা প্রকাশ্যে। এরমধ্যে যেকোনো একটা ধরে নিলেই পারেন।”
নয়নতাঁরা এমন উত্তরে এবং কন্ঠস্বরে রায়ান বুঝল মেয়েটা তার করা বোকা প্রশ্নে চটে গেছে। ফুলটা নেওয়া উচিত হবে কিনা সেটা বুঝে উঠতে পারছে না। তবে মেয়েটার চোখে স্পষ্ট আকাঙ্ক্ষা দেখে ঢক গিলে দুটো আঙ্গুলে ফুল ধরল রায়ান। নয়নতাঁরার হাসির ঝলকে যেন মুখরিত হয়ে উঠল আশপাশ। মেয়েটা এতো ছোট ব্যাপারে খুশি হয়ে গেল কেন? মেয়েটা আর দাঁড়াল না। দ্রুত পায়ে পিছু ফিরে হাঁটা দিল। কিছুদূর গিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,
“ফুলটা কিন্তু আমি আমার বলা লাস্ট রিজনের জন্যই দিয়েছি মিস্টার!”
সর্বাঙ্গে বিদ্যুৎ খেলে গেল রায়ানের। মেয়েটা এক চোখের পলকে কোথাও যেন উধাও হলো। লাস্ট রিজন মানে? ভালোবাসা প্রকাশ্যে? এতটুকু ভাবতেই গলা শুঁকিয়ে এলো রায়ানের। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। কান গরম হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। নয়নের দেওয়া ফুলটি গোলাপ। বারোমাসি গোলাপ যাকে বলে। তবে বেশ স্নিগ্ধ ভাবে ফুটে রয়েছে। শেখরের প্রশ্নে ধ্যান ভাঙ্গে তার।
“স্যার, অফিসার নির্জনের বোন কী বলে গেল ওসব?”
রায়ান থতমত খেয়ে গম্ভীর ভাবে জবাব দেয়,
“কিছু না। তুমি গাড়ি স্টার্ট দাও।”
রাস্তার আশেপাশে কিছু গ্রামীণ দৃশ্য দেখে বেশ ভাবনায় পড়ে গেল কোহিনূর। রাগিনীর বিশেষ চমকটা কী সেটা বুঝে উঠতে পারল না। এবার ধৈর্যহারা লাগছে নিজেকে। শেষমেষ রাগিনীর উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“আপনার সারপ্রাইজটা কি আজকের মধ্যে দেখতে পাব তো ম্যাডাম?”
রাস্তার দুপাশে ধানের ক্ষেত বিমোহিত হয়ে পর্যবেক্ষণ করছিল রাগিনী। বেশিক্ষণ টিকলো না তার মুগ্ধতা। কোহিনূরের কথায় সোজা হয়ে বসে আঁড়চোখে তাকিয়ে উত্তর দিল,
“অবশ্যই আর বেশিক্ষণ নয়। সামনেই আপনার সারপ্রাইজ ওয়েট করছে।”
রাগিনীর কথাবার্তা আজ ঠিক সুবিধার মনে হচ্ছে না কোহিনূরের। মেয়েটা অদ্ভুত ভাবে কথা বলছে। তার প্রতিটা কথায় যেন সাসপেন্সে ভরা। কীসের দৌলতে ঠিক এত সাসপেন্স সেটা বুঝে উঠতে পারছে না কোহিনূর। গাড়ি থামতেই ভাবলেশহীন হয়ে সামনে তাকায় কোহিনূর। জায়গাটা ঠিক তার চেনা নেই। তবে রাগিনী গাড়ি থেকে নেমে কাউকে কল লাগালো প্রথমেই। কোহিনূরও তার দেখাদেখি নেমে দাঁড়াল বাহিরে। গ্রামের পরিবেশ মানেই এক অন্যরকম স্নিগ্ধতা। শীতল বাতাস মন অবধি ছুঁইয়ে দেয়। খোলা মাঠে ধানগুলো দেখে মনে হয় কোনো সবুজ রঙের দীঘি। রাস্তার দুইপ্রান্ত সারিতে লাগানো বড় ইউক্যালিপটাস গাছগুলোর পাতা দুলছে। পাখিরা যেন সুর তুলে আওয়াজ করতে পারে এখানে। কোহিনূর প্রাণভরে একটা নিশ্বাস নিল। অতঃপর গাড়ির সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“সারপ্রাইজটা কিন্তু দারুণ। সো ন্যাচরাল। আই এম ইম্প্রেসড, রাগের রানী!”
গাড়ির ওপ্রান্ত দাঁড়িয়ে থাকা রাগিনী কানে ফোন ধরে একটা উদ্ভট হাসি দিল। যেন মনে হচ্ছে মেয়েটার এই হাসিতেও লুকিয়ে রয়েছে গভীর রহস্য। সেই রহস্য উদ্ঘাটন করার বহু চেষ্টা করেও সফল হলো না কোহিনূর। রাগিনী হাসিমুখেই বলল,
“এটা তো শুরু। আসল সারপ্রাইজ এখনো বাকি।”
কথাটা শেষ করেই ফোনে মনোযোগ দিল পুরোটাই। ফোনের ওপাশে কে কী বলল তা কোহিনূরের কান অবধি পৌঁছাল না। তবে তার উত্তরে রাগিনী যা বলল কান খাঁড়া করে শুনল সে।
“আপনি ঠিক কোথায়? হ্যাঁ, গাড়িটা আমারই। আপনি কোথায় বলুন? আশেপাশে…”
কথাগুলো সম্পূর্ণ করতে চেয়েও করতে পারল না রাগিনী। সম্পূর্ণ এক বাক্য হতে আটকালো তার হাঁচি। জোরে একটা হাঁচি দিতেই গোছানো চুলগুলো মুখের সামনে এসে পড়ল তার। আগের মতো একহাত দিয়ে চুল পেছনে দিতে ব্যর্থ হলো সে। বাতাস তাকে সফল হতে দিল না। হুরহুর করে বাতাস চোখেমুখে আরো চুল ছিটিয়ে দিতেই চুলের উপরই যেন রাগল সে। কিছুহাত দূরে দাঁড়িয়ে কোহিনূর তার এমন তুচ্ছ রাগের কারণে মিটমিটিয়ে হাসতে থাকল। তবে সে খেয়াল করছে রাগিনীও আসার পর থেকে বেশ কিছুবার হাঁচি দিয়েছে। মাঝে মাঝে নাক ঘষছে। চোখটাও কিছুটা ফুলে গিয়েছে বোঝাই যাচ্ছে। তাহলে তারও কি ঠান্ডা লেগেছে কোহিনূরের মতো? অবশ্য খারাপ কী? কথায় বলে না? হাম জিতে হায় তো একসাথ, মারতে হায় তো একসাথই। তাহলে একসাথে বৃষ্টিতে ভিজে একসাথে ঠান্ডা লাগার লজিকটাও ভুল কিছু নয়। এসব উল্টোপাল্টা ভেবেই মাথা ঝাঁকাল কোহিনূর। তার চোখের উপর অন্য কেউ হাত ঝাঁকাতেই দৃষ্টি স্থির হয় তার। রাগিনী বলে,
“কোথায় হারিয়ে যান?”
কোহিনূর মৃদু হেঁসে সহজ উত্তরে বলে,
“আমার প্রেমিকার সঙ্গে এক ভালোবাসার সাগরে।”
সামান্য বাক্যটা শুনে শিরদাঁড়া ঠান্ডা হলো রাগিনী। এই প্রেমিকা নামক শব্দটি শুনলে মনের মাঝে মিশ্র অনুভূতি কাজ করে শুধু। পৃথিবীর অন্যসব ভাবনা বাদ দিয়ে কোহিনূরের বলা এই প্রেমিকা শব্দটির গবেষণা করতে মন চায়। কী এমন অমৃত লুকায়িত আছে এর মাঝে? নাকি এটা শুধু কোহিনূরের কন্ঠে শোনা বলে এতোটা শ্রুতিমধুর? কিছু নীরব থেকে রাগিনী নিচু সুরে বলে,
“এইযে সামনে ধানের মাঝে এই সরু রাস্তা দেখতে পাচ্ছেন এখান দিয়ে আমাদের কিছুদূর হাঁটতে হবে।”
“কেন? আবার কোথায় যাব?”
“ভয় পাচ্ছেন বুঝি?”
“ভয় শব্দটা আমার ডিকশনারিতে নেই। যদি থেকে থাকে সেই ভয়টার নাম তুমিময় একটা ভয়। সেখানে নিজের ক্ষতি, আ’ঘাত পাবার ভয় নেই কোথাও! শুধু রয়েছে রাগিনী নামক মেয়েটিকে মাঝরাস্তায় হারিয়ে ফেলার ভয়।”
নিজেই তাজ্জব বনে গেল রাগিনী। গোল গোল চোখে তাকিয়ে রইল। মানুষটা যে মাঝে মাঝে কী বলে সেটা বুঝতে সময় লেগে যায় বেশ। যদিও বুঝে ফেলে তখন উত্তর দেওয়ার মতো কোনো শব্দ মস্তিষ্কে আসে না। মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে পড়ে। হৃদয় নিজ তাগিদে সরগম সৃষ্টি করে। কী বিশাল যন্ত্রণা!
জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে রাস্তার নিচে সেই ধানের মাঝে সরু রাস্তায় নেমে যাওয়ার চেষ্টা করে রাগিনী। বরাবরের মতোই রাগিনী পায়ে মাঝারি সাইজের উঁচু হিল পড়ে। আর বৃষ্টি হওয়ায় পুরো জায়গায়টা যে পিচ্ছিল ছিল সেটা ধারণাতে আসেনি তার। ফলস্বরূপ পা পিছলে যায়। রাগিনী ব্যালেন্স হারায়। এই বুঝি সব শেষ। অঘটন ঘটার অন্তিম পর্যায়ে রাগিনীর কোমড়ে এক প্রশস্ত এবং শক্ত হাতের স্পর্শ অন্যহাত রাগিনী হাতে আবদ্ধ হয়। মৃদু চিৎকার দিয়ে চোখমুখ খিঁচে নেয় পড়ে যাবার ভয়ে। ফিসফিসিয়ে বলা কথা এবার কানে বেজে ওঠে রাগিনীর।
“এই কোমলিনীর হাতটা যতক্ষণ আমার হাতে আবদ্ধ ততক্ষণ সে এই কোমলিনীকে পড়তে দেবে না।”
আস্তে করে তাকাল রাগিনী। তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে রাখা ব্যক্তিটিকে দেখেই কেমন যেন হৃদয়ের তরঙ্গ নিজ ছন্দে মেতে ওঠে। মানুষটার স্পর্শ সে পেতে না চাইলেও পেলে এতোটা উতলা হয় কেন সে?
কাজের ফাঁকে একটু বিরতি নিয়েছেন রাশেদ সাহেব। শরীরটা যেন দিন যাচ্ছে অকেজো হয়ে যাচ্ছে। আর আগের মতো একাধারে বসে পেশেন্টের সাথে কথা বলতে পারেন না। ক্লান্ত বোধ করেন। চেয়ারে মাথা হেলিয়ে চশমাটা খুলে চোখ বুঁজে নীরবে বসে রয়েছেন। বুকটা হালকা হালকা ব্যথা করছে। গতকাল ঔষধ নিতে ভুলে গিয়েছিলেন। হতে পারে এটা তারই ফল। চিনচিন করছে বুকের ভেতরে। এই সময়ে ফোন বেজে ওঠায় খানিকটা বিরক্ত হন তিনি। ফোন ধরবেন না বলে ঠিক করলেও অনিচ্ছায় চোখ মেলে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখেন বাড়ির ল্যান্ডলাইন থেকে ফোন আসছে। এখান থেকে একমাত্র সৈয়দই ফোন করে। তাই দেরি না করে রিসিভ করলেন তিনি। আর গম্ভীর গলায় বললেন,
“হ্যালো, সৈয়দ! অসময়ে ফোন দিলে যে। কোনো সমস্যা?”
ওপাশ থেকে নরম সুর ভেসে এলো সৈয়দের।
“তেমন কোনো সমস্যা না স্যার। দুঃখিত এই সময় ফোন করার জন্য। কিন্তু কিছু জানার ছিল তাই বাধ্য হয়ে কল দিলাম। বলতেছিলাম, বাড়ির মেহমানদের জন্য কী কী খাবার হবে সেটা যদি বলে দিতেন। এনারা তো আবার সব কিছু খায় না। সকালে অভিরূপ বাবাকে তুলসি দিয়া চা করে দিছিলাম। খাইছে। দুপুরের জন্য কী করব?”
“রাগিনীর থেকে জেনে নিতে। রাগিনী তোমায় বলেনি?”
“রাগিনী মা তো বাড়িতে নাই, স্যার। সেজন্যই তো আপনারে কল দিলাম।”
এবার টনক নড়ে রাশেদ সাহেবের। কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়ে। সন্দিহান হয়ে জানতে চান,
“মানে? বাড়িতে অভিরূপ আর নোমান আছে। ওদের রেখে রাগিনী কই গিয়েছে? বাড়িতে কেউ না থাকলে তো সমস্যা।”
“টিফিনবক্সে খাবার নিয়া বাকি দিনগুলার মতো ওই পাগলটার কাছে গেছে আজকেও।”
মিনমিন করে জবাব দিলো সৈয়দ। রাশেদ সাহেবের বুক চিঁড়ে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস। কেমন যেন হতাশ বোধ করছেন। শান্তভাবে বললেন,
“মাটন বিরিয়ানি কর, সাথে কষানো মাংস, ডাল আর আমরা বাঙালিদের যে যে খাবার দ্বারা আপ্যায়ন করি সেসবই করো। তবে মনে রাখবে ঝাল কম দেবে। অভিরূপ ঝাল খেতে পারে না। আর কিছু মিষ্টি জিনিস বানিয়ে রাখো। আমি রাখছি।”
বিলম্ব না করে কল কাটেন রাশেদ সাহেব। আরো একবার বড় শ্বাস ফেলে নিজের টেবিলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকান। মেয়েটা কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। আগে তো এমন ছিল না। রাশেদ সাহেব তো একবার বলেই দিয়েছিলেন কোহিনূরের কাছে কম যাওয়া-আসা করতে। তবুও কি মেয়েটা কথাটাকে সেভাবে নেয়নি? উনার মেয়ে তো উনার কথা কখনো ফেলেন না। আজ শুধুমাত্র একটা পাগল ছেলের জন্য মেয়েটা এমন আচরণ করা শুরু করেছে? রাগিনীর ভরসাতেই তো অফিসে এসেছিলেন রাশেদ সাহেব। তিনি ভেবেছিলেন রাগিনী ওদিকে সব সামলে নিবেন। কিন্তু তার মেয়েটার এভাবে বোধবুদ্ধি লোপ পাবে ভাবতে পারছেন না। তবে কি ওই ছেলের প্রতি রাগিনীর কোনো অনুভূতি…?
আর ভাবতে পারলেন না রাশেদ সাহেব। এর বেশি ভাবতে চান না। বুকের ব্যথা কিছুটা তীব্র হলো। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন বার বার।
অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে সামনেই একটা লম্বা সিঁড়ি আবিষ্কার করল কোহিনূর। সিঁড়ি পেরিয়ে উপরে কাঠ দিয়ে বানানো একটা খোলা ঘরের মতো। নিজের হাতটা দিয়ে শক্ত করে রাগিনীর হাতটা ধরে রেখেছে সে। রাগিনী এবার সাবধানে হেঁটে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,
“এবার তো ছাড়ুন। আমি ঠিকঠাক হাঁটতে পারব।”
রাগিনীর কথা কানেই নিল না কোহিনূর। বরং হাতটা নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“কোনো রিস্ক নিতে পারব না। দেখা যাচ্ছে পড়ে টড়ে যাবে তারপর পা বা কোমড় ভাঙবে। আর এতোখানি রাস্তা আমাকে তোমায় মতো একটা সত্তর কেজি ওজনকে নিয়ে পাড়ি দিতে হবে হেঁটে। না না বাবা। আমি ওসবে নেই। সেফটি ফার্স্ট।”
“মোটেও আমি সত্তর কেজি ওজনের না। আপনার মতো মনে করেন নাকি আমাকে? মাত্র পয়তাল্লিশ কেজি ওজন আমার।”
রাগে ফুঁসে উঠে জবাব দেয় রাগিনী। নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিতেই কোহিনূর বলে,
“তোমরা যে এই হিল পড়ে কী মজা পাও বুঝিনা।”
রাগিনী এবার কথায় পাত্তা না দিয়ে একটা ভেংচি কেটে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল একমনে। কিছুক্ষণ ঠাঁই দাঁড়িয়ে কোহিনূরও পা বাড়ায় সিঁড়ির দিকে। শেষ সিঁড়িতে পা রেখে সামনে সেই কাঠের ঘরের মাঝে সাইড ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা একটা চেনা ব্যক্তিকে দেখেই কম্পন ধরে গেল কোহিনূরের। সে কী ভুলভাল দেখছে? হঠাৎ এই ইডিয়ট কোত্থেকে আসবে? নিজের চোখটা ভালোমতো ডলে আবারও একই ব্যক্তি দেখে মাথাটা ঘুরে ওঠে কোহিনূরের। পা দুটো সেখানেই থেমে যায়। দৃঢ় শক্ত চাহনি দিয়ে যেন চোখ দিয়েই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, ‘ইডিয়ট মেহরাজ, এই ছিল তোমার মনে? তোমার ব্যবস্থা হচ্ছে।’
অন্যদিকে মেহরাজের করুণ দৃষ্টি। সে যেন বলতে চাইছে, ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি।’
চলবে…
[বি.দ্র. আমি নিয়মিত হতে চেষ্টা করছি। কিন্তু হয়ে উঠছে না। আমি একজন স্টুডেন্ট তাই পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ততা আমারও থাকে। আশা করি সবাই বুঝবেন। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। সবাই রেসপন্স করার চেষ্টা করুন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]