গোধূলি বেলায় তুমি এসেছিলে – পর্ব ৩৫

0
352

#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৫

“কী হলো দাঁড়িয়ে পড়লেন যে! আসুন।”

কোহিনূরের হাতে ঝাঁকুনি অনুভব করতেই তার শক্ত দৃষ্টি সরিয়ে থমথমে মুখে রাগিনের দিকে তাকাল। শেষ রক্ষা হলো না বোধহয়। কোহিনূর রাগিনীকে তার সম্পর্কে কিছু বলে উঠার আগেই রাগিনী হয়তো সব জেনে নিয়েছে। এই ভেবেই শিরদাঁড়া শিরশির করে উঠল তার। না চাইতেও নিজের শুকনো মুখটা কোনোরকমে লুকিয়ে বাকি সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো। কোহিনূর যতই এগিয়ে গেল মুখচোখের রঙ পাল্টে ফ্যাকাশে হতে থাকল মেহরাজের। করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কোহিনূরকে শান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতেই রাগিনী মেহরাজের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“আপনি মি. মেহরাজ?”

“হ্যাঁ। আমিই মেহরাজ। আমাকে দেখা হয়ে গিয়েছে ম্যাডাম তাহলে আমি যাই?”

এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলেই তড়িঘড়ি করে চলে যাওয়ার উদ্যেগ নিলো মেহরাজ। এ যেন জ্যান্ত বাঘের কবলে পড়েছে। একটা থাবা মা’রলে দেহ থেকে প্রাণ বেরিয়ে যাবে। তবে রাগিনী তাকে আটকে বলল,
“আরে, আশ্চর্য লোক তো আপনি। ফোনেও কীসব উল্টাপাল্টা বলছিলেন এখনো উল্টাপাল্টা বকে যাচ্ছেন। আমি কি আপনাকে দেখার জন্য ডেকেছি? আমি কিছু ইম্পর্ট্যান্ট কথা বলতে এসেছি আপনার সঙ্গে উনার বিষয়ে।”

বলেই কোহিনূরের দিকে ইশারা করে দেখিয়ে দিলো রাগিনী। মেহরাজ ঢক গিলে একবার কোহিনূরের দিকে তাকিয়েই সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে নিলো। তারপর স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,
“আপনারা দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন। বসে কথা বলি?”

বলেই আগেই মেহরাজ তার পাশে থাকা চেয়ারটা বেশ বিনয়ের সঙ্গে এগিয়ে দিতেই খপ করে কোহিনূর কৌশলে মেহরাজের চেয়ারে রাখা হাতটা ধরে জোরে চাপ দিতেই আঁতকে উঠে চিৎকার দিতে গেলেও থামল সে। ঠোঁট চেপে কাঁদো কাঁদো হয়ে কোহিনূরের দিকে তাকালো। মানুষটা অন্যকে টাইট কী করে করতে হয় খুব ভালো করে জানে। অতঃপর নির্বিকার ভঙ্গিতে পায়ে পা তুলে বসল কোহিনূর। রাগিনীর দিকেও চেয়ার এগিয়ে দিতেই রাগিনী বসার পরে মেহরাজও ভয়ে ভয়ে বসল। ঠোঁট চেপে বিরবির করে নিজে নিজেকে বলল,
“বসার চেয়ে না বসাই বোধহয় ভালো ছিল। কখন কোথায় ছুট লাগাতে হয় কে জানে! শুধুমাত্র সিংহের গর্জনের অপেক্ষা!”

“কিছু বললেন?”

রাগিনীর প্রশ্নে হকচকিয়ে মেহরাজ উত্তর দেয়,
“না না। আমি আর কী বলব?”

“আপনি উনাকে নিশ্চয় চেনেন?”

রাগিনী এবার ইশারা করে কোহিনূরকে দেখিয়ে দিতেই মেহরাজ কেশে উঠে বলল,
“চিনব না আবার? ক্ষ্যাপা ষাঁড়… থুরি মানে ক্ষ্যাপা পেশেন্ট। আই মিন মেন্টাল পেশেন্ট? আগে তো প্রতিবেশি ছিল আমাদের। অসুস্থ হলো এ’ক্সিডেন্টের পরে তারপরেই তো আপনাদের হসপিটালে রেখে আসলাম!”

“হ্যাঁ সেখান থেকেই আপনার নম্বর পেয়েছি। উনি ঠিক কখন থেকে অসুস্থ বা আপনি কখন থেকে উনার মাঝে পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন বলতে পারবেন?”

“আমি তো উনার সাথে কাজ করার পর থেকেই থুক্কু মানে উনার এ’ক্সিডেন্টের পর যখন সুস্থ হয়ে হসপিটাল থেকে ফিরলেন তারপরেই তো বুঝলাম।”

“কীভাবে বুঝলেন?”

“উনার পাগলামি আচরণ! মাঝে মাঝেই তো একেবারে অ…অস্বাভাবিক আচরণ করে ফেলে। ওইতো ক্ষ্যাপা ষাঁড় বললাম না?”

আটকা আটকা গলায় কথাগুলো বলতে গিয়েই চেয়ারের হাতলে এক থাবা মে’রে বসল কোহিনূর। হকচকিয়ে উঠে কোহিনূরের পানে তাকালো রাগিনী আর মেহরাজ দুজনেই। ভয়ের চোটেই দাঁড়িয়ে গেল মেহরাজ। তোতলানো কন্ঠে বলল,
“দেখুন, দেখুন! এখনি যেভাবে তাকিয়ে আছে। পাগলকে পাগল বলেছি তাই তো ক্ষেপে গিয়েছে।”

কোহিনূরের পক্ষে এবার আর চুপচাপ থাকা সম্ভব হয় না। সে বেশ বুঝতে পারছে এই মেহরাজ সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেতাই বলে যাচ্ছে। পেটে পেটে শয়তানি ভালোই জমে রয়েছে তার। হাত মুঠো করে দাঁড়াতেই দুই ধাপ পিছিয়ে যায় মেহরাজ। কোহিনূর দাঁত কিড়মিড় করে বলে ওঠে,
“ইউ…”

কথাটা অসম্পূর্ণ রেখেই মেহরাজের দিকে তেড়ে যেতেই মেহরাজকে আর পায় কে! সিঁড়ি সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে থাকায় ফট করেই সিঁড়ির কাছে গিয়ে জোর গলায় বলে,
“ওরে বাবারে! পাগল ক্ষেপেছে।”

ব্যাস! মেহরাজ রাগিনীর সব জেরা থেকে বাঁচার সুযোগ পেয়ে যায়। আর সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়? নাহ, একদম নাহ। সে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে লাগায় এক ছুট। রাগিনী চেয়েও থামাতে পারে না তাকে। পিছু ডাকে বেশ কয়েকবার। কোহিনূরও ইচ্ছাকৃতভাবে মেহরাজকে ধাওয়া করতে গেলেই রাগিনী গজরাতে গজরাতে বলে,
“থামুন, কোহিনূর? কী শুরু করেছেন?”

হাফ ছেড়ে বাঁচে কোহিনূর। তার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। মেহরাজও যে তার কাজ এতো সহজে করে দেবে সে ভাবেনি। আপনমনে নীরবে আওড়ায়, ‘যাক স্টুপিড টার বুদ্ধির উন্নতি ঘটেছে। নির্জন আহমেদের সাথে কাজ করে বলে কথা! তাই গোবরের বদলে খানিকটা বুদ্ধির উদয় হয়েছে মনে হয়।’

ভাবনা থেকে ফিরে পিছু ফিরে তাকায় কোহিনূর। বড় শ্বাস নিয়ে রাগিনীর কথার জবাবে বলে,
“দেখলে না ও আমাকে কীভাবে কন্টিনিউয়াসলি পাগল বলে যাচ্ছে? আমি পাগল? আমাকে দেখে পাগল মনে হয়?”

রাগিনীর মেজাজ চড়ে গিয়েছে। সে ভাবেও নি এমন কান্ড ঘটবে। তবে মেহরাজের বেশ কিছু কথা তার মস্তিষ্কে গভীরভাবে গেঁথে গিয়েছে। সাইকোলজি পড়ে এতটুকু যে বোঝার ক্ষমতা রাখে কে কেমন মানুষ সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটির কথাবার্তা দেখে। রাগিনী বুঝেছে মেহরাজ নামক ব্যক্তিটির একটা সমস্যা হচ্ছে কথা চেপে রাখতে না পারা। কিছু মানুষ আছে যাদের পেটে কোনোরকম কথাই থাকে না। এসব মানুষকে নিজের সিক্রেট বলা বিপদজনক। মেহরাজও ঠিক সেরকমই একটা মানুষ। তবে তার সঙ্গে আরো একটু ডিসকাস করতে পারলে হয়ত ভালো হতো। তা আর হলো কই? রাগিনী অনেকটা ভেবে বলল,
“আপনিই তো একদিন আমায় বলেছিলেন আপনি পাগল? তাহলে কেন রাগছেন উনার কথায়?”

“ওই পাগল আর এই পাগল তো এক নয়, রাগের রানী। কারোর আসক্তিতে আসক্ত হওয়া পাগল আমি। কারোর নেশায় উন্মাদনা হওয়া পাগল আমি।”

রাগিনী মূহুর্তেই মিইয়ে গেল। চোখমুখে যেন ঝলক লেগে মুখ নিচু করে নিলো। অথচ এই লজ্জা, এই সংকোচের কোনো কারণ নেই। কারণ বিহীন লজ্জা কেন আসে? কে জানে! আবারও উৎসাহিত হয়ে কোহিনূর বলল,
“আকাশটায় আবার মেঘ করেছে। এবার বৃষ্টি আসলে মনে হয় না থামবে বলে।”

রাগিনী একবার কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করল কোহিনূরের দিকে। তারপর জোর বেগে হাঁটা ধরল। কোহিনূরের পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি দিয়ে জোরে জোরে নেমে গেল। কোহিনূর বুঝল রাগিনীর রাগের কারণ। মেয়েটা চেয়েছিল মেহরাজের সঙ্গে ডিটেইলি কথা বলতে। কিন্তু তা তো কোহিনূর হতে দেয়নি এবং হতে দেবেও না।

বড় বড় পায়ের ধাপ ফেলে আগে আগে হাঁটছে রাগিনী। গ্রামের কাঁদামাখা পথে রাগিনীর হাঁটতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। তার হিল জুতো বসে যাচ্ছে। তবুও থামছে না সে। পেছন পেছন হেঁটে রাগিনীর সাথ ধরতে পারছে না কোহিনূর। এটা মেয়ে নাকি ধানিলঙ্কা কে জানে! একবার চটলে একদম ভেতরের ঝালগুলো বেরিয়ে শ্বাস বন্ধ করে দেওয়ার উপক্রম করে দেয়। হাঁটার গতি ধীরে করে কোহিনূর বলে,
“আরে ওয়েট, ওয়েট! অলিম্পিক রেসের প্রস্তুতি নিচ্ছো নাকি তুমি? একটু তো দাঁড়াও। এবার পড়ে যাবে সত্যি!”

সামনে হাঁটা রাগিনীর মুখ থেকে কোনো জবাব এলো না। সে আপনমনে হেঁটেই চলেছে। যেন মৌনব্রত পালন করছে সে। কোহিনূর তার জবাব না পেয়ে আবারও জোর গলায় বলে,
“রাগিনী! এবার পড়ে গেলে কিন্তু আমি ধরতে পারব না। অন্তত একটু ধীর হাঁটো। যাতে পড়ে যেতে নিলে আমি ধরতে পারি।”

“আপনি যা বলবেন সব মানতে হবে নাকি? আমার যেভাবে ইচ্ছা আমি সেভাবে হাঁটব। আপনি…”

রাগিনী দিয়ে ফেলল হাঁচি জোরে। কোহিনূর হাসতে গিয়েও তারও হাঁচি পড়ল। দিনটা যেন হাঁচিময়! হাঁচি শেষে আবারও হাঁটতে আরম্ভ করল রাগিনী। হতাশ মনে কোহিনূরও পিছু নিলো তার। হাঁটার মাঝে বিরবির করে রাগিনী বলল,
“একে আমার প্ল্যান নষ্ট করে এখন দরদ দেখাচ্ছে। উনাকে নিয়ে আসাই উচিত হয়নি। যদিও উনাদের দুজনের মানে মি. মেহরাজ আর কোহিনূরের দেখা হওয়ার পর রিয়েকশনটা অদ্ভুত ছিল। দুজনে যেন চোখে চোখে কথা বলছিল। এটা আমার চোখ এড়ায়নি।”

“এই ভোমরা!”

কোহিনূরের হঠাৎ এমন চিৎকারে হকচকিয়ে উঠল রাগিনী। ভোমরার কথা শুনে লাফিয়ে উঠতেই নিজেকে সামলানো আর সম্ভব হয় না। ওড়নাটা তার পায়ের জুতোর নিচে পড়তেই অবস্থা বেগতিক হয়। চিত হয়ে সোজা পড়ে একেবারে সবুজ ধানের ক্ষেতে। এবার আর কোহিনূরের পক্ষে ধরা সম্ভব হয় না তাকে। তাকে ধরতে গিয়ে নিজেই হতভম্ব হয়ে যায় কোহিনূর। চিত হয়ে ধানের ক্ষেতে পড়ে চোখমুখ থেকে শুরু করে জামাকাপড়ে যেন রাজ্যের সকল কাঁদা আশ্রয় নিয়েছে। চোখমুখ খিঁচে কাঁদো কাঁদো করে রেখেছে রাগিনী তার মুখশ্রী। কাঁদার ঠান্ডা যেন শিরশির করে শরীরে ঠেকছে। এই অবস্থাতেই সে বলল,
“ভোমরা? কোথায় ভোমরা?”

কোহিনূর আশেপাশে তাকাল। না জানার ভান করে বলল,
“কীসের ভোমরা? কই ভোমরা?”

“আপনি যে এখনি বললেন ভোমরার কথা? চিৎকার দিয়ে উঠলেন?”

এবার কোহিনূরের ঠোঁট কামড়ে হাসি দেখে চোখ দুটো সরু হয়ে আসে রাগিনীর। বেশ বুঝতে পারছে কোহিনূর মিথ্যে বলেছে। এবার তার ইচ্ছে করছে লোকটার মাথা ফা’টিয়ে দিতে। হাতে কিছুটা ব্যথাও পেয়েছে সে। দাঁত কিড়মিড় করে রাগিনী বলল,
“আপনি মিথ্যে বললেন কেন? আপনাকে আমি…”

“ভালোবাসবে?”

রাগিনীর দিকে খানিকটা ঝুঁকে ভ্রু কুঁচকে বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করেই বসল কোহিনূর। তার দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকানোর শক্তি না পেয়ে রাগিনী নিচে তাকিয়ে বলল,
“মে’রে দেব আপনাকে। বাজে লোক। মিথ্যে বলে শুধু!”

“আমি মিথ্যে কখন বললাম? সত্যিই তো ভোমরা ছিল। আমার প্রাণভোমরা যেটা নিয়ে তুমি গড়গড় করে হেঁটে চলে যাচ্ছিলে!”

রাগিনীর রাগ যেন গরমে আইসক্রিমের ন্যায় নিমিষে গলে গেল। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। মানুষটার কথায় কী এমন আছে যা মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দেয়? ভাবনায় অন্ত ঘটালো দূর থেকে ভেসে আসা এক চিৎকার। হতবিহ্বল নয়নে ক্ষেতের ওপারে চাইল রাগিনী। একটা লোক হাত উঁচিয়ে ছুটে আসছে। কিছুক্ষণ ভাবতেই মনে হলো এই ক্ষেতটা ওই লোকের। আর রাগিনী নিজে সেই ক্ষেতের মাঝে পড়ে অনেকটা ধানের গাছ নষ্ট করে দিয়েছে। বুঝতে সময় লাগল না তার খবর খারাপ আছে। আবার লা’ঠিপে’টা করবে না তো? কী ভয়ানক ব্যাপার স্যাপার! কোহিনূর সেই কৃষকের ছুটে আসা দেখেই ভয়ে লাফিয়ে বলল,
“যদি বাঁচতে চাও তাড়াতাড়ি উঠে পড়ো। পালাতে হবে এখনি। নয়ত নিস্তার নেই।”

কোহিনূর এবার বিলম্ব না করে রাগিনীর হাতটা শক্ত করে ধরে টেনেই তুলল রাগিনীকে। নিজের কাঁদা মাখা গা ঝাড়তে চেয়েও পারল না সে। কোহিনূর হাত ধরে টান দিয়ে লাগায় এক দৌড়। রাগিনীর তাল মিলিয়ে দৌড়াতে শুরু করলেও মাঝপথে থামে সে। হাঁপিয়ে উঠে বলে,
“দাঁড়ান! এই হিল পায়ে দৌড়ানো যায় নাকি? একটু ওয়েট করুন আমি জুতো খুলে নিই।”

“তোমার জুতো খোলার চক্করে দুজনের হাল খারাপ না হয়ে যায়! ফাস্ট ফাস্ট!”

জুতো খুলতে খুলতেই মেঘ ফুঁড়ে যেন ভুবনকে আরো শীতলতম করতে ধেয়ে নেমে এলো বৃষ্টি। তাও ধীরে নয় ঝুমঝুম করে। মূহুর্তেই রাগিনীর মাথার উপর দুহাত তুলে রাগিনীকে ঢাকার বৃথা চেষ্টা করে তবুও বৃষ্টির ফোঁটা একের পর এক ছুঁয়ে যায় রাগিনীকে। জুতো খুলে হাতে নিয়েই অবাক পানে কোহিনূরের দুটো হাতের দিকে তাকায় রাগিনী। মানুষটাকে যতই দেখে বিস্ময়ের অন্তিম যেন ঘটতে চায় না। নিজে ভিজে চুপসে যাচ্ছে সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। অথচ হাত দিয়ে কোনো কাজ হবেনা জেনেও মানুষটা কীভাবে আগলে ধরার চেষ্টা করছে! এজন্যই বোধহয় রাগিনীর মনের আস্তাকুঁড়েই পড়ে থাকে সন্দেহগুলো। সেগুলোকে উদ্ধার করা হয় না। আর মনের রাজপ্রাসাদে রাজার হালে বসে থাকে কোহিনূর নামক ব্যক্তিটির যত্ন এবং অব্যক্ত অনুভূতি। আচমকা হাতে হেঁচকা টান অনুভব করল রাগিনী। খেয়াল করে সেও কোহিনূরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছুটতে শুরু করেছে। মুখের কোনে ফুটে উঠল আপনাআপনি এক হাসির রেখা। না চাইতেও মন খুলে আনন্দে চিৎকার করতে মন চাইছে এই বৃষ্টিতে খোলা আকাশের নিচে তার হাত ধরে রাখা মানুষটিকে নিয়ে। অনুভূতিগুলো যেন মনে কী সুন্দর খেলা শুরু করে দিয়েছে! উল্লাসেই যেন আর দ্রুত ছুটতে শুরু করে রাগিনী। রাগিনীর এমন বেগে কোহিনূর হতভম্ব! তবুও মুখ ফুটে কিছু বলা হয়ে উঠেনা তখন।

ক্ষেতের রাস্তা পেরিয়েই দেখা মিলল একটা খোলা মাঠের। পেছন পেছন আর ওই কৃষককে দেখা যাচ্ছে না। রাগিনী দৌড়ানোর মাঝে বেশ কয়েকবার থেমে হাঁচি দিয়েছে। আবারও কেশেছে। কোহিনূরের মনে হলো মেয়েটার বৃষ্টিতে ভেজা আর ঠিক হবে না। এই মাঠ পেরিয়ে আরো একটা ক্ষেত পেরিয়ে তবেই মেইন রাস্তা। এতোদূর যেতে যেতে রাগিনীর অবস্থা আরো বেগতিক হলেও হতে পারে! অন্তত কিছুক্ষণ থামা প্রয়োজন। আশেপাশে চেয়ে একটা ঠেলাগাড়ি নজরে পড়ল কোহিনূরের। ঠেলাগাড়ির উপর রাখা নীল রঙের মোটা প্লাস্টিকের পলিথিনও ভিজছে একাধারে। দেরি না করে রাগিনীকে নিয়ে ঠেলাগাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল সে। ঠেলাগাড়ির উপুড় হয়ে থাকা প্রান্তে ভালো করে পলিথিনটা উপরে দিয়ে দিল সে। অতঃপর নিচু হয়ে ঢুকে গেল ঠেলাগাড়ির ঠিক নিচে। ভেতরে ঢুকেই মাথা বের করে দেখল রাগিনী উৎসুক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে। কোহিনূর রাগিনী না বলা প্রশ্নের জবাব দিয়ে বলল,
“আর কতটা দৌড়াব? একটু রেস্ট নিই এসো।”

দেরি না করেই রাগিনীর হাত টেনে তাকেও নিজের কাছে বসিয়ে দিল কোহিনূর। এবার সব পানি পলিথিনের উপরেই পড়ছে। কেমন যেন শব্দ করে উঠছে পলিথিনের গায়ে পড়লে। ঝুম বৃষ্টিতে আকাশ দেখাচ্ছে বিজলির খেলা। আসলেই ভালো লাগছে এবার। খানিকটা ঠান্ডা লাগলেও পাশ ঘেঁষে হাঁটু উঁচু করে থাকা সেই মানবটির উষ্ণতা যেন এসব ঠান্ডার কাছে তুচ্ছ। রাগিনীর শরীর ও মন জুড়ে বয়ে যায় প্রশান্তির বাতাস। অপলক দৃষ্টিতে উৎসুক হয়ে দেখতে থাকে প্রকৃতির এই খেলা। আর কী চাই? সুন্দর প্রকৃতি, ছোট্ট একটা জায়গা, পাশ ঘেঁষে বসে থাকা প্রিয় মানুষ! আসলেই কি প্রিয় মানুষ? নাহলে আবার কী? জানা নেই রাগিনীর। মনে চলতে থাকা জটিল এই প্রশ্নের সমাধান করতে করতে মাথাটা নুইয়ে পড়ল কোহিনূরের কাঁধে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় কোহিনূর। খুব ইচ্ছে করে রাগিনীর মাথায় একটু চুমু খেতে। তবে ইচ্ছেটাকে চাপা দিয়ে বড় শ্বাস নিয়ে প্রশান্তির এক শ্বাস নেয় সে। মনে মনে বলে, ‘এবার যে করেই হক তোমায় আমার বিষয়ে সব জানাব। দরকার হলে না হয় কঠিন কোনো শাস্তি দিও। তবুও নিজের করে যত্নে সাজিয়ে রাখব তোমায়।’

আজ কাজ সেরে সন্ধ্যার মধ্যে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরতে পেরেছে রায়ান। ঘরে ঢুকেই দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নিল সে। মায়ের সাথে অনেকদিন কথা হয় না। মাকে ভয়ানক ভাবে মিস করছে। বিশেষ করে তার মায়ের হাতের রান্নাগুলো। দৈনিক সার্ভেন্টের হাতে রান্না খেয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে। দিনশেষে কাজ সেরে বাড়িতে এসে মায়ের সঙ্গে দু’দণ্ড কথা বলার মুহূর্তগুলো মিস করে সে। তবে ভিডিও কলে মাকে দেখে কিছু কথা বলা ছাড়া যে আর কোন কিছুই করার নেই। রায়ানের মা মিসেস. রমিলার মারন ব্যাধি ক্যান্সার ধরা পড়েছে। উন্নত মানের চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর অবস্থান করছেন। মিসেস. রমিলা খুব করে চেয়েছিলেন ছেলেকেও নিজের সাথে নিয়ে যেতে। কিন্তু ছেলে যে নিজের আদর্শ ভোলে না। তার জীবনে ঘটে যাওয়া বাবাকে নিয়ে ঘটনা তাকে আরও বেশি আদর্শবান করে তোলে। সে চায় না নিজের বাবার মতো একটা খারাপ পুলিশ অফিসার হতে। রায়ান শান্তশিষ্ট হলেও ভীষণ জেদি ছেলে। একবার যা ভাববে তা করবেই। তাই তার মাও তাকে জোর জবরদস্তি করেন নি।

ডিভানে বসে গলায় টাওয়াল জড়িয়েই মাকে ভিডিও কল লাগায় রায়ান। অতঃপর কিছুক্ষণের মাঝেই ফোন কল রিসিভ হলো। ভিডিও কলে দেখা গেল একজন শ্যামল মায়াবী অর্ধবয়স্ক মহিলাকে। উনার মুখ চোখ দেখে বোঝাই যাচ্ছে ছেলেকে দেখে কতটা খুশি। রায়ান মনোযোগ দিয়ে এক পলক মায়ের দিকে চেয়ে থাকল। তার মায়ের চুলগুলো কেমন যেন পাতলা হয়ে গিয়েছে। মুখশ্রীতে স্পষ্ট একটা দুর্বলতা ধরা দেয়। মায়ের কণ্ঠে চকিতে তাকায় রায়ান।
“হেই বিজি ম্যান! অবশেষে ব্যস্ততা কাটলো তবে? মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময় হলো?”

“পিঞ্চ করছো আমাকে?”

“আরে ধুর! ইন্সপেক্টর রায়ানকে পিঞ্চ করবে তাও সাধারণ রমিলা? এত সাহস আছে নাকি তার?”

রায়ান গালে হাত দিয়ে বসে বসে মায়ের বলা কথা শুনছে। অতঃপর নীরবতা ভাঙ্গে রায়ানের। স্মিত হেঁসে জবাব দেয়,
“আছে তো একজনের সাহস। রায়ানের গর্ভধারিনী মায়ের।”

মিসেস. রমিলা মুগ্ধ দৃষ্টিতে ছেলের দিকে চেয়ে থাকে। ছেলেটার সকলকে মুগ্ধ করার অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে। তিনি প্রসঙ্গ পাল্টে বলেন,
“তারপর বলো, ওখানকার কী‌ অবস্থা? সব ঠিকঠাক তো?”

“আর ঠিকঠাক! দেশে যা হচ্ছে তা শুনলে যে কারোর গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাবে। কিছুই ঠিক নেই।”

“তুমি কি টে’রোরি’স্ট হাম’লার কথা বলছো?”

রায়ান মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালো। রমিলা চিন্তিত সুরে উত্তর দিলেন,
“আমিও আর্টিকেল আর নিউজে বেশ কিছু খবর পড়েছি। শুনলাম অভিরূপ চৌধুরী গিয়েছে। তাকে নিয়েও তো রাজ্যের বিপদ।”

“সে আর বলতে? কিছু মানুষ আপনা আপনি বিপদের দিকে ধেয়ে আসে। আমার মনে হয় এই অভিরূপ চৌধুরী ঠিক সেরকমই মানুষ। আমি যদি প্ল্যানিং করে ভুল গাড়ির ইনফরমেশন না দিতাম তাহলে নিশ্চিত সব শেষ হয়ে যেত।”

“এসব করতে গিয়ে তো নিজেকেও প্রায় শে’ষ করে দিচ্ছিলে। নিজের একটু খেয়াল রাখো। তুমি কখনো ভাবো না তাই না যে তোমার কিছু হয়ে গেলে আমার কী হবে!”

রায়ান খানিকক্ষণের জন্য চোখ বুঁজে নেয়। মায়ের সঙ্গে কথা বলতে গেলে এই এক সমস্যা‌। কথায় কথায় ইমোশনাল হয়ে পড়ে। রায়ান কপাল কুঁচকে উত্তর দেয়,
“মা প্লিজ স্টপ। কিছু তো হয়নি আমার। লুক, আমি একেবারে ফিট আছি। অফিসার নির্জন তো বাঁচিয়ে নিয়েছিলেন সেদিন আমায়।”

“হ্যাঁ, একমাত্র নির্জনের থেকেই আমি তোমায় একা রেখে আসার ভরসা পাই। ছেলেটা সঠিক সময় সঠিক জায়গায় উপস্থিত হতে পারে। আর অফিসার অফিসার কি বলছো? এমন হাবভাব করছ যেন তোমার সঙ্গে ওর শুধু কাজের সূত্রের সম্পর্ক।”

রায়ানের মুখে ধরা দেয় মলিনতা। তারও যে নির্জনকে অফিসার বলে সম্বোধন করতে ভালো লাগে সেটাও না। কিন্তু নিজের মাঝে যে জড়তা বাসা বেঁধেছে সেটাও তো কাটিয়ে ওঠার মতো নয়। রায়ান মলিন গলায় বলল,
“তুমি যাকে ভরসা করে আমায় এখানে রেখে গিয়েছো তার সঙ্গে দুই দন্ড সামনাসামনি হলেই রেষারেষি লেগে যায়। পারলে যেন আমাকে চিরদিনের মতো নিজের চোখের সামনে থেকে সরিয়ে ফেলে। সেই সম্পর্কটা ছোটবেলার মতো নেই মা।”

রমিলা হালকা হেসে বলেন,
“তুমি তাকে এখনো চিনতে পারোনি। সে অন্যদের মতো দেখিয়ে দেখিয়ে কেয়ার করে না মানুষের। সে মানুষকে লুকিয়ে ভালবাসতে পছন্দ করে। যদি সে তোমাকে চিরদিনের মতো তার সামনে থেকে সরিয়ে দিতে চাইতো তাহলে সেদিন তোমাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসতো না। তুমি অসুস্থ বলে সে সব ছেড়ে এয়ারপোর্টে ছুটে গিয়েছিল। তুমি তো আমাকে এটাও বলেছ যে মাঝরাতে হসপিটালে সে তোমার খবর নিতে আসতো। ছোটবেলার বন্ধুত্বের টান এতো সহজে ছিঁড়ে যাওয়ার নয়।”

“আমি জানি তুমি আমার ঠিক যতটা কেয়ার করো ততটাই নির্জনের কেয়ার করো।”

“বাধ্য হয়ে এক প্রকার কেয়ার করি। তার মাঝে এমন কিছু আছে যা কোনো মানুষকেই মুখ ফিরিয়ে রাখতে দেবে না। সে যেখানে অবস্থান করে সেই জায়গাটা মাতিয়ে রাখে। এমনই হচ্ছে নির্জন আহমেদ কোহিনূর।”

রায়ানের মুখে আপনা আপনি মুগ্ধ হয়ে যাওয়া হাসি চলে আসে। সে জানে না মুগ্ধ হওয়ার কারণ। জানার ইচ্ছেও নেই। রমিলা আবারও বলে ওঠেন,
“নিজের খেয়াল রাখার সাথে সাথে নির্জনেরও খেয়াল রাখবে। তার যেকোনো সমস্যায় তোমাকে আমি তার পাশে দেখতে চাই।”

রায়ান বাধ্য ছেলের মতো মাথা ঝাঁকায়। আরো অনেক কথা হয় মা আর ছেলের মধ্যে।

পরদিন সকাল সকাল ট্রেনিং রুমে এসেছে নির্জন। মন মেজাজ খারাপ থাকলেই এখানে হঠাৎ করে উপস্থিত হয় সে। এখন সেখানে কেউ নেই। ফোন দিয়ে ডাক পাঠিয়েছে মেহরাজকেও। টেবিলে থাকা রি’ভলবার হাতে তুলে নিয়ে সামনে থাকা গোল করা নিশানাগুলোর দিকে তাকাল সে। টার্গেট নিয়ে একচোখ বন্ধ করে একধারে কয়েকবার ট্রিগার চাপলো। রি’ভলবার থেকে বে’র হওয়া বুলে’ট গিয়ে সরাসরি একেবারে নির্দিষ্ট নিশানায় লাগতেই বাঁকা হাসলো নির্জন। দরজা ঠেলে কেউ কাঁপা পায়ে ভেতরে ঢুকল। নির্জনের ভাবান্তর হলো না। সে নিজের কাজে ব্যস্ত। মেহরাজের কন্ঠ কাঁপছে। গতকাল সে যা যা বলেছে সেসব মাথায় এলেই তওবা কাটছে। নির্জনের ভ্রুক্ষেপ নেই দেখে সে অবশেষে বলেই ফেলল,
“স…স্যার!”

নির্জন নিজের হাতের রিভ’লবার রেখে একটা সুন্দর হাসি উপহার দিয়ে বলে,
“ওয়েলকাম মি. মেহরাজ! ওয়েলকাম।”

“আই এম সরি স্যার। আই এম রিয়েলি সরি।”

“কীসের সরি?”

ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল নির্জন। টেবিলের উপর বসে দুটো অ্যাপেল পড়ে থাকা দেখে একটা হাতে নিয়ে কামড়ে খেতে লাগল। মেহরাজ ঢক গিলে জবাবে বলল,
“কালকের জন্য। ওইসব ক্ষ্যাপা ষাঁড়, পাগল আরো…”

“আমি তো ওসব মনেই রাখিনি তুমি কেন মনে রেখে দিয়েছো?”

মেহরাজের মুখে রাজ্যের হাসির ঝিলিক চলে আসে। আবেগে আপ্লুত হয়ে বলে,
“সত্যি স্যার? আমি জানতাম আপনি অনেক দয়ালু।”

নির্জন আবারও হাসে। অ্যাপেলে দ্বিতীয় কামড় দিয়ে বলে,
“অ্যাপেল খাবে?”

“না স্যার। বাড়ি থেকে ব্রেকফাস্ট করে এসেছি।”

তবুও মানে না নির্জন। পাশে থাকা আরেকটা অ্যাপেল হাতে নিয়ে ছুঁড়ে দিল মেহরাজের দিকে। তৎক্ষনাৎ মেহরাজ ক্যাচ করল সেটা। নির্জন নেমে দাঁড়াল। নিজের কোটের গলা ঠিকঠাক করে রি’ভলবার হাতে নিলো। অতঃপর বলল,
“গুড ক্যাচ! এখন ভদ্রভাবে অ্যাপেলটা মাথায় রেখে আমার সামনে দাঁড়াও।”

মূহুর্তেই হাসিটা গায়েব হলো মেহরাজের। মুখটা জড়িয়ে গেল। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
“আই এম সরি তো স্যার।”

“জাস্ট সরি? ওকে দেন, আমিও তোমার মাথায় একটা একটা করে বু’লেট ঢুকিয়ে দিয়ে বলব, আই এম সরি মেহরাজ। ওকে?”

চলবে…

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আমি অসুস্থ হয়ে গিয়েছি হঠাৎ। সেটা অনেকেই জানেন। তার উপর প্র্যাক্টিকালের প্রেশার। আমি একজন স্টুডেন্ট। তাই সবদিক সামলে গল্প দিতে হয়। একটু দেরি হওয়ায় অনেকেই হাইপার হয়ে যান দেখি। কিন্তু আমারও তো কিছু সমস্যা থাকে। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here