#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৬
“আমি ক্ষ্যাপা ষাঁড়? আমি পাগল?”
“না স্যার একদম না। আপনি কেন পাগল হতে যাবেন? এতো বুদ্ধিমান মানুষ আপনি। আর ক্ষ্যাপা ষাঁড় বলে তো আমি আপনার প্রশংসা করেছিলাম। আই মিন, সবাই আপনাকে দেখে ভয় পায়। তটস্থ থাকে। তাই জন্যই তো ওই কথা বলছিলাম। স্যার আমাকে দিয়ে প্লিজ এই ডে’ঞ্জারাস কাজ করাবেন না। যদি একটুখানি এদিক থেকে ওদিক হয়ে যায় আমাকে প্রা’ণ বেরিয়ে যাবে।”
নির্জন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিজের রিভ’লবা’র তাক করে মেহরাজের দিকে। আর ব্যস্ত সুরে জবাব দেয়,
“কেন মেহরাজ? আমার টার্গেটের উপর ভরসা নেই তোমার?”
“টার্গেটের উপর তো ভরসা আছে একশো পার্সেন্ট। কিন্তু আপনার উপরে ভরসা একদম জিরো পার্সেন্ট। কখন অ্যাপেলকে টার্গেট করতে গিয়ে মন বদলে যাবে আর টার্গেট আমি হয়ে যাব তার তো ঠিক নেই।”
“কিছু বললে, মেহরাজ?”
ভ্রু উঁচিয়ে ঠোঁটে সুক্ষ্ম হাসি দিয়ে এক চোখ বন্ধ করে নির্জন। রি’ভলবা’র মেহরাজের মাথায় থাকা অ্যাপেলের দিকে তাক করতেই মনে মনে দরুদ পড়া শুরু করে দিল মেহরাজ। টেনশনের চটে কপাল ঘেমে গিয়েছে একেবারে। কাঁপা কাঁপা সুরে জবাব দিল,
“আমি আর কী বলব স্যার। আমার মুখ মনে হয় আজ আজীবনের মতো বন্ধ…”
বিকট শব্দ হলো। মেহরাজ মুখের কথা আর পুরোটা শেষ করতে পারল না। বুঝতে পারল বু’লে’ট অলরেডি রি’ভল’বার থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। সে কি ম’রে গিয়েছে? চোখ খুললে কি সব অন্ধকার দেখবে? বন্ধ করে থাকা চোখ কি খোলা উচিত? নির্জনের গম্ভীর কন্ঠ কানে আসে এবার।
“মেহরাজ! ইউ আর স্টিল অ্যালাইভ।”
মেহরাজ এবার উচ্ছ্বাসের সাথে চোখটা খুলে প্রশান্তির শ্বাস ফেলে নেয়। অ্যাপেলটা নিচে পড়ে আছে। মেহরাজ খুশিতে উৎফুল্লতার সাথে বলে,
“থ্যাংক ইউ স্যার। থ্যাংক ইউ।”
“থ্যাংকস্ দেওয়ার কিছুই নেই। পরেরবার উল্টাপাল্টা বকলে আমার রি’ভলবা’রের সব বু’লেট তোমার মাথার মধ্যেই যাবে।”
“ভুলেও না স্যার। এবার জোর করলেও এই চরম সত্যি কথাগুলো কেউ কথা বের করতে পারবে না। আই প্রমিস।”
মেহরাজ এমন কথায় আবারও চোখ গরম করে তাকাল নির্জন। সঙ্গে সঙ্গে ঢক গিলে নিলো মেহরাজ। নির্জন টেবিলের উপর আয়েশের সঙ্গে বসে বলল,
“তারপর? ওইদিকের কী অবস্থা? মি. শাহ্ রাশেদ সাহেবের সম্পর্কে কী কী জানতে পারলে?”
মেহরাজ বেশ ভাবুক হয়ে উত্তরে বলল,
“উনার সম্পর্কে সন্দেহজনক কিছুই পাইনি। রাগিনী তাজরীন ম্যাডাম যেই হসপিটালে হয়েছিলেন সেখানে খোঁজ নেওয়া হয়েছে। ফাইলস্ চেক করা হয়েছে। কিন্তু টুইন বেবির নামগন্ধও পাইনি আমরা। একটাই বেবি হয়েছিল সেটা হচ্ছে রাগিনী ম্যাডাম।”
“আর ইউ সিউর? এটা কীভাবে হয়? কথায় বলে, পৃথিবীতে একই চেহারার সাতজন মানুষ এক্সিস্ট করে। কিন্তু বিষয়টা এতোটাও নয়। এটা আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে রাগিনীর মতো আরেকজনও আছে। হতে পারে এটা প্রি-প্ল্যানড রাগিনীকে ফাঁসিয়ে নিজের পরিকল্পনা সফল করার। রাগিনীর মতো দেখতে মেয়েটা নিজেও চাইছে নিজের আসল পরিচয় লুকিয়ে রাগিনী নামে কার্যসিদ্ধি করতে। যদি সেটা না হয় তাহলে চট্টগ্রাম টু ঢাকা ট্রেনে দুটো রাগিনী তাজরীন নামে টিকিট কাটা হতো না। নিশ্চিত এটাও প্ল্যান করেই করা।”
“তাহলে এখন উপায় কী স্যার? কীভাবে ওই মেয়েটাকে ধরব আমরা?”
“সেটা জানি না মেহরাজ। কিন্তু মেয়েটা যতই রাগিনী সাজার চেষ্টা করুক। যতই রাগিনীর চেহারা নিয়ে ঘুরে বেরাক কিন্তু আমি আসল আর নকল এক মূহুর্তে ধরে ফেলতে পারব। অভিরূপ চৌধুরী এখন কোথায় আছে?”
মেহরাজ হতভম্ব হয়ে তড়িঘড়ি করে বলল,
“ওহ হো স্যার একটা কথা ভুলে গিয়েছি। অভিরূপ চৌধুরীর বাবার সঙ্গে রাগিনীর বাবার বেশ খাতির ছিল। সেকারণে শুনেছি এখন অভিরূপ রাগিনীদের বাড়িতে আছে। আই থিংক ওটা সেফ জায়গায় তার জন্য।”
কিছুক্ষণ নীরব রইল নির্জন। দৃষ্টি স্থির করে নিয়ে কিছু একটা ভাবলো। তারপর জবান খুলে বলল,
“আই ডোন্ট থিংক সো। আমার তো মনে হয় রাগিনীকে যেহেতু এতো চালাকির সাথে ফাঁসানো হচ্ছে সেহেতু ওই বাড়িতেই এমন কেউ আছে যে কিনা রাগিনীর নজর রাখতে পারে। আর সেই ইনফরমেশন সেই মেইন টিমকে জানানো হয়। তাই এটা ধরে নেওয়া যায় না যে রাগিনীর বাড়িটা সেফ।”
“তাহলে কি এখন রাগিনীর বাড়িতে সবার ফোন নম্বর ট্র্যাক করব স্যার?”
প্রশ্নটা করে উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে মেহরাজ। নির্জন মাথা নাড়িয়ে বলে,
“না। সেট করে আদেও কোনো লাভ আছে বলে আমার মনে হয় না। যে কাজটা করছে সে নিশ্চয় তার আসল সিমকার্ড দিয়ে ইনফরমেশন দেবে না। আর একটা কথা, আমার মনে হয় সময় হয়ে গিয়েছে এবার সরাসরি মি. শাহ্ রাশেদকে জেরা করার। এবার যা শুনতে হবে উনার মুখ থেকে শুনতে হবে। তাছাড়া আর কোনো উপায় নেই।”
“তাহলে কি উনাকে ডাকার ব্যবস্থা করব?”
“হুমম করে ফেলো। আর দেরি করা ঠিক হবে না। সময় যত যাবে ততই মানুষের প্রা’ণনাশের আশঙ্কা বাড়বে। বাট আমি তো সরাসরি কথা বলতে পারব না।”
মেহরাজ হতাশ মুখে তাকিয়ে আমতা আমতা করতে থাকে।
“তা…তাহলে…”
“তাহলে আমি আপনাকে হেল্প করতে পারি, অফিসার নির্জন।”
মেহরাজের কথা কে যেন ছিনিয়ে নিলো। সে নির্জন নয়। ঘরে প্রবেশ করল ইন্সপেক্টর রায়ান। প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে অপেক্ষা করল নির্জনের প্রতিত্তোরের। নির্জন রায়ানকে দেখে কিছুটা অবাক হলেও পরক্ষণেই ধাতস্থ করে রায়ানকে খানিকটা পর্যবেক্ষণ করে নিল। তারপর মুখ ফিরিয়ে বলল,
“হোয়াট অ্যা প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ। ইন্সপেক্টর রায়ান যে। মেহরাজ, কি দেখছো চেয়ে? যাও যাও চা, কফি যা পারো নিয়ে এসো।”
“থাক। তার দরকার নেই। আমি ব্রেকফাস্ট করেই এসেছি। চা খেয়েই বাড়ি থেকে বের হয়েছি। আমি শুধু আপনার মতামত জানতে চাইছি। আপনার হেল্প করার সুযোগ দেবেন তো?”
নির্জন হেঁসে বলে,
“হঠাৎ আমার হেল্প করার জন্য আপনার মন উতলা হয়ে উঠল কেন?”
রায়ান ভাবলেশহীন হয়ে উত্তরে বলল,
“গিভ অ্যান্ড টেক! আপনি আমাকে হেল্প করেছেন সেদিন আমায় বাঁচিয়ে আজ না হয় সেটা ফেরত দেব!”
নির্জনের এবার বেশ রাগ হয়। রায়ান তাকে উপকার ফেরত দিতে চাইছে? নির্জন কি হেল্প ব্যাক পাবার জন্য তাকে হেল্প করেছিল নাকি? আশ্চর্য তো! নির্জন মুখটা ভার করে বলে,
“নো নিড। নির্জন আহমেদ হেল্প ব্যাক পাওয়ার জন্য হেল্প করে না।”
“আপনি আর চান আর না চান আমিই এই কাজটা করব। আমি শেখরকে দিয়ে মি. রাশেদের কাছে খবর পাঠাচ্ছি। চিন্তা করবেন না। সিসিটিভি ক্যামেরা আর রেকর্ডার দিয়ে আমার আর মি. রাশেদের কথোপকথন সবই শুনতে পাবেন। এখন আসছি। আমার কাজ আছে।”
রায়ান আর বিলম্ব করল না। নির্জনের জবাব না শুনেই দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। এখনো স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারছে না রায়ান। সেটা নির্জনের দৃষ্টি এড়ায় না। নির্জন বিরবির করে বলে,
“ভাঙবে তবুও মচকাবে না। বাই দ্যা ওয়ে মেহরাজ, তার পায়ের সমস্যা সারতে কতদিন লাগবে?”
“এখন একটু একটু সমস্যা হবেই স্যার। তবে বেশিদিনও লাগবে না। গু’লি তো পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছিল।”
নির্জন আবার নীরবতা পালন করে। বুক চিঁড়ে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস।
মাথাব্যথায় চোখটা খুলতে পারছে না রাগিনী। কালকে দীর্ঘ সময় বৃষ্টিতে ভেজা আর আনন্দে ছুটে ছুটে বৃষ্টিবিলাস করার ফল ভুগছে এবার। সর্দিতে নাক পুরোটাই বন্ধ। মুখ দিয়ে শ্বাস নিতে হচ্ছে তার। মাঝে মাঝে হাঁচি দিয়ে ফেলছে। ঘুমটা বেশ কিছুক্ষণ হলো ভাঙলেও চোখ বুঁজে শুয়ে আছে সে। রিও এর ডাকে আধো আধো চোখে তাকাল রাগিনী। রিওকে এগিয়ে আসতে দেখে একটা মিষ্টি হাসি দিল। রিও কেমন যেন করুণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে। তার নিকটে এসে সামনের একটা পা দ্বারা স্পর্শ করল রিও তার গাল। তারপর মিউ মিউ শব্দ করে উঠল। রাগিনী বুঝতে পারল এই ছোট্ট ছানাও বুঝতে পেরেছে রাগিনী অসুস্থ। সেকারণেই তার এমন দৃষ্টি। রাগিনী দুর্বল কন্ঠে রিও এর উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“খিদে পেয়েছে বুঝি?”
রিও কোনো শব্দ করল না। চোখ বুঁজে রাগিনীর গালের সাথে নিজের গাল ঠেকিয়ে শুয়ে পড়ল। বেশ আদুরে ভঙ্গিতে ডেকে উঠল। রাগিনীর হাসি প্রসারিত হলো যেন। ব্লাঙ্কেট থেকে একটা হাত বের করে তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিল। দরজায় টোকা পড়ে তখন। দরজার দিকে তাকিয়ে আড়মোড়া ভেঙ্গে শরীরের উপর জোর খাটিয়ে উঠে বসে রাগিনী। হয়তবা সৈয়দ কাকা এসেছে। এই ভেবে কিছুটা জোর সুরে বলে,
“ভেতরে আসুন চাচা।”
দরজাটা খুলল এবার। ছোট ছোট পায়ের ধাপ ফেলে প্রবেশ করল কেউ এবার। হাসি সহ জবাবে এলো,
“ইয়ে মানে আমি তো চাচা নই। আমার বয়স চাচা হওয়ার মতো হয়নি।”
সৈয়দের কন্ঠের বদলে অন্য কোনো পুরুষালি কন্ঠে পিটপিট করে তাকাল রাগিনী। অভিরূপকে দেখে চোখ দুটো কপালে উঠল তার। অভিরূপের হাতে একটা চায়ের কাপ। সেটা নিয়ে রাগিনীর বেডের দিকে এগিয়ে আসছে সে। তাকে দেখে রাগিনী অস্ফুটস্বরে বলল,
“আপনি?”
“হ্যাঁ আমি। সেকারণেই তো বললাম আমি চাচা নই।”
“আপনি কেন চাচা হতে যাবেন? আমি তো সৈয়দ চাচা ভেবেছিলাম। আসলে সকালবেলা খাবার দিতে আর খোঁজ নিতে উনি ছাড়া অন্যকেউ আসেন না তো তাই।”
অভিরূপ ফট করেই চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে স্থির হয়ে রাগিনীর বেডের সামনে দাঁড়াল। আর স্পষ্ট জবাবে বলল,
“অন্যকেউ থাকেনা তাই আসে না। এখন আছে তাই আসবে মিস. তাজরীন। আর কালকে থেকে তো আপনি ব্যস্ত! সকাল সকাল কোথায় বেরিয়ে গেলেন। আবার ফিরলেন বিকেলের দিকে। ফিরেই নিজের ঘরেই এসে বসে আছেন। কথা বলার সুযোগও হলো না।”
রাগিনী জোরপূর্বক হাসি দিয়ে নিচের দিকে তাকায়। তারপর একহাতে নিজের গাল, নাক, মুখ মুছতে থাকে। না জানি ঘুম থেকে ওঠার পর মুখে কত রাজ্যের তেল লেগে থাকে। তার উপর এলোমেলো চুল দেখে এই ফেমাস সিঙ্গার তাকে পেত্নী ভেবে যে পালিয়ে যায়নি এই অনেক। অপরদিকে রাগিনীর প্রতিত্তোর না পেয়ে কিছুটা ভড়কে গিয়েছে অভিরূপ। কারণ শেষবার তার সঙ্গে যখন দেখা হয়েছিল যে হারে ছেলেগুলোকে উত্তমমধ্যম দিয়েছিল তা মনে পড়লেই অভিরূপের মনে হয় কখন জানি মেয়েটা তার উপরেও ঝাঁপিয়ে পড়ে। আচ্ছা হুটহাট মেয়েটার রুমে আসার অপরাধে আবার উত্তমমধ্যম দিতে শুরু করবে না তো? এই ভেবেই কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ায় সে। আটকা আটকা গলায় বলে,
“না সমস্যা নে…নেই। ক…কথা বলতে ইচ্ছে না ক…করলে কথা বলতে হবে না। আমি যাই হ্যাঁ?”
বলেই পিছু ফিরে দরজার পানে হাঁটতে লাগে সে। অভিরূপের এমন অদ্ভুত প্রতিক্রিয়ায় নয়ন দুটো গোল গোল হয় রাগিনীর। লোকটা কি মাইন্ড করল?
“আই এম সরি। আমারই উচিত ছিল আপনাদের সঙ্গে ভালোমতো পরিচয় হওয়া। কিন্তু সেটা হয়ে ওঠেনি। আমি দুঃখিত তার জন্য।”
এবার পা দুটো থামে অভিরূপের। ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়। মেয়েটা কেমন অনুতপ্তের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। এমন দুর্দান্ত সাহসী নারীও যে সরি বলবে এতো সহজে সেটাও ভাবতে পারেনি অভিরূপ। তাই সে প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,
“ইটস ওকে। বাট আপনি কি অসুস্থ? চোখমুখ অন্যরকম লাগছে। কালকে রাতে ডিনারের সময় একটু কাশছিলেন।”
“হ্যাঁ আসলে গতকাল বৃষ্টিতে ভিজতে হয়েছে তো তাই খানিকটা সিক হয়ে পড়েছি।”
কথা বলতে বলতেই দুজনের কথার মাঝে ব্যাঘাত ঘটিয়ে রিও আবারও ডেকে ওঠে। তার দিকে চেয়ে তার মাথায় হাত বুলাতেই অভিরূপ বিড়াল ছানা দেখে উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে এসে বলে,
“কিউট কিটি! হ্যালো…”
অভিরূপ বিড়ালের দিকে হাত বাড়াতেই রিও তার সামনের এক পা উঠিয়ে যেন ধমকে মিউ মিউ করে উঠল। অতঃপর আদুরে ভঙ্গিতে রাগিনীর কোলে ঢলে পড়ল। অভিরূপ হাতটা সরিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকাল। নাহ হাত বাড়ানোই ভুল হয়েছে। বোঝা উচিত! মালিক যেমন হবে তার বিড়ালও তেমন হবে। রাগিনী ফট করে বলল,
“আসলে ও সবার কাছে যেতে পছন্দ করে না। আমার কাছেই বেশি কমফোর্ট ফিল করে।”
“নো প্রবলেম। একচুয়ালি আমি আপনার জন্য চা এনেছিলাম। কাল কাশছিলেন তাই গলার ভালোর জন্য তুলসী চা এনেছিলাম। টেস্ট করতে পারেন।”
বলেই টেবিল থেকে চায়ের কাপ নিয়ে রাগিনীর দিকে বাড়িয়ে দিল অভিরূপ। মুখে রেখে দিল এক সুন্দর প্রশস্ত হাসি। তবে রাগিনীর প্রতিক্রিয়া দেখে আবারও ভড়কে গেল অভিরূপ। কীভাবে যেন চেয়ে থাকে মেয়েটা। শুধু মনে হয় এই বুঝি দিল একটা ঘু’ষি নয়ত থা’প্পড়! সঙ্গে সঙ্গেই চা সরিয়ে নিয়ে মুখের হাসি বিষিয়ে বলল,
“থাক থাক। খেতে হবে না।”
“আরে, এভাবে বলছেন কেন? আমি টেস্ট করব না কখন বলেছি? আসলে আপনি আমার জন্য চা নিয়ে এসেছেন। সেটাই ভাবছিলাম। আপনি আমাদের বাড়ির গেস্ট। তাও স্পেশাল গেস্ট। এসব আপনি কেন করছেন? এসব কোথায় আমার করা উচিত তা না করে বিষয়টা উল্টো হয়ে যাচ্ছে।”
অভিরূপ হাফ ছেড়ে বলে,
“এটা কোথায় লেখা আছে যে গেস্ট হলে শুধু তাদেরই সেবা পাওয়ার অধিকার আছে? সেবা দেওয়া অধিকার নেই! চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে টেস্ট করুন।”
রাগিনী চায়ের কাপ হাতে নিয়ে হালকা হাসে। তার এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে অভিরূপ চৌধুরী তার জন্য চা এনেছে। ভেবেই হাত-পা কেমন যেন কাঁপছে। কোনোরকমে চায়ের কাপে মুখ লাগালো সে। চা মুখে যেতেই মুখভঙ্গি পরিবর্তন হলো তার। অদ্ভুত স্বাদটা ভেতরে কাঁপিয়ে তুলল। এটা কীভাবে খায় মানুষ? অভিরূপ উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কেমন লাগলো?”
না চাইতেও জোরপূর্বক এক হাসি টেনে রাগিনী উত্তর দিল,
“গুড।”
“আমি তো প্রতিদিন সকালে খাই। গলা ভালো রাখে। বুঝতেই পারছো আমাকে গলা ভালো রাখতে হয়। সেকারণে নোমান আমাকে এক ফোঁটা ঠান্ডাও খেতে দেয় না। কী নিষ্ঠুর তার ব্যবহার।”
“আপনার ভালোর জন্যই তো দেয় না। গলা খারাপ হয়ে গেলে গানের সুর আসবে কীভাবে?”
“তার প্রশংসা করা বাদ দাও। সে যে কী জিনিস আমি জানি। বাই দ্যা ওয়ে, তুমি সেদিন ওভাবে পালিয়ে গেলে কেন? ইউ নো হোয়াট? আমি কতটা ভয় পেয়েছিলাম!”
রাগিনী এবার অভিরূপের কথায় স্মরণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল কোন সময়ের কথা বলছে সে? হসপিটালের কথা? সেটাই হবে নিশ্চয়। কারণ এরপর তো কোথাও তাদের দেখা হয়নি। তাই সেটা মনে করেই সে আমতা আমতা করে বলল,
“সেদিনের জন্যও সরি আসলে আমি ভুল করে ওই কেবিনে ঢুকে পড়েছিলাম তো তাই…”
“উঁহু… ওইদিনের কথা বলিনি আমি। লাস্ট যেদিন দেখা হলো আমাদের। রিমেম্বার! ওই জঙ্গলে…”
কুঁচকে গেল রাগিনীর ভ্রুজোড়া। জঙ্গলে কখন, কবে দেখা হলো? ভেবে পেল না সে। তখনি দরজায় আবারও কড়া নাড়ে কেউ। দরজা খোলা থাকাতেই রাগিনীর চোখে পড়ে নোমানকে। রাগিনী বিনয়ের সঙ্গে বলে,
“আসুন ভেতরে আসুন।”
নোমান এমন সুন্দর সম্মতিতে ভেতরে প্রবেশ করেই অভিরূপকে দেখে বলে ব্যাঙ্গাত্বের সাথে বলে,
“বাবাহ্, সামান্য পানি খাওয়ার জন্যেই যেই ছেলে অন্যকাউকে অর্ডার করে তাকে কিনা সকাল সকাল দেখলাম হলরুমে চা নিয়ে সোজা রাগিনীর রুমে আসতে!”
তেতে উঠল অভিরূপ। এই নোমানের সব জায়গায় সব কথা না বললেই নয়। শুধু শুধু ফাঁসিয়ে দেওয়ার ফন্দি। দাঁত চেপে বলল,
“খবরদার বদনাম করবি না। নিজের অকাজগুলো আমার উপরে চাপানোর চেষ্টা করবি না।”
“ওহ হো, আমি তোমার উপরে চাপানোর চেষ্টা করি তাই না? আজকে সকালেই তো জাস্ট এসির টেম্পারেচার কমাতে আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে ধা’ক্কা মে’রে ফে’লে দিয়ে বললি রিমোট নিয়ে টেম্পারেচার কমাতে। মনে নেই? আরো মনে করাবো?”
লজ্জায় যেন নাক কান কাটা যায় অভিরূপের। ইশশ… রাগিনী কী ভাবছে? কে জানে! এই নোমানকে থামাতে হবে। তাই সে রাগ মিশ্রিত হাসি দিয়ে বলল,
“মনে করা। আরো মনে করা। এটাও মনে করা সেদিন হোটেলে তুই আর আমি…”
নোমান তৎক্ষনাৎ ঝাড়ি দিয়ে বলে,
“স্টপ। তোকে আর বলতে হবে না। এখানেই চুপ কর।”
বলেই অভিরূপের মুখে থাবা মা’রে নোমান। অভিরূপ মুখে হাত দিয়ে বুলাতে থাকে আর চোখ রাঙিয়ে তাকায় নোমানের দিকে। এবার নোমান তার অন্য হাতে থাকা চশমার বক্সটা রাগিনীর দিকে এগিয়ে দিতেই ফ্যালফ্যাল করে তাকায় রাগিনী। নোমান ধীর কন্ঠে বলল,
“আসলে কালকে ওই মেয়েটা কী যেন নাম! উর্মিলা। গতকাল ওর সাথে প্রথমে রাগারাগি করলেও পরে আমি রিয়েলাইজ করি যে আসলেই ভুলটা কোথাও আমার ছিল। কারণ চশমাটা তো আমি ভেঙ্গেছি। আর যারা চশমা নিয়ে চলে তাদের অবশ্যই চশমার কিছু হলে খারাপ লাগবে স্বাভাবিক। আমি হয়ত ওভার রিয়েক্ট করে ফেলেছি। তাই কাল আমি মার্কেট থেকে খুঁজে কিছুটা একই ফ্রেমের চশমা আনায়। আর ভাঙ্গা চশমা আমিই কালেক্ট করেছিলাম পাওয়ার কত সেটা জানতে। না বলার জন্য সরি আর এটা তাকে দিয়ে আমার পক্ষ থেকে সরি বলে দেবে প্লিজ?”
নোমানের হাত থেকে চশমার বক্সটা নিলো রাগিনী। বক্স খুলে দেখল হুবহু একই ফ্রেমের চশমা। সেটা দেখে এক গাল হেঁসে বলল,
“আমার মনে হয় আপনারই সরি বলা উচিত। তাহলে বিষয়টা বেশি ভালো দেখাবে।”
নোমান কাতর সুরে বলল,
“কিন্তু আমি কীভাবে?”
“সরি মানুষ কীভাবে বলে? চশমাটা দেবেন আর সরি বলবেন। আমি না হয় ওকে আমার বাড়িতে ডেকে নেব।”
কথাটা শেষ করেই গলায় চাপ দিয়ে বেরিয়ে এলো কাশি রাগিনীর মুখ থেকে। তারপর চশমার বক্সটা ফিরিয়ে দেয় নোমানের দিকে। নোমান ভাবতে থাকে গতকাল যেই উড়নচণ্ডী মেয়েটার সাথে যা হলো মেয়েটা ঘুরেও তার দিকে তাকাবে কিনা ঠিক নেই। তাহলে সরি কীভাবে বলবে?
চেয়ারে হালকা ভর দিয়ে বসে আছে রায়ান। তার বৃদ্ধা আঙ্গুলটা থুঁতনিতে বুলিয়ে যাচ্ছে। শান্ত দৃষ্টিটা অবস্থান করছে রাশেদ সাহেবের দিকে। পরখ করে যাচ্ছে রাশেদ সাহেবের প্রতিটা প্রতিক্রিয়া। লোকটার অবস্থা খুব একটা ভালো মনে হচ্ছে না। বেশ অস্থির হয়ে পড়েছেন রায়ান কোনোরকম প্রশ্ন না করতেই। কেমন যেন হাসফাস করছেন। তা দেখে রায়ান গ্লাসের পানি এগিয়ে দিল উনার দিকে। ভদ্রলোক বেশ কঠিন সুরে জবাবে বললেন,
“নো থ্যাংক্স, ইন্সপেক্টর। আমাকে এখানে কী কারণে ডাকা হয়েছে সেটা জানতে পারি? আমি কী করেছি?”
রায়ান সোজা হয়ে বসল। টেবিলে দুটো হাত রাখল। আর সহজ গলায় বলল,
“আপনি একজন নামি-দামি মানুষ। তাই আপনাকে বিরক্ত করতে চাইছিলাম না আপনাকে। কিন্তু উপায় না দেখে আপনাকে জরুরী তলব করতেই হলো।”
“কিন্তু এর কারণটা কী?”
“তাহলে চলুন। আসল কথাতেই আসা যাক। আপনার স্ত্রীর নাম কী স্যার?”
রাশেদ সাহেব বুঝলেন না এমন অহেতুক প্রশ্নের কারণ। তবুও শান্ত থেকে জবাব দিলেন,
“মিসেস. নীলিমা।”
“আপনার মেয়ের নাম?”
“রাগিনী তাজরীন।”
রায়ান যেন একটা নামে সন্তুষ্ট হলো না। একটু দম নিয়ে বলল,
“এমন কি কোনো ঘটনা ঘটেছে যেখানে আপনার স্ত্রীর হয়তবা টুইন বেবি ছিল কোনো কারণে একটা বেবির মা’রা যাওয়ার খবর পান বা অন্যকিছু? আপনার যে একটাই মেয়ে এক্ষেত্রে আপনি কি নিশ্চিত?”
চলবে…
[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আশা করছি কাল থেকে নিয়মিত হতে পারব আমি। এতোদিন অনিয়মের জন্য দুঃখিত। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]