গোধূলি বেলায় তুমি এসেছিলে – পর্ব ৩৮

0
333

#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৮

ভয়ে শিথিল হয়ে রয়েছে রাগিনী। ফ্লোরে গুটিশুটি হয়ে নিজের ওড়না চেপে ধরে ভীতু নজরে বার বার তাকাচ্ছে সেই প্রা’ণঘাতী অ’স্ত্রের দিকে। সারা অঙ্গ জুড়ে ছেয়ে গিয়েছে এক উত্তেজনা। ক্ষণে ক্ষণে সৃষ্টি হচ্ছে কম্পন। মনে হচ্ছে যেন তার সামনে একটা বাঘ নয়ত সিংহ দাঁড়িয়ে যেটা যেকোনো মূহুর্তে আ’ক্রমণ করে বসতে পারে। না চাইতেও অবাধ্য মস্তিষ্ক জানান দিল উর্মিলার কথা সেদিনের কথাগুলো। সেই কথাগুলোর রেশ বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়ল রাগিনীর মনের অভ্যন্তরে। বুকে চিনচিন ব্যথা অনুভূত করল সে। সারা শরীর যেন অসাড় হয়ে এসেছে। না চাইতেও নিজের হাতের কম্পন থামানোর চেষ্টা করে দূর থেকে হাত বাড়াল সেই রি’ভলবারের দিকে। যদি জিনিসটা মিথ্যা হয়? শুকনো গলায় ঢক গিলে জিনিসটাকে ছোঁ মে’রে দ্রুত নিজের কাছে নিয়ে এসে নেড়েচেড়ে দেখল। কেমন একটা অদ্ভুত গন্ধ আসছে সেটা থেকে। তাহলে সেটা কি গান পাউডার? তাহলে এটা সত্যিই রি’ভলবার? সর্বাঙ্গ জুড়ে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল রাগিনীর তৎক্ষনাৎ সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বেডের নিচে ঢুকিয়ে দিয়ে ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়াল।

দরজার কাছে ছুটে গিয়ে দরজা ধরে কোনোমতে দাঁড়িয়ে আবারও বেডের নিচটায় চোখ গেল তার। কানে যেন হাওয়ার তালে ভেসে আসছে, ‘আচ্ছা! সে যদি সুস্থ হয় আর এমন ভান করে থাকে তাহলে নিশ্চয় তার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য আছে? এখন তো কয়েকদিন ধরে টে’রোরিস্ট হাম’লার বিষয়টা চলছেই। এমন নয় তো? যে ওই কোহিনূর কোনোভাবে টে’রোরিস্ট টিমের সাথে যুক্ত?’

এই কথা স্মরণে আসার পর দাঁড়ানোরও শক্তি পাচ্ছে না রাগিনী। দরজা ধরে রেখেছে। ভেতরে ভেতরে যেন ভেঙ্গেচুরে যাচ্ছে নিজের তৈরি কিছু আপন অনুভূতি। আবার পরক্ষণেই মনে হচ্ছে সে আবার ভুল ভাবছে না তো? কিন্তু ধারণা তখনই পাল্টে যাচ্ছে। এখানে সবটা পরিষ্কার। আরো পরিষ্কার করতে কোহিনূরের সাথে দেখা হবার পর একটার পর একটা ঘটা অদ্ভুত ঘটনার হিসাব মিলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল রাগিনী। প্রথমে কোহিনূরের হুট করেই আগমন। তার পাগলামির মাধ্যমে রাগিনীকে ধরে রাখা, আস্তে আস্তে তার আসল সত্ত্বা প্রকাশ পাওয়া, হসপিটালে বাচ্চা ছেলেটাকে দেখতে যাওয়ার সময় অন্য একটা মেয়ে তাকে আরেক নামে সম্মোধন করা, একদিন ঘুরতে বের হওয়ায় রাগিনীর উপর একদল লোক গু’লি চালানো, কোহিনূরের এক্সি’ডেন্টে ক্ষতি হয়েছে বলা সত্ত্বেও তার যানবাহনে ভয় না পাওয়া, দক্ষতার সাথে গাড়ি ড্রাইভ করতে জানা! এবার সবটাই যেন আপনা-আপনি বোধগম্য হয় রাগিনীর। ভাবনায় নিমগ্ন রাগিনীর দুচোখ ভর্তি পানির উদ্ভব যে কখন ঘটেছে সেটা টের পায়নি রাগিনী নিজেই। অস্ফুটস্বরে কোনোমতে ভাঙ্গা গলায় বলল,
“এটাই তাহলে উদ্দেশ্য। আপনাকে যা ভেবেছিলাম আপনি তাহলে সেটা নয়। আপনাকে যা কখনোই ভাবিনি আপনি সেটাই।”

রাগিনী বুঝে উঠতে পারল না কোহিনূরের জন্য সে অপেক্ষা করবে কিনা! তাকে কিছু বলা উচিত কিনা! বললে যদি আবার তাকেই কিছু করে বসে? মানুষটা তো নিষ্ঠুর। তার প্রতি কি দয়া দেখাবে? না হয়ত। তারা তো স্বার্থপর হয়। যার প্রতি কোমল অনুভূতি ছিল একরাশ। সেই কোমল অনুভূতিগুলো ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গিয়ে পাল্টে গেল এক ঘৃণ্য অনুভূতিতে। এখানে আর এক মূহুর্তও দাঁড়াতে ইচ্ছে করে না রাগিনীর। ঠোঁট কামড়ে চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসা পানিকে বাঁধা দিয়ে ফুঁপিয়ে বলল,
“ওরাই কি তাহলে ফিরে এসেছে?”

রাগিনীর ভেতরটা জ্বলছে। মনে হচ্ছে আগুনের তাপে জ্বলে ছারখার হয়ে যাবে সব। ঝলসে যাবে মনের দুয়ার। এই ঘরটায় আর থাকা সম্ভব নয়। দরজা ঠেলে বাহিরে চলে আসে সে এলোমেলো পায়ে।

ফোনে কথা বলে কোহিনূর ঘরে প্রবেশ করল কিছুটা বিক্ষিপ্ত হয়েই। এর থেকে যেন ফোনটা না ধরাই ভালো ছিল। শুধু শুধু আবারও তাদের ব্যর্থতার গল্প শুনতে হলো। নকল রাগিনীর ট্রেস আর পাওয়া যায়নি। জানা নেই কোন প্রান্তে গিয়ে লুকিয়েছে। এসব কথা শুনে মেহরাজকে ধম’ক দিয়ে ফোন কেটে দিয়েছে কোহিনূর। তারপর জোর পায়ে হাঁটা ধরেছিল নিজের অশান্ত, বিক্ষিপ্ত বিক্ষুব্ধ মনটাকে শান্ত করার প্রতিষেধক নেওয়ার জন্য। সেই প্রতিষেধক একটাই রাগিনী! যাকে দেখলে এই আগুন ধরানো মনটা নিমিষে বরফগলা এক রাজ্যে পাল্টে যেতে বাধ্য। তবে মনের বাসনা আর পূর্ণতা পেল না। রাগিনীর দেখা পেল না দুটো নেত্রপল্লব। ঘরটা খালি। আশেপাশে তাকাল কোহিনূর। আসলেই সে নেই। বিছানায় পড়ে রয়েছে একভাবেই খাবারগুলো। সেসব রেখে রাগিনী কোথায় চলে গেল? ঘরে এসে জানালার কাছে গেল কোহিনূর। উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করল রাগিনীকে গার্ডেনে দেখা যাচ্ছে কিনা। সেটাতেও ব্যর্থ হলো সে। আগে তো মেয়েটা খাবার রেখে এভাবে কোথাও চলে যায় না। তার কাশি আসতেই স্মরণ হলো রাগিনী তো অসুস্থ ছিল। অসুস্থতা কি বাড়লো তবে? কী করে খোঁজ নেবে?
“আমার মনটাকে অতৃপ্ত করেই বিদায় নিলে রাগের রানী? অতৃপ্ত মনটাকে বোঝাই কী করে বলো?”

ঘরে আসার পর দরজা বন্ধ করে রেখেছে রাগিনী। খোলেনি এখনো অবধি। দুপুরের খাবার খায়নি। সৈয়দ তাকে ডাকতে এসেছিল একবার। রাগিনী বলেছে খিদে নেই। আসলেও নেই খিদে। গলা দিয়ে খাবার নামবে না। নিজের বেডে গুটিশুটি হয়ে বালিশ চেপে ধরে বসে আছে। জানালার পাশে থাকা পর্দা হঠাৎ উড়ে উঠতেই ধড়ফড়িয়ে উঠল সে। মনে হলো যেন কেউ তাকে ধরতে আসছে। চিল্লিয়ে বলল,
“আমি কিছু করিনি।”

পর্দা চোখে পড়তেই শান্ত হলো দেহ। স্থির হলো দৃষ্টি। কোহিনূরের কথা স্মরণে আসতেই গুটিয়ে নিল নিজেকে। বিড়বিড়িয়ে বলল,
“যার কাছে নিজেকে সবচেয়ে বেশি নিরাপদ ভেবেছিলাম সে-ই হয়ে উঠল আমার নীরব ঘাতক!”

কথার মাঝে থামল রাগিনী। চোখের সামনে যেন স্বপ্নের ন্যায় ভেসে উঠল অতীতের সবথেকে অবহেলিত, অযত্নে রাখা এক পাতা। যেই পাতার ঘটনা ভুলেও যে স্মরণ করতে চায় না। তবে আজকের ঘটনা যেন সেই ঘটনার সাথেই সংযুক্ত।
“ও…ওরা চলে এসেছে এখান অবধি। আমার পি…পিছু কেন ছাড়েনি এ…এখনো। আমি তাদের থেকে মুক্তি চাই।”

বালিশে মুখ চেপে ধরে ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে রাগিনী। ভয় শুধু হাতছানি দিচ্ছে তাকে। তীব্র কোনো কিছুর আশঙ্কায় সারা গায়ের লোম শিউরে উঠেছে। কানে বাজছে সেদিনের বলা সেসব কথা। কত সুন্দর মূহুর্ত ছিল সেদিন। কতটা আপন ভেবে বলেছিল কোহিনূরের উদ্দেশ্যে সেসব কথা। কতটা স্বাচ্ছন্দ্যে ছিল লোকটার সাথে। নিজের বলা কথাগুলোই তার কানে বারংবার ধা’ক্কা খায় এবার।
‘পৃথিবীতে দুটো পুরুষের কাছে নিজেকে সবথেকে নিরাপদ মনে করি আমি। প্রথমজন আমার বাবা। দ্বিতীয়জন কোহিনূর সাহেব।’

কর্ণকুহরে ভেসে আসা সেই কথা আর শুনতে চায় না রাগিনী। কানটা চেপে ধরে দুহাতে। দাঁত চেপে বড় বড় শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। চোখ খুলে পিছু ফিরতেই দেয়ালের সঙ্গে টানানো কোহিনূরের স্কেচটা যেন জ্বলজ্বল করে ভেসে ওঠে। কোহিনূরের হাসোজ্জ্বল সেই মুখশ্রী ছিল রাগিনীর অদ্ভূত শান্তির কারণ সেই হাসিটা দেখে ভয় করতে শুরু করল তার। সেভাবেই শক্ত গলায় বলে ওঠে,
“আপনাকে বলেছিলাম, আমার বিশ্বাস ভাঙ্গবেন না প্লিজ। আপনি সেটাই করে খুব আনন্দ পেলেন।”

রাগিনীর এরূপ কথায় যেন হাসিটা আরো গাঢ় হলো স্কেচে থাকা কোহিনূরের। অথচ স্কেচে থাকা কোহিনূরের প্রাণ নেই। হাসিটাও আগের মতোই স্থির। তবুও রাগিনীর এমনটা মনে হচ্ছে। পুরো শরীর রি রি করছে। বালিশটা ফেলে দিয়ে রাগিনী দ্রুত ধাবিত হলো কোহিনূরের ঝুলিয়ে রাখা সেই স্কেচের দিকে। হাতের নখ দিয়ে আঁচড় দিতে ইচ্ছে করল তার। তবে পারল না। মানুষটির চোখের দিকে তাকিয়েই পড়ল গভীর ভাবনায়। না চাইতেও ছুঁয়ে দিতে বাধ্য হলো আদুরে স্পর্শে সেই আঁকা চোখ। এই চোখটা সে কত অনুভূতি মিশিয়ে এঁকেছিল। তবে তার জানা নেই কতটা গভীরতা দিতে সক্ষম হয়েছিল। আসল নেত্র তো আরো গভীরতম ছিল। তবে সেটাও কি মিথ্যে ছিল? ছলনা ছিল? দুর্বল কন্ঠে রাগিনী বলল,
“আপনাকে অবিশ্বাস করতে আমার ইচ্ছে করছে না। মনের মাঝে ঘৃণ্য বর্বরোচিত মানুষদের তালিকার মাঝে আপনি নামক মানুষটাকে ফেলতে ইচ্ছে করছে না। আপনি আমার কাছে সবসময়ের জন্য এক মোহনীয় মানুষ। তবে আমায় ভুল প্রমাণ করে দিয়েছেন আজ। আমার সন্দেহকে জিতিয়ে দিয়েছেন। আপনি বড়ই নিষ্ঠুর!”

রাগিনীর বলা কথাগুলো যেন নিজেরই সহ্য হচ্ছিল না তার। কথা শেষ করার সাথে সাথে সরে এলো। তার উচিত মানুষটাকে ঘৃণা করা। সে ঘৃণা করে কথাও তো বলতে পারছে না। দিশেহারা হয়ে পড়েছে। ফিরে গিয়ে ধপ করে সে বসে পড়ল নিজের বিছানায়। নিজের চোখের কোণে লেগে থাকা একটুখানি অশ্রু মুছে নিল হাতের পিঠ দিয়ে। কী করা উচিত কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না তার। কাকে জানাবে সে কথাটা? কেউ কি তাকে বিশ্বাস করবে? এসব আগপাছ ভাবতে ভাবতে আবারও চোখ ভর্তি পানি জমা হলো। তার পায়ে লাগল কারো আলতো ছোঁয়া। মাথা নিচু করে সেই স্পর্শ করার মালিককে দেখে মন শান্ত হলো কিছুটা। রিও মিউ শব্দ করে নিজে থেকে রাগিনীর কোলের উপরে উঠে বসে মাথা উঁচিয়ে রাগিনীর মুখশ্রীর দিকে অসহায় পানে তাকায়। যেন সেও বুঝেছে কিছু একটা। বুঝে নিয়েছে তাকে অতি যত্নে রেখেছে যেই নারী তার আজকে মন খারাপের দিন। রাগিনী পরম যত্নে তাকে দুহাত দিয়ে উঁচিয়ে ধরল। রিও সঙ্গে সঙ্গেই তার সামনের দুটো পা দিয়ে রাগিনীর গলা জড়িয়ে ধরে মিউ মিউ শব্দ করে উঠল। রাগিনীর বুঝতে সময় লাগল না রিও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মন খারাপ করেছে। ভেজা কন্ঠে বলল,
“আজকে খুব অসহায় লাগছে নিজেকে। এতো এতো মিথ্যে অনুভূতির মাঝে একমাত্র তোমার অনুভূতিই সত্যি মনে হচ্ছে। মানুষ হিংস্র, মিথ্যের পাহাড় গড়তে পারে। তোমাদের সরল অনুভূতির সামনে তারা বোধহয় তুচ্ছ।”

অনেক ভেবে উর্মিলার কথা মাথায় এলো রাগিনীর। যাকে এই মূহুর্তে সব ভরসা করে বলা সম্ভব। এই কথাগুলো কাউকে না কাউকে তো বলাই যায়। অন্তত এখন কী করা উচিত সেটা সম্পর্কে যদি সাজেশন পাওয়া যায় ক্ষতির কিছু নেই। আর যাই হক সে চায় না তার বাবার হসপিটালের এতো বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যাক। ভাবতে ভাবতে নিজের ফোনটা হাতে নিল রাগিনী। মলিন মুখে ফোন স্ক্রল করে নম্বর খুঁজে বের করে উর্মিলাকে কল লাগালো। কিছুক্ষণ রিং হতেই ওপরপানে থেকে উর্মিলার চিকন গলার সুর শোনা গেল।
“হ্যালো মামা।”

“আমি তোর মামা নই। আমি রাগিনী।”

উর্মিলা তড়িঘড়ি উত্তরে বলে,
“সরি সরি। জানিস তো আমি এখনো চশমা কিনি নি। তাই ঠিকঠাক দেখতে পাইনি তোর নাম। মার্কেটে গিয়েছিলাম আমার ওই কিউট ব্লু কালার ফ্রেমের চশমা খুঁজেই পাইনি। একজনের কাছে নাকি ছিল সেটাও নাকি কোন যেন ছেলে নিয়ে চলে গিয়েছে। ছেলেগুলো আস্ত একেকটা আপদ। একটা ছেলে আমার চশমা ভাঙ্গল আরেকটা ছেলে আমি কেনার আগে চশমাটা কিনে নিয়ে চলে গেল। শোন রাগিনী, একটা এডভাইজ দিচ্ছি, জীবনে আর যাই হক কোনো ছেলের পাল্লায় পড়বি না। তারা দেখবি তোর জীবনে বিপদ আর বিপদই ডেকে আনবে।”

না চাইতেও যেন রাগিনীর মুখ থেকে ফস্কে বেরিয়ে গেল,
“ঠিকই বলেছিস। অলরেডি হয়ত ডেকে এনেছে।”

“কী ডেকে এনেছে? আর তোর গলা এমন লাগছে কেন? কেমন যেন থমথমে। মন খারাপ নাকি তোর?”

“তুই যা বলেছিস সব মিলে গেছে রে উর্মিলা!”

উর্মিলা একটু নীরব রইল। ভাবার চেষ্টা করল তার কোন কথাটা মিলেছে। বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল,
“আই নো উর্মিলার কথা দেরিতে হলেও সঠিক হয়। বাট কোন কথাটার কথা বলছিস বল তো?”

রাগিনী জোর গলায় কোহিনূরের নামটা। কিন্তু গলায় সমস্ত কথা দলা পাকিয়ে আসছে। ঢক গিলে অস্পষ্ট সুরে বলে ওঠে,
“কো…কোহিনূর! তুই ঠিকই বলেছিলি। উনার উদ্দেশ্য ভালো নয়।”

“কেন, কেন? কী করেছে তোর সাথে? তুই ঠিক আছিস তো?”

“আমার সাথে কিছুই করেন নি। কিন্তু আজকে উনার বেডের নিচে আমি রি’ভলবার পেয়েছি।”

বলেই ঠোঁট কামড়ে ধরল রাগিনী। দম বন্ধ লাগছে এবার। ওপরপাশ থেকে উর্মিলা আঁতকে উঠে বলল,
“কী বলছিস? ঘটনা সত্য? আমি তোকে বলেছিলাম ওর উপর নজর রাখতে। ওর উদ্দেশ্য ভালো নয়। এখন বোঝ। জাতে মাতাল, তালে একেবারে শয়’তান। ও যদি ভালো হয় ওর কাছে এতো বড় মা’রাত্মক অ’স্ত্র কী করে আসবে? নিজের আর ওই হসপিটালের ভালো চাইলে এখনি পুলিশের কাছে যা। সব জানিয়ে দে।”

রাগিনীর মাথায় পুলিশের কথা মাথায় আসেনি সেটা নয়। এসেছে কয়েকবার। তবে সাহস হয়নি। আবার সেই মানুষটার বিরুদ্ধে যেতে মস্তিষ্ক থেকে পা অবধি বারণ করছে। শক্তিতে কুলিয়ে উঠতে পারছে না যে। উর্মিলা রাগিনীর প্রতিত্তোর না পেয়ে আবারও শক্ত কন্ঠে বলল,
“শুনতে পাচ্ছিস কী বলছি? রক্ষা পেতে হলে দেরি করিস না। যত দেরি করবি তত রিস্ক বাড়বে। আর…”

রাগিনীর যেন আর শুনতে ইচ্ছে করল না উর্মিলার বলা কথাগুলো। আস্তে আস্তে ফোনটা কানের পাশ থেকে নামিয়ে নিয়ে কেটে দিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। কিছুক্ষণ আগেও সে কোহিনূর নামক ঘোরে মত্ত ছিল। সেই ঘোর কাটিয়ে ওঠা কি এতোই সোজা?

দরজায় কেউ নক করল আবার। পলক ফেলে দরজার দিকে চাইলো রাগিনী। আবার নিশ্চয় সৈয়দ কাকা এসেছে। মানুষটা ভীষণ চিন্তা করে তাকে নিয়ে। সে ঠিকমতো খেলো কিনা, কী খেলো সব দেখাশোনা করে। রাগিনী রিওকে নামিয়ে দিয়ে ধীর পায়ে দরজার দিকে পা বাড়াল। দরজার লক খুলতে খুলতে গলা খাদে নামিয়ে বলল,
“বললাম তো চাচা। আমার এখন খেতে ইচ্ছে করছে না। আমার দরকার পড়লে খেয়ে নেব।”

“আমার চাচা হওয়ার বয়স এখনো হয়নি। অথচ তুমি আমাকে বার বার চাচা বানিয়ে দাও। দ্যাটস নট ফেয়ার।”

চকিতে তাকায় রাগিনী অভিরূপকে দেখে। ছেলেটা ঠোঁট উল্টিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাগিনী নিচু সুরে বলল,
“আপনি? কোনো দরকার?”

“দরকারটা আমার না। তোমার দরকার।”

কিছুই বুঝে উঠতে না পেরে কপাল কুচকালো রাগিনী। অভিরূপের দিকে চেয়ে রইল শূন্য দৃষ্টিতে। অভিরূপ একগাল হেঁসে বলল,
“বলছিলাম খাবার না খেয়ে কি অনশন শুরু করেছো?”

এবার রাগিনী বুঝল আসল বিষয়টা। মিইয়ে যাওয়া গলায় উত্তরে বলল,
“অনশন শুরু করব কেন? সবার রুচি তো সবসময় এক থাকে না। আপনারা লাঞ্চ করে নিন। আমার খিদে পেলে আমিও করে নেব।”

“তুমি হয়ত অনশন শুরু করো নি। তোমার পেট নিশ্চয় অনশন শুরু করে দিয়েছে খোঁজ নিয়ে দেখো। নিশ্চয় এতক্ষণে বলতে শুরু করে দিয়েছে, ‘chahiye naan ya roti, chahiye raan ya boti, mangalo ram kasam, kasht ho jayee…’

শত বিরহের মাঝেও অভিরূপের সুর করে বলা গানটি কানে পৌঁছাতেই মলিন হাসলো রাগিনী। রাগিনীর হাসি দেখে অভিরূপও বিজয়ের হাসি দিল। যেন তার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। অতঃপর আবারও হাসি বজায় রেখেই অভিরূপ বলল,
“তাহলে এভাবে পেট যেন আর অনশন না করে তার সমাধান করতে খাওয়া দরকার কী বলো?”

“আপনি কী করে বুঝলেন যে আমার পেট অনশন করছে?”

“গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি। ডিল করবে? যদি পেট অনশন করে তাহলে তুমি আমায় ঘুরতে নিয়ে যাবে। আর যদি অনশন না করে তাহলে আমি তোমাকে ঘুরতে নিয়ে যাব! ডিল?”

রাগিনী আবারও নীরবতা অবলম্বন করল। গোল গোল চোখে চেয়ে রইল। তার ভাবমূর্তি কিছুই বুঝে উঠতে পারল না অভিরূপ। আবারও যদি মেয়েটার অগ্নিমূর্তি বেরিয়ে আসে আর এমন ইচ্ছের বিরুদ্ধে খেতে বলায় যদি ঠাস ঠাস করে কয়েকটা লাগিয়ে দেয় তবে? ভেবেই গা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল তার। পলাতক হওয়া বেটার মনে হচ্ছে। তাই সে পেছন ফিরে দীর্ঘশ্বাস দিয়ে হাঁটা ধরে বলে,
“ভাবলাম তোমায় নিয়ে গেলে আঙ্কেল খুশি হবেন। আঙ্কেল খুব আশায় আছেন তুমি গিয়ে উনার সঙ্গে বসে খাবে। আশাটা বোধহয় পূর্ণ হলো না।”

রাগিনীর টনক নড়ে এবার। ফট করে জিজ্ঞেস করে,
“বাবা এসেছে?”

“হ্যাঁ শুনলাম ছুটি নিয়ে এসেছে। স্পেশালি আমাদের সাথে লাঞ্চ করার জন্য।”

রাগিনী এবার কিছু না বলেই তড়িঘড়ি পায়ে অভিরূপের পাশ কাটিয়ে ঝড়ের বেগে চলে গেল। অভিরূপ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ঠাঁই। তারপর নিজে নিজে বলল,
“যাহ্ বাবা। আঙ্কেলের কথা শুনে মেয়েটা সাইক্লোনের গতিতে নামবে জানলে এতো বকবক না করে আঙ্কেলের কথায় আগে বলতাম।”

খাবার টেবিলে খেতে বসেছে সকলে। সৈয়দ আর সাহানা দুজন খাবার পরিবেশন করছেন খুশিমনে। রাগিনী মুখ নিচু করে খেয়ে যাচ্ছে। মুখে বিষণ্নতা। সারা মুখমন্ডল জুড়ে এক ফ্যাকাশে ধূসর বর্ণের আনাগোনা। সেটা চোখ এড়ালো না রাশেদ সাহেবের। তবে উনি প্রথমেই কিছু বললেন না। আগে অভিরূপ আর নোমানকে জিজ্ঞেস করলেন,
“তা বাবা! তোমাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো? আনকমফোর্টেবল ফিল করছো না তো?”

“না আঙ্কেল একদমই না। নিজের বাড়ির চেয়ে কম কিছু মনে হচ্ছে না। আগে জানলে তো প্রথমেই এখানে এসে উঠতাম। আপনি না চাইলেও জোর করে এখানে থাকতাম।”

অভিরূপের কথায় খেতে খেতে নিঃশব্দে হাসেন রাশেদ সাহেব। অভিরূপ আঁড়চোখে রাগিনীর দিকে তাকায়। তৎক্ষনাৎ নোমান নিজের হাতের কনুই দিয়ে গুঁতো দেয় অভিরূপকে। অভিরূপ ক্ষিপ্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নোমানের পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে বলে,
“শরীরে ধার বেশি হয়েছে নাকি তোর? ষাঁড়ের মতো গুঁতোচ্ছিস কেন?”

“চোখটা খুলে পড়ে যাওয়ার আগে বাঁচিয়ে নিলাম। থ্যাংকস দে। পায়ের উপর থেকে পা সরা। নয়ত আমারও পা আছে।”

অভিরূপ ঢক গিলে পা সরিয়ে খেতে ব্যস্ত হলো। রাশেদ সাহেব এবার রাগিনীকে বললেন,
“রাগিনী, তোমার শরীর কি খারাপ এখনো?”

উটকো ভাবনায় বিভোর রাগিনী চমকে নড়েচড়ে তাকাল। মেয়েটাকে আনমনা দেখে কিছুটা চিন্তিত হলেন রাশেদ সাহেব। রাগিনী কোনোরকমে উত্তর দিল,
“না বাবা। আমি ঠিক আছি।”

রাগিনী তার বাবাকে জানাতে চাইছে কথাগুলো। পারছে না। সম্ভব নয়। মানুষটার বুকে ব্যথা উঠেছিল গতকাল রাতে। ডক্টর বলেছে বেশি টেনশন উনাকে না দিতে। তাই এই কথা বলে টেনশন বাড়ানোর কথা ভাবতে পারে না রাগিনী। রাশেদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
“তাহলে খেতে আসছিলে না যে? সৈয়দ বলল আমাকে। কী হয়েছে?”

“বাবা একটু দুর্বল লাগছে। বেশি কিছু না।”

রাশেদ সাহেব এবার বড় শ্বাস ফেলে গাম্ভীর্যের সাথে বললেন,
“একটা কথা বলার ছিল তোমায়। তোমাকে বাড়ি থেকে বেশি বের হতে হবে না। চেষ্টা করো বাড়িতে থাকার। বাহিরে এখন অনেক কান্ড ঘটছে।”

রাগিনী মাথা উঁচিয়ে তাকাল বাবার দিকে। রাশেদ সাহেবও রাগিনীর মনের কথা বোঝার চেষ্টা করছেন। উনি মেয়ের নিরাপত্তা নিয়েই আগে ভাবছেন। যেহেতু এতো বড় ক্রা’ইমের একটা তীর রাগিনী নিজে তাই নিজের মেয়েকে নিয়ে বিপদ বাড়াতে চান না উনি। এরপর আবারও তিনি বলেন,
“আর কোহিনূরকে নিয়ে চিন্তা করলে বলে দিই, প্রতিদিন তার কাছে খাবার পৌঁছে যাবে। চিন্তা করো না। ব্যাস… আমি এটাই চাই তুমি একা একা বাড়ি থেকে বের হবে না।”

রাগিনী মাথা নাড়াতেই অভিরূপ হতাশ হয়ে বলল,
“তাহলে অনশনের হারজিতের পর ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার প্ল্যানিং ক্যান্সেল!”

“কীসের প্ল্যানিং?”

উৎসুক হয়ে জানতে চাইলেন রাশেদ সাহেব। অভিরূপ বলল,
“রাগিনী আর আমার মধ্যে একটা ডিল হয়েছিল। যে হারবে সে ঘুরতে নিয়ে যাবে। সেটার কথাই বলছিলাম।”

রাশেদ সাহেব চুপ করে রইলেন এবার। খেতে খেতে মেয়ের দিকে তাকালেন। মেয়েটার মনমরা চাহনি ভালো লাগছে না। ঘুরতে গেলে ঠিক হতে পারে। আর অভিরূপ তো আছে। তাই সাহস নিয়ে নিজের সিদ্ধান্ত পাল্টে বললেন,
“সবাই মিলে গেলে কোনো সমস্যা নেই। তুমি, নোমান আর রাগিনী যেতেই পারো। আর রাগিনীর ইচ্ছে হলে কোনো ফ্রেন্ড ডেকে নিতে পারো।”

অভিরূপের হাসি গাঢ় হলো। রাগিনীর দিকে চেয়ে উৎসাহ নিয়ে বলল,
“তাহলে হারল কে রাগিনী?”

রাগিনীর যেতে ইচ্ছে করল না বাহিরে। তবুও কথাগুলো ফেলতে পারল না। জোরপূর্বক হেঁসে বলল,
“আমি হার স্বীকার করছি। আমি আপনাদের ঘুরতে নিয়ে যাব। আপনারা তো শহর চিনেন না। তাই দায়িত্বটা আমি নিলাম।”

ফোনের রিংটোনটা এবার পৃথিবীর সবচেয়ে বিরক্তকর শব্দে পরিণত হলো ঘুমন্ত রূপাঞ্জনার কাছে। চেহারা জড়িয়ে গেল বিরক্তিতে। জোর করে আঁখি দুটো খোলার চেষ্টা করল। একহাত বাড়িয়ে চারিপাশে ফোনটা খুঁজতে চাইল। কোহিনূরের কবল থেকে পালিয়ে কোনোরকমে ক্লান্ত ভঙ্গিতে গা ঢাকা দিয়েছিল সে। ফোনটা হাতে পেয়ে চোখ বুঁজেই রিসিভ করে কানে ধরে বলল,
“হ্যালো।”

“অনেক তো ঘুমিয়ে নিলি। এবার জাগার সময় হয়েছে। আসল কাজের সময় হয়েছে।”

শান্ত সুরের মাঝে হিংস্রতা অনুভব করে চোখটা থেকে ঘুম উড়ে গেল এবার রূপার। ভালোমতো জাগতেই মনে হলো আজকের মিশনে আনসাকসেসফুল হয়েছে সে। কোহিনূরকে মা’রতে পারেনি। তার এই অসফলতার কারণে নিশ্চয় রেগে আছে ডার্ক ম্যাক্স। অস্ফুটস্বরে সে বলল,
“আই এম সরি ডার্ক ম্যাক্স!”

“তোর সরি শুনতে শুনতে কান পঁচানোর ইচ্ছে আমার নেই। আমার ক্রোধের স্বীকার হতে না চাইলে দ্রুত তৈরি কর নিজেকে। পরের মিশন আজকেই শুরু হবে। আর ভুলিস না! প্রথম মিশন কমপ্লিট করতে পারিসনি। তাই এই মিশনটাও কমপ্লিট না হলে ফল খুব একটা ভালো হবে না।”

রূপাঞ্জনা উঠে বসে এবার। শুঁকনো গলায় জানতে চায়,
“পরের মিশন অবশ্যই কমপ্লিট হবে ডার্ক ম্যাক্স। কী পরের মিশন?”

“অভিরূপকে শে’ষ করে পুরো দেশে আ’তংক সৃষ্টি করা। আজ বিকেলে রাগিনীর সঙ্গে বের হবে অভিরূপ। কিন্তু আসল রাগিনী নয় রাগিনী রূপি রূপাঞ্জনার সাথে যেন ফেমাস সিঙ্গার অভিরূপের শেষ যাত্রা হয়।”

ভেতরটা নড়ে ওঠে রূপার। সময়টা বুঝি এসেই গেল এবার। এখন তার রক্ষককেই উপড়ে ফেলতে হবে বুঝি। রূপা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“আপনি কী করে জানলেন ডার্ক ম্যাক্স? যে আজ ওরা বের হবে?”

ডার্ক হেঁসে জবাব দেয়,
“ডার্ককে বোকা মনে করিস তুই? ডার্ক সব জানে। নিজেকে তৈরি কর রাগিনী রূপে। ‘দ্যা ফেমাস সিঙ্গার অভিরূপ চৌধুরী বাংলাদেশে ঘুরতে এসে অকালেই টেরো’রিস্টের হা’মলার শিকার হয়ে মৃ’ত্যু হয়ে গেল’। হেডলাইনটা অনেক সুন্দর হবে তাই না?”

রূপাঞ্জনা কিছু বলে না। সে দরদর করে ঘামছে। ওপাশ থেকে ফোনটা কেটে যায়। রূপার নিশ্বাস ওঠানামা করে। নিজের অস্থিরতা যেন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সর্বাঙ্গ। আগে তো এতোটা উতলা হয়নি মন। তবে কি প্রথমবার তার হাত কাঁপবে কাউকে মা’রতে?

চলবে…

[বি.দ্র. রাইটিং ব্লকে পড়ে গিয়ে বাজে অবস্থা হয়েছে আমার। মনে শব্দ আসে না। লিখতে পারি না। বুঝিনি রানিং গল্প অবস্থায় এই কান্ড ঘটবে। খাপছাড়া লাগছে সবটা নিজের কাছেই। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here