ডাক্তার বলে গেছিলো দুই ঘন্টা পরেই ঙ্গান ফিরবে। কিন্তু চার ঘন্টা পার হয়ে যাওয়ার পরও ঙ্গান ফিরে না। সায়ানের ভীষণ টেনশন হচ্ছে।
তুলতুলের হাত পা মালিশ করে দিচ্ছে। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। মনে হচ্ছে দমকটা বেরিয়ে যাবে।
“এই তুলতুল কথা বল না প্লিজ
সায়ান তুলতুলের হাত ধরে বিচলিত কন্ঠে বলে।
তুলতুল চোখ পিটপিট করে। সায়ানের মুখে হাসি ফুটে ওঠে।
সোজা হয়ে বসে সায়ান। তুলতুলের হাত ছেড়ে দেয়।
তুলতুল চোখ পিটপিট করে তাকায়। মাথার ওপরে থাকা সাদা দেয়ালের দিকে নজর যায় তুলতুলের। ঘাড় ঘুরাতে গিয়ে পারে না তুলতুল। ব্যাথায় টনটন করছে মাথা।
চোখ বন্ধ করে মাথায় হাত দেয় তুলতুল। মাথায় ধরে ডান বায়ে তাকায়।
ডান পাশে সায়ানকে শুয়ে থাকতে দেখে বুকটা কেঁপে ওঠে তুলতুলের। মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে আছে। চোখ দুটো বন্ধ করে আছে। দুই হাত বুকে গুঁজে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। সিল্কি চুলের সামনের কিছু অংশ কপালে এসে পড়েছে। নাক ফুলিয়ে শ্বাস টানছে।
কতোটা মায়া জমে আছে এই মুখটাতে। শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। আচ্ছা এই মুখটা না দেখে তুলতুল সারাজীবন থাকবে কি করে?
তুলতুল কাঁপা কাঁপা হাতে সায়ানের গালে হাত দেয়। চোখ দুটো টলমল করছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পারছে না।
কান্না চেপে রাখা খুব কষ্ট।
হঠাৎ করে সায়ান নরে চরে ওঠে। তুলতুল তারাহুরো করে নিজের হাত গুটিয়ে নিতে গিয়ে মাথায় ব্যাথা পায়। তবুও কোনো রকমে শব্দ করে না। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যাথা সয্য করে।
সায়ান তুলতুলের দিকে ঘুরে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে তুলতুলকে। পেটের ওপর এক হাত দিয়ে অন্য হাত বাম হাতের আগুলের ভাজে রাখে। মুখটা তুলতুলের ঘাড়ে রাখে।
শিওরে ওঠে তুলতুল। হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। শ্বাস নিতে ভুলে গেছে। সায়ানের ভাড়ি নিশ্বাস তুলতুলের ঘাড়ে পড়তেই চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নেয় তুলতুল।
“ছাছাছাড়ুন
তুলতুল কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে। এতে সায়ানের কোনো হেলদোল নেই। সে নিশ্চিন্তে ঘুমচ্ছে।
তুলতুলকে হাসফাস করতে দেখে মুচকি হাসে সায়ান। মুখটা আরও একটু এগিয়ে এনে তুলতুলে ঘাড়ে ঠোঁট ছোঁয়ায়।
তুলতুল সায়ানের হাতটা আঁকড়ে ধরে।
এভাবে হাসফাস করতে করতে একটা সময় ঘুমিয়ে পড়ে।
নতুন ভোর নতুন কিছুর সূচনা ঘটায়।
পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভেঙে যায় তুলতুলের। কারো বুকের উষ্ণতায় তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ঘুমিয়েছিলো।
চোখ মেলে তুলতুল। সায়ানের ঘুমন্ত মুখের দিকে মাথা উঁচু করে এক পলক তাকায়।
” আজকে থেকে আমি সেটাই করবো যেটা আপনি চান। আমি বাঁধা হবো না। মুক্তি দিয়ে দেবো আপনাকে।
তাচ্ছিল্য হাসে তুলতুল। সায়ানের হাত ছাড়িয়ে উঠে বসে আড়মোড়া ভাঙে।
এখনো গায়ে সায়ানের সেই শার্ট টা।
বিছানা থেকে নামতেই নিজের লাগেজটা দেখতে পায়।
লাগেজ খুলে নীল শাড়ি বের করে।আজকে শাড়ি পড়বে। খুব ইচ্ছে ছিলো বিয়ের পর প্রতিদিন শাড়ি পড়ার। কিন্তু সময় আর পরিস্থিতির জন্য পড়া হয় নি। কিন্তু এখন তুলতুল এসব ভাবতে চায় না। সময় খারাপ যাবেই। এটাই সময়ের নিয়ম। আমাদেরকেই সময়টাকে ভালো করতে হবে, নিজেদের মনের শক্তি দিয়ে।
বাবাকে কল করে তুলতুল৷ ডিভোর্স পেপার বানাতে বলে। তৌফিক রহমান পাল্টা কোনো প্রশ্ন করে না। কারণ তিনি জানে তার মেয়ে সায়ানের সাথে ভালো নেই।
ইউটিউব দেখে ভালোই শাড়ি পড়া শিখে নিয়েছে তুলতুল। এখন আর শাড়ি পড়তে অসুবিধা হওয়ার কথা না।
মাথার ব্যান্ডেজ খুলে ফেলে দেয়। এই টুকু ঘায়ের জন্য এতো বড় ব্যান্ডেজের দরকার নেই।
ব্যান্ডেজ খোলার পরই একটু খানি রক্ত বের হয়। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে ফেলে তুলতুল।
তারপর শাড়ি পড়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়।
একটু খানি সেজে নেয়।
সায়ান এখনো ঘুমচ্ছে।
আড়চোখে সায়ানের দিকে এক পলক তাকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায় তুলতুল।
তুলতুল চলে যাওয়ার দশ মিনিট পরে সায়ানের ঘুম হালকা হয়ে যায়। বুকটা শূন্য শূন্য লাগাতে ধপ করে চোখ খুলে। আশেপাশে তুলতুলকে দেখতে না পেয়ে ভয় পেয়ে যায় সায়ান।
তুলতুল কি চলে গেলো?
বুকটা কেঁপে ওঠে। তারাহুরো করে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়।
তুলতুল হাঁটতে হাঁটতে অনেক দুরে চলে এসেছে। কোন দিক দিয়ে এসেছে সেটাই ভুলে গেছে তুলতুল। তবুও সেদিকে খেয়াল নেই। এক মনে হেঁটেই চলেছে।
“তুলতুল
খুব পরিচিত একজনের গলার শব্দ শুনে থেমে যায় তুলতুল। মুচকি হাসে। ইফাদ গাড়ি থেকে নেমে তুলতুলের সামনে এসে দাঁড়ায়।
” তুমি এখানে?
অবাক হয়ে বলে ইফাদ।
“হাসবেন্ডের সাথে হানিমুনে এসেছি।আপনি এখানে?
তুলতুল মুচকি হেসে বলে।
” তুমি বিয়ে করেছো?
অবাক হয়ে বলে ইফাদ।
“কেনো করতে পারি না?
বুকে হাত গুঁজে পাল্টা প্রশ্ন করে তুলতুল।
” সেরকম টা না
আসলে বেপারটা হলো
ইফাদ আমতাআমতা করে বলতে যায়।
“ভেবেছিলেন কেউ বিয়ে করবে না। বাবার ঘাড়ের বোঝা হয়ে থাকবো। তারপর কয়েকদিন পরে আপনি আমার সাথে যোগাযোগ করবেন। আমি আপনাকে বিয়ে করার জন্য আপনার পায়ে ধরবো। তাই তো মিস্টার?
ইফাদ ঘাবড়ে যায়। মাথা নিচু করে ফেলে।
” আমি তাহমিনা তুলতুল। এটিটিউট আগেও ছিলো আর বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পরেও ছিলো।
“আই এম সরি
মাথা নিচু করে বলে ইফাদ।
” থ্যাংক্স
আমার জীবন থেকে সরে যাওয়ার জন্য।
আসছি এখন
তুলতুল এক গাল হেসে বলে।
ইফাদ তুলতুলের হাসি দেখছে। কখনো এই মেয়ের মুখের হাসি দেখার সৌভাগ্য হয় নি ইফাদের।
চার বছরে এই প্রথম দেখলো।
তুলতুল দু পা এগোতেই হাঁপাতে হাঁপাতে তুহিন এসে দাঁড়ায় তুলতুলের সামনে।
ইফাদ ধরে নেয় এটাই তুলতুলের বর।
তুহিনকে দেখে তুলতুল মুচকি হাসে।
“তোমাকে দেখলাম সকাল সকাল বের হতে তাই পিছু নিলাম। আবার হারিয়ে না যাও।
তুহিন মাথা চুলকে বলে।
” হারিয়ে যাওয়ার ভয় নেই।
তুলতুল হাঁটতে হাঁটতে বলে।
“একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
তুলতুল বলে।
“হুমম বলো না?
” পাখি আপুর সাথে ভাইয়ার কি সম্পর্ক?
তুহিন তুলতুলের দিকে এক পলক তাকায়।
“যত দুর শুনেছি ওনারা রিলেশনশিপ এ আছে। চাকরিটা চলে যাচ্ছিলো ওনার পাখির সাহায্যে পেয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি ছিলো সায়ান অনেক দিন। পাখি নিজের শরীর থেকে দুই ব্যাগ রক্ত দিয়ে সুস্থ করেছে সায়ানকে।
জানি না কি হয়েছিলো।
এখনো তিন মাস পর পর পাখি সায়ানকে রক্ত দেয়।
তুমি জানো না?
অবশ্য নাও জানতে পারো। সায়ান তো কখনোই মুখ ফুটে কিছু বলে না।
তুলতুলের গাল বেয়ে টুপটাপ কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে।
তুলতুল সায়ানকে ভেঙে দিয়েছিলো আর পাখি সায়ানের গড়েছে।
তুলতুলের কোনো অধিকার নেই সায়ানের সাথে থাকার।
” চলো এবার ফিরে যাই?
তুলতুল মুচকি হেসে তুহিনের কথায় সায় দেয়।
হোটেলের কাছাকাছি আসতেই দেখতে পায় সায়ান পাখির হাত দুটো শক্ত করে ধরে কিছু বলছে। পাখি সায়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে।
তুলতুল চোখ ফিরিয়ে নেয়।
বড়বড় পা ফেলে এগোতে থাকে। উদ্দেশ্য সায়ানের এখান থেকে তারাতাড়ি চলে যাওয়া।
“কোথায় গেছিলি?
সায়ানের চিৎকার করে বলা কথাটা শুনে দাঁড়িয়ে যায় তুলতুল। পেছন ফিরে সায়ানের দিকে তাকায় না। তাকানোর সাহস নেই ওর। চোখ দুটো বন্ধ করে নেয়।
সায়ান ঝড়ের বেগে এসে তুলতুলকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। এটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না তুলতুল।
তুলতুলের মাথাটা সায়ানের বুকে। তুলতুল স্পষ্ট ফিল করতে পারছে সায়ানের বুকের ভেতর ধকধক করছে৷ কাঁপছে সায়ান।
কিন্তু কেনো? তুলতুলকে হারানোর ভয়ে?
“কোথায় গেছিলি তুই? কতোটা ভয় পেয়েছিলাম জানিস? কেনো এমন করিস? আমাকে কি তোর মানুষ মনে হয় না?
তুলতুল ঘাড়ে ভেজা অনুভব করে৷ তাহলে কি সায়ান কাঁদছে? কিন্তু কেনো?
চলবে