# শুভ্রতায় নবনীতা
#কলমে_নবনীতা_নীরু
পর্ব ঃ ১
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে নামাজ শেষ করেই,ঘর ঝাড়ু,আর থালাবাসন মেজে রান্নাঘরে চলে গেলাম।তাড়াতাড়ি রান্না করতে হবে।নইলে আবার সৎমায়ের ঝাটার বারি পিঠে সইতে হবে।এক মুহূর্ত দেরি না করে চুলায় রান্না চাপিয়ে দিলাম।
আমি নবনীতা, ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে অনার্সে ভর্তি হয়েছি।তবে প্রতিদিন ক্লাস করা হয় না।
বাড়িতে টিউশনি আর কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষকতা করে মাসে ভাল কিছু টাকা আসে আমার হাতে।কিন্তু আমার হাতে আসলেও সে টাকা আর ছোটমায়ের হাতেই তুলে দিতে হয়।
বলতে গেলে সংসার টা আমার টিউশনি আর চাকরির টাকাতেই চলে।তাদের কত রঙিন রঙিন পোশাক,আধুনিকত্ব।
এতকিছু করেও ছোট মায়ের ভালোবাসা আমার ভাগ্যে নেই।
রান্না করছি এমন সময় ছোটমায়ের গলা শুনে বাহিরে আসতেই বলল,চোখের মাথা কি খেয়েছিস নাকি?বালতিতে যা পানি নেই সেটা কি চোখে দেখিস না নাকি?
-আমি এখনই পানি তুলে দিচ্ছি….
– আমাকে উদ্ধার করুন মহারানী।
তাড়াতাড়ি করে পানি তুলে দিয়ে,চা বসিয়ে দিলাম।কারণ চা দিতে দেরি হলে আমার আজকে সকালে ভাত জুটবে না কপালে।
সব কাজ শেষ করে,স্কুলে চলে গেলাম।ক্লাশ দশটায় শুরু,কিন্তু আমার আটটা থেকে দুইটা ব্যাচ আছে টিউশনির।
স্কুল যেহেতু বেশি দূর না,তাই হেটেই যাচ্ছিলাম।রাস্তায় নবির ভাইয়ের সাথে দেখা।উনি বললেন উনার কোচিং সেন্টারে নাকি টিচার লাগবে,মাসে ভালো টাকা পাওয়া যাবে।আমি ওখানে ঢুকতে পারব কি না জানতে চাইলো।আমিও বলে দিলাম,পরে জানিয়ে দিব।
কিছুক্ষণের মধ্যে স্কুলে চলে এলাম।হেডস্যার জানালেন আজকে নার্সারিতে একটা নতুন মেয়ে ভর্তি হবে,আমি যেন তার খেয়াল রাখি।আমি নার্সারিতে ক্লাস টিচার পদে আছি।আমি টিউশনি শুরু করলাম।
দশটার দিকে ক্লাস শুরু হলে, আমি ক্লাসে চলে গেলাম।ক্লাস নিচ্ছিলাম এমন সময় হেডস্যার ক্লাসে এলেন।
সবার সাথে নতুন বাচ্চা মেয়েটার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন।
মেয়েটির নাম নীরু।অসম্ভব সুন্দর দেখতে,মায়াবী একটা মুখ।তাকালে মায়ায় পড়ে যাওয়ার মত।মেয়েটাকে স্কুলে নিয়ে এসেছে তার দাদু।স্কুলে ভর্তির দিনে বাচ্চার মা বাবা আসে,দাদুকে দেখে একটু অবাক হলাম।
যাই হোক ক্লাস শেষ করে বেড়িয়ে আসব,এমন সময় নতুন বাচ্চা মেয়েটা পিছন থেকে ডাক দিলো।
– কিছু বলবে তুমি?
– জী ম্যাম।
– হ্যা বলো…
– আপনি আমার মম এর মত দেখতে।
– তাই নাকি! তা তোমার মম আজকে আসলো না তোমাকে রাখতে?
– আমার মম তো নেই ম্যাম,মম তো আকাশের তারা হয়ে গেছে।ওখান থেকে আমাকে দেখে।
এবার যেন মেয়েটাকে দেখে আরও মায়া লাগলো।এতটুকু বাচ্চা মেয়ের মা নেই!
-ম্যাম…..
-হ্যা বলো।
– আমি আপনাকে ম্যাম বলে ডাকব না।
-কি বলে ডাকবে তাহলে?
– আমি আপনাকে মানি বলে ডাকব।
মেয়েটার কথা শুনে ভাল লাগলো।আমি মুচকি হেসে বললাম তোমার যা ইচ্ছে হয় তাই বলে ডেকো।
সারাদিন অন্য ক্লাসে ক্লাস নেওয়ার সময় মেয়েটা আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছে।স্কুল ছুটি হলে আমিও বের হই বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাহিরে এসে দেখি মেয়েটাকে কেউ একজন গাড়িতে উঠিয়ে দিল,হয়তো নীরুর বাবা।মেয়েটা আসলেই খুব সুন্দর।
আমিও আর না দাড়িয়ে বাড়ির দিকে হাটতে শুরু করলাম।
রাতে বসে বসে পড়ছিলাম,যেহেতু ক্লাস করা হয় না তাই বাড়িতেই একটু পড়তে হয়।এমন সময় হেড স্যারের কল,এতরাতে স্যার কেন কল দিবে….
ঃ আসসালামু আলাইকুম স্যার।
ঃ ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কি করছো নবনীতা?
ঃ স্যার তেমন কিছু না,বসে পড়ছিলাম।
ঃ আচ্ছা,আজকে যে নতুন বাচ্চা ভর্তি হলো, সেই বাচ্চা নাকি তোমার সাথে কথা না বললে রাতে খাবে না ঘুমাবে না,খুব বায়না করছে।তুমি কি একটু কথা বলে দেখবে?
ঃ স্যার এতরাতে!
ঃ একটু কথা বলো,বাচ্চাটা আমাদের জন্য খুব স্পেশাল।
ঃ ঠিক আছে স্যার।
ঃ তাহলে আমি তোমার নম্বর ওদের দিয়ে দেই?
ঃ জী স্যার।
কিছুক্ষণ পর আমার ফোনে কল এলো।রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বাচ্চা কন্ঠ ভেসে এলো,
ঃ কি করছো মানি?
ঃ এইতো পড়ছিলাম।তোমার পড়া কমপ্লিট হয়েছে তো নীরু?
ঃ হ্যা মানি আমার সব হোমওয়ার্ক, পড়া শেষ। তুই এখনও পড়া শেষ করো নি কেন?তুমি কিন্তু পচা হয়ে যাচ্ছো।
ঃ আচ্ছা করে বকে দাও তো,যেন তোমার মানি ঠিক মতো পড়তে বসে।
ঃ হিহিহি
এভাবে কিছুক্ষণ কথা বলে নীরু নিজেই ফোন রেখে দিলো।মেয়েটা সত্যিই খুব ভালো,একদম মায়ায় মিশে থাকার মত।পরের দিন সকাল সকাল আবার উঠতে হবে ভেবে ঘুমাতে গেলাম।
সকালে উঠে কাজ শেষ করে,আবার স্কুলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।
কিছুদিন যেতেই নীরু আর আমার মাঝে ভালো একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছে।অন্য বাচ্চাদের সাথেও আমার ভালো সম্পর্ক কিন্তু নীরু সত্যিই স্পেশাল আমার কাছে।মেয়েটা আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে।
আজকে স্কুলে যেতে একটু খারাপ লাগছিলো কারণ আমার আরও একটা ভাল স্কুল থেকে জবের অফার এসেছে। আর আমি আর আমার পরিবার যেহেতু গরিব,নুন আনতে পান্তা ফুরায় তাই আমার নিজের পরিবারের ভালো দেখতে হয়।
হেড স্যারকে আমি আগেই জানিয়েছি,স্যার খুব ভাল মানুষ, তিনি নিজেও চান আমি ভাল কিছু করি,অন্য স্কুলে চলে যাব বলে তিনি হিংসাত্মক মনোভাব পোষণ করেন নি।
আমি স্কুলে গিয়ে স্যারকে রিজাইন লেটার দিলাম।আজকে ক্লাস নেওয়াই আমার শেষ।
হেড স্যার বললেন,বাচ্চারা তোমায় অতিরিক্ত ভালোবাসে,তুমি চলে যাবে এই কথাটা যেন কোন বাচ্চা না জানে।জানলে কি হবে আমি নিজেও জানি না।অন্য টিচারদের তারা এত ভালবাসে না।তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো।
আমি মাথা ঝাকিয়ে হ্যা বলে ক্লাসে চলে গেলাম।কিন্তু ক্লাসে সব বাচ্চা আসলেও নীরু আসে নি।আজকে আবার মেয়েটা আসে নি কেন! ও তো নিয়মিত স্কুলে আসে।
ক্লাস নিচ্ছি আর বারবার বাহিরে তাকাচ্ছি,নাহ মেয়েটা বোধ হয় আর আজকে আসবে না।তাহলে কি স্কুলে আমার শেষ দিনে তার সাথে আমার কোন কথা হবে না!
অতঃ পর স্কুলের সময় শেষ, বিদায়ের ঘন্টা বেজে উঠলো।স্কুলটাকে খুব মিস করব,খুব ভালোবেসে ফেলেছি স্কুলটাকে।
বাড়ি ফিরছি হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো,বাড়ি প্রায় চলে এসেছি তাই আর কোথাও না দাঁড়িয়ে সোজা বাড়ির থেকে ভোঁ দৌড় দেই।এক দৌড়ে বাড়ি পেয়ে যাই।তাড়াতাড়ি করে মাথা মুছে নি,ব্যাগ থেকে ফোন বের করতেই দেখি ফোন বন্ধ হয়ে গেছে।চার্জ দিলাম তবুও ফোন অন হয় না,রাগ করে রেখে দিলাম।
ছোটমা বাহিরে থেকে ডেকে বলে কাপড় ভিজিয়ে রেখেছে,ধুয়ে দিতে হবে।আমিও ভাবলাম তাহলে একেবারে কাপড় ধুয়ে গোসল দিয়ে উঠি।
গোসল করে এসে খেতে গিয়ে দেখি কোন খাবার আমার জন্য রাখা নেই।তুশিকে ডাক দিয়ে বললাম একটু মুড়ি এনে দিতে ও এনে দিলে আমি রুমে চলে আসি।
কিছুক্ষণ পর অনুভব করলাম মাথা ভারি হয়ে আসছে আর গা প্রচন্ড গরম হয়ে গেছে।তার মানে কি বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর চলে এসেছে!
এই জ্বর আমাকে একটানা দশদিন ভুগিয়েছে।এই জ্বর নিয়ে আমি স্কুলে যেতে পারি নি,তবুও বাড়ির এত এত কাজ থেকে আমার রেহাই মিলে নি।আমার এত খারাপ দিনে আমি কারও সঙ্গ পাই না,বাবা ও আজকাল তেমন কথা বলে না।।
চলবে……
আপনাদের মতামত জানাবেন,আশা করছি ভাল লাগবে।