শুভ্রতায় নবনীতা – পর্ব ২০

0
342

#শুভ্রতায়_নবনীতা
#নবনীতা_নীরু
#পর্ব ঃ ২০

— পরিস্কার করে বুঝিয়ে বলো আমাকে।
— এখানে তোর আর তুশির দুজনেরই বিয়ে হবে।
— আমার?!
— হ্যাঁ, নিহান বাবার সাথে তোর বিয়ে হবে আর সেটা আজকেই।
— আমার ওপর কি সবকিছু চাপিয়ে দিতে ভালো লাগে তোমাদের?
— যা করছি তোর ভালোর জন্যই করছি মা।
— আমি এই বিয়ে করতে পারব না বাবা।তিশুর বিয়েতে অন্তত ঝামেলা বাধিয়ো না প্লিজ।

— আমার কথাটা এবার মেনে নে মা,অনেক তো আমাদের জন্য করেছিস এবারই শেষ।
— বাবা আমাকে মে/রে ফেলো তার থেকে।তোমরা যদি বলো আমি সুই/সাইড করে নিচ্ছি তবুও আমি এই বিয়ে করতে পারব না।তাছাড়া উনি আমার স্যার হন,আমি কেন উনাকে বিয়ে করব!আমি নীরুকে ভীষণ ভালোবাসি এটা ঠিক।
— নীরুই চাইছে তোকে মা বানিয়ে নিতে,তাও কি চাস না?
— না বাবা,নীরুকে আমি এমনিই ভালোবাসবো,সে যেখানেই থাকি না কেন।
তবে আমি বিয়েটা করতে চাইছি না।
— তুই নাকি নীরুকে ভালোবাসিস,এটা কেমন ভালোবাসা?ওর কি একটা মা প্রয়োজন হয় না?
এর মধ্যে মা এসে আমাকে ডেকে নিয়ে এলো দূরে।
— কিছু বলবে মা?
— তুই বিয়েটা করে নে মা,নিহান বাবা তোকে সত্যিই খুব পছন্দ করে।তুই এক্সিডেন্ট হলে দেখেছি নিহানের সে কি কান্না!
— মা সবসময় সবকিছু সমান থাকে না।বাদ দাও না এসব।আর শুধু আমি রাজি থাকলেই হবে নাকি উনার ও তো রাজি থাকতে হবে তাই না?
— আমি কথা বলি নিহানের সাথে?
— না না তোমার কথা বলতে হবে না।তুশির বিয়েটা হয়ে যেতে দাও এসব নিয়ে পরে ভেবে দেখা যাবে। এখন চলো।

মাকে টেনে নিয়ে বিয়ের ওখানে চলে গেলাম।
আবিরের একটা জিনিস দেখে আমার খুব ভালো লাগলো।
সে একটাবারের জন্য ও আমার দিকে তাকায় নি।মুখ ফুলিয়েও নেই সে।
উনার ওপর আমার বিশ্বাস আছে ঠিক তিশুকে ভালোবাসতে পারবেন।আর তিশু এত ভাল একটা মেয়ে,আবিরকে খুব ভালোবাসে।

আমার মনে হয় আবির খুব তাড়াতাড়ি তিশুকে ভালোবেসে ফেলবে,ওকে ভালো না বেসে থাকতেই পারবে না।আমার প্রতি উনার শুধু ভালো লাগা ছিল,ভালোবাসাটা তিশুই জিতে নিবে।

কাজী সাহেব আবির আর তিশুর বিয়ের কাজ শুরু করলেন।
কবুল বলার মাধ্যমে দুজনের বিয়ে সম্পন্ন হলো।
এবার তিশুকে ওর শ্বশুড়বাড়ি নিয়ে যাওয়ার পালা।এসময় খুব খারাপ লাগছিল আমার।
মার দিকে তাকিয়ে দেখি কান্না করছে।আমি মার দিকে এগিয়ে গেলাম।
আমাকে ধরে জোরে কান্না শুরু করে দিল মা।সেটা দেখে তুশিও আমাদের জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিল।ওকে কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না।
আবির নিজেই তুশিকে বুঝিয়ে কান্না থামালো।
আমি আবিরকে দেখে ভাবছি আমার তিশু কতটা ভাগ্যবতী। অথচ নিহান স্যার!
আমি যাকে ভালোবাসি উনি আমাকে লজ্জা দিয়ে কটু কথা বলতে ছাড়েন না।মানুষের মধ্যে কত পার্থক্য!!
কিছুক্ষণের মধ্যেই তুশিরা রওয়ানা দিলো বাড়ির উদ্দেশ্যে।
জানি না বাড়ির সবাই মেনে নিবে কি না।আল্লাহ আল্লাহ করে যেন সব ঠিক থাকে।

আত্মীয়রাও তুশির যাওয়ার পর একে একে চলে যাওয়া শুরু করলো।কারণ পরবর্তীতে আর কোন অনুষ্ঠান হবে না।
এর মধ্যে আমার বাড়ি থেকে আবার আমার কথা শুরু হলো।
আমি আমার রুমে গিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম।
মনে মনে স্থীর করলাম আমি কিছুতেই বিয়ে করব না এই লোকটাকে কিন্তু আমি একা বললে কিছুতেই আটকাতে পারব না।নিহান স্যারের সাথে কথা বলতে হবে।

কিছুক্ষণ পর মা এলো আমার রুমে।
— তোর জন্য কাজী সাহেবকে রেখে দেওয়া হয়েছে।
— কি শুরু করলে তোমরা?
— আমার মনে হচ্ছে এই কাজটা ঠিক করেছে তোর বাবা।এটা তোর জন্য এটা অনেক ভাল হবে।
— মা আর আমার ভাল ভেবো না প্লিজ,আমার এসব আর একটু ও ভাল লাগছে না।
— তোর কাছে আমার এটা অনুরোধ, তুই বিয়েটা করে নে।
— মা এরকম অনুরোধ করো না প্লিজ যেটা আমি রাখতে পারব না।
— কি হয়েছে তোর মা?যে ছেলে তোর জন্য এতকিছু করেছে তাকে তুই বিয়ে করতে চাচ্ছিস না!
— কিছু না মা,তোমাদের কি দুই মেয়েকেই একসাথে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে চাও?
— তাড়িয়ে কেন দেব,এটা তো তোদেরই বাড়ি।
— মা আমাকে একটু সময় দাও প্লিজ,কিছুদিন অন্তত।
— আমি তো যতদূর বুঝেছি তুই ও নিহানকে পছন্দ করিস তাহলে এখন কেন বিয়েতে অমত করছিস?নিহানের বাবা স্বয়ং বিয়ের কথা বলেছে তোদের।নীরু নাকি সবসময় তোর কথা বলে,ও তোকে ভীষণ ভালোবাসে।ওর ও তো একটা মায়ের প্রয়োজন। আর তুই তো জানিস রণিতা তোর আপন বোন ছিল।তোর বোনের মেয়ে নীরু।
যদিও তোদের পরিচয় ছিল না,কিন্তু এখন তো জানিস তাই না?
— আমি নীরুকে অনেক ভালোবাসি এটা সত্যি কিন্তু মা নীরু যে আমার আপন বোনের মেয়ে এই কথা আঙ্কেলদের জানিয়ে দিলেই তো নীরুকে আমাদের কাছে থাকতে দেয়,তাহলে বিয়ে করার কি প্রয়োজন?
— তুই সারাজীবন এভাবে থাকবি আর নীরুকে দেখবি?বিয়ে করতে হবে না তোর?
— তা তো করতেই হবে।সেটা পরে ভেবে দেখব।
— পরের টা এখনি ভেবে দেখ,ভুল বুঝাবুঝি হলে মিটিয়ে নে।
— মা বাদ দাও তো এসব।
— আমি নিহানকে তোর রুমে পাঠিয়ে দিচ্ছি দুজন কথা বলে দেখ।একটা মীমাংসা কর,আমি আসছি।
–মা তুমি আগে আঙ্কেলের সাথে কথা বলো।
— তোর বাবা উনার সাথে কথা বলছে,তুই নিহানের সাথে কথা বল।সবাই চলে যাচ্ছে একে একে।

মা যাওয়ার পর আমি রুমে বসে বসে ভাবছি কি করব!এখন কি করা উচিৎ আমার।নাহ কিছুই ভেবে বুঝতে পারছি না।

এমন সময় দরজায় নক করার শব্দ শুনলাম।
— আসব?(এটা যে আমার চির চেনা গলার স্বর)
— হুম।
ভেতরে এসে উনি দাঁড়িয়ে রইলেন,কিছু বলছেন না,আমি কি বলব খুঁজে পাচ্ছি না।দুজনই চুপচাপ আছি।কিছুক্ষণ পর-

— আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই না(আমি)
— সেদিনের ব্যবহারের জন্য এতটা আঘাত করবে আমায়?
— একটা মেয়ের কাছে তার সম্মানটা খুব বড়,ভালোবাসার চেয়েও।আর আপনি সেদিন কি বলেছিলেন আমি টাকার জন্য আপনার পিছে পড়ে আছি,বিয়ে ঠিক হওয়া সত্ত্বেও আপনার কাছে গিয়েছি নোংরামি করতে!!!
— আর কিভাবে ক্ষমা চাইলে ক্ষমা করবে আমায়?আমি জানি সেদিন ওতগুলো জঘন্য কথা বলা আমার ঠিক হয় নি।আমাকে সেদিন থেকে ঘুমাতে পারছিলাম না।আমার জন্য না হোক নীরুর জন্য বিয়েটা কর প্লিজ,ওর তোমাকে খুব প্রয়োজন। তুমি ওর মায়ের অভাব পূরণ করতে পারো যেটা আর কেউ পারে না।
— নীরুকে আমার কাছে রেখে দিন,ওকে আমি খুব যত্নে রাখব।
— তবুও আমাকে ক্ষমা করা যায় না?
— না যায় না।
— আচ্ছা ধরো তুমি কাউকে ভালোবাসো,তুমি ঠিক করে নিয়েছো তাকে তুমি তোমার মনের কথা বলবে,আর তখন তুমি জানতে পারলে তার বিয়ে ঠিক অনেক আগে থেকে,সে তোমার ব্যবহারে বুঝেছে যে তুমি তাকে ভালোবাসো অথচ সে তোমাকে আটকায় নি,বলেও নি যে তার বিয়ে ঠিক তাহলে কি তোমার অভিমান হওয়া স্বাভাবিক না?

— আমি আপনার জন্য শুধু মাত্র আপনার জন্য আবিরকে বেশি সময় দেই নি,আলাদা কথা বলি নি তাকে আমি জানতে বুঝতে যাই নি সবসময়ই একটা গ্যাপ রেখে দিয়েছি।আমি কি পারতাম না যে ছেলে আমাকে প্রেম নিবেদন করেছে তাকে ভালোবাসতে?

আমি যখন বিয়ে ভাঙতে প্রস্তুত ছিলাম শুধুমাত্র আপনার একটা কথাতেই,তখন আপনি আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছেন।
— সেদিন আমার খুব খারাপ লেগেছিল,আমি চাই নি ওরকম ব্যবহার করতে কিন্তু কিভাবে যেন হয়ে গিয়েছিল।আমাদের মাঝে প্রেম হয় নি,চোখে চোখ রেখে কথা বা হাতে হাত রেখে চলা,ভালোবাসার বাক্য বিনিময় কোনটাই হয় নি কাউকে ভালোবাসতে এতটুকু যথেষ্ট নয়।তাকে মন থেকে অনুভব করতে হয়।আচ্ছা মানুষ কত ভুল, অন্যায় করেও তো ক্ষমা পায়,ভুল বুঝতে পারলে তাহলে আমি কেন পাবো না?

— আমার ওই দিনের কথা মনে পড়লে অন্যসব ভাল কিছু ভুলে যাই,আমার ইগো বা রাগ যেটাই বলেন এগুলো খুব বেশি,আমি সহ্য করতে পারি না।
— আচ্ছা একবার ক্ষমা করেই দেখো না প্লিজ,আমি আর কোন সময় তোমাকে কষ্ট দিব না।

নিহান স্যার আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার হাতটা তার হাতের মাঝে নিয়ে বললেন-
— আমি আসলে ভালোবাসা নামক জিনিসটা খুব একটা এক্সপ্লেইন করতে পারি না।
প্লিজ ওই একটাদিনের জন্য আমার থেকে দূরে চলে যেও না।আমি বলব না তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারব না,কিন্তু তুমি থাকলে আমার জীবনটা একদম অন্যরকম হয়ে যাবে।প্লিজ নবনী আমাকে একটা বারের জন্য মাফ করে দাও না প্লিজ।
এবার যদি আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলি আমি আর বাঁচতে পারবো না।পুরুষের কষ্ট আসলে কেউ বোঝে না,সেদিন আমি কি পরিমাণে আঘাত পেয়েছিলাম তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না,তাই ওরকম জঘন্য কথা আমার মুখ দিয়ে বের হয়েছিলো।
তুমি যেহেতু একেবারেই রাজি না আমাকে বিয়ে করতে তাহলে আমার কিছু হয়ে গেলে প্লিজ তুমি আমার রুমটাতে নীরুকে নিয়ে থেকো, না এটা তো আর ভবিষ্যতে সম্ভব হবে না তোমার ও তো অন্যকারো হতে হবে,তুমি প্লিজ আমার মেয়েটাকে একটু ভালোবেসো।

নীরুর কাছে তুমি থাকলে,আমি মারা গেলেও এটা ভেবে শান্তি পাব যে তুমি আমার কাছেই আছো।আসলে কি বলো তো মানুষ বেঁচে থাকতে ভালোবাসা বোঝে না,মারা গেলে বোঝে ঠিক কোন জিনিসটা সে হারালো।
তোমার ও একদিন ঠিক বুঝতে হবে নবনীতা, প্লিজ আমাকে বাঁচতে দাও না!আমি কি সারাজীবন কষ্টই পেয়ে যাব?আমার কি ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার নেই?প্লিজ নবনীতা বলো না প্লিজ…..

হঠাৎ হাতের ওপর টুপ করে পানি পড়ায় খেয়াল করলাম উনি কান্না করছেন।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here