#শুভ্রতায়_নবনীতা
#নবনীতা_নীরু
#পর্ব ঃ ৪
এগারোটার দিকে বের হলাম নতুন জবের উদ্দেশ্যে। নীরু যে নম্বর থেকে ফোন দিয়েছে এই ক’দিন সেই নম্বরে ফোন দিয়ে কথা বলে নিলাম।আঙ্কেল ফোন রিসিভ করে আমি পরিচয় দিলে আমাকে যেতে বললেন।
একটা গাড়ি করে ঠিকানা অনুযায়ী পৌঁছে গেলাম।প্রথম দিনেই যা বুঝলাম অফিসটা আমার বাড়ি থেকে খুব একটা দূরে না।আমি অফিসের সামনে এসে চারপাশটা দেখছি,কত বড় বড় তিনটা বিল্ডিং,চারপাশে কত সুন্দর করে সাজানো।ভেতরে ঢুকে আঙ্কেল এর সাথে দেখা করব বললে আমাকে একজন বসতে দিলো।একটা সময় খেয়াল করলাম চারপাশে সবাই আমাকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে আর নিজেদের মধ্যে কিছু একটা বলাবলি করছে।আমার খুবই আনকম্ফোর্ট লাগছিল।
কিছুক্ষণ পর আঙ্কেল বের হয়ে আসতেই প্রায় সবাই উনার দিকে এগিয়ে গিয়ে কি যেন বলছে।আঙ্কেল ও সবার সাথে কথা বলে আমার কাছে এলেন।
–তুমি এখনও এখানে বসে আছো?চলো আমার সাথে।
— জ্বী আঙ্কেল।
–খাওয়া দাওয়া করে এসেছো নাকি,নাস্তার ব্যবস্থা করব মা?
— না না আঙ্কেল আমি খেয়েই এসেছি।আঙ্কেল একটা কথা বলতে পারি?
— হ্যা বলো।
— সবাই আমার দিকে ওভাবে তাকিয়ে ছিল কেন?
— ওই যে বললাম না তোমাকে আমার বউমার মত দেখতে?তাই সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল।
— সত্যিই কি এতটা মিল হতে পারে একটা মানুষের সাথে আরেকটা মানুষের!
— কি জানি বাবা।
— আচ্ছা আঙ্কেল নীরুর বাবা কোথায়?
— আমার ছেলে দেশেই ছিল সপ্তাহখানেক আগে কাজের সূত্রে দেশের বাহিরে যেতে হয়েছে।দুদিন পরই ফিরে আসবে।
— আচ্ছা।আমার এখানে কি কাজ?
— আমার ছেলের পারসোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট।
— আচ্ছা ঠিক আছে।
— হ্যাঁ তুমি দুদিন পর থেকে আসবে,আজকে থেকেই তোমার মাস শুরু।
— আঙ্কেল যদি কিছু মনে না করতেন, আমার স্যালারি কত হবে?
— ষাট হাজার হবে।
— ষাট হাজার!!
— হুম।হবে না?
— হবে না কেন আঙ্কেল?আমি এখনও অনার্স শেষ করি নি আর এত টাকা আমরা একসাথে চোখেও দেখি নি।
— আচ্ছা মা তোমার কাগজ যেগুলো নিয়ে আসতে বলেছিলাম এনেছো?
— হ্যাঁ এই যে।
— আচ্ছা এখানে রেখে দাও।আর তুমি কি বাসায় যাওয়ার আগে নীরুর সাথে দেখা করে যাবে? কালকে আমি আমার নাতনীকে বলেছি তোমাকে নিয়ে যাব।
— ঠিক আছে আঙ্কেল। আপনি গাড়ি নিয়ে বের হন আমি পিছনে রিকশায় আসছি।
— তুমি আলাদা রিকশায় কেন আসবা?দুজন একসাথেই যাব।
আঙ্কেল ড্রাইভারকে ডেকে গাড়ি বের করতে বলল।আঙ্কেল আমাকে বাহিরে সবার সামনে এনে বললেন ইনি তোমাদের স্যারের নতুন পিএ আশা করছি সবাই তাকে কাজ বুঝিয়ে দেবে,তার সাথে ভাল ব্যবহার করবে।
সবাই হ্যাঁসূচক বাক্য বলল।আমরা অফিস থেকে বের হয়ে গেলাম।গাড়িতে উঠে বসতেই ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করলো।কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা বাড়ির গেইটে পৌছে গেলাম।গাড়ি গেইট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই ইয়া বড় একটা দোতলা বাড়ি চোখে পড়লো।বাড়ি দেখে একটা কথাই মাথায় এলো মানুষের টাকা থাকলে কি না করতে পারে।
বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই এক মহিলা ‘আপামণি’ বলে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। কতটা ভালোবাসতো সবাই নীরুর মাকে।উনি হয়তো খুব ভাল মানুষ ছিলেন।আমাকে নিয়ে আঙ্কেল নীরুর রুমে নিয়ে গেলেন।দরজায় দাঁড়িয়ে দেখি একজন তাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু মুখে একটাই কথা, “দাদু বলেছে আজকে আমার মানি আসবে।আমি আর মানি একসাথে খাব।”
আমি নীরুকে ডাক দিতেই নীরু দৌড়ে আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
— মানি তুমি এসেছো?দেখ না আমি কতবার বলেছি আমি তোমার সাথে খাবো,তাও আমার কথা শুনছেই না।
— আচ্ছা ঠিক আছে আমরা একসাথে খাব।কি খাবে আমার পরীটা?
— আমি আজকে পাস্তা খাব।
–এই দুপুরবেলা পাস্তা খাবে?দুপুরে পেট ভরে ভাত খেতে হয় বাবা।
— না আমি আজ পাস্তা খাব।
— আচ্ছা ঠিক আছে চলো আমরা রান্না করি।
— আমি তো পারি না।
— তুমি আমাকে হেল্প করবে আর আমি রান্না করব তারপর আমরা তিনজন মিলে পাস্তা খাব।
–তিনজন কে কে?
— তোমার দাদুও তো খাবে আমাদের সাথে।
— ইশ কত্ত মজা হবে!বাবা থাকলে আমরা চারজন খেতাম মজা করে।
–হুম এখন চলো আমার সাথে।
আমাকে একজন রান্নাঘরে নিয়ে গেল।নীরু পিছনে পিছনে চলে এলো অতঃপর আধাঘন্টা ধরে রান্না করলাম। তারপর সবাই একসাথে বসে খাওয়া দাওয়া করলাম।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিকেল গড়িয়ে গেল,মেয়েটা আমাকে আসতেই দিতে চাচ্ছিলো না।আঙ্কেল আমাকে গাড়ি করে পৌছে দেওয়ার কথা ও বলেছিল ড্রাইভারকে কিন্তু আমিই গাড়িতে আসি নি।আমার বাড়ি থেকে অফিস আর নীরুর বাড়ি খুব একটা দূরে না।
বাড়িতে ঢুকতেই দেখি তুশি মার মাথায় পানি ঢালছে।আমি এই অবস্থা দেখে দৌড়ে গেলাম।
— কি রে তুশি কি হয়েছে মার?
— আর বলিস না আপা, মা মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল।ভাগ্যিস আমি ছিলাম নইলে তুই ও বাড়ি ছিলি না কে দেখতো বাবাও তো বাসায় নাই।
— এমন হলো কি রে মা?
— এমনি মাথাটা ঘুরছিল একটু।
আজকে খেয়াল করলাম মার চোখমুখ কালো হয়ে গেছে।আমি মার পাশে বসে আছি,মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।
— মা…
— হ্যাঁ বল।
— আমার চাকরিটা হয়ে গেছে, ওরা বলেছে স্টার্টিং এ ষাট হাজার টাকা দিবে,তিনমাস পর আবার বেতন বাড়বে।
— এত টাকা দিবে?
— হ্যাঁ তাই তো বলল।দুদিন পর থেকে জয়েন।
— এই দুদিন ভাল করে পড়াশোনা করবি।
— আচ্ছা।
— তুই তো এখন বিয়ে করতে চাইছিস না তাই না?
— আবার বিয়ের কথা কেন?
— তোর টাকা থেকে আমি অল্প অল্প করে তোর বিয়ের জন্য টাকা গুছিয়ে রেখেছি।তোর বাবার তো সামর্থ্য নাই।
— ওটা থাক,কোন সময় কো প্রয়োজন হলে কাজে লাগবে।
— জানতে চাইলি না কত হয়েছে?
— ওই কয়েকটা টাকাই তো পেতাম,কত আর জমবে!যা হয়েছে হয়েছে আপনার কাছে রেখে দেন।
মা ও আর কিছু বলল না,এই দুদিন সময় আমি একদম নষ্ট করি নি,পড়াশোনা করে পড়ার চাপ অনেকটা কমিয়ে রেখেছি।আর পড়ার জন্য ও মা খুব কড়া শাসনে রেখেছে আমাদের দুই বোনকে।
এই কয়েকদিনে মা আবার আগের মত অনেক কাছে চলে এসেছে,আবার আগের মত ভালোবাসা আর যত্নে রাখছে আমাকে।এখন আর না পাওয়া বলতে কিছুই নেই।এখন শুধু এই ভালোবাসার মানুষগুলোকে সম্পূর্ণরূপে ভাল রাখতে পারলেই আমি সুখী।
এখন আর আগের মত কাজ করতে দিতে চায় না মা,পারলে উনি সবই করে ফেলে।কিন্তু আমিও উনাকে সব কাজ করতে দেই না,কিছুদিন ধরে শরীর আসলেই খুব খারাপ উনার।আমি আর তুশি মিলেই কাজ করার চেষ্টা করি।এই দুদিনে আবার আগের মতো আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছি।এখন আমরা সুখী পরিবার।আর যেন বাহিরের কোন আঘাত আমাদের পরিবারে না আসে এটাই চাওয়া।
সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি এমন সময় মা একগ্লাস দুধ নিয়ে আমার ঘরে আসলো।
— নবু?
— হ্যাঁ মা বলো।
— এই এক গ্লাস দুধ খেয়ে তারপর বের হবি।
— তুমি তো জানোই আমি দুধ পছন্দ করি না।তোমার শরীরটা তো খারাপ, তুমি বরং এটা খেয়ে নাও।
— নবু এখন আমার মাথা গরম করাবি না,বেশি কথা বললে পিঠে কিন্তু বেত ভাঙবো আমি বলে দিলাম।
— আমি আর কথা না বাড়িয়ে খেয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হলাম।
রিকশায় প্রায় আধাঘন্টা লাগলো অফিসে পৌছাতে। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া দিয়ে ভেতরে চলে গেলাম।আমি যেতেই একজন এসে বলল ম্যাম আসুন আমি আপনাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিচ্ছি।
আমিও তার সাথে সাথে চলে গেলাম।
কিছুক্ষণ পর আমি যে স্যারের পিএ অর্থাৎ নিহান স্যারের কেবিনে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো।কেবিনে নিয়ে গিয়ে আমার সাথে যাওয়া আপুটি পরিচয় করিয়ে দেওয়া শুরু করলো।
–হ্যালো স্যার, ইনি আপনার নতুন পিএ নবনীতা
বড় স্যার আপনার পিএ হিসেবে ইনাকে সিলেক্ট করেছেন,স্যার আপনাকে বলেছে কি না জানি না আজকে থেকে উনার জয়েন।আমি উনাকে সব বুঝিয়ে দিয়েছি কোন সমস্যা হবে না।
— নিহান স্যার আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে,হয়তো সবার মতো আমাকে দেখে উনার স্ত্রীর কথা মনে পড়ছে।
— স্যার আমি আসছি তাহলে আপনারা কথা বলুন,ম্যাম আমি আসছি।বলেই আপুটা চলে গেল।
স্যার বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে গেলেন।আমার দিকে তাকিয়েই আছে উনি,আমি খুবই অপ্রস্তুত হচ্ছি বিষয়টিতে।
একপর্যায়ে উনি আমাকে বসতে বললেন।
— নীরু আর বাবা যখন আপনার সম্পর্কে বলল আমি বিশ্বাস করতে পারি নি,কিন্তু এখন আমি আমার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না।আপনি একদম হুবহু আমার এক্স ওয়াইফ রনিতার মতো দেখতে।
— জ্বী স্যার কথাটি আমি অনেকবার শুনেছি।
চলবে…..
নিহান আর নবনীতার মিল করিয়ে দিলে কেমন হয়??