ভুল -পর্ব ১০

0
187

#ভুল ১০ম পর্ব
#jannat_Nur

একটা অন্ধকার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে সিরাত! চারপাশে তাকিয়ে দেখে কোথাও কেউ নেই। কোন রাস্তা দেখতে পাচ্ছেনা, কিভাবে কোথায় যাবে সেটাও বুঝতে পারছে না সিরাত! ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। এমন সময় একজন বয়স্ক লোক তার সামনে এসে দাঁড়ালো, তাকে বলল ভয় পাচ্ছিস? তখন সিরাত ভয়ে জড়সড় হয়ে বলল, হ্যাঁ আমি খুব ভয় পাচ্ছি বাট আমি এখানে কেন? কিভাবে এই অন্ধকারে আসলাম।

তুই তো সবসময় অন্ধকারেই আছিস, তোর চারপাশে কখনোই আলো ছিল না।

আপনি কি বলছেন, আপনার কথার মানে আমি বুঝতে পারছি না, সিরাত লোকটাকে বলল।

তোর সম্বন্ধে কি তুই ঠিকমতো জানিস?কখনো কি জানতে চেয়েছি তুই অতীত সম্পর্কে। তুই একটা মায়ের গর্ভ থেকে দুনিয়াতে এসেছিস, সে কেমন আছে বেঁচে আছে না কি মরে গেছে, ভালো আছে না খারাপ আছে কখনো এই প্রশ্ন তোর মনে জাগেনি? তুই তো সন্তান হিসেবে অযোগ্য! এই গভীর অন্ধকারে তোর ডুবে যাওয়া উচিত।
কথাগুলো বলে সিরাতের হাত ধরে সেই বয়স্ক লোকটা গভীর অন্ধকারের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সিরাত চিৎকার করে যাচ্ছে আর বলছে আমাকে ছেড়ে দেন আমার ভয় লাগছে! আমি তো অন্ধকারে হারিয়ে যাব।

এত ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখার সাথে সাথে সিরাত চিৎকার দিয়ে উঠে বসলো। তার চিৎকার শুনে আমিরুল ইসলাম দরজার পাশে এসে ডাক দিচ্ছে, সিরাত কি হয়েছে এত রাতে এভাবে চিৎকার দিয়েছিস কেন? কিছুক্ষণ পর দীপা এবং তার স্বামী দুজনেই উঠে আসলো, তারা বুঝতে পারছে না সিরাতের কি হয়েছে।

সজাগ হয়ে সিরাত ভয়ে এখনো কাঁপছে, সে কেন এমন স্বপ্ন দেখল সেটাই ভাবছে। সত্যিই তো তার যে মা তাকে জন্ম দিয়েছে তার সম্পর্কে সে কিছুই জানার চেষ্টাই করেনি কখনো। তার বাবা সবসময় বলে এসেছে তার মা তাকে দেখে অন্য কারো সাথে চলে গিয়েছে! এটাই বিশ্বাস করছে, কখনো জানতে চায়নি এটা সত্যি না কি মিথ্যা। সত্য মিথ্যা জানতে হলে অবশ্যই তাকে বাংলাদেশে যেতে হবে এমনটাই ভাবছে সিরাত।
এত ভয়ঙ্কর স্বপ্ন কেন সে দেখলো এই বৃদ্ধ লোকটা তাকে এভাবে অন্ধকারে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল কেন, আর তাকে বলছিল তুই তো অন্ধকারে ডুবে আছিস আবার অন্ধকারে কিসের ভয়! সত্যি কি আমি অন্ধকারে ডুবে আছি আমাকে মিথ্যা বলা হয়েছে? ভাবতে ভাবতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল সিরাত বাংলাদেশে আসবে, যেভাবেই হোক তাকে সত্যিটা জানতে হবে। যদি তার মা তাকে রেখে চলে যেয়ে থাকে এটা জানতে পারে তাহলে তো বাবার কথাই সত্যি, আর যদি তার মায়ের সাথে কোন অন্যায় করা হয় সে তার বাবাকে ছাড়বে না।

দরজার ওপাশে আমিরুল ইসলাম দীপা এবং দীপার স্বামী ডেকে যাচ্ছে, সিরাত এসে দরজা খুলে দিলো।

কি হয়েছে তোমার এভাবে চিৎকার করলে কেন? কিছু হয়েছে তোমার। সবাই একসঙ্গে প্রশ্ন করছে?

না কিছু হয়নি, আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি স্বপ্নটা দেখে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম! তাই চিৎকার করছি।

তাহলে আমি তোমার সঙ্গে থাকি, রাতে একা একা আবার ভয় পাবে! আমিরুল ইসলাম বললেন।

না পাপা তোমার থাকতে হবে না, আমি একাই থাকতে পারবো, তোমরা এখন যাও! এটা বলে দরজ বন্ধ করে দিলো সিরাত। সে রাতে আর ঘুম হলো না ভাবতে থাকলো অবশ্যই তাকে বাংলাদেশের যেতে হবে। মনে মনে ভাবলো রোদকে সে ভালোবাসে তাকে বিয়ে করে নিয়ে বাংলাদেশে যাবে, কালকে রোদকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে। সিরাতের মনে হয় রোদ তাকে পছন্দ করে, সেটা সে এতদিনে বুঝতে পারছে। সকাল হলে সিরাত রোদের সাথে দেখা করতে চলে গেল! এই সকাল সকাল সিরাত কেন তার সাথে দেখা করতে চাইছে রোদ জানতে চাইলো।

তোমাকে আমি পছন্দ করি সেটা তুমি অবশ্যই জানো! মুখে কখনো বলা হয়নি তোমাকে কতটা ভালোবাসি, আমি বিশ্বাস করি তুমি আমাকে ভালোবাসো! আর জানো আমি কেমন ছেলে আমি শোয়াইবের মত ছেলে না, আমি তোমাকে যথেষ্ট পরিমাণে শ্রদ্ধা সম্মান করি এবং এতদিন আমাদের বন্ধুত্ব টিকিয়ে রেখেছি, ভয়ে বলতে পারেনি তুমি যদি আমাকে ফিরিয়ে দাও, আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হবে। বাট আজকে তোমাকে বলতেই হবে কারণ আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি বাংলাদেশে চলে যাব, তারপরে এখানে আমি ফিরব কি ফিরবো না সেটা শিওর না। আমি তোমাকে হারাতে চাই না তাই আজ সরাসরি বলছি আমি তোমাকে প্রচন্ড পরিমাণ ভালোবাসি, এবং জীবন সঙ্গী করতে চাই! তুমি কি আমাকে বিয়ে করতে রাজি আছো।

সত্যি বলতে তোমাকে বিয়ে করতে আমিও চাই মনে মনে। কখন যে তোমার প্রতি দুর্বল হয়ে গেছি সেটা বুঝতে পারিনি। শোয়াইবের কাছ থেকে ধোঁকা খেয়ে তোমার সাথে ফ্রেন্ডশিপ করার পর ভাবছিলাম কখনো তোমার প্রেমে পড়বো না, কিন্তু কি করবো বলো মনকে তো আর মানানো যায় না। তুমি যখন বলতেছ বিয়ের কথা তাহলে আমার বাবার সাথে কথা বল! চলো তোমাকে নিয়ে এখন আমি গির্জায় যাব।

সিরাতকে নিয়ে রোদ তার বাবার কাছে আসলো। রোদের বাবা এতক্ষণ প্রার্থনায় মগ্ন ছিল, রোদ আর সিরাত কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর মিস্টার ক্লাক মেয়ের সামনে আসলো।

হ্যাঁ বল কিসের জন্য অপেক্ষা করছিস, আর এই ছেলে কে? তোর বন্ধু নাকি।

বাবা তার নাম সিরাত ইসলাম, আমাকে সে অনেক ভালোবাসে আমাকে বিয়ে করতে চায়! আমিও তাকে ভালোবাসি তাই তোমার কাছে নিয়ে আসলাম, আর একটা কথা সিরাত কিন্তু মুসলিম! বাবা তুমি এটার জন্য বাধা দিও না।

মিস্টার ক্লাক সিরাতের দিকে তাকিয়ে তাকে প্রশ্ন করলেন তুমি কি আমার মেয়েকে অনেক ভালোবাসো? তাকে সত্যি সত্যি বিয়ে করতে চাও?

হ্যাঁ আঙ্কেল আমি চাই রোদকে বিয়ে করতে, তাকে আমি অনেক ভালোবাসি।

সেটা যদি হয় তাহলে প্রমাণ দিতে পারবে তুমি তাকে অনেক ভালোবাসো, তাকে কখনো ছাড়তে চাইবে না।

আপনি কি প্রমাণ চান? আমার মন প্রাণ জুড়ে শুধুই রোদ, আমার লাইফের প্রথম ভালবাসায় আপনার মেয়ে! তাকে ছাড়া তো আমি কোন কিছুই ভাবতে পারিনা। আমি চাচ্ছি বাংলাদেশে যেতে রোদকে হারাতে চাই না বলেই বাংলাদেশের যাবার আগে তাকে বিয়ে করতে চাচ্ছি।

ঠিক আছে আমি তোমার সাথে বিয়ে দিতে রাজি আছি, কিন্তু তোমার খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করতে হবে! তুমি যদি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করতে পারো তাহলে তুমি আমার মেয়ের জামাই হতে পারবে। আমি আমার মেয়েকে মুসলিম হতে দিতে চাইবো না কখনো, এত কষ্ট করে বড় করেছি অন্য ধর্মে চলে যেতে নয়।

মিস্টার ক্লাকের কথা শোনার সাথে সাথে সিরাতের মুখ কালো হয়ে গেল, সে ভাবতে পারেনি রোদের বাবা এমন প্রস্তাব দিবে। এটা কিভাবে সম্ভব নিজ ধর্ম ত্যাগ করে সে খ্রিস্টান হয়ে যাবে, এটা অসম্ভব সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম ইসলাম, সেটা কিভাবে ত্যাগ করবে সে।
সিরাতের মুখে কোন কথা নেই দেখে মিস্টার ক্লাক আবার বললেন,

আমি বুঝতে পারছি তুমি তোমার ধর্ম ত্যাগ করতে রাজি নয়! বললে তো অনেক ভালোবাসো যদি অনেক ভালোবেসে থাকো ধর্ম ত্যাগ করতে পারতে। তুমি কি চাও আমার মেয়ে খ্রিস্টান ধর্ম ত্যাগ করে মুসলিম হয়ে তোমাকে বিয়ে করবে? তুমি যদি তোমার ধর্ম না ছাড়তে পারো আমার মেয়ে কেন তার ধর্ম ছাড়বে।

সিরাত রোদের দিকে তাকালো, রোদের চোখে পানি! সে তার বাবাকে বলল, বাবা তুমি এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিও না, সিরাতকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে দিও না এমন একটা শর্ত দিয়ে।

তাহলে কি তুমি তার ধর্ম গ্রহণ করবে, মুসলিম হয়ে বিয়ে করবে তাকে? রোদকে প্রশ্ন করলেন মিস্টার ক্লাক।

রোদ কি উত্তর দেবে ভাবতে পারছেন না।

মিস্টার ক্লাক আবার বললেন, আমি একজন পাদ্রী জীবন কাটিয়ে দিলাম ইশ্বরের সেবা করে! কখনো বিয়ে থা করিনি, তোমাকে আমি এতিম অসহায় অবস্থায় রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনেছিলাম, নিজ ধর্মে দীক্ষিত করে বড় করেছি। আমি আশা করিনি তুমি আমার অবাধ্য হবে কখনো, যদি আমার প্রতিদান দিতে চাও তুমি কখনোই ধর্ম ত্যাগ করে একজন মুসলিমকে বিয়ে করবে না। সিরাত যদি তার ধর্ম ত্যাগ না করতে পারে তুমি কেন তোমার ধর্ম ত্যাগ করবে। তার ভালোবাসা তোমার প্রতি বেশী না হলে তোমার কেন এত ভালোবাসা থাকবে তার প্রতি। তুমি এখনই সিদ্ধান্ত নেবে তুমি আমার কথা রাখবে, না কি সিরাতকে বিয়ে করবে মুসলিম হবে।

রোদ পড়ে গেল কঠিন হিসাব নিকাশে, ভাবতে থাকলো আমাকে যদি এতিম অসহায় অবস্থায় এনে বড় করে এ পর্যন্ত লেখাপড়া করায় তার প্রতিদান আমি কিভাবে না দেই। আর আমিও তো কখনো ভাবিনি আমার নিজের ধর্ম ছেড়ে অন্য ধর্মেচলে যাবো। রোদ সিরাতের দিকে তাকিয়ে বলল তুমি যদি আমাকে ভালোবাসো তাহলে চলে এসো আমার ধর্মে। সিরাত আমি তোমাকে হারাতে চাই না, আমি চলে যেতাম তোমার ধর্মে কিন্তু পারছি না বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে।

সিরাত কিছু উত্তর না দিয়ে বের হয়ে আসলো গির্জা থেকে, তার মনে হচ্ছে সে এটা কখনো পারবে না। ভালোবাসা জীবন মরণ সবকিছুর ঊর্ধ্বে তার ধর্ম, সে শেষ নবীর উম্মত, মুসলিম হিসেবে তার জন্ম হয়েছে এটাই তার সবচেয়ে পরম পাওয়া। সে কিভাবে তার ধর্মকে ছেড়ে ভালোবাসার জন্য অন্য ধর্মে চলে যাবে। যতই কষ্ট হোক রোদকে ছেড়ে আসতে হবে, ভুলে থাকতে হবে। রোদ পিছন থেকে অনেকবার ডেকেছে কিন্তু সিরাত আর পিছন ফিরে তাকায়নি। দুঃখ-ভরাক্লান্ত মন নিয়ে সে বাসায় চলে আসলো, এবং তার বাবাকে বলল আমরা একেবারে বাংলাদেশে চলে যাব! এখানে আর থাকবো না তুমি সবকিছু ব্যবস্থা করো। সিরাজের এমন কথা শুনে তার বাবা যেন অবাকের চেয়ে বেশি অবাক হয়ে গেল। যে ছেলে বাংলাদেশে কখনো বেড়াতে যেতে চায়নি আর আজকে বলছে বাংলাদেশে একেবারে চলে যাবে। কারণ কি সেটা জানার জন্য ছেলেকে প্রশ্ন করল,

কি হয়েছে, কেন বাংলাদেশে যেতে চাচ্ছো।বাংলাদেশের যেয়ে আমরা কি করব?
এখানে আমাদের বিজনেস বাংলাদেশ যাবার কোন দরকার নেই। তোমার কি হল তুমি বাংলাদেশে কেন চলে যেতে চাও, কখনো তো বেড়াতে যেতে চাওনি এতদিন।

যেতে চাইনি সেটাই তো আমার ভুল ছিল, কেন আমার জন্মভূমি বাংলাদেশে আমি যেতে চাইলাম না সেটাই অনেক বড় ভুল। এখানে থেকে আর ভালো লাগছে না, আমি এখন আমার দেশে ফিরে যেতে চাই। তুমি যদি না যাও আমাকে ব্যবস্থা করে দাও আমি সেখানে চলে যাব। আর বিজনেস করতে চাইলে বাংলাদেশেও করা যাবে, বাংলাদেশে বিজনেস করে অনেকে জীবনযাপন করছে। টাকা থাকলে সবখানে বিজনেস করা যায়! সেটার জন্য সমস্যা হবে না। আমার মনে হয় তুমি বাংলাদেশে বসবাস করতে ভয় পাও, সেখানে থাকতে তোমার কিসের ভয়।

সিরাতের এমন কথা শুনে আমিরুল ইসলামের বুক কেঁপে উঠলে, সত্যিই তো সে বাংলাদেশে যেতে ভয় পায়। সবসময় ভয় পায় তার ছেলে যদি চলে যায় তার মায়ের কাছে। কি আর করা ছেলে যখন বলেছে আমিরুল ইসলামের না করার কোন উপায় নেই, বাংলাদেশে যেতেই হবে। তারা বাবা ছেলে চলে আসবে বাংলাদেশে দীপা রয়ে যাবে তার স্বামীর কাছে, কিছুদিন পর দীপাও বাংলাদেশে চলে আসবে।

সিরাত শুধু অপেক্ষা করছে সে বাংলাদেশে যাবে এবং তার মায়ের সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবে! অবশ্যই কেউ না কেউ আছে তাকে সত্যিটা বলতে পারবে। সে মনে করে স্বপ্নটা তাকে সত্যি জানার জন্য আগ্রহী করে তুলেছে, এতদিন তার ভিতরে এগুলো নিয়ে কোন প্রশ্ন ছিল না।

চলবে….

/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here