#ভুল ২য় পর্ব
#jannat_Nur
সুফিয়া বেগম অনেকক্ষণ ধরে অঝোরে কান্না করলেন তার মনে আজ পাহাড়সম কষ্ট হচ্ছে। যে স্বামী তাকে এত ভালোবাসতো সেই স্বামী আজ তাকে নষ্টা দুশ্চরিত্রা বলে গালি দিলো! ভাই-বোনদের কথা বিশ্বাস করল। সে তার স্ত্রী সাথে অনেক বছর সংসার করা সত্ত্বেও আজকে আমিরুল ইসলাম তাকে বিশ্বাস করে নাই বিধায় সুফিয়া বেগমের কষ্টটা বেশি হচ্ছে। মায়ের কান্না দেখে শিশু ছেলে সিরাত এদিক ওদিক তাকাচ্ছে আর ভাবছে তার মা কেন এত কান্না করছে। অনেকক্ষণ ধরে তাকে সুফিয়া বেগম কোলে নিচ্ছেন না। সিরাত আস্তে আস্তে মায়ের কাছে গেল, মায়ের কোলের উপর বসে চোখের পানি মুছে দিচ্ছে হাত দিয়ে। ছোট্ট শিশুর হাতের ছোঁয়া পেয়ে সুফিয়া বেগম আরো জোরে কান্না করে দিলেন। ছেলেকে বুকের সাথে জড়িয়ে বলতে শুরু করলো, বাবারে তোর মা কখনো কোন অন্যায় করেনি! তোর মা নির্দোষ। কেন আমার নামে তারা এরকম বদনাম ছড়াচ্ছে, তোর বাবা বলছে দেশে এসে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দেবে। আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিলে তোকে তো রেখে দিবে! তোকে ছাড়া আমি বাঁচবো কিভাবে, এই দুনিয়াতে একমাত্র তুই আমার ভরসা আমি কখনো তোকে ছাড়া বাঁচবো না! আমি মরে যাব, না হয় পাগল হয়ে যাবো তোকে ছাড়া। কথাগুলো বলছে আর সিরাতের কপালে চুমু খাচ্ছে সুফিয়া বেগম। ছেলেকে হারাতে হবে এটা ভাবতে সুফিয়া বেগমের কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে। কি করে সে স্বামীকে বুঝাবে সে কোন পাপ করেনি, সবকিছু তার বিরুদ্ধে বানোয়াট। সুফিয়া বেগমের মনে হল শাশুড়ির কথা, সে তো অনেক বছর ধরে শাশুড়িকে সেবা যত্ন করে আসছে! শাশুড়ি মাকে গিয়ে বুঝালে তার ছেলেকে যদি বলে তার ছেলে মায়ের কথা রাখতে পারে। সিরাতকে কোলে নিয়ে সুফিয়া বেগম শাশুড়ি মায়ের রুমে গেল, শাশুড়ি মায়ের কানে আগেই কথাটা তুলে দিয়ে আসছে তার ছোট মেয়ে রুমা। যখন সুফিয়া বেগম তার শাশুড়ির কাছে গিয়ে বসলো, শাশুড়ি তার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল তার বড় ছেলের বউ অনেক কান্নাকাটি করেছে! চোখ একদম ফোলে গিয়েছে। সুফিয়া বেগমের শাশুড়ি বললেন, বৌমা আমি শুনেছি কালকে রাতের ঘটনা আর আজকে আমাদের বাড়িতে চেয়ারম্যান সাহেবকে ডাকা হয়েছিল। আমাদের বাড়িতে অন্য কেউ এসে বিচার করবে এটা কখনো আমি ভাবতে পারিনি, তোমার শ্বশুর থাকলে এটা সহ্য করতে পারত না।
মা আমি কোন অন্যায় করিনি আমার ঘরে কোন পর পুরুষ ঢোকেনি! এগুলো বানোয়াট, কিসের জন্য দুলাভাই এমনটা বলছে আর সবাই নাকি দেখেছে একটা লোক আমার ঘরের সামনে থেকে বের হয়ে গিয়েছে। আমি কোন কিছু জানিনা আপনি বিশ্বাস করেন, আপনার ছেলেকে বলেছি সে বিশ্বাস করেনি! সে বলছে এসে আমাকে নাকি বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিবে। মা আমার দ্বারা কোন পাপ হয়নি, আপনি আমাকে বিশ্বাস করুন মা। আমাকে যদি তাড়িয়ে দেয় আমার ছেলেকে ছাড়া আমি বাঁচবো না মরে যাব।
শাশুড়ি মা বললেন তুমি আমার কাছে বস আগেই এত চিন্তিত হয়ো না! আমিরুল ইসলাম আসুক আমি তাকে বুঝিয়ে বলব, আমার কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছে না তুমি এই কাজটা করতে পারো। হয়তো চোর আসতে পারে তোমার রুমের ওইদিকে থেকে বের হতে দেখেছে ঘরে ঢুকতে পারেনি। আর তারা সন্দেহ করে নিয়েছে অন্যকিছু। তুমি আমাকে যে আদর ভালোবাসা দিয়েছো তোমার মন আমি বুঝতে পারি, তোমার মনটা অনেক ভালো! তুমি এমন পাপ করতে পারো না। শাশুড়ীর কথায় সুফিয়া বেগমের মনে কিছুটা সান্ত্বনা আসলো। একজন তো তাকে বিশ্বাস করেছে আর তার শাশুড়ি যদি তার স্বামীকে বুঝিয়ে বলে হয়তো তার স্বামী থাকে এ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিবেন না। এগুলো ভাবতে ভাবতে ছেলেকে নিয়ে তার রুমে গেল।
আজকে সারাদিন তার খাওয়া হয়নি এখন প্রায় সন্ধ্যা। কেউ একবার বলেনি তাকে খাবার খেতে। ধীর পায়ে সে রান্না ঘরের দিকে গেল খাবার নিয়ে আসতে। তখনই তার ছোট দেবরের বউ শাপলা এগিয়ে এসে বলল, ভাবী রান্না ঘরে কি করছেন? সুফিয়া বেগম বলল কি করছি মানে? সারাদিন আমি খাইনি আমাকে খিদা লাগে না নাকি। একবারও তো কেউ আমার খবর নিলে না।
আপনার খবর নেওয়ার জন্য কেউ প্রয়োজন বোধ করেনি। আর রান্নাঘরে ঢুকা আপনার নিষেধ।
তুমি কি বলতে চাও, আমি না খেয়ে থাকবো! নিষেধ কে দিয়েছে?
কে আবার দিবে মেজ ভাই সেজ ভাই।
তখনই সুফিয়া বেগমের সেজ দেবর এসে বললেন, ভাবী আপনার রুমে যান তুলি আপনাকে ভাত দিয়ে আসবে।
তুলি এই বাসার কাজের মেয়ে, তুলিকে দিয়ে সুফিয়া বেগমের জন্য ভাত পাঠিয়ে দেওয়া হলো। সুফিয়া বেগমকে রান্না ঘরে ঢুকতে দিলো না তার দেবর এবং দেবরের বউ। তুলি ভাত নিয়ে এসে রেখে বলল,
ভাবী আপনার সাথে ওরা যা করছে এটা মস্ত বড় অন্যায়! আমারও বিশ্বাস হচ্ছে না আপনি এমনটা করতে পারছেন। মানুষে এর চেয়ে কত কিছু অন্যায় করে তারপরেও কি তাকে না খাইয়ে রাখে? এই মানুষগুলো সারাদিন আপনাকে খাবার দিল না, খোঁজখবর নিল না। এদের জন্য আপনি কতটা বছর রান্না করলেন কত আদর যত্ন করে খাওয়ালেন আর শেষে কিনা আপনাকে নির্দয়ের মতো ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে।
সুফিয়া বেগম তুলি কে বলল থাক তুমি চুপ করে থাকো! আমার পক্ষ নিয়ে কথা বলছো শুনলে তোমাকে কাজ থেকে তাড়িয়ে দিবে।
তাড়িয়ে দিলে দিক আমি ভয় করিনা, অন্যখানে কাজ করে খাব! তবে এদের মতো মানুষের বাসায় চুপ করে থাকবো না। আপনার মত একজন ভালো মানুষের সাথে তারা এরকম ব্যবহার করছে।
আচ্ছা তুমি যাও আমি খাবার খাই খুব খিদে পেয়েছে, শরীরটা দুর্বল লাগছে।
সুফিয়া বেগমের কথা শুনে তুলি রুম থেকে বের হয়ে গেল। সুফিয়া সিরাতকে কাছে নিয়ে তার মুখে ভাত তুলে দিচ্ছে, সে নিজেও খাচ্ছে, আর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে, চোখের পানি মুছে আবার খাওয়া শুরু করছে। এমন দিন কখনো আসবে সে ভাবেনি, কত সম্মানের সহিত ছিল সে স্বামীর কাছে! এ সংসারের প্রতিটা মানুষ আজ তার বিরুদ্ধে, এলাকার মানুষ তাকে দুশ্চরিত্র বলে ভাবছে শুধু এই রফিকের কারণে। রফিকের ষড়যন্ত্রের কারণেই জীবনটা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ভাবতে ভাবতে খাবার খাচ্ছে সুফিয়া বেগম।
সে শুধু ভয় পাচ্ছে তার ছেলেটাকে নিয়ে, যদি থাকে বাসা থেকে তাড়িয়ে দেয় তার একমাত্র সন্তান তাকে ছাড়া সে কিভাবে থাকবে।
চারদিন পরে আমিরুল ইসলাম চলে আসলো তার বাড়িতে। বাড়িতে আসার পর সুফিয়া বেগমের সাথে একটি কথাও বলছে না। স্বামীর কাছে গিয়ে বলল তুমি আমাকে যা নিয়ে কসম করতে বলো আমি কসম করতে পারবো আমি এমন মেয়ে না তুমি জানো! আমার বিরুদ্ধে এটা রফিকের ষড়যন্ত্র।
একদম চুপ থাকবে তুমি আমার বোন জামাইয়ের উপর মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছো! এখন সব দোষ চাপাতে চাচ্ছ রফিক মিয়ার উপর? কারণ সে দেখে ফেলেছে তাই দোষটা এখন তার হচ্ছে। এত চালাকি করবেনা আমার সাথে! আমি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাই হবে।
আমি তোমার সাথে চালাকি করছি না, মাস দেড়েক আগে রফিক আমার রুমে এসে আমার হাত ধরে ফেলে। আমাকে কুপ্রস্তাব দেয় আমি তার প্রস্তাবে রাজি হয়নি এবং অপমান করে তাড়িয়ে দেই। সেটার শোধ নিতেই রফিক মিয়া আজ আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছে।
আমিরুল ইসলাম এবার রেগে উঠলো,
এই তোকে না বলছি তুই আর একটা কথা বলবি না! তোকে যদি রফিক মিয়া আগে হাত ধরে থাকে কুপ্রস্তাব দিয়ে থাকে তুই আমাকে বললি না কেন? কেন বললি না! এখন যখন পর পুরুষের সাথে ধরা পড়েছিস এখন আমার বোন জামাইয়ের নাম দিচ্ছিস।
আগে কেন বলিনি সেটাই তো ভুল হয়েছে, এটাই আমার জীবনে মস্ত বড় ভুল। ভাবছিলাম যদি এটা তোমাদের বলি, রুমার সংসার ভেঙে যাবে। আমি ভাবছিলাম রফিককে যে কথা বলে অপমান করেছি তারপরে দ্বিতীয়বার সে এমন কাজ করবে না। কিন্তু তা হলো না, মিথ্যা অপবাদ দিয়ে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সর্বনাশ করে দিচ্ছে রফিক। তুমি বিশ্বাস করো আমি এমন করিনি।
আমিরুল ইসলাম সন্ধ্যার পর তার তিন ভাই, বোন জামাই ও বোনদের নিয়ে বসলো। রফিক মিয়াকে জিজ্ঞেস করল তুমি যা দেখেছো তা কি সত্যি? দেখো একদম মিথ্যা বলবে না। আমি যদি বুঝতে পারি তুমি মিথ্যা বলছো বা অন্যকিছু তাহলে তোমাকে আমি ছাড়বো না।
ভাইয়া আমি কেন মিথ্যা বলব আমার কি লাভ আপনার সংসার ভেঙে দিয়ে। আমি তখন বাথরুম যাবার জন্য উঠেছিলাম, দেখি ভাবীর রুম থেকে দরজা খুলে একজন বের হলো। আমি বললাম কে লোকটা তখন তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছিল! আমার একার কথা কেউ বিশ্বাস করবেন না তাই আমি সঙ্গে সঙ্গে রুমাকে ডাক দেই। রুমা উঠে দেখতে পারে লোকটা চলে যাচ্ছে! আমি দাঁড়িয়ে থেকে রুমাকে বললাম ভাইয়াদের ডাক দিতে। তারা তখন উঠে দেখে ওই বড় রাস্তার ওই পারে লোকটা দৌড়ে চলে যাচ্ছে। এখানে শুধু আমি নয় রুমা এবং মেজ ভাই সেজ ভাই দেখেছে।
আমিরুল ইসলাম তার ভাইদের জিজ্ঞেস করল, তোরা কি দেখেছিস সত্যি বলবি।
আমিরুল ইসলামের দুই ভাই বললো রুমা আমাদের ডাক দিলে লোকটা অনেক দূরে চলে গেছে, তখন আমাদেরকে দেখায় বলে ওই দেখ লোকটা চলে যাচ্ছে। আমরা তখন দুইজন তাকে ধরার জন্য গিয়েছিলাম কিন্তু ততক্ষণ এসে চলে গিয়েছে। আর আমাদের কি লাভ তোর বউয়ের নামে মিথ্যা বলে। তোর কি মনে হয় আমরা চাই তোর সংসারটা ভেঙে যায়? এতদিন পর তোর একটা ছেলে হয়েছে ছেলের বয়স মাত্র তিন বছর, এই ছেলেটা ইয়াতিম হোক এটা কি আমরা চাইবো নাকি। এখন তুই ভেবে দেখ যদি অসতী স্ত্রী নিয়ে সংসার করতে চাস করতে পারিস! কিন্তু আমরা কেউ তোর সঙ্গে থাকবো না, তোরা আলাদা থাকবি।
তোরা কি আমাকে পাগল পেয়েছিস আমি এমন স্ত্রী নিয়ে সংসার করবো। আমার ছেলের বয়স তিন বছর হয়েছে তো কি হয়েছে, আমি তাকে আমার কাছে নিয়ে রাখবো! আমি তাকে আয়া রেখে লালন পালন করব। তবু এমন কলঙ্কিনী মায়ের কাছে আমার ছেলেকে রেখে মানুষ করবো না। তাকে আমি কালকে ডিভোর্স দেবো।
আমিরুল ইসলামের কথা শোনার সাথে সাথে সুফিয়া বেগম এসে আমিরুল ইসলামের পায়ে জড়িয়ে ধরল।
না তুমি এটা করবেন না, তুমি আমাকে ছাড়তে পারো না। আমি কোথায় যাব? আমার বিরুদ্ধে এগুলো সব ষড়যন্ত্র! আমাকে সন্তানহারা করো না, তুমি আমাকে ডিভোর্স দিও না।
আমিরুল ইসলাম সুফিয়াকে ধাক্কা মেরে তার পা ছাড়িয়ে নিলো।
তুই কোথায় যাবি সেটা আমি জানিনা,আমি যা বলেছি তাই হবে।
সুফিয়া বেগম তখন কেঁদে কেঁদে শাশুড়ির কাছে গেলো। মা আপনি আপনার ছেলেকে বুঝান সে নাকি আমাকে ডিভোর্স দিবে, আমার ছেলেটা ইয়াতিম হয়ে যাবে! আমি কিন্তু মরে যাবো আমার ছেলেকে ছাড়া। নয়তো পাগল হয়ে যাব।
সুফিয়া বেগমের কান্না দেখে শাশুড়ি বলল আমার এই সোনার সংসারটায় কি একটা ঝামেলা শুরু হয়ে গেল! কেন এমন হলো বুঝতে পারছি না। সুফিয়ার শাশুড়ি তুলিকে বললেন, ছেলে আমিরুলকে ডেকে আনতে।
তুলি আমিরুলের কাছে গিয়ে বলল ভাইজান খালাম্মা আপনাকে ডাকছে, এখনই আপনাকে যেতে বলছে।
আচ্ছা তুই যা মাকে বল আমি আসতেছি।
কিছুক্ষণ পর আমিরুল ইসলাম তার মায়ের কাছে আসলো, মা তুমি আমাকে ডেকেছো?
দেখ বাবা তুই নিজের চোখে কিছু দেখিস নি, আমার মনে হয় না বৌমা এমন কিছু করছে! তুই তাকে ডিভোর্স দিস না। ছেলেটাকে এই বয়সে মা হারা করিস না,বৌমা অনেক ভালো।
সে অনেক ভালো এতদিন আমার এই বিশ্বাসটা ছিল! শুধু যদি একজন মানুষ দেখতো আমি না হয় বিশ্বাস করতাম না। রফিক পরের ছেলে কিন্তু আমার ভাই বোন তারা তো আমার আপন, তারা তিনজন মিথ্যা বলতে পারেন না! আমি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাই হবে।
চলবে….
https://m.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/679307983790977/