#ভুল ৮ম পর্ব
#jannat_Nur
সুফিয়া বেগমকে মানসিক নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে যাবার পর নিজাম উদ্দিন তাকে মানসিক চিকিৎসক দেখায়। মানসিক ডাক্তার তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে রিপোর্ট দেখে বলেন সুফিয়া বেগমের স্মৃতিগুলো অনেক বছর আগে আটকে রয়েছে। সে তার অতীত থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি, খুব বড় আঘাত পাওয়ার কারণে সুফিয়া বেগমের মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ঠিকমতো চিকিৎসা করলে স্মৃতিশক্তি ফিরে আসতে পারে, সেটা অনেক সময়ের দরকার। নিরাময় কেন্দ্রে কয়েকজন নার্স আছে তারা অনেক আদর যত্ন করে রোগীদের খাবার খাওয়ায় ওষুধ খাওয়ায়। কিছুদিনের মধ্যে সুফিয়া বেগমের শারীরিক অবস্থার উন্নতি হলো। দিনের পর দিন অনাহারে না খেয়ে থেকে থেকে সুফিয়া বেগম শুকিয়ে হাড্ডিসার হয়ে গিয়েছিল। এখন ঠিক মতন খাবার খেতে পেয়ে সেবাযত্ন পেয়ে অনেকটাই সুস্থ শারীরিকভাবে! কিন্তু মানসিকভাবে আগের মতই আছে।
আমিরুল ইসলাম সিরাতকে নিয়ে ও দীপাকে নিয়ে বাংলাদেশে আসার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তার মা খুবই অসুস্থ তাই তাকে আসতেই হবে। আসার দুই দিন আগে আমিরুল ইসলামের বড় বোন রুমেলা ফোন করলো, তার মায়ের নাকি কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছে কথা বলতে পারেনা! অবস্থা খুবই খারাপ। তাই আমিরুল ইসলামকে তাড়াতাড়ি বাংলাদেশে চলে আসতে বললেন রুমেলা বেগম। তার মা হয়তো বাঁচবে না এমনটা শুনে আমিরুল ইসলামের মনটা খুব ভরাকান্ত হয়ে গেল। কেন সে আরো আগে গেল না তাহলে কি মায়ের সাথে তার আর কথা বলা হবে না। এগুলো ভাবতে ভাবতে নিজের প্রতি নিজের রাগ হচ্ছিল! কেন সে আর দুই তিন মাস আগে গেল না।
নির্দিষ্ট তারিখে আমিরুল ইসলাম বাংলাদেশে এসে পৌঁছালো! নিজের দেশে পা রেখে বুকে চিনচিন করে ব্যথা অনুভব করলো সে। ভাবছিল কিছুদিন আমেরিকায় থেকে দেশে একেবারে এসে স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে সুখের সংসার সাজাবে। সে সুযোগটা সুফিয়া বেগম তাকে দিল না, তাইতো সে প্রবাসী হয়ে ভিনদেশে পড়ে আছে। দীর্ঘ আট বছর পর নিজের বাড়িতে এসে সবাইকে কেমন অচেনা লাগছিল। এই আট বছরে এ বাড়িতে আরো কয়েকজন বাচ্চার জন্ম হয়েছে আমিরুল ইসলাম তাদেরকে দেখেনি। রুমার এক ছেলে ছিল এখন আর একটা মেয়ে হয়েছে মেয়ের বয়স ৬ বছর। আমিরুল ইসলাম ভাগ্নী অবন্তিকে কোলে তুলে নিলেন, ভাগ্নীকে কোলে নিয়ে আমিরুল ইসলাম তার মায়ের কাছে এসে দেখে তার মা প্রায় অর্ধ মৃত অবস্থায় আছে। মাকে ডাক দিল আমিরুল ইসলাম, ছেলের ডাকে মা চোখ মেলে তাকালেন! আস্তে করে হাত তুলে ছেলের গায়ে হাত বুলালো কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারলো না। তার দুই বোন এবং ভাইয়ের বউয়েরা বলল আপনার জন্য মা অনেক কান্না করেছে আপনি এতদিন না এসে খুব বড় অন্যায় করেছেন, আসলেন আর কয়েকটা দিন আগে আসলে কি হতো।
সত্যি আমিরুল ইসলামের কিছু বলার মুখ নেই সে চুপ করে আছে। মায়ের পাশে বসে অনেকক্ষণ কান্না করলো আর আফসোস করতে থাকলে কেন সে আগে আসলো না। সিরাতকে তার দাদীর কাছে নিয়ে বসানো হলো তাকে চেয়ে চেয়ে দেখছে আমিরুল ইসলামের মা, কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারছে না। আমিরুল ইসলাম বাড়িতে ফেরার দুইদিন পরেই তার মা না ফেরার দেশে চলে গেলেন। ছেলের মুখটা শেষবার দেখার জন্য হয়তো এতদিন বেঁচে ছিল।
দুই মাসের জন্য বাংলাদেশে এসেছে আমিরুল ইসলাম সিরাতকে সে সবসময় তার সঙ্গে সঙ্গে রাখে। সিরাত আমিরুল ইসলামের ভাইবোনের ছেলেমেয়েদের সাথে খেলতে বাইরে যেতে চায়। কিন্তু আমিরুল ইসলাম বলে তোমার এগুলো খেলাধুলা করে অভ্যাস নেই তুমি ব্যাথা পাবে, তুমি আমার সাথে থাকো কোথাও যাবে না। আসলে আমিরুল ইসলামের মনে ভয় যদি সুফিয়া আসে ছেলেকে নিয়ে যেতে চায়, আর যদি না হয় কেউ বলে তার মাকে এ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, জোর করে তাকে রেখে দিয়ে। তাহলে তো সিরাতের আমিরুল ইসলামের প্রতি ঘৃণা জন্ম নিতে পারে। সিরাতকে তার বাবা সবসময় বলেছে, তার মা তাকে রেখে চলে গিয়েছে। কিন্তু সিরাত এটা জানে না তাকে জোর করে রেখে তার মাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এখানে আসার পর সিরাতের ফুপি ও চাচিরা তাকে বলেছে তার মা খুব খারাপ ছিল বাজে ছিল! তাকে রেখে চলে গিয়েছে। এই শিশু বয়সে তার মাথায় এমন কুবুদ্ধি ঢুকিয়ে দিচ্ছে মায়ের প্রতি বিষিয়ে তুলতে। সিরাত ভাবতে থাকে তার মা কেন এমন ছিল, সবার মা কত ভালো নিজের সন্তানদের আদর করে অনেক ভালোবাসে। আর তাকে মাত্র তিন বছরের রেখে তার মা চলে গেল, একটু কি মায়া মহাব্বত হলো না! কেন তার মা এতটা নির্দয় নিষ্ঠুর ছিল,এগুলো ভাবে সে যখন একা থাকে।
এখানে এসে দেখে তার চাচীরা তার ফুপি কাজিনদের মুখে তুলে খাইয়ে দেয়। তারও ইচ্ছা করে মায়ের এমন ভালোবাসা পেতে, কিন্তু কারো কাছে বলতে পারেন না নিজের মধ্যেই সবকিছু লুকিয়ে রাখে সিরাত।
দেখতে দেখতে দুই মাস চলে যায়, আবার আমিরুল ইসলাম দীপাকে ও ছেলেকে নিয়ে আমেরিকা চলে যাবে। যাবার আগে আমিরুল ইসলামের তিন ভাই আমিরুল ইসলামের কাছে এসে বললেন,
ভাইয়া শহরের পাশে যে জমিটা বাবা কিনে রেখেছিল আমরা চাচ্ছি সেখানে আমাদের নতুন করে বাড়ি করতে। এখন ছেলেমেয়ে বড় হচ্ছে গ্রামের ভেতর থাকলে তাদের ভালোভাবে লেখাপড়া হবে না প্রাইভেট কোচিং পড়ার সুবিধা শহরের দিকে থাকে। আমরা চাচ্ছি সেখানে চারতলা একটা বাড়ি করতে, চার তলায় চার ভাই থাকবো।
ভাইদের কথা শুনে আমিরুল ইসলাম বললেন, আমি তো আমেরিকাতেই থাকবো! বাড়ি ফেরার কোন ইচ্ছা নাই।
আমিরুল ইসলামের ভাই রবিন বললেন, ভাইয়া তুমি এটা ঠিক বললে না, নিজের দেশ ছেড়ে তুমি পরদেশী হয়ে সারাজীবন পড়ে থাকবে? যদি তুমি অসুস্থ হও বিছানায় পড়ে থাকো তোমাকে কে দেখবে! এখানে আমরা সবাই আছি। তুমি একবার ভেবে দেখো যখন তুমি অসুস্থ হলে তখন যদি সাবের ভাইয়া না থাকতো তোমার কি হতো? সবসময় তো তিনি তোমার পাশে থাকবেন না। শেষ বয়সের কথা চিন্তা করে হলেও আর কিছুদিন থেকে দেশে ফিরে আসো। ভাবছো ছেলে বড় হলে ছেলেকে বিয়ে দিবে, ছেলের বউ তোমাকে দেখাশোনা করবে। আমেরিকার মত দেশে থেকে এটা আশা করো না, এটা আশা করলে বোকামি হবে! তোমার ছেলে বিয়ে করলে ওই দেশের কোন মেয়েকে বিয়ে করবে,আর তারা শ্বশুর শাশুড়ির সেবা যত্ন নিয়ে অনেক উদাসীন।
তার তিন ভাই মিলে এ কথাগুলো বলল আমিরুল ইসলামকে। আমিরুল ইসলাম ভেবে বললেন, হ্যাঁ এটা ঠিক বলেছিস আচ্ছা ঠিক আছে এখন কি করতে হবে বল।
ছোট ভাই সাব্বির বলল, বাড়ি করার জন্য চার ভাই সমান সমান টাকা দেবো তোমার ভাগের টাকা তুমি পাঠিয়ে দিও।
তখন রুমা বলল ভাইয়া তো আর এখানে থাকবে না, যতদিন না থাকে ভাইয়ার ফ্ল্যাটে আমরাই থাকবো।
ঠিক আছে থাকিস সমস্যা নাই, আর টাকা আমি পাঠিয়ে দেবো বাড়ি করার জন্য।
রফিক মিয়ার ছোটখাটো একটা ব্যবসা আছে, এখনো সে শ্বশুর বাড়িতেই পড়ে আছে। রফিক মিয়া মনে মনে ভাবছে ভাইয়া তো বিদেশ থেকে আর আসবেন না এত তারাতাড়ি। সে টাকা দিয়ে বাড়ি করলেও সেটা আমাদেরই হয়ে যাবে! আমেরিকা থেকে অভ্যাস বাংলাদেশে আর ফিরবে না মনে হয়। রফিক মিয়া মুখে কিছুটা হাসি লেগে আছে, তার হাসি হাসি মুখ দেখে আমিরুল ইসলাম বললেন, কি ব্যাপার তোমার মুখে হাসি? কোন খুশির খবর নাকি।
ভাইয়া আপনি কিছুদিন পর দেশে ফিরে আসেন, সিরাত বড় হলে, সিরাতকে এদেশে বিয়ে দিবেন। নিজের আত্মীয়দের মধ্যে কোন মেয়েকে ছেলের বউ করে নিবেন, তাহলে শেষ বয়সে দেখাশোনার জন্য আর চিন্তা করতে হবে না আপনার।
সেটা দেখা যাক আমার ছেলে আগে বড় হোক, পরে কি করবো না করবো পরে ভেবে দেখা যাবে! আর বিয়ে-শাদীর ভাগ্যের উপর সেটা তো আগেই নির্ধারণ করে বলা যায় না। রফিক মিয়া আমিরুল ইসলামের ছেলের বিয়ের ইঙ্গিত দেওয়ার কারণ হলো, রফিক মিয়ার ইচ্ছা মেয়ে বড় হলে তার মেয়েকে সিরাতের কাছে বিয়ে দিবে। তাহলেই তো সিরাতের বাবার এত টাকা-পয়সা তাদের থাকা খাওয়ার কোন প্রবলেম হবে না।
রফিক মিয়া লোকটা সবসময় নিজের স্বার্থের বাহিরে কিছুই ভাবে না।
আমিরুল ইসলাম চলে আসলো আমেরিকার নিউ জার্সি শহরে। কেটে গেল আরো দশ বছর, এই দশ বছরে আমিরুল ইসলাম একবার বাংলাদেশে গিয়েছিল দীপাকে নিয়ে। সিরাতের আর বাংলাদেশে যাওয়া হয়নি। দীপা এখনো আমিরুল ইসলামের সাথেই আছে, দীপার বিয়ে হয়েছে দুই বছর আগে!
সে এখন প্রেগন্যান্ট। আমিরুল ইসলামের বাসার সামনের বাসায় একজন বাংলাদেশি ড্রাইভার হিসেবে চাকরি করতো, নাম সুমন মিয়া। তার সাথে রিলেশন করে বিয়ে হয় দীপার। তাই দীপা এখন আমেরিকাতেই রয়ে গেছে, সে আমিরুল ইসলামের বাসায় থাকে। সিরাতের বয়স এখন ২১ বছর, সে ভার্সিটিতে স্টাডি করতেছে ফ্যাশন ডিজাইনের উপরে।
দীপা প্রেগনেন্ট থাকা কারণে রান্না করা ঠিকমতো করতে পারেনা! দীপার এখন সাত মাস চলে।
সিরাত ভার্সিটি থেকে ফিরে দেখে দীপার রান্না হয়নি! তাই সিরাত দীপাকে হেল্প করতে চলে আসে কিচেনে। সিরাত দীপার কাছ থেকে অনেক কিছু রান্না শিখে নিয়েছে অনেক আগেই। সিরাত বলল তুমি সবজিগুলো কেটে দাও আমি রান্না করি। সিরাতের পছন্দের খাবার সবজি আর বুটের ডাল, সেগুলো সে রান্না করছিল! তখন আমিরুল ইসলাম প্রবেশ করলো কিচেনে। আমিরুল ইসলাম বলে দুই ভাইবোন কি রান্না করা হচ্ছে?
পাপা আপুর তো এখন রান্না করতে প্রব্লেম হয়! তাই ভাবলাম আমি আপুকে হেল্প করি, সবজি রান্না করছি আর বুটের ডাল! আপু মাংস রান্না করে ফেলেছে আগেই।
সিরাতের সবচেয়ে পছন্দের খাবার হল সবজি বুটের ডাল। আমিরুল ইসলাম ছেলের কথা শুনে হেসে বললেন, ভালোই হলো এখন থেকে তোমার হাতের রান্না খাওয়া যাবে? মেয়ে নেই তো কি হয়েছে ছেলে আমার মেয়ের স্বাদ পূরণ করবে রান্না করে খাওয়াবে। বাবা ছেলের খুনসুটিতে দীপা বললো, মামা সিরাত কিন্তু আপনাকে তেমন রান্না করে খাওয়াবে না! সে রান্নাটা শিখেছে তার বউয়ের জন্য। বিয়ে করে বউকে বসিয়ে রেখে সে রান্না করবে, সিরাত আমাকে তাই বলেছিল।
আপু তুমি কিন্তু আব্বুর কাছে আমাকে বউ পাগল বানিয়ে দিচ্ছ, আমি কখন বলেছি আমি রান্না করে বউকে খাওয়াবো। আর বিয়ে তো অনেক দেরি আছে এত সহজে বিয়ে করছি না।
কেন কেন এত সহজে বিয়ে করবে না কেন, আমি আর মামা মিলে তোমাকে খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে দিবো বাংলাদেশে নিয়ে যেয়ে। সিরাত লজ্জা পেয়ে কিচেন থেকে চলে গেল।
চলবে….