#শুভ্রতায়_নবনীতা
#নবনীতা _নীরু
পর্ব ঃ ১৩
— হ্যাঁ এসো ভেতরে এসো।এখানে আসতে আবার অনুমতি নিতে হবে কেন?
— আপু সৃজা ফোন দিয়েছে,ও তোকে দেখতে আসছে তো,হাসপাতালের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে।তোরা কথা বল আমি আসছি।
— আচ্ছা ঠিক আছে যা।
— কেমন আছো বউমণি এখন?
— এখন অনেকটা ভালো।তুমি কেমন আছো?
— ভালোই তো ছিলাম তোমার এসব দেখে কি ভালো থাকা যায় বলো,তুমি ঠিক থাকলে কত আনন্দ করতাম!!
— তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাব।একাই এসেছো?
— না ভাইয়া আসছে তো,তোমার এই অবস্থা শুনে আসার জন্য কি শুরু করে দিয়েছিলো,বেচারা কেঁদেই ফেলেছিল।তুমি খুব ভাগ্যবতী গো।
— কোথায় উনি? উনাকে তো আমি এখনও দেখি নি।
— কে যেন ফোন দিয়েছে কথা বলছে বাহিরেই।চলে আসবে এখনি।
কিছুক্ষণ পর ছাব্বিশ /সাতাশ বছর বয়সের একটা ছেলে ভেতরে ঢুকলো।
কে উনি চিনতে পারলাম না কারণ আমি উনাকে আগে কখনো দেখি নি।মিখি চেয়ার থেকে উঠে তাকে বসতে বলল।তার মানে এটা আবির!গায়ে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি।
— ভাইয়া বস।(মিখি)
— কেমন আছেন আপনি?শরীর কেমন এখন আপনার?(আবির)
— আলহামদুলিল্লাহ।
— বিকেলে খেয়েছেন কিছু?
— হ্যাঁ আমার বোন খাইয়ে দিয়েছে।
— ভাইয়া তোরা কথা বল আমি একটু বাহিরে।(মিখি)
কথাটি বলেই মিখি বাহিরে চলে গেল।আমি আর উনি দুজনই বুঝতে পেরেছি মিখি আমাদের আলাদা কথা বলার জন্য চলে গেল।কিন্তু আমি আর এখন কি আলাদা কথা বলব!তুশিটা যে কোথায় গেল,তাড়াতাড়ি আসছে না কেন!!
— আচ্ছা ডাক্তার কি বলেছে আপনার সুস্থ হতে আর কতদিন লাগবে?
— ডাক্তার তো বলেছে এখানে সপ্তাহখানেক থাকলেই এনাফ।
— তাহলে একদম সুস্থ?
— আমি এখনই অনেকটা সুস্থ হয়ে গেছি,তবে পা ঠিক হতে কিছুদিন সময় লাগবে।
— শুনলাম সেদিন নাকি আমাদের বাড়িতে গেছিলেন?
— আপা?(তিশু)
— হ্যাঁ আয় এদিকে আয়,সেই কখন গেছিস বাহিরে।
— আসসালামু আলাইকুম আপু (সৃজা)
— ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কেমন আছো?
— আলহামদুলিল্লাহ আপু।আপনি কেমন আছেন?
— আলহামদুলিল্লাহ। এসো বসো…
— না আপু আপনারা কথা বলুন, আম্মু কল দিয়েছিল প্রাইভেট পড়ে এখানে আসছি।বাসায় যেতে বলছে।
— আচ্ছা ঠিক আছে যাও,সাবধানে।
— আচ্ছা আপু।
— তিশু থাক গেলাম।
— আমি ও কয়েক মিনিট পরই বের হবো,তুই যা।
সৃজা চলে গেল,আমি তিশুকে বললাম আয় আমার পাশে বস।
তিশু আমার পাশে এসে বসে পড়লো।।
— আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া কেমন আছেন?
— ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কোথায় যেন দেখেছি আপনাকে!
— কো কোথায় আবার দেখবেন রাস্তায় কোথাও হয়তো আপুর সাথে দেখেছেন বা অন্য কোথাও।
— মনে পড়ছে না।
— থাক এত কষ্ট করে মনে করতে হবে না।
— আচ্ছা ঠিক আছে।
— আপা থাক আমি বাসায় যাই এখন।
— ঠিক আছে যা, ভাল করে পড়াশোনা করে পরিক্ষা দিবি।
— আচ্ছা আপা।
তিশু ব্যাগপত্র নিয়ে বেরিয়ে গেল,আমি ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম।মেয়েটা তখন বাহিরে যাওয়ার সময়ও তো কত হাসিখুশি ছিল,বাহিরে থেকে এসে হঠাৎ কি হলো? একদম মন খারাপ।
— শুনছেন?(আবির)
— হ্যাঁ কি যেন বললেন তখন?
— শুনলাম আমাদের বাড়ি গিয়েছিলেন!
— হ্যাঁ গিয়েছিলাম সেদিন।
— বাড়ির সবাইকে কেমন লেগেছে আপনার?
— হ্যাঁ সবাই তো অনেক ভাল।
— আমার মা কিন্তু খুব ভাল মানুষ।
— আপনাদের বাড়িতে কে কে থাকে,অনেক মানুষ দেখলাম।
— থাকে অনেকেই বাবা মা,চাচা-চাচি,একটা ফুপু,সবার ছেলে মেয়ে,ছেলের বউ,দাদিমা অনেকে থাকে।
— দেখলাম সেদিন।
কিছুক্ষণ কথা চলল আমাদের মাঝে,উনার কথায় যা বুঝলাম নিতান্তই একজন ভাল মানুষ। তবে উনার বাবার বিষয়টা জানেন না।আমি সিদ্ধান্ত নিলাম বাড় ফিরলে উনাকে সব পরিস্কার করে জানাবো।যাওয়ার সময় উনি বললেন,বিশ্রাম নিন তাহলে আমি আবার আসব।ধীরপায়ে বেরিয়ে চলে গেলেন দরজা দিয়ে।
বসা থেকে একটু শুয়ে পড়লাম,কারণ অনেকক্ষণ বসে থেকে আর ভাল লাগছিল না।চোখ বন্ধ করে চোখের ওপর হাত দিয়ে শুয়ে আছি।হঠাৎ “মানি” ডাক শুনে চমকে উঠলাম।তাকিয়ে দেখি আঙ্কেল আর নুরী দাঁড়িয়ে আছে। নুরীকে দেখে আমার চোখে পানি চলে এলো।মেয়েটাকে কতদিন দেখি না।
কত কান্নাকাটি করেছে আমার জন্য।আমি উঠে বসলাম ধীরে ধীরে।
— কেমন আছো মানি?
— আমি তো ভাল আছি, আমার নীরু কেমন আছে?ঠিক মত পড়াশোনা করছে তো নাকি শুধু দুষ্টমি করে হুম?
— আমি তো আর দুষ্টমি করি না।
— আমি জানি তো,এটা আমার ভাল মেয়ে।
এই নাও তোমার জন্য চকলেট এনেছি(চকলেট বক্স এগিয়ে দিয়ে)
— আমার জন্য?দাও তাহলে।এসো তুমি আমার পাশে বসো।
— হুম খেতে হবে।
— জানিস মা তুই যেদিন এক্সিডেন্ট হোস সেদিন আমার ছেলেটার যে কি অবস্থা হয়েছিল।সেদিন আমি ও
অফিসে ছিলাম।
— আমার কিছুই মনে নেই আঙ্কেল।একটু বলেন না শুনি কে বাঁচালো আমায়?
— সেদিন অফিস দেখতে আমি ও গিয়েছি।নিহান ও ছিল আগে থেকে।হঠাৎ বাহিরে চেচামেচি শুনে অফিসের সবাই বাহিরে চলে আসি।নিহান এগিয়ে এসে দেখে তুই রাস্তায় রক্তা/ক্ত অবস্থায় পড়ে আছিস।ড্রাইভারকে তাড়াতাড়ি গাড়ি বের করতে বলে, ড্রাইভার গাড়ি বের করলে সে একা তোকে কোলে তুলে গাড়িতে উঠিয়ে হাসপাতালে রওয়ানা দেয়।আমরাও পিছন পিছন চলে আসি।ও গাড়িতে থেকেই ডাক্তারকে সবকিছু রেডি করে রাখতে বলে।
তোকে সোজা আইসিইউতে নেওয়া হয়।প্রায় দেড় ঘণ্টা ডাক্তার ভেতরে ছিল,নার্সদের দৌড়া দৌড়ি শুরু হয়ে যায়।দুজন কথা বলতে বলতে যায় তোর অবস্থা খুব খারাপ, বাঁচানো সম্ভব হবে না।কথাটি শুনে আমার ছেলের দিকে তাকাতেই দেখি রক্তা/ক্ত শার্টে ভেতরের দিকে অনাথের মত তাকিয়ে আছে,আমি সেদিন তার চোখে পানি দেখেছিলাম।আমার ছেলেটা সেদিন পাগলের মত হয়ে গিয়েছিল,তোর বাড়ির মানুষ দেখেছে।আমার ছেলের একটাই কথা যত টাকা লাগে আমি দেব,তবুও নবনীতাকে বাঁচিয়ে দিন,ওর কিছু হলে আমাএ মেয়েটা আবার মা হারা হবে,প্লিজ ওকে সুস্থ করে দিন।আমি সেদিন আমার ছেলের আহাজারি দেখেছিলাম।ডাক্তার যখন বেরিয়ে বলেছিল যা চেষ্টা করার সব করেছে এখন আল্লাহ ভরসা তখন সবাই ভেবেই নিয়েছিল তুই আর ফিরবি না।কিন্তু নিহান বারবার বলছিল ওর কিচ্ছু হবে না।তোর বাবাকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছে সেদিন।সারাদিন সারারাত নিহান দরজার বাহিরে কাটিয়েছে।সকালে জোর করে ওকে বাড়ি নিয়ে গিয়েছি।
ওর বাবার অবস্থা আর তোর অবস্থা দেখে নীরু ও কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছিল।আর ও তো ছোট মেয়ে,তোকে কত ভালোবাসে তুই তো জানিস।
আমি চুপ করে আঙ্কেলের কথা শুনছিলাম।আমার পরিবার ছাড়াও এই মানুষগুলো আমাকে এত ভালোবাসে।নীরু নাহয় আমাকে ভালোবাসে কিন্তু স্যার? স্যার কেন সেদিন কান্না করেছিল?তার মৃত স্ত্রীর মত আরেকজন দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবে শুধু মাত্র এই কারণে নাকি আমি এতদিন যা ভেবে এসেছি তাই সত্যি?স্যার কি আমাকে…….
— মা…..
— হ্যাঁ আঙ্কেল বলেন শুনছি।
— তুমি কান্না করছো কেন মানি?তুমি কাঁদবে না একদম(আমার চোখ মুছতে মুছতে নীরু কথাটি বলল)
— তুই কি পারবি না মা আমার নাতনি আর আমার ছেলেটার সাথে থাকতে?আমি বুঝতে পারি, নিহান না বললেও আমি বুঝি যে আমার ছেলেটা তোকে কী ভীষণ ভালোবাসে। আমি হয়তো একটু বেশি তাড়াতাড়ি বলে ফেললাম কথাগুলো,তোদের আরও সময় লাগতো।
— অনেক দেরি হয়ে গেছে আঙ্কেল,আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।আপনাদের আসার আগ মুহূর্তে আমার হবু বর বেরিয়ে গেল।
— তুই তোর এই বুড়ো বাবার সাথে মজা করছিস?
— না আঙ্কেল আমি মোটেও মজা করছি না।আমি সত্যি বলছি।
— তুই নীরুকে ছাড়া থাকতে পারবি মা? আর নীরুই বা কিভাবে থাকবে একটুও ভাবলি না?
আমি ভেবেছিলাম তোর বাবার সাথে কথা বলব কিন্তু আর কিছুই যেহেতু করার নেই,আর কি কথা বলব।
আমি আর আঙ্কেলকে কিছু বলতে পারি নি,কি বা বলব আমি উনাকে?আমি যে বড় স্বার্থপর হয়ে গেছি।আঙ্কেল থাকা অবস্থাতেই নিহান স্যার আসে।
— কি হয়েছে বাবা,কাঁদছো কেন?
— নবনীতাকে দেখে,কেমন হয়ে গেছে মেয়েটা।আচ্ছা তোরা কথা বল আমি আর নীরু বাহিরে,ও নাকি চিপস খাবে।আঙ্কেল আর নীরু বেরিয়ে গেলে নিহান স্যার চেয়ার নিয়ে বসেন।
— কেমন লাগছে এখন?
— আলহামদুলিল্লাহ। কেমন আছেন স্যার?
— আছি ভাল,কিন্তু অফিসে তুমি নেই তো আমার ওপর দিয়ে অনেক চাপ যাচ্ছে।তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে আমার কাজগুলো হালকা করে দাও তো।
— নবু,আবির কি এসেছিল?( মা ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে প্রশ্নটা আমার দিকে ছুড়ে দিল)
— হ্যাঁ এসেছিল।
— আবির কে?(আমার দিকে তাকিয়ে নিহান স্যার জিজ্ঞেস করলেন,আমি কি বলব ভেবে পাচ্ছি না)
— নবুর তো আবিরের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে,ও সুস্থ হলেই বিয়ের কাজ শুরু হবে।তুমি কিন্তু অবশ্যই আসবে।(মা)
— জি আন্টি অবশ্যই।
কংগ্রাচুলেশনস নবনীতা(আমার দিকে তাকিয়ে কথাটি বলল নিহান স্যার।
চলবে……..
গল্পের সাইলেন্ট পাঠকরাও আজকে বলে যাবেন কেমন লাগছে গল্পটা?