#শুভ্রতায়_নবনীতা
পর্ব ঃ ২
#নবনীতা_নীরু
গতকাল থেকে শরীরটা ভাল লাগলে আমি সকাল সকাল ছোট মায়ের থেকে ফোন ঠিক করার জন্য কিছু টাকা চাই
– আমার কাছে এখন কোন টাকা নেই।
– ছোটমা আমার ফোনটা এখন ঠিক না করলে স্কুলে যোগাযোগ করব কিভাবে বলেন?আমার তো জয়েন করা হবে না জবে।তখন আমি আপনাদের দায়িত্ব নেব কিভাবে?একটু তো বোঝার চেষ্টা করুন।
– তোর বাবার থেকে চেয়ে দেখ,আমার থেকে একদম টাকা চাইতে আসবি না,আমি তোর মা না সৎমা,সৎমা রা কখনও ভালো হয় না।
– এভাবে বলছেন কেন?আমি তো আপনাকে কখনও অসম্মান করি নি,আমার ছোটবেলায় মা মারা যায়,যখন কি না আমি নিজে হাতে ভাত খেতে পারতাম না, বাবা যখন আপনাকে এনে বলে নবু এটা তোর মা,, আমি তখন কি যে খুশি হয়েছিলাম।একদম দৌড়ে গিয়ে আপনাকে জাপটে ধরেছিলাম।ভালোই তো যাচ্ছিলো আমাদের সময় তারপর হঠাৎ কি যে হয়ে গেল……
– হয়েছে হয়েছে আর ন্যাকামি করতে হবে না,বিদেয় হ’ তো আমার চোখের সামনে থেকে,টাকা লাগবে বললি না?দাড়া এখানে…
ঘর থেকে পাঁচশ টাকার নোট এনে বলল এখন হয়েছে?যা এখন বিদেয় হ’ আমার চোখের সামনে থেকে।
আমি টাকা আর ফোন নিয়ে বাজারে ফোন ঠিক করতে বের হয়ে গেল,কারণ যোগাযোগ করতে এটাই তার একমাত্র মাধ্যম।
আমার যাওয়ার দিকে একপলকে তাকিয়ে থাকে ছোটমা।আমি সেটা বুঝতে পারি,এটাও বুঝতে পারি তিনি আমাকে একটু হলেও ভালবাসেন।কিন্তু এমন কেন করেন আমার সাথে!
ফোন ঠিক করে বাড়ি ফিরছিলাম।বাড়ি প্রায় চলেই এসেছি,সামনের গোলি পার করলেই পৌঁছে যাব।এমন সময় পাড়ার এক দাদু বলল, কি রে নবু,তোদের বাড়ির সামনে বড় মাইক্রো গাড়ি দেখলাম।কে এসেছে রে?তোদের তো এমন কোন আত্মীয় নেই,যার কি না ওত বড় গাড়ি আছে,ওত বড়লোক!!কে এসেছে রে?
আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না।হাটতে হাটতেই বললাম কি জানি দাদু,আমি তো মোবাইলটা ঠিক করতে গেছিলাম,দেখছো না এখনও বাড়িই যেতে পারলাম না,আমি তো তোমার থেকেই শুনছি।এখন দেখি গিয়ে কে এলো…..
কথা বলেই আমি আবার জোরে হাটা ধরলাম।বাড়ির আশেপাশের মানুষ নিজ নিজ বাড়ি থেকে বের হয়ে আমাদেরর বাড়ির সামনে রাখা গাড়ির দিকে তাকিয়ে কথা বলাবলি করছে।
আমি বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতেই কানে এলো,ওই তো নবু হয়তো কোন বড়লোককে ফাসিয়েছে,গরিবঘরের মেয়ে কি আর করবে?ছোটমাও তো আর দেখতে পারে না,মেয়েটা বাড়ি থেকে যেতে পারলেই বাঁচে।
আমার কথাটা খুব খারাপ লাগলো শুনতে,চরিত্র বিষয়ক কথাকে খুব ভয় পায়।
অতঃপর সবকিছু পেরিয়ে আমি নিজের বাড়িতে ঢুকলাম।বাড়িতে ঢুকতেই বাচ্চা মেয়ের জোরে চিৎকার শুনতে পেল….
– ওই যে আমার মানি এসে এসে গেছে…….
আমাকে দেখতে পেয়েই,ঘরের বারান্দা থেকে দৌঁড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো।
– তুমি অনেক পঁচা মানি…
– হ্যাঁ আমি তো অনেক পঁচাই,কিন্তু আমার নীরু বাচ্চাটা অনেক ভালো।
– হ্যাঁ, তুমি তো আমার খবরই নাও নি,জানো আমি কত কান্না করেছি,তোমার সাথে কথা বলতে ফোন দিয়েছি,কিন্তু ফোনে থাকা ওই পঁচা আন্টিটাও সবসময় বলেছে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
কথাটি বলেই নীরু কেঁদে দিল।আমি শক্ত করে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরলাম।
– আর এমন হবে না,তুমি দেখো আর কখনও এমন হবে না।এই দেখো আমার ফোন নষ্ট হয়ে গিয়েছিল,তাই তোমার সাথে কথা বলতে পারি নি,এখন থেকে আবার কথা হবে।
আমার আর নীরু দুজনের মান অভিমান ভাঙার পালা চলছে,আর এই ভালোবাসার গভীরতা আর আমাকে দেখে নীরুর দাদু খুব অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।কারণ স্কুলে নীরুকে নিয়ে গেলেও আমার সাথে কখনো উনার দেখা হয় নি।
ভদ্রলোক আমার আর নীরুর দিকে এগিয়ে গেলেন।
-তুমি…….
– জ্বী আঙ্কেল,আমি নবনীতা। আমি নীরুর টিচার ছিলাম।অন্য ভাল একটা স্কুলে জব হয়েছে জন্য ওখান থেকে চলে এসেছি।
– তুমি একদম আমার বৌমা মানে নীরুর মায়ের মত দেখতে।
আমার এই কথা শুনে মনে পড়ে,নীরু ও প্রথম দিন তাকে অবাক চোখে দেখেছিল,আর বলেছিল আমি নাকি তার মায়ের মত দেখতে।আজকে এই ভদ্রলোক ও একই কথা বলছে।ও না হয় ছোট্ট বাচ্চা,কিন্তু ইনি……
– কি জানি আঙ্কেল, আমি তো নীরুর মাকে দেখি নি।আমি ঠিক জানি না,আর চেহারায় একটু মিল থাকতেই পারে,এটা স্বাভাবিক।
পাশে দাঁড়িয়ে নীরুর ছোট মা আর বাবা ওদের কথা শুনছিল।তবে নীরুর বাবা ওদের কথাটি স্বাভাবিকভাবে নিলেন না।এগিয়ে গিয়ে ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলেন
– কি নাম ছিল আপনার বৌমার?তার বাবার নাম কি?
– রনিতা,আমার বেয়াইয়ের নাম আজগর।
বাবার এমন আগ্রহ দেখে আমি বাবার দিকে তাকিয়ে রইলাম।তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন-
– আপনার বৌমা কি অসুস্থ নাকি,আপনি বাচ্চাকে নিয়ে এসেছেন যে?
-না আসলে সে মারা গেছে গতবছর।
-নীরুর দিকে তাকাতেই বাবার চোখে পানি চলে এলো।
– এত ছোট বাচ্চা মা হারা হয়েছে!!যা নবু মা উনাদের ভেতরে নিয়ে যা বসতে দে।
-জ্বী বাবা।
– তুশির মা, আমি দোকান নাস্তা নিয়ে আসছি,তুমি কিছু বানিয়ে দাও।(বাবা)
– আচ্ছা ঠিক আছে।(মা)
– নীরুর এখন চলে যাওয়ার পালা তার মানিকে রেখে।নীরু ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আমার ভেতরটা যেন দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে নীরুর মুখ দেখে,মেয়েটার থেকে এতটা ভালোবাসা পাবে সে বুঝতেই পারি নি।
যাওয়ার সময় নীরুর দাদু আমার হাতে একটা কার্ড দিয়ে বলল,এখানে চলে এসো কালকে তোমার ব্যবস্থা আমি করে দিব।আমি চাই না নীরু তোমার থেকে দূরে থেকে মা হারানোর কষ্টটা আবার পাক,তুমি তো বোঝোই ও তোমাকে কতটা ভালোবাসে।আমি মাথা ঝাকিয়ে হ্যা বললাম।
কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়ি বের হয়ে চলে গেল।আমাদের আশপাশ ছাড়িয়ে গাড়ি আপন গতিতে এগিয়ে চলল।
রাস্তা থেকে বাড়ির ভেতরে চলে আসি।এসে বাবার গলা শুনতে পাই,বাবা ছোটমাকে বলছে
– তুশির মা,তুমি আর আমার বড় মেয়েটার সাথে খারাপ ব্যবহার করো না,ও ছোটবেলায় নিজের মাকে হারিয়েছে,আজকে যা শুনলাম তাতে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে।বাবা হয়ে মেয়ের মৃত্যুর খবর নিজে কানে শুনলাম।হাজার কিছু হয়ে গেলেও ও যে আমার মেয়ে ছিল।
– তুমিও নিজের কথায় বুঝিয়ে দাও যে আমি নবনীর মা না,সৎমা,সৎমা কখনো ভাল হয় না।তাই আমিও ভাল না।
বাবা খুব আকুতি মিনতি করে ছোটমার সাথে কথা বলছে।ছোটমার কথায় ও অভিমান রয়েছে,যার গভীরতা অনেক।
আমি তাদের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না।কিছুক্ষণ পর ছোটমার ফুপিয়ে কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম।কাঁদছে আর বলছে ওরা সবাই আমাকে মা হয়ে উঠতে দেয় নি।আমি সৎমা এটা আমার বারবার শুনতে হয়েছে,আমার কানে এখনও ভেসে আসে সবার কথাগুলো যে আমি নবনীর সৎমা,সৎমা কখনো আপন মা হতে পারে না।কিন্তু আমি তো আমার পুরোটা দিয়েই ওর মা হতে চেয়েছিলাম।আমার আর ওর মাঝে তো কোন দূরত্ব ছিল না,দূরত্ব তৈরি হয়েছে তোমার তথাকথিত আপন মানুষগুলোর জন্য।
কেমন লাগছে আপনাদের জানতে চাই!