#শুভ্রতায়_নবনীতা
পর্ব ঃ ৩
#নবনীতা_নীরু
কথা বলতে বলতে ছোটমা কান্না করে দিল।কান্না করছে আর বলছে ওরা সবাই আমার নবুকে ভালবাসতে দেয় নি।নবু আমার মেয়ে,ওর সাথে আমি যাই করি আমি ওকে ভালবাসি।আমি আমার পেটের মেয়ের চেয়ে আমি নবনীকে বেশি ভালবাসি আমি।আমাকে খারাপ বানিয়েছে মানুষের আঘাত করা কথা গুলো।ওরা সবাই আমাকে আঘাত দিয়ে দিয়ে আমার হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলেছে……………….
-বাবা গিয়ে মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে।ছোটমা কাঁদছে ঠিক আছে কিন্তু কেন জানি না আমার আজকে খুব করে মন চাইছে আমার জন্য আমার মা একটু ভালোবেসে চোখের পানি ফেলুক।আমি আমার এই মায়ের কান্না করাটা খুব বেশি পরিমাণে অনুভব করছি।
– আমার কি এখন রুমে ঢোকা ঠিক হবে!
আমার যে আজকে খুব ইচ্ছে হচ্ছে মায়ের আদর পেতে।মা কি আমায় আগের মত ভালবাসবে? আমি বাড়ির সব কাজ করব,সবকিছু তার বিনিময়ে যদি একটু ভালোবাসতো আমায়,একটু যদি ভালোবাসার চাদরে জড়িয়ে নিতো।
আমি রুমে এসে নীরুর দাদুর দেওয়া কার্ড টা দেখছি আর ভাবছি,স্কুলের জবটায় কি নিষেধ করে দিব আগেই?যদি ইনার এখানে ভাল বেতনের জব পাই তাহলে তো আলহামদুলিল্লাহ। আর যদি না পাই তাহলে আমার খুব ক্ষতি হয়ে যাবে।সংসার চালাবো কিভাবে যদি কিছু করতেই না পারি।
কিছুক্ষণ পর দরজায় নক করার শব্দ করে বাবা ভেতরে ঢুকলেন।বাবাকে দেখে আমি খুব অবাক হলাম কারণ বাবা অনেকদিন আমার ঘরে আসে না।আমি ঘুমের মত চোখ বন্ধ করে আছি,দেখতে চাইছিলাম বাবা কি করে।
বাবা এসে আমার পাশে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।আমি পাশে রাখা হাতে গরম পানি অনুভব করলাম।বাবা কিছুক্ষণ পর চলে গেল।আমি উঠে হাতের পানি নেড়ে বুঝলাম এটা বাবার চোখের পানি ছিল,কিন্তু বাবা কান্না করছেন কেন?
আর তখন বাবা কি যে বললেন বাবার কথার অর্থ বুঝতে পারি নি তখন।আসলে কি নিয়ে কথা বলছিল বাবা? আর আমার প্রতি এত ভালোবাসা কেন আবার….
সকালে ফোনটা ঠিক করে আনার সময় ভার্সিটির এক বান্ধবীর সাথে দেখা হয়েছিল সে বলল খুব তাড়াতাড়ি আমাদের পরিক্ষা।আমি অনার্স থার্ড ইয়ারে উঠব,তারই পরিক্ষা।ক্লাস করতে যাওয়া হয় না তেমন।ক্লাস না করেও ভাল রেজাল্ট হয় জন্য ডিপার্টমেন্টের সব স্যার ম্যাম ই চেনে আমাকে সাহায্য ও করে খুব।এতকিছুর মধ্যে আমার বন্ধু হয়ে ওঠে নি কেউ।কারণটা আর নাই বলি।
যাই হোক বই খুলে মাত্রই পড়তে বসেছি ওমনি ছোটমা ঘরে এলো।
-বিকেলবেলা কি পড়ার সময়?
– আ আসলে ছোট মা আমার সামনে পরিক্ষা,তাই ভাবলাম ধীরে ধীরে পড়া শুরু করি তাহলে পরিক্ষার সময় বেশি চাপ পড়বে না।
– তোকে দেখতে আসতে চাইছে,বিয়ের জন্য।
– কেন মা এখন আবার বিয়ে কেন?
ছোটমা চুপ হয়ে গেল,মনে হয় আমার মুখের মা ডাকটা তার পছন্দ হয় নি।
-ছোটমা..
– এই তোরা সবাই মিলে আমাকে খারাপ মানুষ বানিয়েছিস,সবাই কানের কাছে সবসময় তজবির মত জপতে থাকে আমি সৎমা,তোর বাবাও বলে আশে পাশের মানুষ, আত্মীয় সবাই…সবাই।
আবার এখন তুই মা বলে ডেকে আবার ছোটমা বলছিস।তোরা কি সত্যিই চাস আমি খারাপই থাকি?তাহলে এই কথাই থাক আমি সৎমা হয়েই থাকি।
কথাগুলো বলেই উনি চলে যেতে লাগলেন।আমি বসা উঠে হাতটা ধরলাম,
– আমাকে একটু ভালোবাসবেন মা?
-………..
– মা..
-………….
– আমার না অনেক ইচ্ছে করে আমার মা বাবা সবার বাবা মার মত আমাকে ভালোবাসুক।অন্য বাবা মায়ের তাদের ছেলেমেয়েদের প্রতি ভালবাসা দেখে আমার খুব কষ্ট হয়,বুকের মধ্যে চিনচিন ব্যথা করে।আমি আর ওই জায়গায় থাকতে পারি না।কেন অন্য সবার কথা কানে নিয়ে আমাকে ভালোবাসা বন্ধ করে দিলেন মা?আমি তো ছোটবেলা থেকে আপনার ভালোবাসা পেয়ে অভ্যস্ত ছিলাম তবে এখন কেন?
আপনি যখন মাঝেমাঝে আমার সামনে তুশিকে মুখে তুলে খাইয়ে দেন,জানেন তখন আমার বুক ভারি হয়ে আসে । আমি চোখে পানি নিয়ে মুখ নিচু করে খেয়ে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ি।আমার ভাগ্যটা এমন কেন?কি হতো আমার ভাগ্যে একটুখানি ভালোবাসা থাকলে….?
কথা শেষ করতেই উনি হুহু করে কেঁদে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।কোন কথাই বলতে পারছেন না,উনার কান্না শুনে তুশি দৌড়ে আমার ঘরে চলে এলো।এই মেয়েটাও আমাকে ভীষণ ভালোবাসে শুধু ছোটমার জন্য ভয় পায়।আজকে তাকেই এভাবে দেখে সে অবাক হয়ে চেয়ে রইলো।
আমি তুশির দিকে আমার আরেকটা হাত বাড়িয়ে দিতেই তুশির চোখ ছলছল হয়ে গেল,ও আসলে বুঝতে পারছে না হঠাৎ কিসের থেকে কি হয়ে গেল যে তার মা তার সৎবোনকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে।
রাতে খাওয়া দাওয়া করে আমার ঘরে এসে একটু পড়তে বসেছি,এমন সময় তুশি আমার ঘরে এলো।এসেই দরজার ওখানে দাড়িয়ে আছে।
— কি রে কিছু বলবি?
— আপা, আজকে মা তোর কাছে থাকতে বলল।
— ওমা তো দাঁড়িয়ে আছিস কেন?এসে এখানে বস।
— তুই কি পড়ছিলি?
— হ্যা রে সামনেই তো আমার পরিক্ষা।
— নিরবের কথা মনে আছে তোর?ওর কথা বলেছিলাম তোকে সেদিন?
— হ্যাঁ মনে আছে।কি হয়েছে আবার?
— আমার না ওকে ভালো লাগতে শুরু করেছে।
— পিটুনি খাবি বুঝছিস?মাত্র ইন্টারে পড়তেছিস,অনার্সে ভর্তি হবি ভাল করে পড়াশোনা করবি,মা বাবা তোর জন্য ভাল পাত্রের সাথে বিয়ে দিবে সুখে থাকতে পারবি।
–কিন্তু আপা…
–কোন কিন্তু না সোনা।তুই এখনি এসবে জড়াস না।
— আচ্ছা আপা তোর কি কাউকে ভালো লাগে নি এখনও?
— আমার মাথায় এসব আসে না রে বোন।যে বাড়িতে বাবার বয়স বেড়ে গেছে মাথার ওপর কোন বড় ভাইয়ের ছায়া নেই, বাড়িতে শুধু মা আর ছোট বোন সেই বাড়ির বড় মেয়েদের মাথায় এসব আসতে নেই।বাড়ির বড় ছেলেদের কাধে যেমন অনেক দায়িত্ব ঠিক তেমনই বাড়ির বড় মেয়েদের কাধে ও অনেক দায়িত্ব। আমার তো অনেক দায়িত্ব সংসার চালাতে হবে তোর পড়াশোনা আবার আমার পড়াশোনা চালাতে হয়।কাউকে পছন্দ বা অপছন্দ করার সময়ই তো পাই না।
–তুই আমাদের নিয়ে কত ভাবিস রে আপা! অথচ মা তোর সাথে কত বাজে ব্যবহার করে।
— এগুলো তো লোক দেখানো,মা আমাকে তোর চেয়ে বেশি ভালোবাসে তুই জানিস না।
–এটা যদি সত্যি হয় তাহলে আমার চেয়ে বেশি কেউ খুশি হবে না।আমিও তোকে ভীষণ ভালোবাসি রে আপা।
— আমি তো জানি রে বোন, আমি এই ছোট বোনটাও আমাকে খুব ভালোবাসে।
আজকে অনেক দিন পর আমি আর তুশি একসাথে ঘুমোবো রাতে।আমি ভেতরে ভেতরে আজকে অনেক খুশি।আমি আবার কাছের মানুষগুলোর থেকে ভালোবাসা পাওয়া শুরু করেছি।হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসাগুলো ফিরে পেলে আসলেই সীমাহীন আনন্দ হয়।
আমারও আজ এর ব্যতিক্রম না।দুই বোন মিলে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করলাম।কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে তুশিকে ডাকলে দেখি বেচারি আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে গেছে।কতদিন পর মেয়েটা আমার কাছে এলো আজকে।
আমিও আর দেরি না করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলাম কারণ কালকে আবার নতুন কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে।
সকালে আজকে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে তুশিকে ডাক দিয়ে তাড়াতাড়ি করে উঠে নামাজ পড়ে বাহিরে এসে দেখি মা রান্নাঘরে রান্না চাপিয়ে দিয়েছে।ভয়ে ভয়ে এক পা দু পা করে মায়ের কাছে গিয়ে ডাক দিলাম।
— মা
— হ্যা বল
–অনেক রাতে ঘুমিয়েছি তো তাই উঠতে দেরি হয়ে গেছে,আপনি উঠেন আমি বসছি।
— যা গিয়ে পড়তে বস,পরিক্ষা দুদিন পর,ভালো রেজাল্ট না করলে আবার আশেপাশের মানুষ বলবে আমি তোকে পড়তে দেই না।
— আমি রান্না শেষ করেই পড়তে বসছি।
–মুখে মুখে কথা আমার একদম পছন্দ না,আরেকজন ঘুম থেকে উঠে নি?
— ও নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়েছে।
–ওকে ডেকে তুলে দুজন পড়তে বস।দেখ ঘরে টেবিলে বিস্কুট আর কলা রাখা আছে দুজন খেয়ে নে।
— মা আমি রান্না করেই যাই।
— যেতে বলেছি নবু…
মার মুখে অনেকদিন পর নবু ডাকটা শুনলাম।মার এত গরম গরম কথার মাঝেও আমি যত্ন আর ভালবাসা দেখতে পাচ্ছিলাম।
–মা আমি তাহলে আজকে যাই নীরুর দাদু যেতে বলেছিল গতকাল।
— সেটা তুই যা ভাল মনে করিস,কর।
–আচ্ছা মা।
আমি ঘরে এসে তুশিকে ডেকে একসাথে পড়তে বসলাম।
–অনেকদিন পর আজকে মা আমাকে পড়তে বসতে বলেছে জানিস!
–তাই আমাকেও এভাবে জ্বালাচ্ছিস তুই আপা।একটু ঘুমোলে কি হতো..
— কোন ঘুমোনো নেই পড় মন দিয়ে।
দুবোন অনেকদিন পর একসাথে পড়তে শুরু করলাম।আর মায়ের কথা মনে করে মনের মধ্যে কেমন যেন আনন্দের বন্যা বয়ে যাওয়া শুরু করলো,ভালোবাসার প্রবল ঢেউয়ে আমি ভেসে চলেছি।
কেমন লাগছে জানাবেন সবাই🖤❤️