কহিনুর_দ্বিতীয়_খণ্ড,পর্ব৫০

0
676

#কহিনুর_দ্বিতীয়_খণ্ড,পর্ব৫০
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন

হঠাৎ ধুমকেতুর ন্যায় সুলতান ভিলাতে পা রেখেছে সুলতান আরমান ফারুকীর বড় মেয়ে পসরা ফারুকী। মেয়েটা দুদিন আগেও সুলতান ভিলাতে আসার নাম শুনলে ভ্রু কুটি করছিলো। অথচ আজ হঠাৎ নিজে থেকেই চলে এসেছে। জুবায়ের বোনদেরকে ভীষণ ভালোবাসে। আরমান ফারুকীর পাঁচ মেয়ের মধ্যে পসরা বেশ দাম্ভিক টাইপের মেয়ে। অধরা এতোদিন সেটাই জানতো তবে এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে। তবুও অধরা তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া করছে না। এই বাড়িতে বউয়েদের দায়িত্ব পালন নিয়ে তেমন কোনো ঝামেলা নেই। বাড়িতে বিস্তার কাজের মানুষ আছে যে যেমন পারে তেমনিভাবে হুকুম দিয়ে নিজের কাজ করিয়ে নেয়। জামসেদ অফিসের কাজকর্ম নিয়ে ভীষণ বিজি। কোনোরকমে কাজ শেষ হলেই কহিনুরের সঙ্গে দেখা করতে যাবে। মেয়েটা ভীষণ জেদি বিপদে পড়ার সম্ভাবনা আছে। মেয়টাকে নিয়ে যত চিন্তা। ও ভোরবেলা বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে ফিরবে অনেক রাতে। ঐশ্বর্য বিছানায় শুয়ে আছে। ফোসকার জন্য নড়াচড়া পযর্ন্ত করতে পারছে না। আদি ওর বিষয়ে প্রায় উদাসীন। যতটুকু দরকার ততটুকু ছাড়া বিন্দু পরিমাণ সাহায্য করছে না। কহিনুর ঐশ্বর্যের থেকে দূরে থাকতে চাইছে। সেটাই হচ্ছেনা। তবে কাজকর্মের মধ্যে ফ্রি থাকার চেষ্টা করছে। সেই সুযোগে ও কাজের মেয়েদের সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করেছে। তবে ফলাফল শূণ্য। সন্ধ্যায় সুলতান ভিলার ডাইনিং রুমে খোটখাটো একটা সভা বসলো। পসরা সবাইকে ডেকেছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলার জন্য। জুবায়ের জানতো এমনিই হবে। বোনকে ওর হাড়ে হাড়ে চেনা আছে। একে একে সবাই যখন উপস্থিত হলো পসরা বেশ আয়েশী ভঙ্গিতে পায়ের উপরে না তুলে আরমান ফারুকীর দিকে তাঁকিয়ে উচ্চারণ করলো,
> ড্যাড আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি বিয়ে করবো। জ্যাকি বেলহাম নামের একটা ছেলেকে আমি পছন্দ করি।যদিও আমাদের আলাপ খুব বেশিদিনের না। আগে ওর স্ত্রী ছিল তবে লাষ্ট ইয়ারে ডিভোর্স হয়েছে।আমার সঙ্গে ওর নাইট ক্লাবে পরিচয়। আমরা ভালো বন্ধু। তুমি অনুমতি দিলে আমি ওদেরকে আসতে বলবো।
পসরার কথা শুনে অধরা ভ্রু কুচকে ফেলল। এর আগেও পসরার বয়ফ্রেন্ড ছিল হঠাৎ আবারও একটা জুটিয়ে ফেলেছে কি সাংঘাতিক মেয়ে। কহিনুর বেশ মজা নিয়ে সবাইকে কফি বিলাচ্ছে। কথাটা ওর কানে আসতেই ঢোক গিললো। ভদ্রমহিলার বয়স প্রায় পঞ্চাশ ধরতে চলেছে তবে চেহারায় বয়সের ছাপ পড়েনি। যথেষ্ট সুন্দরী। নীরবতা কাটিয়ে আরমান ফারুকী গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলেন,
>নাম শুনেই বুঝেছি ছেলেটা খ্রিস্টান । আমি জেনে শুনে এই বিয়ের অনুমতি দিতে পারব না। প্রণয়ের আগে পরিণতি ভাবাটা তোমার উচিত ছিল।
ড্যাডের কথা শুনে পসরা তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসলো। এই বাড়ির ইতিহাস ওর অজানা নেই।তাই দাঁতে দাঁত চাপিয়ে বলল,
> অপ্রিয় কথা বলতে বাধ্য করোনা। আমি এতোটা ভালো নয় ড্যাড যে জুবায়ের আর অধরার মত এই বাড়ির অন্যায়কে মেনে নিবো। জানানোর দরকার ছিল জানিয়েছি বাকিটা আমি নিজেই বুঝে নিবো। তাছাড়া ও কোন ধর্মের অনুসারী সেটা আমি এখনো বলিনি। শুধু নাম শুনেই যদি ধর্ম বিচার করা যেতো তবে সবাই অন্ততপক্ষে নামের সঙ্গে ধর্মীয় অনুশাসনে চলাফেরা করোতো। এই ধরো সুলতান পরিবার ইসলাম ধর্মের অনুসারী অথচ তাঁরা কালো জাদুর জন্য বিখ্যাত। এখন বলো কালো জাদু তো শয়/তানের কাজ। শয়তান ঠিক কোন ধর্ম পালন করে বলে তোমার মনে হয় ড্যাড?

পসরা নিজের মতো করে উত্তর দিয়ে দিলো। এই প্রথমবার সবার সামনে কালোজাদুর বিষয়টা উচ্চারিত হলো। যদিও সবাই জানে তবে সেটা মনে মনে থাকে। কেউ কাউকে বলে না। পসরার মাথা ঠিক নেই। একটা প্রস্তাব দিয়েছে ভেবে চিন্তা করে বা কিছু জানার থাকলে জেনে তবে মতামতের আশা করেছিলো। তানা করে আরমান ফারুকী দম্ভ নিয়ে মানা করে দিলো। দাদুও ছেলের কথায় মাথা নাড়িয়ে চলেছে। দুটোই এক। জুবায়ের হঠাৎ বলে উঠলো,
> আপা ছেলেটার সঙ্গে কথা বলা যাবে? তুমি ওর তথ্য গুলো আমাকে ইমেইল করে দাও আমি দেখে নিবো। চিন্তা করো না। আমি দেখছি বিষয়টা।
পসরা ভাইয়ের দিকে তাঁকিয়ে ছলছল চোখে বলল,
> ভাই ড্যাড সব সময় আমার সঙ্গে অন্যায় করে। আমি এই বাড়িতে থাকবো না। ছেলেটা আমাকে বলেছে আমার জন্য ধর্ম পরিবর্তন করতে ওর অসুবিধা নেই তবে কিসের সমস্যা বল? আমি ওকে শেষ জীবনের সঙ্গী হিসেবে চাই।

> বললামতো আমি দেখছি। তুমি কক্ষে যাও।

জুবায়ের অধরাকে ইশারায় ডেকে নিয়ে প্রস্থান করলো। আরমান ফারুকী নিজের বাবার সঙ্গে উঠে গেলেন উপরে। দীর্ঘক্ষণব্যাপী চলবে আলোচনা। ওরা যেতেই কহিনুর রান্নাঘরে এসে হাজির হলো। ঐশ্বর্যের জন্য খাবার রেডি করতে হবে। এটা শেষ হলেই রাতের জন্য বেরিয়ে পড়বে। কথাগুলো ভেবে ও সবজি কাটতে শুরু করলো। জীবনে প্রথমবার এসব করছে। হাত ঠিকঠাক চলছে না। একটু অসাবধান হলেই অবস্থা খারাপ। হঠাৎ পেছনে থেকে ওর হাত থেকে পাথর খঞ্জ/ররা কেড়ে নিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,
> হাত কা/টাতে চাইছো নাকি? র/ক্ত ঝরলে শত্রুরা ঝাঁপিয়ে পড়বে তখন বুঝবে। যতই সবার নজর বন্ধী করো লাভ হবে না। যাইহোক এই পসরা ফারুকীর বয়ফ্রেন্ডের বিষয়টা কেমন জানি অদ্ভুত লাগছে। তোমার লাগছে না?
কহিনুর কড়াই পরিস্কার করতে করতে উত্তর দিলো,
> তাঁর আগে আমার ফুপিকে সম্মান দিয়ে ফুপি আম্মা ডাকুন মিস্টার পাথর খান। নয়তো আপনার খবর আমি তাড়াতাড়ি খারাপ করে দিবো।

কহিনুরের কথা শুনে পাথর হাসলো। বিষয়টা খেয়াল ছিল না। তাই মিনমিনে কন্ঠে বলল,

> আচ্ছা ফুপি বলবো তবে এবার বলো হঠাৎ এই বয়সে উনার এমন মতিভ্রম কেনো হলো? রহস্য আছে নাকি?
কহিনুর কোমরে হাত দিয়ে চোখ রাঙিয়ে বলল,
> বিয়ে করা খারাপ নাকি?। বয়স হয়েছে বলে নিজের পছন্দে বিয়ে করতে পারবে না কে বলেছে? বিয়ে করছে করতে দিন। রাত কিন্তু হয়ে গেছে। তৈরী হয়ে থাকুন। রাত আসলেই এখানে ঝামেলা শুরু হয়।
> যাইহোক সাঈদ কোথায়? ওকে তো দেখলাম না?
> খোঁজ করুণ পেয়ে যাবেন। বেচারা আমার কক্ষে হাড্ডি চিবাচ্ছে। দুদিন ধরে অভুক্ত। এই বাড়িতে অদৃশ্য অনেক কিছুই আছে। ওর ধরা পড়ার ভয় আছে।
কহিনুরের উত্তর শুনে পাথর থমকে গেলো। এমনিতেই সাঈদকে ওর পছন্দ না। এখন শুনছে ছেলেটা নাকি কহিনুরের কক্ষে ঘাপটি মেরে পড়ে আছে। যেখানে নিজের বিবাহিত বউয়ের হাত ধরতে হলেও লুকিয়ে ধরতে হয় সেখানে সাঈদ একেবারে ঘরে? ওর শান্ত মেজাজ গরম হয়ে উঠলো। ভ্রু কুটি করে উত্তর দিলো,
> ওই বে/য়াদব তোমার কক্ষে কি করে আসলো? ওকে এখুনি গিয়ে বলো বেরিয়ে আসতে। আর তুমি ছেলেদের সঙ্গে রুম শেয়ার করছো, মানা করেছিলাম না?
কহিনুর ওর কথার পাত্তা দিলো না। রান্না বসিয়ে দিতে দিতে উত্তর দিলো,
> গতকাল মুখের অবস্থা খারাপ ছিলো। ও ওষুধ এনেছিলো আমার জন্য। তাছাড়া ও কখনও আমার বিছানার আশেপাশেও থাকে না। জানালায় বসে থাকে। ওয়াশরুমে থাকে। বুঝলাম না এতে আপনার কি অসুবিধা। ওর জন্য আমি সতর্ক থাকতে পারি। আমাকে ও পাহারা দিয়ে রাখে। আমার মধ্যে যে কহিনুর শক্তির উৎস আছে সেটার রক্ষক ও। যতক্ষণ এটা আমার মধ্যে আছে ততক্ষণ ও আমার সঙ্গেই থাকবে।
কহিনুরের কথা শুনে পাথর ভ্রু কুচকে ফেলল। এই কথাটা ওর জানা ছিলো না। তাই প্রশ্ন করলো,
> কহিনুরের রক্ষক?
> আপনি এতোদিনেও বুঝতে পারেননি? সাঈদকে এক মূহুর্ত্তের জন্যও কি আমার থেকে দূরে থাকতে দেখেছেন? ওর বাবা সঠিক দায়িত্ব পালন করতে পারেনি কিন্তু ও ঠিক পারবে। ও বাবা চেয়েছিলো কহিনুর যেনো হস্তান্তর না হয়। পর্যায়ক্রমে কহিনুরের রক্ষা করার দায়িত্ব ওদের পরিবারের উপরে পড়বে। জানিনা হাকিম সাহেব কেনো আমাকে এটা লুকিয়ে গেলেন। আমি ঠিক উত্তর খুঁজে নিবো।
কহিনুর ফিসফিস করে কথা বলছে। আশেপাশে যদিও কেউ নেই তবুও সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরি ছিল। পাথর বুঝতে পারলো বিষয়টা তাই কথা না বাড়িয়ে শুধু বলল,
> ওর বাবা বেই/মানি করেছিলো এসব জ্বীনদের প্রতি বিশ্বাস রেখোনা।ওর থেকে দূরুত্ব মেনে চলবে। নূর তোমাকে নিয়ে আমি ভীষণ চিন্তিত। জেলাসি থেকে এমন করছি সেটা না।আমি তোমার এতোটা কাছাকাছি কেনো এসেছি এটা এখন বলতে পারছি না। জেনে রেখো আমি ভাগ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করছি জানিনা আমার নিয়তিতে কি লেখা আছে। সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো সফল হতে।
কহিনুর উত্তর দিলো না। পাথর কেনো ভয় পাচ্ছে ওর জানা আছে তাই খাবার নিয়ে বেরিয়ে আসলো। পাথর সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মেয়েটাকে ইচ্ছে করে বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে। যাতে পৃথিবীর কোনো খারাপ শক্তি ওকে খুঁজে না পাই।
***********
গভীর রাত সুলতান ভিলার সামনে গতদিনের মতো আবারও সেই কুকুর ছানার দেখা মিললো। তবে আজ যেনো এই অবলা প্রাণীটা খানিক ভয়/ঙ্কর হয়ে উঠেছে। গার্ডদের উপরে হামলে পড়ছে। ওরা ভয়ে গেট বন্ধ করে ভেতরে এসে দাঁড়িয়ে আছে। কুকুরের আওয়াজে শব্দ দূষণ হচ্ছে অথচ কেউ গুরুত্ব দিচ্ছে না বিষয়টা তেমন না। এই আওয়াজ সুলতান ভিলা ছাড়া কেউ হয়তো শুনছে না। আকাশে চাঁদ নেই রাস্তার পাশের ল্যাম্পপোষ্টের আলোটা কেমন নিভুনিভু করছে। মনে হচ্ছে কখন নিভে যাবে। জার্মানির মতো এমন একটা রাষ্ট্রের জন্য সত্যি এটা দুঃখজনক তবে আদো ঘটনা তেমন না। নিয়ম করে এখানকার আলো মাঝেমাঝেই বন্ধ থাকে যতই ভালো সার্ভিসের ব্যবস্থা করা হোকনা কেনো। তাই আপাতত হাল ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কুকুরটা যখন ঘেউ ঘেউ শব্দ করে গেটের দিকে তেঁড়ে আসছিলো ঠিক তখনই একজন হুড়ি পড়া লোক এগিয়ে আসলো। ওর হাতে ঝকঝকে লম্বা তলো/য়ার টাইপের খ/ঞ্জর। কিছু বুঝে উপার আগেই কুকুরের শরীরটা দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেলো। লোকটা এক কো/পে কুকুরের শরীর থেকে মা/থা আলাদা করে ফেলল। টাটকা লাল উষ্ণ তরল চার‍দিকে ছিটিয়ে পড়লো। কুকুরের শরীরটা রাস্তার উপরে লাফাতে লাফাতে অদৃশ্য হয়ে গেলো। এখনও রাস্তার উপরে টকটকে লাল র/ক্ত পড়ে আছে। সাধারণ মানুষ সেই দৃশ্য দেখলে নির্ঘাত উন্মাদ হয়ে যেতো। লোকটা খঞ্জ/রের দিকে তাঁকিয়ে হালকা ঝাড়া দিলো যাতে র/ক্ত ছাড়িয়ে যায়। তারপর টুপ করে দেয়াল টপকে পেছনের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো। সঙ্গে চারদিকে নির্জনতা ছেয়ে গেলো পূর্বের মতো।
***********
চুপচাপ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে কহিনুর। উপর থেকে ঠকঠক আওয়াজ আসছে। মনে হচ্ছে বারান্দা ধরে কেউ হাটছে। সিঁড়ির সঙ্গে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হছে। অন্ধকারে তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না তবুও ভয় করছে যেকোনো সময় লাইট জ্বলে উঠতে পারে। পাথর স্টোর রুমে আছে। সেখানে কি একটা দেখেছে তাই নিয়ে রিসার্চ শুরু করেছে। কহিনুর বিরক্ত হলো তবুও কিছু করার নেই। ও উপরের দিকে তাঁকিয়ে হঠাৎ চমকে উঠলো। আবছা আলোতে সাদা পাঞ্জাবী পরা দাদুকে ওর চিনতে অসুবিধা হলো না। লোকটা ঠুকঠাক করে লাঠিতে ভর দিয়ে ঐশ্বর্যের কক্ষের সামনে গিয়ে থামলো। তারপর মৃদু আওয়াজ করে দরজা খুঁলে গেলো। দাদু ভেতরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। কহিনুর চোখ বড়বড় করে দেখলো। ওর জানা মতে দাদু ঐশ্বর্যকে পছন্দ করে না তবে আজ কি দেখলো ও? যেনো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। মনে হলো সব ভুল ছিল তাই দ্রুতগতিতে আগে দাদুর কক্ষের সামনে আসলো। উঁকিঝুঁকি দিতেই ঘুমন্ত দাদুকে দেখে ওর ভ্রু কুচকে গেলো। কি হলো বিষয়টা মাথায় ঢুকলো না। কিছুক্ষণ আগে যেটা দেখলো সেটা কি চোখের ভুল ছিল নাকি সত্যিই? এবার ঐশ্বর্যের কক্ষটা চেক করার পালা। কথাটা ভেবে ও আনমনে হাটার সময় হঠাৎ একটা দরজার সামনে থেকে ওকে হ্যাচকা টান দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে নিলো একটা কোমল হাত। কহিনুর চোখ বন্ধ করে ফেলল ভয়ে। তারপর পিটপিট করে সামনে তাঁকিয়ে ভড়কে গেলো। জুবায়ের আর অধরা ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে। অধরা হাতের মুঠো শক্ত করে ওর গালে থা/প্পড় দিতে গেলো কিন্তু পারলো না। জুবায়ের দ্রুত গিয়ে কহিনুরকে সরিয়ে নিলো। কহিনুর জুবায়েরের বুকের সঙ্গে লেপ্টে আছে। অধরা রাগে কাঁপছে। জুবায়ের কহিনুরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
> কাজটা তুমি ঠিক করোনি নূর। একবার বলতে তাহলে আর এসব করতে হতো না। তোমার মা কিন্তু ভীষণ রেগে আছে।
কহিনুর বাবার কথা শুনে ভ্রু কুচকে ফেলল। ভালো করে মনে আছে সুগন্ধি ব্যবহার করেছিলো তবে কি সেটা কাজ করেনি? বাবা মা ওকে চিনলো কিভাবে তবে? কথাটা ভেবেই ও ঢোক গিললো। মিনমনে কণ্ঠে বলল,
> ঠিক বুঝতে পারলাম না। ম্যাম আমাকে ভুল বুঝেছে বাবা।
কহিনুরের এমন উত্তর শুনে অধরা জুবায়েরের থেকে ওকে টেনে সরিয়ে নিয়ে মিররের সামনে দাঁড় করিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
> তুমি আমার মেয়ে নাকি আমি তোমার মেয়ে কোনটা? হঠাৎ চেহারা পরিবর্তন করলেই আমি চিনতে পারবো না? এই দুহাতে তোমাকে আমি মানুষ করেছি নূর। একদম আমার থেকে লুকানোর চেষ্টা করবে না। আমার মেয়ে আমার চোখের সামনে অন্য পরিচয় দিয়ে ঘুরছে সেটা আমি দেখছি কি কপাল আমার। এখন তোমাকে টেনে না আনলে তো জানতেই পারতাম না।

কহিনুর চোখ বন্ধ করে হাতের মুঠো শক্ত করে ফেলল। সামনে যে মিরর আছে এটা খেয়াল ছিল না। মায়ের বুদ্ধি যে তুখোড় সেটা ওর ভালো করে জানা আছে। কিন্তু এখন তো তর্কবিতর্কের সময় না। তাই নিজেকে সামলে নিয়ে উত্তর দিলো,

> এই বাড়ির রহস্য জানতে হলে এখানে আসাটা আমার দরকার ছিল। আমি চাইছি না এই বাড়াতে কেউ আমাকে চিনুক। আশাকরি তোমরা সেটা বুঝতে পারবে। বাবা তুমি তো পারো মাকে বোঝাতে? প্রমিজ করছি খুব তাড়াতাড়ি সবটা সামনে আসবে।

জুবায়ের কিছু একটা ভেবে প্রশ্ন করলো,
> তোমার আরেকজন দোসর স্টোর রুমে তদন্তে লিপ্ত ওটাকে কোথা থেকে ধরে এনোছো। কিছুক্ষণ আগে আমি আর তোমার মম গিয়েছিলাম। ওখানে গিয়ে দুজন হতভম্ব। ওকে বুঝতে না দিয়ে চলে এসেছি। ভেবেছিলাম ওর উপরে নজর রাখবো। তোমার মম তো পারলে মাথায় বা/ড়ি দিয়ে দিতো।
কহিনুর বাবা মায়ের কথা শুনে চমকে উঠলো। কি সাংঘাতিক পরিকল্পনা। শাশুড়ির হাতে জামাই খু/ন হয়ে যেতো। ভাবা যাচ্ছে না। কথাটা ভেবেই ও ঝটপট উত্তর দিলো,
> সর্বনাশ হতে গিয়েও হয়নি বাবা। ওটা তোমার জামাই ছিলো। বেচারা আমাকে সাহায্য করতে এসেছে। ওর মনে হয়েছে স্টোর রুমে কিছু আছে। সেটাই খোঁজ করছে।
কহিনুরের কথা শুনে জুবায়ের শব্দ করে হেসে ফেলল। অধরা কিছুটা নরম হয়েছে। এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ছলছল চোখে বলে উঠলো,
> কতদিন পরে তোমাকে কাছে পেলাম বলোতো? এখন থেকে আমার কাছাকাছি থাকবে। বাড়িতে জামাই আছে অথচ তাঁর সেবাযত্ন করতে পারলাম না।
> বেশি ভক্তির দরকার নেই। আপাতত যেমন চলছে সব তেমনি চলতে দাও। শুধুমাত্র আমার জন্য আলাদা কক্ষের ব্যবস্থা করে দাও প্লিজ। সাঈদ ভয়ে লুকিয়ে আছে। ওর কষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া আমি যখন তখন বাইরে আসছি তোমাদের কাজের মেয়েগুলো বড্ড চালাক। গতকাল প্রায় ধরে ফেলেছিলো।
জুবায়ের ভ্রু কুচকে বলল,
> এই বাড়িটা তোমার জন্মের আগেই আমি তোমার নামে লিখে দিয়েছি নূর। মালকিন হয়ে সামান্য একটা কক্ষের জন্য অনুরোধ করছো কেনো? যেটা পছন্দ ঢুকে পড়ো তোমার ড্যাড আছে না? সব সামলাতে পারবে।
জুবায়েরের কথা শুনে কহিনুর হেসে ফেলল। বাবার সম্পর্কে ওর ধারণা আছে। তাই উত্তর দিলো,
> আমি এখানে মেয়ে বা মালকিন হয়ে না কাজের মেয়ে হয়ে এসেছি।তোমাদের অতিরিক্ত মমতা আমার কাজে বাঁধা হয়ে আসবে ভেবেই পরিচয় লুকিয়েছি। আমার উপর দিয়ে ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেলেও তোমার চুপচাপ থাকবে। আপাতত এখন আসছি। আমার কাজ আছে।
কহিনুর আর অপেক্ষা করলো না। দ্রুতগতিয়ে বেরিয়ে আসলো। ওকে এগিয়ে যেতে দেখে দক্ষিণের বারান্দা থেকে পাথর প্রায় দৌড়ে এসে ওর হাত ধরে ফিসফিস করে বলল,
> এতোক্ষন লাগে আসতে? দাদু আর ঐশ্বর্য জঙ্গলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ওদেরকে ফলো করতে হবে।
পাথর উত্তরের আশা করলো না। ওকে প্রায় টানতে টানতে এগিয়ে গেলো। বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়াতে গিয়ে পাথরের হাতপা কম্পিত হলো। হঠাৎ ও থমকে গেলো। অসহনীয় যন্ত্রণাতে কুঁকড়ে উঠলো। পিঠের হাড় ভেদ করে সেখানে পাখা গজাতে শুরু করলো। পায়ের নক ক্রমশ বৃদ্ধি হয়ে লম্বা পশম দেখা গেলো। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ও সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে অর্ধমানবে রূপে নিলো। পাশে কহিনুর চোখ বড়বড় করে দেখলো সবাটা। চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো পাথরের এই অ/ভিশপ্ত জীবন দেখে। পাথর ঝট করে ওকে কোলে তুলে নিয়ে জঙ্গলের রাস্তার দিকে ছুটলো। আঁকাবাঁকা গাছের সারি ভেদ করে ওর চলতে বেশ কষ্ট হচ্ছে তাই কিছুটা উপরের দিকে উঠে গেলো। দাদু ততক্ষনে মাঝ অরণ্যে পৌঁছে গেছে। পাথর ওকে সেখানেই নামিয়ে দিলো। ওর চেহারা আবারও স্বাভাবিক হয়ে গেলো। ওদের থেকে কিছুটা দূরে চকচকে খ/ঞ্জর হাতে ঐশ্বর্য দাঁড়িয়ে আছে। ওর সামনে নত মস্তকে এক যুবতী বসে আছে। কিছু বুঝে উঠার আগেই ঐশ্বর্য মেয়েটার গ/লাতে খ/ঞ্জর চালিয়ে দিলো। ছট/ফট করতে করতে মেয়েটার শরীর শান্ত হয়ে গেলো। পাথর বাঁকা হেসে বলল,
> ঐশ্বর্যের বিষয়ে কতটুকু জানো?
কহিনুর মাথা নাড়িয়ে বলল,
> কিছুই জানিনা। মেয়েটা আমাকে একদিন দুটো থাপ্পড় দিয়েছিলো। কিন্তু হঠাৎ আজ এই রূপ?
পাথর ঝটকরে কহিনুরের ডান গালে ওষ্ঠ রেখে বলল,
> ওর গালটাই তো থাকবে না। নয়তো থা/প্পড়টা ফিরিয়ে দিতে পারতে। এই দাদুর সঙ্গে ঐশ্বর্যের একটা সম্পর্ক আছে বুঝলে? আমার মন বলছে তোমার বাবাকে ঠকানো হয়েছে। যাইহোক এখন ফিরে চলো। এখানে এখন মহা ভোজ চলবে সেটা দেখাটা তোমার ঠিক হবে না।
কহিনুর মাথা নাড়িয়ে চুপচাপ বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। এই ঐশ্বর্যের মধ্যে আবার কি রহস্য আছে কে জানে? বাবাকে দুঃখ দিতে ওর ইচ্ছা করছে না। মনে মনে দোয়া করলো ঐশ্বর্যের মধ্যে যেনো বড়সড় কোন রহস্য না থাকে। প্রশ্ন কি রহস্য লুকিয়ে আছে ঐশ্বর্যের মধ্যে? তাঁর সঙ্গেই বা কহিনুরের কি সম্পর্ক?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here