কহিনুর_দ্বিতীয়_খণ্ড,পর্ব:৫২

0
437

#কহিনুর_দ্বিতীয়_খণ্ড,পর্ব:৫২
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন

বারবার ফোন দিয়েও যখন জ্যাকির ফোন বন্ধ পেলো তখন পসরা ফারুকী অস্থির হয়ে উঠলো। সারারাত ঘুম হয়নি। লোকটা ঠিক আছে কি জানাটা খুব দরকার। কিন্তু কিভাবে জানবে? জ্যাকির বিষয়ে ওর তেমন কিছু জানা নেই। লোকটা একা মানুষ। বাচ্চা হয়না তাই স্ত্রী ওকে দোষারোপ করে ছেড়ে চলে গেছে। এমন ভালো একটা মানুষকে কিভাবে সেই মহিলা ছেড়ে চলে গেলো পসরার মাথাতে আসে না। যোগ্যতার চাইতে মানুষ যখন বেশি কিছু পেয়ে যায় তখন এমনিই হয়। কথাটা ভেবে ও দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ল্যাপটপের দিকে নজর দিলো। ভাইকে ইমেইল করা হয়নি। কথাটা ভেবে ও যখন ফোন হাতে করলো ঠিক তখনই অচেনা নাম্বার থেকে বেশ কিছু পিকচার আসলো। পসরা তাঁতে ক্লিক করে ভ্রু কুচকে ফেলল। শরীর মৃদু কাঁপছে। হাতের তালু ঘামতে শুরু করেছে।ভাজ করা কপালে বিন্দু বিন্দু পানির কণা জমা হচ্ছে। মনে হলো ও কিছুক্ষণের মধ্যে জ্ঞান হারাবে। চোখের সামনে জ্যাকির সঙ্গে কয়েকটা মেয়ের অন্তরঙ্গ পিকচার জ্বলজ্বল করছে।রেস্টুরেন্টে হোটেল আর বারের ছবিও আছে। জ্যাকি ওকে মিথ্যা বলেছে। পসরার চোখে পানি চলে আসলো।ছবি গুলোর নিচে ছোট্ট একটা টেক্সট,
নরপ/শুদের জাত ধর্ম হয়না। শয়/তানের কাজ মানুষ ঠকানো তাই ওদের জন্য অশ্রু ঝরানোর মতো বোকামি করোনা। খান পরিবারের জ/ঘণ্য একজন সদস্যদের থেকে এর চাইতে ভালো ব্যবহার আশা করা যায় না।ও তোমাকে ব্যবহার করে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করতে চাইছিলো। যাইহোক ওকে আর খোঁজ করোনা। কাউকে অবলম্বন করে বাঁচার চাইলে নিজের মতো বাঁচো। দোয়া করি আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুন। ভালো থেকো। আর মুক্তার মতো অশ্রুকণা কোনো ভুল মানুষের জন্য ঝরিও না।

টেক্সট পড়ে অজান্তেই পসরার চোখ থেকে আবারও কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। যখনই কাউকে ও নিজের জীবনে চেয়েছে তখনই এরকমটা হয়েছে। বহুকাল আগে একজনকে ভালোবেসেছিলো সে ওকে ঠকিয়ে মিথ্যা বলে পালিয়ে গিয়েছিলো। যখন ফিরলো তখন তাঁকে ক্ষমা করা যায়না। পসরা কথাটা ভেবে ছবিগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখে নিলো। তারপর সোসাল সাইট থেকে জ্যাকির আইডিতে ব্লক দিয়ে ছবিগুলো ডিলিট করলো। মানুষটাকে ভুলতে ওর কষ্ট হবে কিন্তু সুলতানা পসরা ফারুকী কোনো বেইমানদের মনে রাখে না। ভেঙে পড়া সুলতান পরিবারের সদস্যের র/ক্তে নেই। কারো সামনে নিজেকে ছোট করার কোনো মানে হয়না। কথাগুলো ভেবে নিজেকে শক্ত করেও আবার শব্দ করে কেঁদে ফেলল। ঐশ্বর্যের চিৎকার চেচামেচি থেমে গেছে তবে এখনো ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। জুবায়ের অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে দরজা খুঁলে ভেতরে প্রবেশ করেও তেমন কিছু করতে পারেনি। ডাক্তার এসেছিলো ওষুধ দিয়েছে। ফোসকা কমে গেছে। যেভাবে পুড়েছিলো অন্ততপক্ষে মাস ছয়েক বিছানায় থাকার কথা ছিল। ডাক্তার নিজের ক্রেডিট নিজেই দিলেন। বেশ ভাব নিয়ে বলে গেলেন উনার ওষুধের গুণে এই চমৎকারটা হয়েছে। অধরা জুবায়েরের সঙ্গে মিলে চেষ্টা করছে ঐশ্বর্যের কান্না বন্ধ করার জন্য। অদি প্রচণ্ড বিরক্ত। কহিনুর নিজের কক্ষে বসে আছে সাঈদের সঙ্গে। পাথর দাদুর কক্ষের বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিমুচ্ছে। বোঝানোর চেষ্টা করছে ও বড্ড ইনোসেন্ট। কহিনুরের কক্ষ থেকে ফিরে নিজেকে বুঝিয়ে নিয়েছে। দুমদাম খু/ন আরও হবে। নিজেকে তৈরী করতে হবে। না হলে দুঃখের শেষ থাকবে না। ঐশ্বর্যের মায়ের সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়নি। কহিনুর ইচ্ছে করে ওকে বলছে না। পাথর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাবার সঙ্গে দেখা করবে। সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। চোখ বন্ধ করে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হলো ওর সামনে কেউ দাঁড়িয়ে ওকে পর্যবেক্ষণ করছে। পাথর কৌশলে এক চক্ষু মেলতেই জুবায়েরেরকে দেখে থতমত খেয়ে গেলো। শশুর মশাই ওকে গভীরভাবে দেখছে কি সাংঘাতিক ব্যাপার। কিন্তু এভাবে দেখার কি মানে? ওকে চেনা যাচ্ছে না এটা সিউর, তবে? পাথরের ধ্যান ভাঙলো জুবায়ের গুরু গম্ভীর আওয়াজ শুনে।,

> রাতে চু/রি করতে যাও যে দিনের বেলা ঘোড়ার মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমাও? এভাবে এসেছো সুলতান বাড়িতে কাজ করতে? যা পারোনা তাই নিয়ে নাচানাচি করো। মনে রেখো সবার দিয়ে সব কাজ হয়না। গাধা আর শেয়ালের মধ্যে পার্থক্য জানো?
পাথর ভ্রু কুচকে ফেলল শশুরের কথা শুনে। এই ভদ্রলোক ওকে চিনতে পেরে ইচ্ছা করে অপমান করছে নাকি না চিনে করছে কে জানে। তবে ওর গায়ে বড্ড লেগেছে। বউয়ের থেকে এই ভদ্রলোকের জন্যই ওকে দূরে থাকতে হয়েছিলো। হিটলারের মতো খতরনাক বুদ্ধি। কথাটা ভেবে ও মিনমিনে কণ্ঠে উত্তর দিলো,
> শেয়ালের এতো বুদ্ধি থেকে কি হবে? সেটাতো আর মানব সভ্যতার কাজে আসেনা। গাধা নির্বোধ প্রাণি সহজ সরল কিন্তু বড্ড কাজের। মানুষের দরকারে গাধাকেই লাগে শেয়ালকে না।

পাথর উপযুক্ত একটা জবাব দিতে পেরে শান্তি পেলো কিন্তু জুবায়ের পেলো না। এই ছেলেটার সঙ্গে ওর পূর্বে আলাদা কথাবার্তা হয়নি অথচ মেয়ের জামাই করতে হয়েছে। জুবায়েরের মনে হয় বুদ্ধি জ্ঞান আর মেধাতে বাঙালীদের জুড়ি মেলা ভার। সেখানে পাথর সম্পূর্ণ বিদেশি। বাবা মা চৌদ্দ পুরুষের মধ্যে কেউ বাঙ্গালী নেই। শুধু পালিত বাঙ্গালী বাবার কাছে লালন পালনের জন্য বাংলা বলতে পারে এই যা। নীরবতা ভেঙে জুবায়ের বলে উঠলো,
> গাধার মতো খাটুনি আপাতত আমাদের লাগবে না। কক্ষে গিয়ে বিশ্রাম করো। আর আলখেল্লা টাইপ কি সব পরে থাকো?এখনকার কাজের মানুষগুলো এতোটাও দীনহীন চলাচল করে না। যথেষ্ট স্মার্ট। তুমি সত্যিই গাধা কোনো সন্দেহ নেই। অতিরিক্ত রঞ্জিত পোশাক পরতে গিয়ে মনে হচ্ছে তুমি পুরোই ফেইক। ঘাবলা আছে। কেমন সন্দেহ হচ্ছে। চেহারায় কেমন ছিনতা/ইকারীর ভাব আছে। বখাটে টাইপ আর কি।

জুবায়েরের কথা শুনে পাথরের মুখটা চুপসে গেলো। এতো বড় অপমান? শশুর হয়ে কোথায় জামাইকে আদর যত্ন করবে। মেয়ের সুখ কামনা করবে তানা ওকে কতকিছু বানিয়ে দিলো। এখন শেষমেশ ছিনতা/ইকারী? পাথরের থমথমে মুখটা দেখে জুবায়েরের বেশ মজা লাগলো। কোনোরকমে হাসি চাপিয়ে সরে পড়লো। জামাইকে জব্দ করতে পেরে শান্তি লাগছে। কোনোরকমে কক্ষে এসে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লো। অধরা ফোন চেক করছিলো হঠাৎ জুবায়েরের হাসি দেখে ও থেমে গেলো। ভ্রু কুচকে বলল,
> এই কিছুক্ষণ পূর্বে না আপনার মন খারাপ ছিলো? হাসির মতো কি করেছেন আবার?

জুবায়ের হাসি থামানোর যথাযথ চেষ্টা করলো কিন্তু হলো না। হাসতে হাসতেই উত্তর দিলো,
> বাগে পেয়ে জামাইকে ইচ্ছে মতো বোকা বানিয়ে এসেছি। জাষ্ট মুখটা একবার দেখতে। বিলাতি বিলায়ের মতো ছলছল নয়নে হাসি মাখা বদনে আমার দিকে চেয়ে ছিলো। এই গাধা কিছুতেই আমার মেয়ের উপযুক্ত না। আমরা হচ্ছি বাঙ্গালী, আমাদের কর্মঠ শরীর আর হাতের পেশিতন্তুে আলাদা একটা সৌন্দর্য ফুটে থাকে।

জুবায়েরের কথাশুনে অধরা চরম বিরক্ত হলো। এই লোকটার নিজের ঘটে কোনো বুদ্ধি নেই গেছে আরেকজনের বুদ্ধি পরিক্ষা করতে কেমন লাগে? তাছাড়া জামাই শশুরের সম্পর্ক কি মজা করার মতো? ছেলেটা কি ভাবছে কে জানে। কথাগুলো ভেবে ও বিরক্তি মাখা কণ্ঠে উত্তর দিলো,

> আপনি কিন্তু একদম ঠিক করছেন না। ছেলেটা ইচ্ছে করে এখানে আসেনি। আপনার মেয়েকে সাহায্যে করতে নিজের কাজকর্ম ছেড়ে কাজের ছেলে সেজে পড়ে আছে। কি দরকার ওকে অপমান করা? আমার মনে হচ্ছে আপনি ওর উপরে নিজের ব্যক্তিগত প্রতি/শোধ নিতে এসব করছেন। মেয়ে কিন্তু ওই ছেলের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। ডিভোর্স নিয়ে ভাবতে যাবেন না।

অধরা বেশ শক্ত কণ্ঠেই বলল। জুবায়েরের বুদ্ধি সম্পর্কে ওর ধারণা আছে। এরকমটা ভাবতেই পারে। ওকে দিয়ে এসব খুব ভালো হয়। ওকে রাগ করতে দেখে জুবায়ের বিছানা থেকে নেমে এসে অধরার কোলের উপরে শুয়েপড়লো। তারপর ওর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
> আমাকে তোমার কি মনে হয়? এতটা জঘ/ণ্য যে মেয়ের ডিভোর্স করিয়ে দিবো। নিয়তিতে বিশ্বাসী আমি। কোন পরিস্থিতিতে এসব হচ্ছে জানা আছে। কহিনুরের উপরে আমার ভরসা আছে। তুমি আজও আমাকে বিশ্বাস করতে পারলে না। ম/রে গেলেও এই আফসোসটা আমার রয়ে যাবে। প্রিয়জনের বিশ্বাসটুকু নিয়ে কব/রে যেতে পারবো না। আমি এমনিতেও পাপি। জান্নতের আশা করা আমার শোভা পাইনা তবুও করি। মানুষের মন তো তাই।
জুবায়েরের বেশ আফসোস নিয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে কথাগুলো বলল। ওকে আবারও দুঃখ দিয়ে ফেলেছে বুঝতে পেরে অধরা ভড়কে গিয়ে কেঁদে ফেলল। অতীত কেনো পিছু ছাড়ে না কে জানে। কতবার মনকে শাসন করেছে বুঝিয়েছে তবুও খোচা দিয়ে কথাবলতে দুবার ভাবেনা। অধরা চনচল হয়ে উঠলো। জুবায়ের হাতটা ছাড়িয়ে দিয়ে ওর মুখে হাত রেখে অনুরোধের সুরে বলল,
> আমি আপনাকে নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করি। কথাটা আমি ওভাবে বলতে চাইনি। আপনি তো ধুমধাম না ভেবেই কাজকর্ম করেন। তাই জন্য বলেছি। প্লিজ ক্ষমা করুন আমাকে।

অধরাকে চোখের পানি ফেলতে দেখে জুবায়ের ভ্রু কুচকে বিরক্তি নিয়ে বলল,
> এই তুমি আবার ছিঁদকাদুনে কবে থেকে হলে? সামান্য কারণে আমার অধরার চোখে পানি ঠিক হজম হচ্ছে না। শুনো তুমি যেমন ছিলে তেমন থাকবে। এসব কান্নাকাটি কিন্তু জুবায়ের সহ্য করবে না। শুনো না চলো ঘুরে আসি।
জুবায়ের উঠে বসলো। তারপর দুহাত কাজে লাগিয়ে অধরার মুখটা মুছিয়ে দিয়ে উঠে গেলো আলমারির কাছে। দুদিন আগে বাংলাদেশে থেকে একটা কুরিয়ার এসেছে। জুবায়ের অর্ডার দিয়েছিলো। বেশ কয়েক রকমের শাড়ি আর পাঞ্জাবী এসেছে। বাংলাদেশ থাকতে ও নিয়মিত শুক্রবারে পাঞ্জাবী পরে মসজিদে যেতো এখানেও আছে তবে বেশ কম। জুবায়ের সেখান থেকে শাড়ি গুলো অধরার সামনে রেখে একটা কালো রঙের সুতি সিল্কের শাড়ি ওর সামনে তুলে ধরে বলল,
> তোমার মায়ের শাড়িটার মতো অতটা ভালো হবে না। তবুও বরের দেওয়া প্রথম গিফট হিসেবে এটা পরলে আমার শান্তি লাগবে। বিকেলে পথ ভ্রমণটা রোমাঞ্চকর মনে হবে। পরবে তুমি?
অধরা চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে নিলো। মায়ের দেওয়া শাড়ি গুলো অনেক পুরাতন হয়েছে তবুও অধরা সেগুলোই পরে। মা মা গন্ধ মিশে থাকে। তবুও স্বামীর দেওয়া প্রথম গিফট সামনে পেয়ে ও আবেগী হয়ে উঠলো। উপহার পেতে কারনা ভালো লাগে?আর সে যদি নিজের মানুষ হয় তাহলে তো কথায় নেই। ও দ্রুত জুবায়েরের থেকে শাড়িটা নিয়ে লাজুক হেসে বলল,
> দারুন সুন্দর। তবে এর জন্য আপনাকে আমি ধন্যবাদ দিতে পারবো না। এটা আমার অধিকার। আজ বিকেলে নিশ্চয়ই আমি এটা পরে যাবো। তবে বাইরে ঘুরতে না মারিয়াকে দেখতে যাবো।

জুবায়েরের হাসলো ওর কথা শুনে।ও নিজেও মারিয়াকে দেখতে যাওয়ার কথায় ভেবেছিলো। দুজনের চিন্তা শক্তির কতটা মিল। নিশ্চয়ই আল্লাহ রহমত ছিল নয়তো এমন মেয়েকে ওর জীবন সঙ্গী হিসেবে পেতো না।
****************
জার্মানিরতে নগরায়নের হার অত্যন্ত উঁচু। বালির্ন দেশের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। তবে প্রাক্তন পশ্চিম জার্মানির রাজধানী বন শহরে এখনও বেশ কিছু সরকারী অফিস রয়েছে। বাংলাদেশের থেকে আসা সুলতানরা ব্যবসার সুবিধার জন্য বালির্নে প্রথম নিজেদের গৃহ নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু পরে রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় প্রকোপে অতিষ্ঠ হয়ে বন শহরে চলে গেয়েছিলেন। ফলে এখানকার গৃহটা প্রায় অকেজো হয়ে যায়। জুবায়েরের দাদু বুদ্ধি করে একজন ইউরোপীয় নাগরিক জুড়ি সিং এর নিকটে সেটা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। লোকটা খ্রিস্টধর্মের অনুসারী তাছাড়া এখানকার দুই-তৃতীয়াংশ লোক রোমান ক্যাথলিক অথবা প্রোটেস্টান্ট খ্রিস্টান। ইসলাম জার্মানির তৃতীয় ধর্ম। যাইহোক জার্মানি থেকে প্রায় সাড়ে চার শ উগ্র ইসলামপন্থী সিরিয়া যাত্রা করে তাদের মধ্যে মোট ১০ শতাংশের বাস বন শহরে। সুলতান পরিবার ১৯৯০ সালে বন শহর ছেড়েছিলো তার কিছু বছর পরের ঘটনা। দোতলা বিশিষ্ট বাড়িটাতে জুডি সিং নিজের স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস শুরু করেন। এক সন্ধ্যা লগ্নে শহরের মধ্যে হঠাৎ এক রেস্তোরাঁয় সন্ত্রা/সী হামলা হয়।বো/মা আর গু/লির শব্দে মুখোমুখি হয়ে উঠে উঠে চারিদিক। পোড়া লা/স বা/রুদের গন্ধে নিশ্বাস নেওয়া কঠিন। সামরিক বাহিনী যথাযথ চেষ্টা করে সবটা নিয়ন্ত্রণের জন্য কিন্তু ফলাফল শূন্য। শহরের অপর দিক থেকে আরও এক দল আক্র/মণ হানে শহরের উপরে। ফলে জনগণের প্রাণের ঝুকি বেড়ে যায়। এমন অবস্থায় জুডি সিং তখন ভয়ে স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ির সিঁড়ির নিচে থাকা গোপন স্টোর রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করলেন। উপরে যায় হয়ে যাক এখানে কেউ আসবে না। দরজা থেকে দফায় দফায় মৃদু আওয়াজ ভেসে আসছিলো। জ/ঙ্গিরা নাকি সাধারণ কেউ এসেছে বোঝা গেলোনা। কথায় বলে আপনি বাঁচলে বাপের নাম। স্টোর রুমে আবছা আঁধারে ভয়টা ওদের কমে এসেছিলো কিন্তু ঘটলো আরেক ঝামেলা। লম্বা টেবিলের নিচে এক নারী অবয়ব দেখে দুজনের প্রাণ কেঁপে উঠেছিলো। জুডি সিং লাইট জ্বালিয়ে সামনে তাঁকিয়ে চোখ বড়বড় করে ফেলল। কারণ ওর সামনে এক আ/হত অল্প বয়সী মেয়ে বসে আছে। যার ঠোঁট থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে র/ক্ত ঝরছে। কি করা উচিৎ বুঝতে পারলেন না। ফর্সা তকে কালো আঘা/তের চিহ্ন দেখে জুডির স্ত্রী মেয়েটাকে কাছে এগিয়ে গেলেন। কিভাবে কি হয়েছে আর মেয়েটা এখানে কি করছে জানতে চাইলে মেয়েটা কোনো উত্তর দিলোনা। হুট করে অচেতন হয়ে যায়। ততক্ষণে বাইরের পরিবেশ বেশ শান্ত হয়ে উঠেছে। জুডির স্ত্রী ওকে সেবাযত্ন করে বুঝতে পারে মেয়েটা গর্ভবতী। মেয়েটা সুস্থ হয়ে জোবান দেয় ওর স্বামী ছাড়া পৃথিবীতে নিজের বলতে কেউ নেই। জ/ঙ্গিরা ওর স্বামীকে হ/ত্যা করেছে। ও বাঁচার জন্য এখানে এসে লুকিয়ে আছে। অনুরোধ করলো দয়াকরে ওকে যেনো রাখা হয়। সেই থেকে মেয়েটা সুলতানের পরিত্যক্ত বাড়িতে থাকতে শুরু করে। আরমান ফারুকী প্রায় এখানে যাওয়া আসা করতেন। মেয়েটার কাজে খুশি হয়ে ওকে বালির্নে নেওয়ার জন্য প্রস্তাব দেন। মেয়েটা রাজি হয় তবে বাচ্চা প্রসবের পরে যাবেন শর্ত দিলেন। ঘটনা সেটাই ঘটলো। মেয়েটার বাচ্চা হলো তারপর সুলতান পরিবারের খাশ কাজের লোক হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন। সেই মেয়েটাই হচ্ছে ঐশ্বর্যের মা মিসেস রুবিতা খান। রুবিতা নিজের ইচ্ছাতে সুলতান পরিবারে আস্তানা গড়েনি ওকে এক প্রকার বাধা করা হয়েছিলো। তাছাড়া খান ভিলাতে কোনো নারীর স্থান নেই। ইচ্ছে করলে ওকে রাখাও যেতোনা। রুবিতার বাবা নিজের ছেলের প্রাণ রক্ষা করার জন্য রুবিতাকে শয়তা/নের নামে উৎসর্গ করেন। মেয়েটা অভি/শপ্ত হয়ে যায়। জ্যাকি নিজের বাবার জন্য ওকে গ্রহণ করেন। পরে নিজের স্বার্থের জন্য আর তথ্য আদানপ্রদানের জন্য ওকে সুলতান ভিলাতে পাঠেছিলো। তারপরের ঘটনা সবার জানা। জ্যাকি নিজের বুদ্ধিতে চলতো। ওর দুটো মেয়ের মধ্যে একটা আঁধরারে মায়ে কাছে ছিল অন্যটা জুবায়ের লালন পালন করে। ঐশ্বর্য সবটা জানতো না। কিন্তু ওর বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নিজের মধ্যে নানারকম পরিবর্তন লক্ষ্য করে। তারপর জুবায়ের যখন অধরা আর কহিনুরকে খুঁজে পেলো তখন ও হিং/স্র হয়ে উঠলো। ঠিক সেই সময় জ্যাকি ওর সঙ্গে দেখা করে আর নিজের আসল পরিচয় প্রদান করেন। ঐশ্বর্য প্রথমে হীনমন্যতায় ভুগছিলো একজন কাজের মেয়ে হওয়ার দরুন। কিন্তু পরে যখন জানতে পারলো ও খান পরিবারের সন্তান তখন আবারও গর্ব করতে শুরু করলো। অহংকারী হয়ে উঠলো। এখন কিভাবে দাদুর সঙ্গে হাত মিলালো এটা আমি জানিনা তুমি খোঁজ করো।

জুবায়ের বাবা প্রথম থেকে পুরোটা নিজের মতো করে পাথর কে বর্ণনা করলো। পাথর চুপচাপ শুনছিলো। কি স্বার্থপর নিজের চাচা আর বোনেরা ভাবতেই ঘৃ/ণা হলো। দুপুরে যখন সবাই নিজেদের কক্ষে ব্যস্ত ছিল পাথর বাবার কাছে ছুঁটে এসেছে। ঐশ্বর্যের মা সুলতান পরিবারে কাজের লোক হিসেবে ছিল বিষয়টা ওর কেমন জানি লাগছিলো। খান পরিবারের মেয়েদের যে কতটা মূল্য দেওয়া হয় বুঝতে বাকী নেই। নিজের মায়ের মৃ/ত্যু আর বাবার গৃহবন্ধীর জন্য খুব কষ্ট হয় ওর। বাবা মায়ের ভালোবাসা থেকে ওকে বঞ্চিত হতে হলো। কথাগুলো ভেবে ও মাথা তুলে বলল,
> আমি আসছি আপনি সাবধানে থাকবেন। দাদু হঠাৎ চুপচাপ কেনো এটা ভাবাচ্ছে আমাকে। আঁধারের খোঁজ নেই। ঘাপটি মেরে বসে আছে। হঠাৎ আক্র/মণ করে বসবে।
পাথরের কথা এড়িয়ে গিয়ে উনি প্রশ্ন করলেন,

> তুমি কি সুলতান ভিলাতে থাকছো? বলেছিলাম তো কহিনুরের থেকে দূরে থাকো। তাঁর জন্ম হয়েছে একটা উদ্দেশ্য নিয়ে। কোনো সংসার পাতিয়ে পথির্ব জগতের সুখ দুঃখ বিলাস করতে না। কালো শক্তির ধ্বং/সের সঙ্গে সঙ্গে সেও কিন্তু ধ্বং/স হবে। পৃথিবীর নির্মল করতে তাঁর ধ্বং/স অনিবার্য। আবেগপূর্ণ হয়ে ভুল করোনা। দয়াকরো প্লিজ।

পাথর হাতের মুঠো শক্ত করে ফেলল। বুকের মধ্যে অজানা ভয় এসে বাসা বাঁধতে শুরু করেছে। অশান্ত হয়ে উত্তর দিলো,
> পারবো না ড্যাড পারবো না। মৃ/ত্যু হলে দুজনের এক সঙ্গে হবে। আমি ওকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না। আপনি নিজেও বন্ধি ছিলেন আমার মায়ের জন্য। পেরেছেন তাঁকে ভুলে গিয়ে বাঁচতে। তবে আমার ক্ষেত্রে কেনো এই অবিচার বলুন?

পাথরের বাবা ছেলের কষ্ট উপলব্ধি করতে পারছেন কিন্তু এটাইতো নিয়তি। নিয়তিকে আটকানোর জন্যই হয়তো কালো শক্তির উপরে লোকজন এভাবে ভরসা করে পথভ্রষ্ট হয়। সেখানে উনি নিজের ছেলেকে কিভাবে সেই রাস্তায় ছেড়ে দিবেন? কথাটা ভেবে উনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিলেন,
> কহিনুরের আছে আমার জাদুলিপি আছে। জাদুলিপির অষ্টম পৃষ্ঠাতে যদি কেউ অপরের জন্য কিছু চেয়ে কিছু লিখে তবে জাদুলিপি সেটা পূরণ করে। তুমি ওটা কহিনুরের থেকে যেভাবেইহোক উদ্ধার করো। তারপর লিখে ফেলো তোমার মনের কথা। বিসর্জন দাও নিজের কিছু প্রিয় জিনিস তবেই কহিনুর তোমার হবে। এটাও কিন্তু কালো শক্তির একটা অংশ। কহিনুর জেনে বুঝে কখনও এটা তোমাকে দিবে না। কৌশল অবলম্বন করো, ছলনা করো যা ইচ্ছা তাই করো তবুও ওটা নিজের করে নাও। আশাকরি তোমার ইচ্ছা পূরণ হবে। এর চাইতে ভালো বুদ্ধি আমার কাছে নেই। তবে জেনে রেখো তোমরা যতই এগিয়ে যাবে কহিনুরের জীবন থেকে আয়ুষ্কাল কমতে শুরু করবে।
পাথর মন দিয়ে নিজের বাবার কথাগুলো শুনে বিড়বিড় করলো ‘জাদুলিপি আমার চাই।
********************
কিচেনে স্যুপ তৈরি করছে কহিনুর। সাঈদ রান্নার বই ঘেটে ঘেটে ওকে উপকরণগুলো বুঝিয়ে যাচ্ছে। অধরা আর জুবায়ের বাইরে গেছে। ঐশ্বর্যের জন্য অধরা যা রান্না করে রেখেছে মেয়েটা হঠাৎ বলছে সেটা খাবে না। আদেশ করেছে চিকেন স্যুপ এখুনি ওর চাই।তাই অপেক্ষা না করে সাঈদকে নিয়ে রান্না বসিয়ে দিলো। যদিও ভালো হবে কি ওর জানা নেই। সাঈদ বলেছিলো রেস্টুরেন্ট থেকে আনিয়ে দিবে কিন্তু ওইয়ে শকুনের চোখ। ঐশ্বর্য ধরে ফেলবে তখন ঝামেলা হবে। গাজরের টকরো পানিতে ছাড়তে ছাড়তে কহিনুর কিছুএকটা ভেবে প্রশ্ন করলো,
> এই সাঈদ দুদিন আগে এই বাড়ির সামনে একটা খু/ন হয়েছে তুমি জানো?
কহিনুরের কথা শুনে সাঈদ মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলো,
>জানি,তবে এটা কে করেছে এটা বলতে বলোনা প্লিজ কারণ আমি তখন এখানে ছিলাম না। ফেরার সময় গেটের সামনে অনুভব করলাম। তবে ওটা ডগের রূপে অন্যকিছু ছিল। এই হত্যা/টা যেই করেছে সে কিন্তু বাড়ির বাইরের কেউ না। ভেতরের কেউ। সন্দেহের তালিকায় অনেকেই আছে। আমি তদন্ত করছি।
কহিনুর হাসলো সাঈদের কথা শুনে। ছেলেটা বেশ কাজের।না চাইতেই কেমন সব বুঝে যায়। কথাটা ভেবে ও প্রশ্ন করলো,
> আচ্ছা সাঈদ কহিনুর যদি এখন অন্যকারো কাছে চলে যায় তখন তুমি কি আমার শ/ত্রু হয়ে যাবে?
সাঈদ মলিন হেসে উত্তর দিলো,
> আমরা দাস,আমাদের নিজস্ব কোনো ভালোলাগা চাওয়া পাওয়া নেই। মনিবের ভালোর জন্য তাকে রক্ষা করাই আমাদের দায়িত্ব। তবে তোমাকে আমার ভীষণ ভালো লাগে। তোমার ক্ষতি হোক আমি চাইনা। আম্মি বলেছিলেন আমাদের এই জীবন থেকে অচিরেই মুক্তি মিলবে। তুমি আমাদের মুক্তির রাস্তা নূর। আল্লাহ তোমার মধ্যে দিয়ে আমাকে এই কঠিন জীবন থেকে উদ্ধার করবেন। আমি আম্মিকে নিয়ে নিজ রাজ্যে ফিরে যাবো। কহিনুরের শক্তি পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে যাবে। নির্মল হয়ে উঠবে পরিবেশ।
কহিনুর ছলছল চোখে তাঁকিয়ে আছে। নিজের জীবন দিয়ে হলেও সবাইকে ও এই অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি দিবে বলে প্রতিজ্ঞা করলো। কথাগুলো ভেবে ও খাবারটা পাত্রে নিয়ে ওকে বলে আসলো চারদিকে নজর রাখতে। দুদিন আগে এই বাড়ির কে তলো/য়ার হাতে প্রাচিল টপকে ভেতরে এসেছিলো। সিসি ক্যামেরাতে কোনো ফুটেজ নেই। ঝিরঝির করছে। যেই হয়ে থাক তাঁর উদ্দেশ্যে ভালো নাকি খারাপ?

ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে লিখেছি আজকের পর্বটা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here