#অভিশপ্ত_জীবন
সিজন 2
পর্ব ৭
লেখিকা #Fabiha_Busra_Borno
আমার জোরে জোরে কথার আওয়াজে শশুর শাশুড়ীও বেড়িয়ে আসছে। আজ যেন কথার বাধ ভেঙেছে আমার। মুখে যা আসছে তাই বলছি। রাসেল রাগে চোটে ঘরের দরজাতে জোরে লাত্থি মেরে বলে,,
ছিহ্ রজনী,, এতো কুৎসিত চিন্তা ভাবনা তোমার আগে বুঝিনি। তুমি আমাকে এই ভালোবাসো আর এই চেনো? আমার ভাবতেও লজ্জা করছে তুমি কিভাবে এইসব কথা বলতে পারলে। নিশিকে কখনো নিজের ছোট বোনের মতো ছাড়া অন্য কোন ভাবে দেখিনি। বড় ভাইয়ের মতো শাসন এবং আদর করার চেষ্টা করছি সব সময়। কিন্তু তুমি কিভাবে এতো এতো নোংরা শব্দ উচ্চারণ করতে পারলে?
এখন আমার সত্যিই ভয় হচ্ছে,, পুরোপুরি না জেনে ভুল কিছু বললাম নাকি। নিশি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। অনেক রাগী আর জেদি মেয়েটা কি রাগের বসে ঘরের ভিতর ভুল কিছু করছে। ভয়ে আমার অন্তর আত্মা কেঁপে ওঠে। রাসেল মা বাবা সবাই বারবার নিশিকে দরজা খোলার জন্য ডাছে। নিশির কোন সারা শব্দ নাই।
নিশির আর রাসেলের মাঝে কি আছে না আছে সেটা পরে জানা যাবে, আগে আমার সেই ছোট্ট মায়ের অবহেলায় রেখে যাওয়া বোন কে বাচাতে হবে। আমি ও ডাকছি,,
নিশি,, নিশি বোন আমার, আমার ভুল হয়ে গেছে রে, প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দে,, নিশি রে তুই তো আমার বোন সাথে আমার সন্তানের মতো। ছোট বেলায় তো তোকে কত বকা দিছি তাই বলে কি তুমি আমাকে ছেড়ে গেছিস। ফিরে আয় বোন আমার। রাসেল, ও রাসেল, জানালা দিয়ে দেখো না, নিশি ভিতরে কি করছে,,
রাসেল জানালায় উঁকি দিয়েই চিল্লিয়ে বলে, নিশি পাগলামি করো না, নিশি নিশি, নিইইই
আমার শশুর আর রাসেল সাথে সাথে দরজা ভেঙে ভিতরে যায়। নিশি ওড়না দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়েছে। আমার পক্ষে দরজা থেকে ভিতরে যাওয়া সম্ভব না। ওখানেই পা মেলিয়ে দিয়ে বসে বারবার জিজ্ঞেস করছি,, মা আমার বোন বেঁচে আছে, রাসেল, রাসেল নিশির কি অবস্থা। কেউ কিছু বলছো না কেন? নিশি কথা বল,, কথা বলছিস না কেন।
আমি হামাগুড়ি দিয়ে ভিতরে যাওয়ার চেষ্টা করছি। নিশিকে আমার শাশুড়ী কোলে হেলান দিয়ে বসে আছে। গলা থেকে ওড়না খোলার চেষ্টা করছে রাসেল আর শশুর। আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো অবস্থা তাদের নেই।
হে আল্লাহ তুমি আমার বোন কে ভিক্ষা দাও, আমার পাপের শাস্তি আমার বোন কে দিওনা। মায়া গো বলো না আমার বোনটা বেঁচে আছে নাকি। এমন সময় নিশির কাশির শব্দ শুনতে পেলাম। চোখ গুলো বড় বড় করে ফেলেছে। নিশ্বাস ফেলতে গেলেই কাশি হচ্ছে নিশির।
এতো অভিমান তোর,, আজ তোর কিছু হলে আমি কিভাবে বাঁচতাম,, সারাজীবন তোকে ছাড়া থাকা অসম্ভব হতো আমার,, এইসব বলতে বলতে এগিয়ে যাচ্ছি। রাসেল আমাকে ধরে নিশির পাশে নিয়ে যায়। নিশিকে আমি শক্ত করে জরিয়ে ধরি। যেন আজরাইল আসলেও আমার বোন কে আমার কাছে থেকে আলাদা করতে না পারে তার বৃথা চেষ্টা করছি।
আপা,,,বলতেই আবারও কাশি উঠে নিশির। আমি বললাম, কিচ্ছু বলতে হবে না তোর। মা মা নিশির জন্য একটু পানি এনে দেন না। পাশের টেবিল থেকে রাসেল পানি এগিয়ে দিলো। আমি গ্লাস টা নিশির সামনে ধরে বলি, একটু পানি খা,, কাশি থামবে। কিন্তু গলার ব্যাথায় পানি খেতে পারে না। আমি ভালো করে লক্ষ্য করি, আমার ছোট্ট পুতুল বোন টার গলায় দাগ বসে গেছে। দাগে ভরা গলায় অসংখ্য আদর মাখা চুমুতে ভরিয়ে দিলাম।
সন্দেহ জিনিস টা খুব খারাপ। আজ এর কুফল হাতে নাতে পেলাম। কতবড় সর্বনাশ হতে যাচ্ছিলো আমার এই সন্দেহের জন্য। আল্লাহর কাছে মনে মনে বারবার ক্ষমা চাইছি। নিশিকে এখনো জড়িয়ে ধরে আছি, ছাড়বো না। যতক্ষণ পর্যন্ত পারি এভাবেই থাকবো। নিশির চোখের পানি গুলো আমার পিঠে পড়ছে। দুইবোন অঝোর ধারায় কেদে চলেছি।
অনেক্ক্ষণ পর মা আমাকে শান্ত হতে বলে। আমার অবস্থা ও তেমন ভালো না। এতো দিন এই সন্দেহের অশান্তির জন্য ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া বা মানষিক দিক দিয়ে শান্তি পাইনি। আর আজ এতো বড় ঘটনার জন্য নিজেকে অনেক দুর্বল লাগছে।
আমি মাকে বললাম আজ আমি নিশির সাথে থাকবো।রাসেল বলে এই ঘরের দরজা ভাঙা, তোমরা দুই বোন আমাদের ঘরে থাকো, আর আমি এখানে থাকি। তারপর আমাকে ধরে এঘরে নিয়ে আসে। মা নিশিকে হাত মুখ ধুইয়ে নিয়ে আসেন। আজ দুবোন কোন কথা বলবো না। নিরবে নিবৃত্তে মনে মনে কথা হবে দুজনের।
অনেক দিন পরে আজ দুই বোনের মধ্যে কোন দ্বিধা দ্বন্দ্ব নেই , ভালোবাসার আবেশে রঞ্জিত দুই বোনের বর্তমান অবস্থা। প্রায় জেগে জেগে রাত পার করলাম। গত রাতের ঘটনা টা আমাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। বাড়ির গোপন কথা গুলো বাইরের কাউকে জানানো টা বোকামি। আর যেহেতু আমাদের বাড়ির আশেপাশে তেমন কারো বাড়ি নেই তাই মনে হয় কেউ ঘটনা টা জানে না।
নিশির গলার দাগ গুলো ভালো না হওয়া পর্যন্ত বাইরে কোথাও যেতে নিষেধ করা হয়েছে। এতো বড় ঘটনার পরে সবারই মনের অবস্থা খারাপ। তাই কেউ কারো সাথে প্রয়োজনের বেশি কথা বলছে না। আজ সারাদিন নিশিকে বিভিন্ন ভাবে বুঝালাম যেন আর কখনো এমন ভুল না করে।
নিশির ঘরের দরজা ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। রাতে নিশি ওই ঘরে থাকবে। আমার খুব ভয় হচ্ছে যদি আবারও কিছু করে। তাই নিশিকে বললাম ও ঘরে থাকবি ভালো কথা কিন্তু দরজা খুলে রাখবি। রাতে রাসেলের কাছে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাইলাম। রাসেল আমাকে ক্ষমা করেছে।আমি জিজ্ঞেস করি,,
পুরো ঘটনা টা কি আমি জানতে পারি,,,যদি তুমি বলতে চাও,,,,
হ্যাঁ পরিস্থিতি এমন যে,, এখন তোমাকে না বললে তুমি মনে মনে চিন্তায় থাকবে, যা আমাদের সন্তানের জন্য ক্ষতিকর।
তারপর রাসেল বলতে শুরু করে,,
উত্তর পাড়ার শিহাব কে চিনো??
কোন শিহাব?
ওইযে, খিটখিটে লম্বা, চুল গুলো বড় বড়, হাতে বালা, গলায় মালা, আঙুলে অনেক গুলো আংটি দিয়ে ফুটানি মেরে ঘুরে!!!
ওওহ হ্যাঁ দেখেছি মনে হয়। একদিন আমি বাজারে যাওয়ার সময় আমাকে দেখে শিটি মেরে কি কি সব বললো। সাইজ দেখে বুঝা যায় বখাটে বখাটে।
হ্যাঁ শুধু বখাটে না,,সাথে অনেক গুন আছে,, খুব ভালো চুরি করতে পারে সে,, সাথে নেশা করে প্রচুর। এমন ছেলের প্রেমে নিশি মজে গেছে। ঘটনা টা আমি অনেক আগে থেকেই জানি। তুমি বা ফ্যামিলির অন্য কেউ জানলে কষ্ট পাবে ভেবে আমি নিজে চেষ্টা করতাম বিষয় টা মিটিয়ে ফেলতে।
নিশি অবশ্য মাঝে একবার ফিরে এসেছিলো। কিন্তু ওইযে,, একবার মনে কারো যায়গা দিলে তাকে ভোলা অসম্ভব হয়। আর এটাই হয়েছে নিশির প্রধান সমস্যা। আমি শিহাব কে অনেক শাসিয়েছি,, মারার হুমকি দিয়েছি কিন্তু ওই ছ্যাচড়া ছেলে কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। নিশিকে বিভিন্ন ভাবে আবারও ব্যাক করতে বলে।
পরশুদিন, গ্রামের একজন বলে,, মাঝে মাঝে নাকি নিশি আর শিহাব বিলের পাশের দীঘির পাড়ে দেখা করে। সেদিন নাকি কারো একটা ছাগল চুরি করে নেশা করেছিলো তা নিয়ে গ্রাম্য সালিশ বসেছিলো। এমন একটা ছেলের সাথে নিশির সম্পর্ক আছে এটা মেনে নেওয়া ইম্পসিবল। তার উপর ওই ছেলের জন্য পড়াশোনা ঠিক মতো করে না বলে রেজাল্ট খারাপ তাই নিশিকে থাপ্পড় মারি।
পুরো বিকাল আমি ওই শিহাব কে ফলো করি, সে কোথায় কি করে, কার সাথে মিশে, কি কি নেশা করে সব কিছুর ছবি তুলে নিয়ে এসে রাতে খাবার দিতে গিয়ে বুঝিয়ে বলি এবং সেগুলো দেখায়। আর তখনই তুমি কোন কিছু না বুঝে এমন রিয়েক্ট করলা।
সত্যিই আমি অনেক নিচ, ছোট মনের মানুষ। যে মানুষটা কে আমি আমার চেয়ে বেশি বিশ্বাস করতাম সেই মানুষ কে ভুল বুঝেছি,, অথচ সে আমাদের ভালো জন্য কত কি করেছে। কিভাবে ক্ষমা চাইবো,, ক্ষমা চাওয়ার মতো যোগ্যতা আমার নাই। কত মহৎ মনের অধিকারী আমার ভালোবাসার মানুষ টা।
আমি রাসেল কে জরিয়ে আবারও নিরবে কেঁদে চলেছি। ক্ষমা চাওয়ার মতো মুখ আমার নাই। এমন ফেরেস্তার মতো মানুষকে এতো দিন কত কিছু বলেছি মনে মনে। আমার নিরব কান্না দেখে হয়তো রাসেল অনুভব করেছে আমি অনুতপ্ত। তাই সে বলে,,
পাগলি বউ আমার। আমি জানি তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসো। আর ভালোবাসো বলেই তো সন্দেহ করো। সন্দেহ তাকেই করা যায় যাকে ভালোবাসা যায়। শোন তুমি আপাতত নিশির সাথে শিহাব সম্পর্কে কিছুই বলো না। যদি সে তোমাকে বিষয়টি জানানোর প্রয়োজন মনে করে তাহলে তুমি তোমার মতো করে বুঝাবে।
আজ আমাকে নিয়ে মেডিক্যালে যাবে। এই ঘর আর বিছানা বন্দী জীবন থেকে মুক্তি পাবো। পেটের ভিতর আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠা সন্তানদের মুখ দেখবো আজ। এক দিকে আনন্দ লাগছে অন্য দিকে ভয়। নিজের শরীরের অবস্থা তো বুঝি আমি। আল্লাহ যেন সব কিছু ভালোই ভালো শেষ করেন।
আমার সাথে নিশি, রাসেল আমার শাশুড়ী, ওই বাড়ি থেকে মা বাবা এসেছেন মেডিক্যাল এ। বিকাল চারটায় আমার সিজারের কথা। আমি রাসেল হাত ধরে বারবার ক্ষমা চাইছি,, নিজের অজান্তে বা জেনে বুঝে যত ভুল করেছি সব যেন ক্ষমা করে দেয়। শাশুড়ীর থেকে ও ক্ষমা চেয়ে নিলাম। মা আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,, রজনী মা আমার!! আমার সাহসী মেয়ে, এভাবে ভেঙে পড়লে হবে না। মনে সাহস রাখো, দেখো কিচ্ছু হবে না। আমার নিষ্পাপ মেয়েদের কোন ক্ষতি আল্লাহ করবেন না এটা আমার বিশ্বাস।
ডাক্তার অপারেশন এর আগে (O-) ব্লাড ডোনার রেডি রাখতে বলেছেন। আমার ফুফু শাশুড়ীর ছেলের আসার কথা আছে। কিন্তু এখনো এসে পৌঁছায় নি। হয়তো এসে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যে। আমরা সকালে এখানে আসার সময় উনার সাথে কথা বলে এসেছিলাম। উনার নাকি কি একটা কাজ আছে তাই উনি দুপুর পরে আসার কথা বলেছিলেন। প্রায় চারটা বেজে গেছে কিন্তু উনার এখনো আসার নামগন্ধ নেই। রাসেল বারবার উনার নাম্বারে কল দিচ্ছে কিন্তু উনি নাকি ফোন বাসায় রেখে আসছেন। উনার বউ ফোন রিসিভ করে বলে , অনেক আগেই চলে গেছেন উনি।
হয়তো আশেপাশে আছে ভেবে রাসেল আমাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়। অপারেশন থিয়েটারে আসার সময় সবাই আমাকে নির্ভয়ে থাকার পরামর্শ দিলেও সবার চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ভাজ আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম। কেন যেন মনে হচ্ছে এটা আমার শেষ দেখা।
সিজারের সময় নাকি পুরো শরীর অবশ করতে হয় না। আমার সাথে ডাক্তার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে সিজারের কার্যাবলী করে যাচ্ছেন। কোন ব্যাথার অনুভব হচ্ছে না,, শুধু মাঝে মাঝে ঝাকুনির অনুভব হচ্ছে। যে ডাক্তার টা একটু আগেও আমার সাথে কথা বলাতে ব্যাস্ত ছিল সেই ডাক্তার এখন আমার শরীরের নিচের অংশ নিয়ে ব্যাস্ত। আমার পেটের উপর সামান্য উঁচু করে একটা পর্দা দেওয়া আছে বলে নিজের পেট দেখতে না। তবে সবার চলাফেরা এটা সেটা নেওয়া দেওয়া সব কিছু দেখতে পাচ্ছি।
ডাক্তার রা সবাই শঙ্কিত,, অন্য কোন ডাক্তার কে নিয়ে নিয়ে আসার জন্য বলাবলি করছে। তাহলে কি অস্বাভাবিক কিছু ঘটেছে অপারেশন এর সময়। একজন নার্স কে বাইরে গিয়ে ডোনার কে নিয়ে আসতে বলেন। ইমার্জেন্সি ব্লাড লাগবে।
হাতের আঙুল গুলো কেমন যেন ঝিঝি ধরছে,, মাথাটাও কেমন যেন করছে আমার। নিশ্বাস স্বাভাবিক এর চেয়ে বেশি নিচ্ছি তবুও মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে নিশ্বাস বন্ধ করে আছি। রুমের ভিতর যতগুলো নার্স এবং ডক্টর ছিলো সবাই যে যার মতো এটা থেকে সেটা ঠিক করা, এগিয়ে দেওয়া ইত্যাদি নিয়ে ব্যাস্ত।
চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছে, উনাদের কথা সাউন্ড এখন তেমন আর শুনতে পাচ্ছি না। নিজের নিশ্বাসের সাউন্ড ই শুধু আমার কানে আসছে। এমন সময় ছোট্ট নব্য-ভুমিষ্ট হওয়া বাচ্চার কান্নার আওয়াজ কানে আসে। এই আওয়াজ মধুর বানীর মতো মনে হচ্ছে আমার অন্তরে। এই মিষ্টি কান্নার আওয়াজে মনে হচ্ছে আমিও পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে যাচ্ছি,,৷
চলবে,,,,,,ইনশাআল্লাহ।