#তুমি_আছো_তুমি_রবে ( উপন্যাস) #পর্ব_২৩ বোনাস #রেহানা_পুতুল
জীবনের ডায়েরি থেকে মুছে গেল চারটি নিরানন্দ বসন্ত। প্রকৃতির দুয়ারে আজ বইছে ফাগুনের মাতাল হাওয়া। বাতাসে হেলেদুলে ভেসে বেড়াচ্ছে ফুলের সুবাস। রুক্ষ শীতের পাতা ঝরানোর দিনগুলোকে পিছনে ফেলে ফাগুন এলো নব রঙের ছোঁয়া নিয়ে।
আরশাদের মনে হবু বাবা হওয়ার উপচানো সুখ তিরতির করে দুলছে গাছের কচি শাখার মতো। এই অনুভূতি অন্যদের চেয়ে বহুতরো ভিন্ন। যতভাবে পেরেছে কোনভাবেই চেষ্টার সামান্যতম ঘাটতি করেনি আরশাদ। বহু কাঠখড় পোহাতে হয়েছে। প্রায় রাতেই একটা সন্তানের জন্য ঝিনুকের আত্মহাহাকার আর দীর্ঘস্বাস আরশাদকে দুঃখের অতলে নিক্ষেপ করতো। নিজেও কম পুড়তোনা নিঃসন্তান পিতা হয়ে।
ঝিনুককে দেশের বাইরে নিয়ে গিয়েছে। উন্নত চিকিৎসা করিয়েছে দুইভাবেই মাসের পর মাস। একটা হলো কোমরের হাড়ের জন্য। বাকিটা সন্তান হওয়ার জন্য। ফকির দরবেশ থেকেও ঝাড়ফুঁক করালো। ঝিনুকের অসুখের সময় সবার সদকা দেওয়ার মানতগুলোও পূরণ করা হলো।
এ ভিতরে ঝিনুকের মাস্টার্স ও কমপ্লিট হয়ে গিয়েছে। এম পিল করছে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পাশাপাশি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছে ঝিনুক।
ঝিনুকের এত বড় দূর্ঘটনার পর বেঁচে ফিরে আসা অলৌকিক ঘটনার মতো। ব্যস্ততম রাস্তায় লোকাল বাসের ভিতরে উঠে গেল তার দুই বন্ধু। মানুষের ভিড় ঠেলে ঝিনুক বাসের ভিতরে যেতে পারেনি। তাই দরজায় হাতল ধরেই দাঁড়িয়ে ছিলো। সেই বাসের সাথে পাল্লা দিয়ে পাশাপাশি আরেকটা বাস ঘেঁষে চলে যাওয়ার সময় ঝিনুককে চাপা দেয়। পিচ্ছিল হাতল থেকে ঝিনুকের হাত ছিটকে রাস্তায় পড়ে যায়। উপস্থিত জনতা বাস দুটিকে আটক করে। স্থানীয় পুলিশ এগিয়ে আসে। হাসপাতালে নিলে জানা যায় ঝিনুকের কোমরের হাড় ভেঙ্গে যায় বাসের চাপায়। বুকের হাড়েও ভেঙ্গে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে। শরীরের ভিতরে কালো রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছে। সেই রক্ত বের না করা গেলে ঝিনুককে বাঁচানো যেতনা। মাথায় ও প্রচুর আঘাত পেয়েছে জেব্রাক্রসিং এর উপরে মাথা পড়ে যাওয়াতে।
মা বাবার অনুরোধে একটা সন্তান দত্তক নিল আরশাদ ও ঝিনুক। ঘটনাক্রমে সেটা ছিলো আরশাদের খালাতো বোন মারিয়ার ছয়মাসের কন্যাশিশু। আল্লাহ মুখ তুলে চেয়েছেন। তারপরেই ঝিনুক সন্তানসম্ভবা হয়। এখন চারমাস চলছে। প্রথম সন্তানের নাম রেখেছে মুগ্ধা । ঝিনুক সারাদিন অপলক মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকে কন্যার দিকে। আধো বোলে কথা বলে তার কন্যাটি।
আরশাদ বাইরে থেকে এলো। ভীষণ গরম। সারা শরীর ঘামে চুপসে গেলো। তাওয়েল খুঁজে পাচ্ছেনা।
মাম্মি মাম্মি দেখ দেখ পাপা না তোমার ওড়না দিয়ে মুখ মুছেছে৷
ঝিনুক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে মেয়ের অভিযোগ সত্যি। চোখ কটমট করে আরশাদের দিকে তাকালো। এটা কি করলেন? বিকেলে ঘুরতে বের হব এই ড্রেস পরেইতো। নতুন ওড়না ভাঁজ ফেলে দিয়েছেন ধলাই মলাই করে। আর পারিনা বলে মেয়েকে কোলে তুলে নিল। সারাগালে মায়ের উষ্ণতার পরশ মাখিয়ে দিলো। সোনাপাখি আমার পাপা কখন কি করে মাম্মাকে এমন করে বলে দিবা। কেমন?
উহু বলবইতো।
আরশাদ হাহ বলে আফসোসের তীর ছুঁড়লো ঝিনুকের দিকে। অন্যদিকে মুখ করে বলল, আমার সারাগালে কেউ এমন করে আদর করেনা।
মুগ্ধা কপাল ভাঁজ করে মাম্মা, পাপাতো ঠিকই বলছে। কই তোমাকেতো কখনো পাপার গালে আদর করতে দেখিনি। শুধু আমার গালেই আদর করো। যাও বলছি। পাপাকে ভালো করে আদর করে দাও।
ঝিনুকের সারামুখ মরিচ লাল হয়ে গেল শুনে। মেয়েটা মনে হয় নারকেল তরিকারির মতো হবে। সবদিকেই ভাব রেখে চলতে শিখে যাচ্ছে।
আরশাদ মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে সালেহার কাছে দিয়ে আসল। দরজা ভিড়িয়ে দিলো। ঝিনুককে টেনে বিছানায় নিজের উপরে শুইয়ে দিলো। ঝিনুকের দুই হাত মেলে ধরলো। নিজের পাঁচ আঙ্গুল দিয়ে ঝিনুকের পাঁচ আঙ্গুলকে বন্ধী করলো।
কি অসভ্যতামি হচ্ছে দিনে দুপুরে? ছাড়ুন না বলছি। ছিহ! বিয়ের এত বছর পরেও এত রোমান্স আপনার মনে। নিলজ্জ পুরুষ কোথাকার।
ভিলেনের মতো চোখ বড় করে আরশাদ বলল, হু.. হাহাহাঃ। এই নারী এত কথা বুঝিনা। প্রেম দিবি কিনা বল। নইলে ছাড়াছাড়ি নাই। আমার সারাগাল ভিজিয়ে দে তোর রসালো ঠোঁটের অমৃত দিয়ে। পান করতে চাই তোর আকন্ঠ সুধা।
ঝিনুক সারাসারাভাবে কয়েকটি চুমু দিয়ে বলল,আপনার খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে আমার গাল জ্বলতেছে।
আরশাদ উল্টে ঝিনুককে বিছানায় শুইয়ে নিজে উপরে উঠলো। আমার অল্পতে হয়না বউ। বিয়ের একযুগ ও তো হয়নি। আমার দাদা দাদীকে দেখতাম সত্তর পার হয়ে যাওয়ার পরেও একে অপরের কুঁচকানো গালে চুমু খেত।
হুম ভুয়া । মিথ্যা কথা। বানোয়াট। নাক তুলে বলল ঝিনুক।
আরশাদ ঝিনুকের নাকের আগায় নিজের নাক ঢলে বলল,
শুনো দাম্পত্য সম্পর্ক সুন্দর থাকলে এসব ভিতর থেকে এমনিতেই চলে আসে। আর এমন ভালোবাসাগুলো স্বামী স্ত্রীর পথচলাকে দৃঢ় করে। গভীর করে। মধুর করে তোলে। এই বলে ঝিনুকের খোলা ঘাড় চুমোয় চুমোয় উষ্ণ করে দিল।
ঝিনুক এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। মনে মনে বলল,তুমি ঠিক বলছ আশু গুণ্ডাটা আমার। দিনে দিনে তোমার ভিতরের এক আদর্শ মানুষকে আমি আবিষ্কার করেছি। যে সন্তান হিসেবে,ভাই হিসেবে,বন্ধু হিসেবে,প্রেমিক হিসেবে,পিতা হিসেবে,স্বামী হিসেবে শতভাগ পারফেক্ট।
পথ চলায় উপরে উপরে ম্যাচ করার চেয়ে অন্তরের বোঝাপড়াটা বড় বেশি জরুরী। মুখ দেখেই যে উপলব্ধি করতে পারবে সঙ্গীর মন খারাপ। বিছানায় বেশী সময় শুয়ে থাকতে দেখলেই যে বুঝে নিবে, শরীরটা বোধ হয় ভালো নেই। বলবে আজ রান্না করতে হবেনা। কিনে খাব।
যার কাছে আবেগের মূল্যায়ন হবে অপার্থিব বস্তুর মতো। মাঝরাতে একফালি চাঁদের দিকে হা করে চেয়ে থাকলে যে রাগী চোখে বলবেনা , এসব কি ছেলেমানুষী দেখাও। ভরা বরষার থৈথৈ জলে নৌকায় করে ঘুরতে চাইলে যে বলবেনা,এসবের বয়স ফুরিয়ে গিয়েছে।
জোছনারাতে খোলা আকাশের নিচে শীতলপাটিতে গা এলিয়ে ঘুমানোর আবদার করলে, যে বলবেনা তোমার এসব ন্যাকামি আর নেয়া যায়না।
বরং কাব্য করে বলবে,
‘ এসো দুজনে করি জোছনাস্নান,
হই দুজনে বিবাগী।
তুমি আছো তুমি রবে,
বুঁজে গেলেও এ দুটি আঁখি। ‘
মুগ্ধাকে নিয়ে তারা দুজন ফাগুনের হাওয়া মাখতে বের হয়ে গেল। এক বিকেল সন্ধ্যা ঘুরে বাসায় এলো প্রাণোচ্ছল মনপ্রাণ নিয়ে।
সালেহা রান্নাঘরের সামনে আছাড়ি পিছাড়ি করে কেঁদে যাচ্ছে। সবাই কারণ জানার জন্য তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। সে কিছুই বলছেনা। শুধু বিলাপ করেই যাচ্ছে। একটু পর গায়ের ওড়নার একপাশ দিয়ে নাকচোখ মুছে নিলো। আড়ভাঙা গলায় আরশাদের দিকে চেয়ে,
ভাইজানগো আমার একটা উপকার কইরা দিবেন। শুনছি টিবরা দ্যাশে নাকি বড় বড় যাদু শিখায়। আমারে সেই দ্যাশে নিয়া যাদু শিখায়া দিতে পারবেন।
সবাই বিস্ময়ভরা চোখে জিজ্ঞেস করলো, যাদু শেখা কেন?
এটাই এখন আমার খুব দরকার। নইলে ডাকু সাজুম। সিনেমাতে দেখি ক্যামনে আমার মত ফকিরনী ডাকাত দলের সর্দার হয়। এছাড়া প্রতিশোধ নেওনের আর কোন রাস্তা নাই।
আরশাদ বিরক্ত হয়ে চলে গেল নিজের রুমে কিছু না বলে। জোবেদা বেগম বললেন ঘটনা খুলে বল কি হয়েছে? তোর কাছের কারো দুঃসবাদ?
না খালাম্মা।
কারো অসুখ?
না খালাম্মা?
তো কি হয়েছে?
আমার স্বামী পরকিয়া কইরা আরেক বিয়া করছে। তাও কারে জানেন?আমার ফুফাতো বইনরে। কি জালিমের ঘরের জালিম দেখছেন খালাম্মা। আমি বাইঁচা থাকলে এর খেলা দেখামুই।
জোবেদা বেগম হতবাক হয়ে গেলেন শুনে।
জিজ্ঞেস করলেন, সালেহা তুই না বললি তোর স্বামী নেই। মারা গিয়েছে। তুই বিধবা?
সালেহা ভয়ে শুকনো ঢোক গিলে ফেলল। নিজের কথার ফাঁসে নিজেই আটকে গেল।
ঝিনুকের প্রেগন্যান্সির ছয়মাস ছলছে। অফিস থেকে মাতৃত্বকালীন অবসর নিয়েছে ছয়মাসের জন্য। অনাগত সন্তান মায়ের পেটের ভিতর একটু একটু করে নড়াচড়া শুরু করেছে। জানান দিচ্ছে তার আগমনী বার্তা ভোরের উদীয়মান সূর্যের মতো।
ঝিনুক এখন ঢিলেঢালা পোশাক পরে সারাদিন। শরীরটাও ভারী হয়ে আসছে। হাত পায়ে পানি জমে যাচ্ছে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আনুপাতিক হারে তার দৈহিক সৌন্দর্যটুকুও বেড়ে চলেছে। এ সময় মেয়েদের সৌন্দর্য এমনিতেই দিগুণ হয়ে যায়। যেন চাঁদটাও ঝিনুককে দেখে হিংসায় পুড়ে মরবে।
_____
ফাল্গুনের নিশুতি রাত। দূরবন হতে ভেসে আসছে দোলনচাঁপা ফুলের মন আকুলিবিকুলি করা খুশবু। সন্তানের নাম কি রাখবে তা নিয়ে দুজন খুনসুটিতে মেতেছে।
আরশাদ ঝিনুকের ফুলে ফেঁপে উঠা পেটের উপর নিজের হাতখানি রাখল যত্ন করে। পেটের দিকের দুটো বোতাম খুলে নিল নাইটি থেকে। নাইটি দুপাশে সরিয়ে উদাম পেটে নরম স্পর্শ দিতে দিতে ঝিনুকের চোখে চোখ রাখল।
বলল তোমার আমার ভালোবাসার সোনালি ফসল ও । ঝিনুক দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল লাজরাঙা নববধুর মতো।
গোপনে বলল,
‘ তুমি আমার বাম পাঁজরে চিনচিনে ব্যথা আর অবাধ্য উচ্ছ্বাস।
তুমি এখন হয়ে গেছো আমার প্রতিক্ষণের ভালোবাসার অভ্যাস। ‘
#সমাপ্ত