তুই আমার অঙ্গারাম্লজান – পর্ব ১৭

0
168

#তুই_আমার_অঙ্গারাম্লজান
পর্ব_১৭
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা

২১.
ফায়াজের শ্বশুরবাড়ি থেকে মেয়ের বড় মামা আর চাচা এসেছেন। ছেলেকে ফার্নিচার দেবে। কাঠের দেবে নাকি অন্যকিছু, ম্যাট্রিক্সের মাপজোক নিয়ে কথা বলতে এসেছেন।
বাড়ির মূল ফটক অতিক্রম করে বৈঠকখানার মতো মোটামুটি বড় জায়গায় সোফার সেট বিছানো। পাশে ডাইনিং টেবিল। ডাইনিং টেবিলে বসে আমি পানি গিলছিলাম আর তাদের কিচ্ছা কাহিনী শুনছিলাম।

বিরক্ত হয়ে ভেতরের দিকে চলে গেলাম। আমার জন্য বরাদ্দ রাখা রুমে আম্মু আসতেই শাসানো গলায় বললাম,
“এইজন্য এই মহিলাকে আমি দেখতে পারি না। মেয়ের বাড়ি থেকে জিনিসপত্র পাওয়ার জন্য জিহ্বা চার হাত বের হয়ে আছে। ছোটলোক!”
আম্মু জিহ্বায় কামড় দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। দরজাটা সন্তর্পণে আটকিয়ে আমার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালেন।
“তুই বেশি পাকনামো করিস। বেয়াদব মেয়ে। মেয়েরা নিজেরাই দিতে চাইছে। না জেনে এডভান্স কথা বলবি না।”

আমার মায়ের এক সমস্যা। ছোটলোকের সঙ্গে থেকে ছোটলোকী মন-মানসিকতা নিজের মধ্যে ধারণ করতে চায়। কিন্তু আমার তো মেজাজ বিগড়ে গেলো। আমাকে এডভান্স কথা বলতে নিষেধ করা, বেয়াদব সম্বোধন করা তরতর করে রক্ত যেন শরীর নাড়া দিয়ে ওঠলো। কিছুক্ষণ স্থির নয়নে আম্মুর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
আম্মু তেতে উঠে জিগ্যেস করলেন,
“কি? কি সমস্যা?”
আমি আম্মুর চোখের দিকে চোখ রেখে বললাম,
“ভবিষ্যতে যদি আমার মেয়ে হয়, আর সেই মেয়েকে যদি জিনিসপত্রের বিনিময়ে বিয়ে দিতে হয়; আগে নিজের মাথা কুড়াল দিয়ে কাটবো, পরে বেঁচে থাকলে নিজের মেয়েকে কুচি কুচি করে কাটবো।”
আম্মু কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে নিঃশব্দে চলে গেলো।

বড় হচ্ছি? আসলেই বোধহয় হচ্ছি। আজকাল অনেক কিছু নিয়ে আম্মু কিংবা আব্বুর সঙ্গে আমার শান্ত কিন্তু জোরালো ঝগড়া সংঘটিত হয়। কেউ জানে না, কেউ শুনে মাঝেমধ্যে আমার শিরায় শিরায় কেমন আগুন ধরে। সেইসময় প্রিয়লের সঙ্গে আমার অনাকাঙ্ক্ষিত বিয়ের কথা মনে পড়ে যায়। ফাহাদের পরিবারের ফায়াজ ভাইয়ের হবুর মতো আমাকে বৈধভাবে বিক্রির আয়োজন না করলে এসব হতো না। হলেও তো তাদের জানাতাম। কিন্তু কি করছি? না জানিয়ে অজানা একটা ছেলের সঙ্গে প্রেম করছি। তাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করে মনপ্রাণ উজাড় করে দিয়েছি। আর তার কাছ থেকেই আমার হৃদয়ের সকল ব্যথার ঔষধ সংগ্রহ করছি।

সাকেরা খোলা দরজা দিয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে প্রবেশ করলো। আমাকে রাগান্বিত মুখায়বে বসে থাকতে দেখে খানিক মাথা ঝুঁকিয়ে জিগ্যেস করলো,
“ভাবি তোমার কি মন খারাপ?”
আমার রাগ কমে গেলো। বিস্ময় নিয়ে তাকালাম। সাকেরা ফের আমার সঙ্গে ভাবি-ভাবি খেলা খেলে দুষ্টুমি করছে।
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার ভঙ্গি করে মুখ বিকৃত করে বললাম,
“আসতাগফিরুল্লাহ! আপামণি কি বলেন এসব?”
আমার রাগ নেই আন্দাজ করে সাকেরা তার সর্বজনীন দুষ্টমাখা হাসি নিয়ে কোমরে হাত রেখে দাঁড়ালো।
ঠোঁট গোল করে বললো,
“ওপস!”
আমি চোখ ছোট ছোট করে তাকালাম। সে আমার পাশ ঘেঁষে বললো,
“কেন জানি তোমাকে দেখলে বারবার ভাবি চলে আসে। মুখটাকে স্কচটেপ দিয়ে আটকে রাখতে চাইলেও পারি না।”
চকিত হয়ে গালে হাত ঠেকিয়ে বললো,
“এটা কোনো ইঙ্গিত নয় তো! ফায়াজ ভাইয়ার তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। তবে কি ফাহা.. ”
“তবে রে!”
আমি সাকেরার কান মলে দিতে তার পিছন পিছন ছুটলাম।
এসব বার্তা যে ফাহাদের শেখানো, আর আমার কাছে পৌঁছানোর ষড়যন্ত্র আমি তা খুব ভালো করেই জানি।

সাকেরা চুপটি করে তার বাবার পাশে সোফায় গিয়ে বসলো। আড়চোখে আমাকে দেখে ঠোঁট টিপে হাসলো।

মোজাম্মেল চাচ্চু সামনে বসে থাকা মাঝ বয়সী লোকটার উদ্দেশ্যে প্রসন্ন হাসি দিয়ে বললো,
“মকবুল সাহেব, আপনার মেয়ে আমার মেয়ের মতোই থাকবে।”
পাশ থেকে আন্টি বললেন,
“হ্যাঁ ভাই, আপনার মেয়েকে এনে কয়দিন আরেক মেয়েকে আনবো। তিনজন মেয়ে নিয়ে হবে আমার সোনার সংসার।”
পরের কথাটুকু না বললে তো আমি ধরেই নিচ্ছিলাম যে, ফায়াজের জন্য তার মাতা আরেকটা মেয়ে আনবে। কথার কি ছিরি! মকবুল সাহেবের চেহারাও এক মুহূর্তের জন্য ফ্যাকাশে হয়ে ওঠেছিল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর তাদের কথাবার্তায় বুঝলাম উনিই ফায়াজ ভাইয়ার হবু শ্বশুর। মেয়ের বড় মামা আর চাচাকে পাঠানোর পর তিনি নিজেই এলেন।

মোজাম্মেল চাচ্চু আমাকে লক্ষ্য করে কাছে ডাকলেন।
আমি গেলাম। আমার আব্বুকে ইঙ্গিত করে বললেন,
“ও হলো এই ভাইয়ের মেয়ে। আমার আরেক মেয়ে।”
টিপ্পনি ভঙ্গির কথা শুনে আমি চোয়াল শক্ত করে রইলাম।
মকবুল সাহেব উৎফুল্ল গলায় বললেন,
“ওহ আচ্ছা, আচ্ছা। এটা তাহলে আপনার আরেক মেয়ে? মাশাল্লাহ। মা এদিকে আসো তো।”
আমাকে উনার পাশে বসতে ইশারা করলেন।
আমিও শান্তভাবে ভদ্র মেয়ে হয়ে বসলাম।
উনি নমনীয় গলায় জিগ্যেস করলেন,
“ভালো আছো মা?”
সবার আধো আধো, খাপছাড়া, বেখেয়ালীর বেখাপ্পা টুকরো টুকরো বাণীতে বুঝলাম আমার কথা এই বাড়িতে এবং এই বাড়ির মানুষের আত্নীয়দের সঙ্গে বিস্তর আলোচনা করা হয়েছে।
মাথার থিতিয়ে থাকা রাগটা অনুমতি নিয়ে বাড়তে চাইলো। অনুমতি দিলাম না, টোকা মেরে ডাস্টবিনে পাঠালাম।
আমি হাঁটুতে দুই হাতের করতল স্তুপাকারে স্থাপন করে ফায়াজ ভাইয়ার হবু শ্বশুরের দিকে তাকালাম।
মিষ্টি হাসি ঠোঁটে অঙ্কন করে জিগ্যেস করলাম,
“ভাইয়াকে নাকি অনেক কিছু দিচ্ছেন? খাট ফার্নিচার?”
আমার বোকা প্রশ্নে আমার মা ছাড়া সবাই হাসলো। আম্মু প্রথমে চমকে উঠে তাকালো। নিজের জায়গা ছেড়ে খানিক নড়েচড়ে কাছে এলো। পরক্ষণেই দৃষ্টি সরিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে স্থির রইলো।
আমি বলতে শুরু করলাম,
“এগুলো কি আঙ্কেল-আন্টি চেয়েছে? বায়না করেছে নাকি নিজ দায়িত্বে প্রদান করছেন?”
আমার কথার সুরে বুঝে যাওয়ার কথা এবড়োখেবড়ো বাণী আমি ছুড়িনি। ভেবেচিন্তেই করেছি এবং স্বচ্ছ সোজা উত্তর দাবি করে করছি। মকবুল সাহেব নেহাত ভালো মানুষ। খেঁকিয়ে উঠলেন না।
বিস্ময় ভরা দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে বললেন,
“অনেকটা মিউচুয়াল। মানে এটা তো অনেকটা প্রচলিত ব্যাপার। আমার দেওয়ার সামর্থ্য আছে, আর ছেলের মা-বাবা.. মানে সমস্যা তো নেই?”
“সমস্যা তো আছে আঙ্কেল। আমি যখন প্রথমে ব্যাপারটা শুনলাম, একটা শব্দ প্রথমেই মাথায় এলো। ছোটলোক! ছোট শব্দ, কিন্তু কত নিকৃষ্ট। অভাব নেই ঠিক আছে; কিন্তু মানুষ ভাবলে তো এমনই বলবে। এতে চাচ্চু এবং ফায়াজ ভাইয়ারও সম্মানহানি।”
আঙ্কেল হেসে বললেন,
“আমি তোমার কনসার্ন বুঝতে পারছি মা। যৌতুক বিরোধী তুমি। কিন্তু এখানে ঠিক তা হচ্ছে না। আর লোকের কথায় কান না দেওয়াটাও একটা বিচক্ষণতা।”
আমি শীতল ভঙ্গিতে বললাম,
“লোকের কথা আমি কানে নেই না আঙ্কেল। কিন্তু প্রচলিত শব্দ প্রয়োগের সঙ্গে সুষ্ঠু সম্পর্ক গঠনের পন্থা হিসেবে রাজকীয় ফার্নিচার আদানপ্রদান কর্মকে একজন বিচক্ষণই ছোটলোকী বলবে। আমি কখনো এক ছোটলোককে আরেক ছোটলোকের কর্মের উপর নাক ছিটিয়ে সমালোচনা করতে দেখিনি। যৌতুক বিরোধীও হতে দেখিনি। দেখছি কড়ায় গন্ডায় জিনিসপত্র না দিলে তাদের দৃষ্টিকটু অঙ্গভঙ্গি ও মুখের বুলি। সর্বশেষে, তাদের জন্যই কুসংস্কার হলো প্রচলিত এবং ঐতিহ্যের ধারক-বাহক।”
মকবুল সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন।
ফাহাদের মা হতবিহ্বলতা নিয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে গলা চওড়া করলেন। আমাকে মৃদু ধমকে বললেন,
“তুমি এখান থেকে যাও।”
আমি চোখ ফিরিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। অনেকটা ফিসফিসানি লোমহর্ষক গলায় জিগ্যেস করলাম,
“কোথায় যাবো?”
উনি থমকালেন, আর আমি তা-ই চাইলাম।
মকবুল সাহেব আমাকে জিগ্যেস করলেন,
“যৌতুক দেব না?”
আমি প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে তাকালাম।
উনি মাথা নাড়িয়ে বললেন,
“তুমি ঠিকই বলেছো আম্মু। জিনিসপত্র দেওয়া যৌতুকের অন্তর্ভুক্তই। উপরন্তু আমাদের মতো মানুষ এটাকে বেশি প্রশ্রয় দেয় প্রচলিত অভিহিত করে। এমন তো না যৌতুক না দিলে মোজাম্মেল ভাই আমার মেয়েকে মেরে ফেলবেন। কি ভাই, তখন আর মেয়ের মতো রাখবেন না?”
চাচ্চু নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে রইলেন। আমার আব্বু তখন বললো,
“কেন রাখবে না ভাই? মেয়ে তো মেয়েই।”
তখন মোজাম্মেল চাচ্চু হেসে মাথা নাড়লেন।
মকবুল সাহেব বললেন,
“ঠিক আছে। তাহলে যে টাকা ছেলে বাড়ি খরচ করবো বলে রেখেছিলাম তা গরীব মিসকীনদের আলাদাভাবে দেওয়ার আয়োজন করবো। বিয়ের দিন বা গায়ের হলুদের দিন।”
নতুন আলোচনায়, নতুন সিদ্ধান্তে মোটামুটি সবার মুখেই হাসি ফুঁটে ওঠলো। বিয়ে বাড়ি উৎসব মুখরিত পরিবেশ নতুন আনন্দের ছাউনিতে সজ্জিত হলো।
শুধু একজন ব্যতীত সবাই তা উপভোগ করলো। আর তিনি হলেন ফাক-আদের আম্মাজান।

তখন থেকে উনি সারাদিন আমার সঙ্গে কথা বলেন না। থমথমে মুখ নিয়ে থাকেন। আর আমি ফাবলীহা এসবে অনেক পাত্তা দেই। ঠেঙ্গা দেই, ঠেঙ্গা!

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here