ধূসর প্রেমের অনুভূতি – পর্ব ৪২

0
200

#ধূসর_প্রেমের_অনুভূতি
#ফারহানা_ছবি
#পর্ব_৪২
.
.
(৭৫)

পুরো শরীরে প্রচন্ড শীত অনুভব হতে পিটপিট করে চোখের পাতা মেলে তাকায় তনু৷ তখনকার হঠাৎ আংশিক ঘটনা বুঝতে না পারলেও এখন তনুর বুঝতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না তার সাথে কি কি ঘটেছে৷ বড় ড্রাম ভরা বরফের ভেতর বসে আছে তনু৷ তনু বরফ থেকে ওঠার চেষ্টা করতে সামনে চারটা কুকুর জোড়ে জোড়ে ঘেউঘেউ করতে লাগলো৷ তনু বরাবর কুকুর ভয় পায়৷ আর আজও ভয় পাচ্ছে৷ তখনি হঠাৎ মেইলি কন্ঠে কেউ বলে উঠলো, ” ওদের তোমাকে ওয়েলকাম জানানোটা কেমন লাগলো জেসিকা?”

তনু মাথা তুলে সামনে তাকাতে এক প্রকার শক্টড হয়ে যায়৷ কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ওঠে,” মিমি!”

” ইয়েস মিমি অরফে সামিরা খান্না৷ শ্রাবণ চৌধুরীর উডবি ওয়াইফ৷ আর তোদের সকলের কাল৷”

তনু খানিকটা ভয় পেয়ে গিয়ে মিমি অরফে সামিরাকে বলে,” দেখ মিমি তোমার সাথে আমার কোন শত্রুতা নেই আর না ভালোবাসা৷ তাহলে আমাকে কেন এখানে তুলে নিয়ে এসেছো? ”

মিমি তনুর কথা শেষ হতে না হতে ঝড়ের গতিতে তনুর গলা চেপে ধরে বলে,” কারণ তুই আরুর বেস্টফ্রেন্ড ৷ আরুকে মেরে দিয়ে শুরু করেছি তোদের ধ্বংসের আর এখন তোর পালা৷ তোর জন্য আমার ভালোবাসা আমার আগুন আজ মৃত ৷ তোর নরবরে সিকিউরিটির জন্য ওই আরু আমার আগুনকে তুলে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলেছে৷ ”

তনু সামিরার হাত থেকে নিজের গলা ছাড়ানোর জন্য ছটপট করতে করতে বলে, মিমি আমার লাগছে ছাড়ো প্লিজ৷”

“ছাড়বো মানে? হা হা হা ঠিক আছে তোকে আজ চিরদিনের জন্য ছেড়ে দিচ্ছি৷”

সামিরা তনুর গলা ছাড়তে তনু বলে ওঠে,” মিথ্যে বলছো মিমি৷ তুমি মিথ্যে বলছো কিং ফায়ারকে তুমি মটেও ভালোবাসতে না৷ তুমি শুরু থেকেই কিং ফায়ারের পাওয়ারকে ভালোবেসে এসেছো৷ তুমি যদি কিং ফায়ারকে ভালোবাসতে তাহলে মেঘের বড় ভাই শ্রাবণকে কেন বিয়ে করছো? ইভেন তোমার বাবা আয়মান দেশের একজন বড় নাম করা ব্যবসায়ী হয়েও কিং ফায়ারের সাথে জড়িত৷ কিন্তু কিং ফায়ারের জন্য তোমার এই হঠাৎ উতলে পড়া ভালোবাসার কারণটা আমার কাছে পরিষ্কার নয়৷ আমার মৃত্যুর আগে যদি তুমি এটা ক্লিয়ার করতে তাহলে আমি মরেও শান্তি পেতাম৷”

সামিরা তনুর কথা শুনে দাঁতে দাঁত চেপে কটমট করে তনুকে বলতে লাগলো৷

” ওয়েল তুই যখন সবটা জানতে চাইছিস তখন আমি বলবো কারণ এটা তোর মৃত্যুর আগে শেষ ইচ্ছা৷ ” সামিরা তার আসনে গিয়ে বসে বলতে লাগলো,” আমি সত্যি আগুনকে ভালোবাসি জেসিকা৷ তখন থেকে ভালোবাসি যখন আমি কিশোরী ছিলাম৷ লন্ডনের আমি একাই পড়াশুনা করতাম৷ নিজের স্বাধীন খেয়াল খুশি মতো চলতাম৷ হঠাৎ একদিন ড্যাড লন্ডনে এসে আমাকে তার সাথে নিয়ে শহর থেকে একটু দুরে নিজর্ন একটা বাংলোয় নিয়ে আগুনের হাতে তুলে দেয়৷ তখন জানতে পারি আমার ড্যাড এই টেরোরিস্টদের সাথে হাত মিলিয়েছে৷ ইউ নো না প্রথম দেখায় প্রেম, প্রথম ভালোবাসা কেউ ভুলতে পারে না৷ আমিও ঠিক তাদের দলে ছিলাম৷ আগুনের লুক এ্যাটটিটিউড দেখে ভালোবেসে ফেললাম ৷ কিন্তু আগুন আমাকে পাত্তাই দিতো না৷ এর মাঝে কেটে তিন তিনটে বছর আমার অনুভূতি গুলো দিনকে দিন আরো গাঢ় হতে লাগলো আর ভালোবাসা সীমাহীন৷ আর তখন আগুন আমাদের মাঝে আরু মারু আর তোকে নিয়ে এলো৷ আগুনের সম্পূর্ন ফোকাস তখন আরু ছিলো৷ প্রচন্ড হিংসে হতো আরুকে তারপরও নিজেকে বুঝিয়েছি আগুন শুধু আমার শুধু আমার৷ কিন্তু একদিন আগুনের সাথে আরু কাছাকাছি আসে ৷ সেদিন ইচ্ছে হয়েছিলো নিজের হাতে আরুকে শেষ করে দি৷ কিন্তু তবুও নিজেকে শান্ত রেখে আমি ড্যাডকে জানাই সবটা৷ কিন্তু ড্যাড, ড্যাড আমার কথা পাত্তা না দিয়ে আমাকে প্রচন্ড বাজে ভাষায় গালাগাল করে ট্রাস্ট মি জেসিকা সেদিন নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারি নি ৷ নিজের হাতে ড্যাডকে খুন করেছি৷ ”

” কিহ! তুমি মেরেছিলে তোমার ড্যাডকে? আর দোষ চাপিয়েছিলে আমাদের উপর তাই না? আর কিং ফায়ারের সাথে আরু নয় মারু কাছাকাছি এসেছিলো৷”

” মিথ্যে বলছিস আমার চোখ কখনো ভুল দেখেনি৷ বেস্টফ্রেন্ডকে বাচাঁনোর চেষ্টা নাইস৷ ওহ কি যেন বলছিলাম? ইয়েস কিন্তু আগুন হয়তো সবটা বুঝে গিয়েছিলো আর সে জন্য আমাকে দলের সব কাজ থেকে দুরে সরিয়ে রাখতো৷ তখন আমার ভেতরকার রাগ জেদ যেন তরতর করে বাড়তে লাগলো৷ ”

” এই জন্য তুমি আমাদের শেষ করতে চাইছো মিমি?”

” বাংলাদেশে আশার পর পরই আগুন আমাকে ভালোবাসার কথা জানায়৷ আগুন আমাকে ভালোবাসে আর আরু মারু আমাদের এক হতে দিতে চায় না ৷ এটাও আগুন আমাকে জানায়৷ ”

তনু মিমি অর্থাৎ সামিরা কথা শুনে মনে মনে বলতে লাগলো,” শালা কু*বা* মরার আগেই মিমিকে মিথ্যে বলে ক্ষেপিয়ে রেখেছে যাতে সে না থাকলেও এই মিমি তার হয়ে প্রতিশোধ নিতে পারে৷ কিন্তু ফারু তো শেষ এখন শুধু আমি আর মারু রয়েছি তাহলে মেঘের ভাই শ্রাবণকে কেন ভালোবাসার জালে আটকে রেখেছে?”

কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনে তনু তার ভাবনার জগত থেকে বেড়িয়ে আসে৷

” মিমি তোমার প্রত্যেকটা কথাই শুনলাম তবে আমার কিছু প্রশ্ন আছে৷”

” কি প্রশ্ন?”

” আরু তো শেষ৷ আর আমি ভালো করেই জানি তুমি আমাকে এবং মারুকে শেষ করে দিবে৷ তাহলে তুমি শ্রাবণকে কেন নিজের ভালোবাসার জালে ফেললে? আর কিং ফায়ারকে যে মেরে ফেলা হয়েছে তুমি জানলে কি করে?”

” কারণ শ্রাবণ হলো আমার ট্রাম কার্ড ৷৷শ্রাবণ আর আমি লন্ডনের এক ইউনিভার্সিটিতে পড়তাম৷ আমি শ্রাবণের এক বছরের জুনিয়র ছিলাম৷ আরুর ফ্যামিলির সব খবরই আমার কাছে ছিলো৷ তাই শ্রাবণকে চিনতে আমার অসুবিধা হয়না৷ তখন থেকে শ্রাবণের পেছনে লেগে থাকতাম আর ওই শ্রাবণ স্টুপিটটা আমার প্রেমের জালে ধরা পরে গেল৷ তখনই পুরো প্লান করে নিলাম৷ শ্রাবণের দ্বারাই আমি মেঘ সহ তার পুরো পরিবার শেষ করে দিবো৷ হা আমি চাইলে পারতাম এক সাথে সবাইকে শেষ করে দিতে কিন্তু তাহলে এতে কোন ফান থাকতো না৷ সাপকে যেমনটা খেলিয়ে খেলিয়ে ঝুড়িতে আটকে বিষ দাঁত ভেঙে ফেলে৷ ঠিক তেমনি প্রত্যেকটা ফ্যামিলি ম্যামবারকে খেলিয়ে মারবো৷ আর সেটা মেঘের সামনে, কারণ আরুর শাস্তির ভাগ তো মেঘকে নিতেই হবে তাই না৷”

” শেষ প্রশ্নের উওর পেলাম না মিমি?”

” যেদিন আগুন আমাকে তার মনের কথা গুলো জানিয়েছিলো৷ সে দিনই আমি বাংলাদেশে আশার জন্য ফ্লাইটের টিকিট কেটে নি৷ দেশে ফিরে আমি নিজেকে আড়াল করে ফেলি৷ আড়ালে থেকেই আমি তোদের উপর নজর রাখতাম৷ সেদিন খান মঞ্জিলে বিষ্ফোরণ আমি ঘটিয়েছিলাম৷ কিন্তু সবার সন্ধেহ ছিলো তোর উপর; আমি আড়ালে থেকে সবটা নজরে রাখতাম৷ আরু যখন কিং ফায়ারকে তুলে নিয়ে যায় তখনকার খবরটা আমার কাছে পৌছাতে পৌছাতে অনেকটা দেরি করে ফেলে আর না আমি আরুর লোকেশনটা খুজে পাই৷ কিন্তু মেঘ আর তার পিএ আসলামকে ফলো করে যখন সঠিক জায়গায় পৌছাতে পারলাম তখন অনেকটা দেরি হয়ে গেছে৷ ওই আরু সবটা শেষ করে দিয়েছে৷ আমার ভালোবাসা আমার আগুনকে ওই মাংস খেকো মাছের মুখে ছেড়ে দিয়ে দিয়েছে৷ কতোটা যন্ত্রনা নিয়ে আমার আগুন এই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেছে তা আমার থেকে ভালো আর কেউ জানে না৷ আরুকে তো আমি শেষ করেই দিয়েছি এবার তোদের পালা বি রেডি জেসিকা৷ মৃত্যু তোমার অতি সংনিকটে দাড়িয়ে আছে৷ ” বলে পাগলের মতো হাসতে লাগলো মিমি অরফে সামিরা৷ তনু সে সুযোগে কয়েক টুকরো বরফ হাতে নিয়ে কুকুর গুলোর গাছে ছুড়ে মারতে কুকুর গুলো দুরে সরে যায় সুযোগে ড্রাম থেকে নেমে পালাতে নিলে সামিরা তনুর সামনে এসে দাড়ায়৷ তনু সামিরার দিকে তাকিয়ে অদ্ভত এক হাসি দিয়ে সামিরার মুখে হঠাৎ রুমাল চেপে ধরে৷ সেই রুমাল যেটা দিয়ে তনুকে সেন্সলেস করে তুলে নিয়ে আসে সামিরার লোকেরা৷ সেই রুমাল দিয়ে সামিরাকে সেন্সলেস করে পালিয়ে যেতে নিলে কুকুর গুলো আর সামিরার লোকেরা তনুর উপর এট্যাক করতে নিলে তনু সামিরা রিভালবার নিয়ে কুকুর সহ বাকি লোকদের শুট করে পালিয়ে যায়৷

(৭৬)

আঁকা বাঁকা ছোট ছোট পাথরের উপর দিয়ে নূপুর আর ফারহা হেটে যাচ্ছে৷ ফারহা নূপুরের বকবক শোনার ভান করে এদিক ওদিক তাকিয়ে খেয়াল রাখছে৷ নূপুর ফারহাকে নিয়ে নদীর দিকে চলে যায় ৷ জোয়ার না থাকায় নদীতে পানি বেশ কম বিধায় বড় ছোট পাথর গুলো দৃশ্যমান তার সাথে সাথে নানা রকমের মাছ দেখতে পায় ফারহা নূপুর৷ নূপুর দেরি না করে নদীতে নেমে পড়ে মাছ ধরার জন্য, এদিকে ফারহা নুপূরের বাচ্চামো দেখে নিজেও নদীতে নেমে পড়ে৷ দুজনে বেশ কয়েকটা মাছ ধরে কূলে উঠতে ফারহা খেয়াল করে ওখানকার দুজন ছেলে লোলাতুপ দৃষ্টিতে নূপুরের দিকে তাকিয়ে আছে৷ নূপুরের দৃষ্টি ছেলে দুটোর উপর পড়তে ভয়ে কেমন সিটকে যায় নূপুর৷ ফারহা ছেলে দুটোর দিকে আগুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে নুপূরের হাত ধরে বাড়ির দিকে ফিরতে লাগলো৷ ছেলে দুটোও ফারহা আর নুপূরের পেছন পেছন যেতে লাগলো৷ ফারহা বিষয় টা খেয়াল করে নুপূরকে জ্বিজ্ঞাসা করে,” ওই ছেলে গুলোকে তুমি চিনো?”

” আপু ওরা মিনচে আর আলান এখানকার আদিবাসী৷ প্রত্যেকটা দিন আমাকে এবং অন্য মেয়েদের ডিসটার্ব করে৷ শরীরে হাত দেওয়ার চেষ্টা করে৷”

” পুলিশকে জানাও নি?”

” লাভ নেই আপু৷ ওরা পুলিশকে টাকা খাইয়ে ওদের দিকে করে নেয়৷”

” ফারহা আর কিছু বললো না ছোট্ট কুঠিরে ফিরে ফারহা নুপূরকে রান্না করতে বলে একা একাই বেড়িয়ে পড়ে ফারহা৷ এদিকে নুপূর মাছ গুলো কেটে পরিষ্কার করে রান্না করতে লাগলো৷ ঘন্টা খানিক পর ফারহা গোছল করে চেন্জ করে নুপূরের পাশে বসে বলে,” নুপূর আর কোন দিন ওই ছেলে গুলো তোমাকে এবং এখানকার মেয়েদের ডিসটার্ব করবে না৷” বলে উঠে গেল ফারহা৷ এদিকে নুপূর ফারহার কথার মানে বুঝতে না পেরে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে৷

বিকেলে পুলিশে ছেয়ে গেছে এলাকা, মিনচে আর আলানকে কে বা কারা খুন করে জঙ্গলে অর্ধেক পুঁতে রেখেছে৷ পুলিশ তদন্ত করছে৷ নুপূর সবটা দেখে বুঝতে পারে ফারহার তখনকার বলা কথা গুলো৷

নুপূর ফারহাকে কুঠিরে লুকিয়ে রেখে বাহিরে বেড়িয়ে যায়৷

ফারহা দরজা ভেজিয়ে ফোন বের করে মেঘকে কল দিতে গেলে হুট করে ফারহার হাত দিয়ে ফোনটা ছিনিয়ে নেয়৷ ফারহা পেছনে ঘুরে দেখে সেই আগন্তক৷

” ভাই! ”

” আরুপাখি তুমি ঠিক কি করতে চাইছো?”

” মেঘরাজ……” বাকিটা বলার পূর্বে আগন্তক বলে উঠলো,” লিসেন আরুপাখি তুমি যদি মেঘকে এখন কল করো তাহলে মেঘ তোমাকে ট্রেস করে ফেলবে তার চেয়ে বড় কথা মিমি তোমার খোজ পেয়ে যাবে মেঘকে ফলো করে৷ তোমার ছোট্ট ভুলের জন্য আমাদের সব প্লান নষ্ট হয়ে যেতে পারে সেটা কি তুমি জানো?”

ফারহা অসহায় দৃষ্টিতে আগন্তকের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,” ভাই মেঘকে ভিষণ মিস করছি৷”

আগন্তক ফারহাকে কিছু না বলে নিজের ফোন বের করে ফারহার সামনে একটা ভিডিও প্লে করে দিলো৷

_________________

মেঘ তার টিম মেম্বারদের নিয়ে হেডকোয়ার্টসে ফিরে গিয়ে সিনিয়র অফিসারকে সবটা জানায়৷ সিনিয়র অফিসার তারেক শেখ মেঘকে এই কেসটা নিয়ে তদন্ত করতে বলে৷ মেঘ অফিসারের কথা শুনে নিজের কেবিনে চলে যায়৷ জ্যাক আসলাম প্রথম থেকে মেঘের দিকে কেবিনে মেঘের জন্য অপেক্ষা করছিলো৷ মেঘ কেবিনে ঢুকতে জ্যাক মেঘ কে বলে উঠলো, ” স্যার ম্যামকে ট্রেস করতে পেরেছি৷”
.
.
.
#চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here